কৃষ্ণাবতী
৬ষ্ঠ_পর্ব
নামটি দেখতেই গ্লানিতে বুকটা ভরে উঠলো দেবব্রতের। হাতটা কাঁপছে, কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই অপরপাশ থেকে শোনা যায়,
– দশ মিনিটের মাঝে আমার বাসায় তোমাকে দেখতে চাই দেবব্রত
– আঙ্কেল, আমি….
– আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না দেবব্রত৷ আমি জানি না তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে। তবে তোমার বাসা থেকে আসার সেই যে মিনী দরজা দিয়েছে এখনো দরজা খুলে নি। তোমার আন্টি বারবার তাকে দরজা খুলতে বলছেন কিন্তু সে সেটাও শুনছে না। রাতে খায় নি মেয়েটা, সকাল হয়ে গেছে একটা দানাও পেটে দেয় নি। না পেরে আমিও দরজা ধাক্কালাম। যে মেয়ে আমার কথা কখনো ফেলে নি, সেই মেয়ে আমার কথায়ও দরজা খুললো না। আমি জানি না তুমি কতোটা ব্যস্ত, জানতেও চাই না। আমি শুধু জানি আমার মেয়ে কাল রাত থেকে ঘরের দরজা দিয়েছে, তুমি এখনই আসো৷
বলেই ফোনটা রেখে দিলেন অনুরাগ বাবু। দেবব্রতের বুঝতে বাকি রইলো না অনুরাগ বাবু কিছুই জানেন না। দামিনীও বাড়িতে কাউকে কিছুই বলেই নি। নিজের মাঝেই তার দেওয়া আঘাতকে সীমাবদ্ধ রেখেছে তার দামিনী। হঠাৎ বুকের মাঝে কামড় পড়লো দেবব্রতের। মেয়েটা কোনো উলটাপালটা কিছু করে ফেললো নাতো!! গায়ে কোনোমতে কোট পড়ে ছুটলো সৌদামিনীর বাড়ি দেবব্রত। তার হুড়মুড় করে নামা দৃষ্টিতে এড়ালো না কৃষ্ণার। কি এমন হলো যে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলো তার মাষ্টারমশাই। একবার চাইলো অন্নাকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু পরে ভাবলো, অন্না কিভাবে জানবে সে তো পুরোটা সময় তার পাশেই ছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাষ্টারমশাই এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকলো কৃষ্ণা।
সৌদামিনীর বাসায় যখন পৌছালো দেবব্রত তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো দেবব্রত। অনুরাগ বাবু এবং তার স্ত্রী তাপসী দেবী চিন্তিত মুখে সোফায় বসে আছেন। তাপসী দেবী দেবব্রতকে দেখে ছুটে তার কাছে আসলেন, অনুনয়ের স্বরে বললেন,
– দেখো না দেবব্রত, মিনী যে দ্বার দিয়েছে এখনো খুলছে না। মেয়েটাকে আমি যতবার ডেকেছি আমাকে দিব্যি দিয়েছে যাতে তাকে একা থাকতে দেওয়া হয়। আজ সকাল থেকে মেয়েটা কথাও বলছে না। তার বাবাও চেষ্টা করেছেন। কি সুন্দর কাল খুশি মনে তোমার বাড়ি গিয়েছিলো।
– আপনারা দরজা ভাঙ্গেন নি কেনো? দামিনী যদি
– কি বলছো তুমি? তোমাদের মাঝে কি এমন হয়েছে দেবব্রত?
– অহেতুক কথা বাড়িয়ে কি লাভ তাপসী? তাড়াতাড়ি চলো।
বলেই উঠে দাঁড়ালেন অনুরাগ বাবু। ছুটে গেলেন মেয়ের রুমের দরজায়। বারবার ” মিনী” “মিনী” করে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু যখন কোনো সাড়া পেলেন না। তখন অধৈর্য হয়ে দেবব্রত বললো,
– দামিনী, এই শেষবার বলছি দু মিনিটে দরজা খুলবি। নয়তো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবো এই দরজা আমি।
সময় যেনো গলার কাটা হয়ে গেছে। অসহ্য লাগছে দেবব্রতের। কোনো সাড়া মিলছে না সৌদামিনীর। এবার মনে মনে দরজা ভাঙার সংকল্প নিলো দেবব্রত। যেই না দরজা ভাঙতে যাবে অমনি অপরপাশ থেকে দরজা খুলে দিলো সৌদামিনী। দেবব্রত অধীর চোখে সৌদামিনীকে দেখতে লাগলো। শ্যামলা মেয়েটা যেনো একদিনে আরোও কালো হয়ে গেছে। চোখগুলো ফুলে আছে। চোখের কাজল চোখের চারপাশে লেপ্টে গেছে। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে গেছে। মুখে দুঃখের ছাপ স্পষ্ট। সৌদামিনীর এরুপ দেখে বুকে যেনো রক্তক্ষরণ শুরু হয় দেবব্রতের। চিনচিনে ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়ে সে। কিন্তু করার কিছুই নেই, অপরাধী চোখে শুধু চেয়ে থাকে। তাপসী দেবী দৌড়ে মেয়েকে আলিঙ্গন করলেন। শুন্য দৃষ্টিতে তাপসী দেবীর দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভাবে বললো,
– মা, দেবের সাথে আমার কিছু কথা রয়েছে। তোমরা তোমাদের ঘরে যাও।
তাপসী দেবী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনুরাগ বাবু তার হাত চেপে ধরে বললেন,
– ওদের একা ছেড়ে দাও তাপসী। কথা বলুক মন শান্ত হবে।
স্বামীর কথার পরে আর কোনো কথা বলতে পারলেন না তাপসী দেবী। অনুরাগ বাবুকে কিছু না বললেও তার বুঝতে বাকি রইলো না ব্যাপারটা সামান্য ঝগড়া নয়। নিজ ঘরে আসার পর তাপসী দেবী হিনহিনে গলায় বলে উঠলেন,
– তুমি আমাকে টানতে টানতে এখানে নিয়ে এলে কেনো?
– একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। প্রস্তুত থাকো।
– মানে?
– মেয়ের মুখটা দেখো নি? আমার মিনী এতো দূর্বল নয় সে সামান্য ঝগড়ায় দ্বার দিয়ে বসে থাকবে। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিবে। খুব বেশির চেয়েও বেশি ঘটেছে। আমাকে নারায়নের সাথে কথা বলতে হবে।
তাপসী দেবী ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। ভিন্ন,ভিন্ন কুচিন্তা মনে বাসা বাধছে। সৌদামিনী দেবব্রত বলতে পাগল, মেয়েটা তো ভেঙ্গে পড়বে যদি তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে!!
সৌদামিনীর সামনে বসে রয়েছে দেবব্রত। সৌদামিনী মূর্তির ন্যায় এক ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। তার চোখের জল শুকিয়ে রেখা হয়ে গেছে। তার চোখ শুকনো, কোনো কথা নেই তার চোখে। দৃষ্টি এক দিকে স্থির, আশাহীন। ঠান্ডা গলায় বলে উঠে সে,
– এখানে কেনো এসেছিস? বাবা ফোন করেছিলো?
– হ্যা
– ভয় পেয়েছিলি বুঝি? মরি নি আমি, এতোটা ভীতু নই যে নিজের কষ্টের সম্মুখীন হতে পারবো না।
– কাল রাত থেকে দ্বার দিয়ে বসে আছিস আর বলছিস তুই ভীতু নস।
– হ্যা ভীতু আমি, ভয় পাই আমার চোখের জল মা-বাবা না দেখে ফেলে। তুই বরং বাড়ি যা। আজ তো তোর ফুলসজ্জা।
– চুপ কর।
– মেয়েটা তোর অপেক্ষায় আছে। আমার কাছে এসে সময় নষ্ট না করে নতুন বউ এর কাছে যা
– চুপ করতে বলেছি তো তোকে।
– কেনো চুপ করবো বলতো? কেনো কেনো? কেনো এসেছিস দয়া দেখাতে? চাই না তোর দয়া। কেনো দেখবো তোর দয়া? যে মানুষটাই আমার নয় তার দয়া দিয়ে কি হবে?
