#কৃষ্ণাবতী
৪র্থ_পর্ব
নারায়ন বাবুর কথাগুলো চুপ করে শুনলেন প্রদীপ বাবু। এরপর ঠোঁটে হাসি একে বললেন,
– তোমার ঋণ পরিশোধের সময় এসেছে যে নারায়ণ। ভুলে যাচ্ছো কেনো শ্যামলীর কাছে আমরা দায়বদ্ধ! এ দায় যে তুমি এড়াতে পারো না।
– ওই মেয়েটা শ্যামলীর মেয়ে?
অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেন নারায়ন বাবু। প্রদীপ বাবু মুখে মলিন হাসি টেনে উত্তর দেন,
– হ্যা, সে শ্যামলী সাহার মেয়ের কৃষ্ণাবতী সাহা। সেই শ্যামলী যার ঋণ আমাদের উপর হয়তো সারাটাজীবন থাকবে। তুমি তোমার কথা ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলি নি। শ্যামলী পৃথিবীতে না থাকলেও ওকে দেওয়া কথাটা সারাটাজীবন থাকবে।
– তাই বলে আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে দিবো? আমার ছেলের সুখের কি কোনো দাম নেই! সাহায্য তো অন্যভাবেও করা যায়!
নারায়ন বাবুর কথাটা শুনে তীক্ষ্ণদৃষ্টি প্রয়োগ করলেন প্রদীপ বাবু। প্রদীপ বাবুর দৃষ্টির মর্মার্থ বুঝতে পেরে চুপ মেরে গেলেন তিনি। নিজের ছেলের কাছ থেকে এরুপ কথা যেনো একেবারেই নিতে পারছেন না সে। ঠান্ডা থমথমে গলায় বললেন,
– যে ছেলের সুখ নিয়ে তোমার এতো চিন্তা সেই ছেলে কি থাকতো যদি সেদিন শ্যামলী নিজের সুখের বলি দিয়ে তাকে না বাঁচাতো। আমাদের জন্য অজান্তে তার কতোটা অনর্থ হয়েছে সেটা তো তোমার অজানা নয়।
– বাবা, সৌদামিনীর কথাটা চিন্তা করা কি যেতো না। মেয়েটাকে কিছু টাকা দিয়ে
– নারায়নননন, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। দেবব্রত তো কোন ছাড়, তুমি নিজের মুখে শ্যামলীকে কথা দিয়েছিলে তার ত্যাগের প্রতিদান স্বরুপ কৃষ্ণা হবে এ ভট্টাচার্য পরিবারের বধু। কিন্তু শ্যামলী চিতার সাথে তুমি সেই কথার দাহ করে দিলে। আমাদের পরিবারের প্রদীপকে বাঁচাতে গরীব মেয়েটি তার সকল সুখের আত্নহুতি দিয়েছিলো; মনে পড়ছে না তোমার?? যেদিন সৌদামিনীর সাথে দেবব্রতের বিয়ে ঠিক করলে আমি বাধা দিলেও তুমি শোনো নি। পাপবোধে কুড়ে কুড়ে মরছিলাম আমি, কিন্তু দেবী মায়ের কৃপায় অবশেষে সেই কৃষ্ণাবতীর সাথেই সাত পাকে বাধা পড়লো তোমার ছেলে। দেবী মায়ের ইচ্ছাই ছিলো এই বিয়ে নয়তো কেনোই বা দেবব্রত কৃষ্ণার বিয়ে ভাঙ্গবে? আর কেনোই বা দেবব্রতকে গ্রামের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে? যাক এসব তোমার ঘটে ঢুকবে না। অভিজাত্যের চাঁদরে অন্ধ হয়ে আছো। সব কিছুর সমাধান টাকা নয়। যাও যাও ঘুমোতে যাও।
প্রদীপ বাবুর চোখ থেকে যেনো অগ্নি বের হচ্ছে। নারায়ন বাবুর বুঝতে বাকি নেই কথা বাড়ালে কাজ হবে না বরং বাবা আরোও রেগে যাবেন। তাই তিনি নম্র ভাবে বললেন,
– আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আসছি।
বলে উঠে দরজা অবধি যেতেই প্রদীপ বাবুর একটা কথা কানে এলো তার,
– একাকীত্বে নিজের জীবনের হিসেবগুলো কষো পারলে, তোমাদের সুখের জন্য কতো নির্দোষ মানুষের সুখ পায়ের নিচে পিষে যায়। অথচ দিন শেষে তাদের অস্তিত্বের সাথে তাদের কীর্তি, ত্যাগগুলো ও মিলিয়ে যায়।
