#কেন এমন হয়
পর্ব – ৭
এখন প্রায় সবগুলো রাতই নির্ঘুম কাটে হিয়ার। আহনাফকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর ও ঘুম আসছে না। সারাদিন তবুও কেটে যায় কোনভাবে কিন্তু রাতগুলো হয় বিশাল , ভেজা ভেজা আর অন্ধকার।
হঠাৎ কুকুরের ডাক শুনে হিয়া বুঝতে পারলো রাত অনেক হয়ে গেছে।রাত দেড়টার পর থেকে প্রথমে একটা কুকুর ডাকা শুরু করে ,এরপর অনেক গুলো কুকুর এক সঙ্গে ডাকতে থাকে।
প্রথম যখন এই বাসায় এসেছিলো হিয়া,সেই রাতের কথা মনে হতেই হাসি পেলো।রাতে কুকুরের ডাক শুনে ভয় পেয়ে দৌড়ে রিয়ার রুমের সামনে গিয়ে আপু আপু বলে ডাকে উঠিয়ে ছিল ওদের।
রিয়া ঘুম থেকে উঠে এলো, পেছনে আদনান ।কুকুরের ডাক শুনে ভয় পেয়েছে শুনে আদনান হাসতে হাসতে বলেছিল,’গ্রামের মেয়ে হয়ে কুকুরের ডাক শুনে ভয় পাও?’
রিয়া বলেছিল,’মেয়েটা ভয় পেয়েছে আর উনি হাসছে?’
হিয়া বলেছিলো, ‘আমাদের গ্রামে এমন ভয়ঙ্কর ভাবে এত কুকুর একসাথে ডেকে উঠে না।কুকুর জ্বীনদের দেখতে পায় তাই তারা এভাবে ডাকে।এমন জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছেন কেন?’
‘ভালোই তো তোমাদের ওইখানে জ্বীন নেই এখানকার একটা জ্বীন তোমাকে পছন্দ করে ওদের দেশে নিয়ে যাবে।’
‘আপুওওও’
‘আমার বোনকে আর ভয় দেখাবে না তো। খুব তো আমাদের আমাদের করছ ,তুমি নিজে ও মনে হয় আমাদের এলাকার না,অন্য জায়গার।এখানে কিন্তু পরীরাও থাকতে পারে, তোমার নিজের নজর কারো উপর পড়তে পারে।’এই কথাটা বলে আপু খুব হাসছিল।
‘আমার ঘরেই যে সুন্দরী পরী আছে , বাইরের পরীর দিকে আর নজর যাবে না।’এই বলে দুজনেই হেসে লুটোপুটি হয়েছিল।
হিয়া বলেছিলো,’এত রাতে আপনাদের রোমান্টিতা শুরু হলো ! আর আমি ভয়ে মরছি।’
রিয়া , আদনানকে বলেছিল,’ও আমার সাথে ঘুমাবে, তুমি ঐ রুমে গিয়ে ঘুমাও।’
হাসতে হাসতেই আদনান বলেছিল,’ দিলে তো শ্যালিকা রাতটা মাটি করে।’
এর পর আমরা দুই বোন বাকি রাতটুকু আর ঘুমায়নি। আহনাফ যেন জেগে না যায়,তাই আস্তে আস্তে কথা বলেছিলাম,কত কথা,আগা মাথা ছাড়া কথা,কত কথা!
একসময় এই কুকুরের ডাকে আর ভয় লাগতো না,স্বাভাবিক ব্যপারে পরিনত হয়েছিল।জীবনে সব কিছুই কি ,এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যায়?এ রকম কত স্মৃতি,এসব কি ভোলা যায়? সময়ের স্রোতে হয়তো হালকা হয়।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রলিং করতে লাগলো হিয়া। ফেসবুকে আগে কতটা সময় কাটতো এখন সেটাও ভালো লাগে না।কে কি পোস্ট করেছে দেখতে লাগলো।একটা ফিল্টার ম্যাসেজ এসেছে আরো কয়েক ঘণ্টা আগে।ম্যাসেজটা দেখে হিয়া অসম্ভব অবাক হলো। আরজুর ম্যাসেজ,’কেমন আছ হিয়া?’
রাগে গা জ্বলে গেল দেখে।রিপ্লাই দিবে না ভাবলেও হিয়া লিখলো,’কেমন আছি সেটা জেনে আপনার কি দরকার?আর কখনো আমাকে ম্যাসেজ দিবেন না।’
আরজু জেগেই ছিলো,’তোমাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে থাকি না, বেড়াতে এসো।’
এবার হিয়া রাগে কাঁপতে লাগলো।
হিয়া মনে মনে ভাবতে লাগলো,’ আমাকে নিয়ে কি খেলতে চাচ্ছে আরজু?আমাকে ম্যাসেজ পাঠানোর সাহস হয় কি করে?’