এবার যেনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সৌদামিনী। সৌদামিনীর শুকনো চোখ গুলো আবার ভিজে যায়। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না দেবব্রত। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার ভালোবাসাকে। পারছে না নিজের ভালোবাসাকে এভাবে কষ্ট পেতে। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,
– ভাবলি কি করে আমি তোকে দয়া দেখাবো? তুমি আমার সবকিছু দামিনী। তোকে দয়া দেখাবার সাধ্যি যে ভগবান আমায় দেয় নি। আমার হাতজোড়া শুধু বাধা। তোকে সুখ দেবার ক্ষমতা আমার নেই। ক্ষমা কর, ক্ষমা কর। তুই এভাবে ভেঙ্গে বলে আমি প্রতিদিন নতুন করে মৃত্যুবরণ করবো যে। আমার যে অনেকটা পথ চলতে হবে। আমার যে অনেকটা পথ চলতে হবে।
সৌদামিনী চুপ করে দেবব্রতের কথা শুনে। তার সামনে আজকে তার দেব নয় বরং একজন পরাজিত সৈনিক দাঁড়ানো। যে দায়িত্বের ভারে নুয়ে গেছে। দেবব্রতের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
– তুই ফিরে যা দেব। আমি ঠিক সামলে যাব
– আচ্ছা আমাদের সম্পর্কটা কি শুধু প্রেমের? আমরা তো আগে বন্ধু ছিলাম। নাহয় প্রেমিক দেবব্রত তোর সাথে প্রতারণা করেছে। বন্ধু দেব তো নয়। তোর তাকে প্রয়োজন নাই থাকতে পারে। কিন্তু তার যে তার বন্ধু দামিনীকে খুব প্রয়োজন। তার বন্ধু যে তার শক্তি রে। আমি ক্লান্ত দামিনী, আমি ক্লান্ত।
বলে সৌদামিনীর কোলে মাথা রাখে দেব। প্রথমে সরিয়ে দিতে চাইলেও কেনো যেনো তাকে সরাতে পারে না সৌদামিনী। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। শুধু অশ্রুর বিনময়ে দুই বন্ধু তাদের কষ্টগুলো ভাগ করে নিচ্ছে। এটাই হয়তো তাদের শেষ অশ্রুর বিনিময়। এই বিনিময়ের মাঝে শেষ হচ্ছে একটি ভালোবাসা। থাকুক না কিছু ভালোবাসা তোলা, সময় আসলে ঠিকই তার পরিস্ফুটন হবে। এটাই যে কৃষ্ণা, দেবব্রত এবং সৌদামিনীর ভাগ্য। সৃষ্টিকর্তা একই সুতোয় বেঁধেছে এই তিনটি জীবনকে। একটি ভালবাসার পরিস্ফুটনের জন্য, একটি ভালোবাসার যে ত্যাগ অনিবার্য________
৫.
সকাল ৬টা,
সূর্যের কোমল রশ্নি শিশির ভেদ করে কৃষ্ণার মুখে আছড়ে পড়ছে। কাল রাতে এক মূহুর্তের জন্য ঘুমোয় নি মেয়েটা। ঠায় বারান্দায় রাত থেকে দাঁড়িয়ে ছিলো। মাষ্টারমশাই এর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো। দিন পেরিয়ে রাত পেরোলো। তারপর রাত পেরিয়ে এখন সকাল। অথচ মাষ্টারমশাই ফিরলেন না। নিয়মমতো কাল রাত তাদের ফুলশয্যার রাত ছিলো। ভাগ্যের কি নির্মমতা! বধু হয়েও ফুলশয্যার রাতে বারান্দায় মাষ্টারমশাই এর অপেক্ষায় কাঁটাতে হলো। লোকটা রাতেও ফিরলো না। না চাইতেও অন্নার মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেলো,
– দাদাভাই তো সৌদামিনী দিদির বাড়ি।
সেই থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো কৃষ্ণা। সোমা মাসি তবে কি ঠিক ই বলেছেন, তার মাষ্টারমশাই ওই দিদিমনিকেই বিয়ে করবে? অজান্তেই বুকের মাঝে হাহাকার শুরু হলো। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আচ্ছা সিঁদুরের কি কোনোই জোর নেই? তার সিঁথির সিঁদুর কি বলহীন? আচ্ছা মা তো বললেন,
” সিঁথির সিঁদুরের অনেক জোর, দেখবি তোর বাপ ও আমার সিঁদুরের জোড়েই আমার কাছে ফিরে আসবে”
কিন্তু মার কথা সত্যি হয় নি। তার বাবা ফিরে আসে নি। শেষ পর্যন্ত ধুকে ধুকে মরতে হয়েছিলো শ্যামলীকে। কৃষ্ণার ভাগ্যেও কি গোপাল তাই লিখেছেন!! মাষ্টারমশাই কি তার যোগ্য হয়ে উঠার একটি সুযোগ ও দিবে না কৃষ্ণাকে!! আজ গোপালের আরতি করতে ইচ্ছে হচভহে না। খুব দূর্বল ঠেকছে কৃষ্ণার শরীর। মনটাই যদি অশান্ত থাকে তবে দেহের কি দোষ। হঠাৎ দেখতে পেলো মেইন গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকছে। তবে কি দেবব্রত ফিরেছে? বারান্দার থেকে দেখেই চাঁদরখানা পেছিয়ে ছুট লাগালো কৃষ্ণা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেব কলিংবেল টিপতেই দ্বার খুলে দিলো কৃষ্ণা। সকাল সকাল কৃষ্ণার মুখ দেখেই মেজাজটা কেনো যেনো খারাপ হয়ে গেলো দেবের। তাকে এড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো সে। তখনই কৃষ্ণা বলে উঠলো,
– কাল রাত কোথায় ছিলেন?
কথাটা এতোও খারাপ নয় কিন্তু প্রশ্নটা একেবারেই সহ্য হলো না দেবের। সে তখন……
চলবে
( সরি দেরী হবার জন্য। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ কালকে রাতে দিবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না)
মুশফিকা রহমান মৈথি