নারায়ন বাবু মাথা নিচু করে ঘর থেকে ব্রিয়ে গেলেন। প্রদীপ বাবু আজ ছেলের উপর বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছে। ভেবেছিলেন শ্যামলী দেবীর পরিচয় পেয়ে হয়তো এই বিয়ের বিরোধীতা করবেন না। কিন্তু তা ঘটলো না। নারায়ন বাবু তার গাণ ই গাইতে লাগলেন। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো প্রদীপ বাবু। তার বয়স হয়েছে, তার মৃত্যুর ডাক যেকোনো সময় আসবে। তার অগোচরে মেয়েটার কোনো অহিত না হয়ে যায়। গভীর চিন্তার শেষে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন প্রদীপ বাবু। নারায়ন বাবু চান বা না চান দেবব্রত কে অতীতের সব কিছু জানাতে হবে। দেবব্রতই একমাত্র মানুষ যে কিনা কৃষ্ণার দুঃখমচন করতে পারবে_____
সকাল ৬টা,
শিশির ঘেরা সকালে নগ্ন পায়ে ঘাসে হাটার অভ্যেস প্রদীপ বাবুর। সকালের স্নিগ্ধতায় নিজের ক্লান্তি উম্মোচন করতে তার ভালো লাগে। কিন্তু কাল রাত নারায়ন বাবুর আচারণ দেখবার পর থেকে আর ঘুমের ছিটাফোঁটা ও চোখের কোণায় আসে নি। তাই সকালে ঘুমটা ভাঙ্গলেও বাহিরে যেয়ে হাটতে ইচ্ছে হলো না। শরীর যেনো চলছেই না। মনের মাঝে চিন্তার কালোমেঘ জমে আছে। সেই চিন্তা শরীরটাকেও দূর্বল করে ফেলেছে। হঠাৎ কানে এলো,
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।।
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর
মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে,
জানি না কখন ডুবে যাবে কোন্
অকুল-গরল-পাথারে!
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা,
তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা;
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর
মত্ত-বাসনা গুছায়ে !
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে, ভূধরসলিলে, গহনে;
আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়, শশীতারকায় তপনে।
আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া,
ব’সে, আঁধারে মরিগো কাঁদিয়া;
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু,
দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর
মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে,
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে _____
কন্ঠটা এতোটা সুমধুর, নিমিষেই মনের ভেতরের একটি ঠান্ডা পরশ বয়ে গেলো প্রদীপ বাবুর। বিছামা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কন্ঠটি ঠাকুরঘরের থেকে আসায় তিনি ঠাকুরঘরের কাছে গেলেন। শিশিরের সকালে সাদা শাড়ি লাল পাড়ের শাড়ি পরিহিতা কৃষ্ণা পুজো করছিলো। প্রদীপ বাবু বিমুগ্ধ নজরে দেখছেন তার নাত বউকে। কি গুছিয়ে পুজো করছে! আচলটা মাথায় নিয়ে মাথানত করে নমস্কার করে উঠে পড়ে কৃষ্ণা। পেছনে ফিরতেই দেখে ঠাকুরঘরের সামনে প্রদীপ বাবু দাঁড়ানো। কৃষ্ণাকে দেখেই গদগদ গলায় বললেন,
– পুজো করছিলি রে মা?
– হ্যা, দাদান। তুমি ভেতরে আসবে না
– না স্নান করি নি যে। ভোগ দিয়েছিস?
– হ্যা, আমি নিজে বানিয়েছি।
– অবন্তীকা জানে তুই তার ঠাকুরঘরে ঢুকেছিস?