মায়া খেয়াল করলেন , রিয়ার বাসা থেকে আসার পর থেকে নিপা একদম চুপ, জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেলেন না।মেয়েটাকে নিয়ে আগে ভয় লাগতো আর এখন আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। নিরাকে ফোন দিলেন নিরা বলল-
— মা ওকে আবার ডাক্তার দেখাও।
—ডাক্তার দেখিয়ে লাভ কি ?ডাক্তার তো ঔষধ চালিয়ে যেতে বলেছিল।ও তো ঔষধ খেতে চায় না।কোন ভাবেই কথা শোনানো যায় না।
—তুমি নিজের কাছেই ঔষধ রেখে সময়ে সময়ে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াবে।
মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
—সেটাই তো করতে চাই।হাতে দিলে ঔষধ ছুঁড়ে ফেলে দেয়।নিরু তুই তো ওকে ভালো করেই চিনিস।
—যে কোন ভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।ডাক্তার কাউন্সিলিং করলে কিছুটা হলেও বুঝবে।
—যত বার যাই আসার পরে কিছু দিন ভালো থাকে।
—সেটাই তো বলছি,কোন ভাবে বুঝিয়ে নিয়ে যাও।
—আচ্ছা ।
নিরার সাথে কথা বলতে দেখে নিপা বলল-
—ওহ্ শুরু হয়ে গেল আদরের মেয়ের কাছে আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ শোনানো।
ফোন রেখে এবার রেগে গিয়ে মায়া বললেন-
—নিপু আন্দাজে কথা বলা বন্ধ কর।
—যেটা ঠিক সেটাই বলি।
—কি ঠিক আর কি বেঠিক সব কিছুই তোর মন গড়া কথা।এ সব বন্ধ কর,তুই ভালো করেই জানিস,তোকে আর নিরুকে কখনো আলাদা চোখে দেখিনি, দুজনকে সমান ভালোবেসেছি, সন্তানকে মা কখনো আলাদা চোখে দেখে?
রেগে রেগে কথা বলতে বলতে শেষের দিকে মায়ার গলা ধরে এলো।
নিপা কিছুটা নরম হয়ে বলল-
—তোমার কথা বলছি না, তোমার স্বামীর কথা বলছি।
—নিজের বাবা সম্বন্ধে এভাবে কথা বলে কেউ?
—সে আমাদের কেউ না,যেদিন আরেকটা বিয়ে করেছে সেদিন থেকেই কেউ না। তুমি কেন তাকে ডিভোর্স দিচ্ছ না,কেন এত দিন থেকে ঝুলিয়ে রেখেছ?ঐ লোকের কথা মনে হলে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়।
—সেই সব কোন কিছুর চিন্তা আমি করি না মা,এখন তোকে নিয়েই আমার চিন্তা। নিপু মা , চল কালকে ডাক্তারের কাছে যাই।
—ডাক্তারের বক বক শুনতে ভালো লাগে না।
—কাউন্সিলিং করলে তোর ভালো লাগবে মা,চল না যাই ।
—আচ্ছা ভেবে দেখবো।আমি এখন যাই,ঘুমাবো।
নিপা ঘুমাবো বলে চলে এলেও ঘুম আসছে না, এলোমেলো চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
হিয়া কেন এসে উঠেছে এই বাসায় ,মনে হতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।আরেকটা মহিলাকেও দেখলো, কাজের মহিলা মনে হয়।
হঠাৎ করে আবার মাথায় বশির উদ্দিন ভর করলো কেন? বাবার নামটাও মনে করতে চায় না সে।
নিপার স্পস্ট মনে আছে,ও যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে ,নিরা ক্লাস এইট এ পড়ে। পাশের রুম থেকে মারার শব্দ আসছিলো,এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল কিন্তু সেদিন নিপা আর সহ্য করতে পারছিল না,এক দৌড়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল ,’আমার মাকে আর মারতে পারবে না।’
বশির সেদিনের মত থেমে গিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে ঝলসে দিচ্ছিল নিপাকে।
মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল,’এখন মেয়েদেরকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিস?থাক তোর মেয়েদের নিয়ে।’
এর পর দুই দিন আর বাসায় আসেনি বশির। তৃতীয় দিন যখন এলো , তখন থেকেই নিপার সাথে বৈরী আচরণ। অনেকগুলো খাবার জিনিস এনে নিরার হাতে দিয়ে বলেছিল,’আমার নিরু মায়ের জন্য এনেছি।’
কি অদ্ভুত ব্যপার যারা অন্যায় সহ্য করে মুখ বুজে তারাই ভালো হয়ে গেল।প্রতিবাদ করে সে চক্ষুশূল হয়ে গেল। সেদিন থেকেই ওদের সবার উপর নিপা ক্ষুব্ধ । বশিরের উপর অন্যায় করার জন্য আর মা-বোনের উপর সেটা সহ্য করে ভালো সাজার জন্য।
এ সব চিন্তায় আরো বেশি অস্থির লাগছে।উঠৈ গিয়ে একসঙ্গে দুইটা ট্যাবলেট খেয়ে ফেলল।এর আরো ঘন্টাখানেক পর সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
সকালে আদনান তারাতারি করে রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো-
—কিছু লাগবে? লাগলে আসার সময় নিয়ে আসবো।
হিয়া ভেতরের রুমে ছিল, খেয়াল করলো শাপলা কিংবা মফিজ নেই।সে বের হয় এসে বলল-
—আহনাফের কর্নফ্লেক্স লাগবে।
তাকিয়ে দেখলো হিয়া। নাস্তার টেবিলে হিয়া ছিল না, শাপলা নাস্তা দিয়েছে।
—আচ্ছা নিয়ে আসবো। আহনাফ উঠেনি?
—না।
বেডরুমে গিয়ে ঘুমন্ত আহনাফকে আদর করে এলো আদনান।
—আচ্ছা তাহলে বের হচ্ছি।
হিয়া আস্তে বলল-
—হু।
আদনান অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করেছিল, অফিস যাওয়ার আগে রিয়াকে সবসময় এভাবে জিজ্ঞেস করতো ।রিয়া থাকলে বিদায় পর্বটা অন্যরকম হতো।বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়েই অফিসে রওনা হলো আদনান।
শাপলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ফোনে কথা বলছে দেখে মফিজের সন্দেহ হলো।কার সাথে , কি এমন কথা বলে শাপলা?
চলবে…
ফাহমিদা লাইজু
৫ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1201449017036790/
৬ষ্ঠ পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1202138286967863/