#কেন এমন হয়
পর্ব – ১৬
রিকশায় উঠার পর হিয়া বলল-
—আমরা বাসে করেও ফিরতে পারতাম।
—না,রিকশাই ভালো।
—এত দুরের পথ রিকশায় বিরক্ত লাগে।
—আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার বিরক্তি দুর করতে চল তোমাকে ফুসকা খাওয়াই।খাবে?
—যেই জিনিসের কথা বললেন,সেটার কথা শুনলেই তো জিভে পানি চলে আসে,কখনো মানা করা যায়?
রিকশাওয়ালাকে হিয়া বলল-
—ফুচকা ওয়ালা দেখলে দাঁড়িয়েন তো মামা।
আদনান দেখলো হিয়ার চোখে, মুখে উচ্ছলতা খেলা করছে।এই মেয়েটার মুখটা এত দিন বিষন্নতায় ছেয়ে ছিল। হঠাৎ আদনান মনে মনে বলল,’এই মেয়েটা এখন যেমন ঠিক যেন তেমনই থাকে, পৃথিবীর কোন দুঃখ যেন ওকে স্পর্স না করে।’
ফুচকা খাওয়ার সময় আদনানকেও এক প্লেট খেতে হলো।আদনান অবাক হলো এই দেখে রিকশাওয়ালার জন্য ও একপ্লেট নিয়ে খেতে দিল।এই মেয়েকে এত বছর থেকে চিনেও জানতে পারলো না, অবশ্য হিয়াকে জানার তো প্রয়োজনও হয়নি।
আবার রিকশা চলতে শুরু করল।আদনান জিজ্ঞেস করলো-
আরজু কি আরো কোন মেসেজ দিয়েছে?
হিয়া গম্ভীর হয়ে গেল। আদনানের নিজের কাছে খারাপ লাগছে, এই কথাটা বলার এখন কি দরকার ছিল তার?
রিয়া সব সময় বলতো ,’ তুমি সময় বুঝে কথা বলতে পার না। অনেক সময় দেখা যায় আমি খুব ফুরফুরে মেজাজে আছি তুমি হঠাৎ এমন প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু কর, মুড নষ্ট হয়ে যায়।’
—এখন তো আজেবাজে মেসেজ দেয়া শুরু করেছে।পড়তেও ঘৃণা হয়।এমন সময় আদনানের মোবাইল বেজে উঠল-
—আম্মা ,হিয়া আমার সাথেই আছে। চিন্তা করো না।আমরা তারাতাড়ি চলে আসবো।
—এত তারাহুড়ার কিছু নাই।তোরা আস্তে ধীরে আয়।আমি আর আহনাফ সাজিয়াদের বাসায় আছি। আহনাফ, রিদভী -অভির সাথে খেলতাছে। চিন্তা কইরো না।
—আচ্ছা ঠিক আছে আম্মা।
—আদনান মুচকি হাসছে দেখে হিয়া জিজ্ঞেস করলো কি হলো হাসছেন যে।
—আম্মা বললেন আমাদের তারাহুড়া করে না যেতে, আস্তে ধীরে বাড়ি যেতে।
হিয়া রিকশাওয়ালাকে হাসতে হাসতে বলল-
—মামা শুনলেন তো আমার শাশুড়ি কি বলেছেন সেটাই পালন করেন, হেঁটে হেঁটে রিকশা চালান।তাহলেই আস্তে আস্তে যাওয়া হবে।
সমস্ত কষ্টের গলিকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তাদের।
শাপলা আর মফিজের মধ্যে বিরাট ঝগড়া হয়ে গেছে। শাপলা দরজা খোলার পর হিয়া দেখলো শাপলার চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে একটু আগে ও সে অনেক কেঁদেছে। চোখের কান্না বন্ধ হলেও মনটা কেঁদেই চলেছে ।
হিয়া ফ্রেশ হয়ে আলাদা করে শাপলাকে নিয়ে বসলো।কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই শাপলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।শাপলা কেঁদেই চলেছে।হিয়া বসে আছে, শাপলা কাঁদুক , মনের কষ্টগুলো হালকা হোক।
মানুষের অনেক বড় একটা থেরাপি হলো কান্না থেরাপি।এই থেরাপিতে চলে বেশির ভাগ মেয়েরাই। তারা যদি কেঁদে কেঁদে চোখ দিয়ে পানি গুলো বের না করতো তাহলে দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয়গুলো বুকের খাঁচায় ডুবে মরতো।
কান্নার গতি যখন কমে এলো তখন শাপলা বলল-
—এই পাঁচ বছরে কোন দিন এই কথা আমারে সে বলে নাই,কত মানুষ কত কথা বলছে,সে বলে নাই।
—কি কথা ভাবি?