– না, জানে না। আমি তো রোজ সকালে গোপালের আরতী করি, ভোগ বানাই তাই ঠাকুরঘরেই তাকে আসন দিয়েছি।
– ভালো করেছিস। আজ তোর ফুলসজ্জা মনে আছে? যা একটু জিরিয়ে নে। তারপর ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হবে।
কৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে হাটা দিলো। প্রদীপ বাবু ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– মেয়েটাকে দেখো ঠাকুর। এই নিষ্পাপ মেয়েটা কে দেখো তুমি!
বুকের মাঝে দুঃচিন্তা যেনো ঝেকে বসলো আবার। তার মৃত্যুর পর মেয়েটার কি হবে ভেবেই তার কষ্ট হচ্ছে। নীরবে ধীর পায়ে হেটে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করলেন প্রদীপ বাবু।
সকাল ৯টা,
পুজোঘরে কৃষ্ণার উপস্থিতি টের পেয়ে মেজাজ বিগড়েছে অবন্তীকা দেবীর। তার উপরে প্রদীপ বাবু ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ উদগ্রীব হয়ে আছেন। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রয়েছেন তিনি। শ্বশুর মশাই এর উপর কথা বলতে পারছেন না আবার সইতেও পারছেন না তিনি। মেয়েটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারলে মনটা শান্ত হলো। কাল রাতে নারায়ন বাবুকে পাঠিয়েছিলেন তিনি প্রদীপ বাবুর কাছে। কিন্তু তিনি ঘরে এসে যে কুলুপ এটেছেন। এখনো সেই অবস্থা। অবন্তীকা দেবী কপাল কুঁচকে চেয়ারে বসে রয়েছেন। আর রীতা দেবী সব কাজ করছেন প্রদীপ বাবুর কথা অনুযায়ী। একবার সাহস করে বলতে এসেছিলেন,
– দিদিভাই, বিয়ে তো হয়ে গেছে। এখন রাগ করে কি হবে বলো?
– তোর তো ছেলে নেই, তুই বুঝবি না। আর তোর ছেলে থাকলে দেখতুম কতো মেনে নিস।
রীতা দেবী আর কোনো কথা কইলেন না। আসলেই বলা সহজ কিন্তু করা খুব কঠিন। পুত্রবধু নিয়ে সব মায়েদের কিছু আশা থাকে। কৃষ্ণার মতো গেয়ো, অশিক্ষিত মেয়ে যার কোনো পরিচয় সমাজে দেওয়া যায় না তাকে নিজের বউ করতে কেউ ই রাজী হবেন না। প্রদীপ বাবু অন্নাকে দিয়ে দেবব্রতকে ডেকে পাঠালেন। দেবব্রত তখন কেবল ঘুম থেকে উঠেছে। সারাটা রাত তার নির্ঘুম কেটেছে। চোখ জোড়া ফুলে রয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। রুম থেকে বেরিয়ে প্রদীপ বাবুর কাছে যেতেই তিনি কইলেন,
– দেব, কৃষ্ণার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিতে হবে তো।
দেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকালো। হলুদ লাল কাতানের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। কাল দেবব্রতের এতো সুন্দর করে বুঝানোর পর ও দাদানের পাগলামীকে মুখ বুঝে সে এই নিয়ম পালন করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রীতা দেবী ভাত কাপড়ের থালাটা আগিয়ে দিতেই দেবব্রত ঠান্ডা গলায় বললো,
– এই পাগলামীর কি আদৌ দরকার আছে?
দেবব্রতের এমন প্রশ্নের উত্তর স্বরুপ প্রদীপ বাবু বলেন,
– তুমি কৃষ্ণার স্বামী। তাই তোমাকে তার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিতে হবে দেবব্রত।
– শুধু ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলেই কি স্বামী হওয়া যায় দাদান? যে বিয়ের স্বীকৃতি সমাজে আমি দিবো না সেই বিয়ের নিয়ম মানা আর না মানা একই বলে আমার মনে হয়।
কথা শেষে দেবব্রত চলে যেতে নিলে..……..
চলবে
(পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ কালকে রাতে দিবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না)
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩য় পর্বের লিংক