—গ্রামের মানুষ কত অপবাদ দিছে,তারে আবার বিয়া করতে বলছে তবুও সে আমারে কিছু বলে নাই।
—আচ্ছা ভাবি কি কথা বলবে তো।
—আমি নাকি বাজা মেয়েমানুষ।হিয়া ভাবি সে আমারে বলে আমি বাজা, এই পাঁচ বছরে আমাদের কোন সন্তান হয় নাই,আমি বাজা। তুমি চিন্তা কর কত বড় কথা সে আমারে বলছে।
আবার শাপলা কাঁদতে শুরু করল।
—আচ্ছা শোন ভাবি , সমস্যা যে তোমার এটা মফিজ ভাই আন্দাজে বলল কিভাবে? সমস্যা যে কারো থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে।সমস্যা কার সেটা ডাক্তারই শুধু বলতে পারবে।
অনেক হয়েছে এবার কান্নাকাটি থামাও।আমি সাজিয়া ভাবিকে জিজ্ঞেস করে আসি কোন ডাক্তার দেখালে ভালো হবে।
সাজিয়ার সাথে নূরজাহান গল্পে মেতে আছেন।হিয়া বসতে বসতে বলল-
—ভাবি একটা জিনিস জানতে এসেছি।ভালো কোন গাইনোকলজিস্টের নাম বলেন তো, খুব দরকার।
এই কথা শুনে নূরজাহান মিটমিট করে হেসে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-
—আমি এখন যাই, একটু কাজ আছে।
—কি ব্যপার হিয়া এত তাড়াহুড়া কিসের, দুষ্টুমির একটা ইঙ্গিত।
এতক্ষণে হিয়া বুঝতে পারলো তার শাশুড়ি এমন করে হাসছিল কেন?
নিজের জন্য ডাক্তারের দরকার হলে হিয়া কি শাশুড়ির সামনে এভাবে বলতো?
হিয়া খুলে বলল সাজিয়াকে শাপলার কথা।
—তাহলে শাপলাকে ইনফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে।আমি রাতে পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলে জেনে রাখবো কোন ডাক্তারের কাছে গেলে ভালো হবে।
—ঠিক আছে ভাবি।এখন আসি তাহলে।
—একটু বস তো,তুমি তো আসোই না।কি ব্যপার আজ নাকি দুজনে একসাথে বের হলে আবার একসাথে ফিরলে?
—আম্মার জন্যই।উনি তো ভাবেন,আমি একা চলাফেরা করলে হারিয়ে যাবো।
—আসলে খালাম্মা চান তোমরা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে যাও।
—কিন্তু সব কিছুর জন্যই তো উপযুক্ত সময় লাগে ভাবি।
—সেটাই।
সাইকিয়াট্রিস্ট এনামুল হকের সামনে নিপা বসে আছে।কোন দিকেই নিপার কোন আগ্রহ নেই, তার দৃষ্টি মনে হচ্ছে শূন্য। হসপিটালে ভর্তির পর এনামুল হক নিপাকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।
—কেমন আছ নিপা?
নিপা একবার ফিরে তাকালো শুধু, উত্তর দিলো না।
—এখানে কেমন লাগছে তোমার?
কোন উত্তর নেই।
—তুমি কি জান এই মানসিক হাসপাতালটা করেছি কার নামে? আমার মায়ের নামে। আমার মা ও কিছু মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন,ঐ সময় তো এতটা উন্নত চিকিৎসা ছিল না।
এবার নিপার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে শুনতে আগ্রহী।
ছোট বেলায় মায়ের সমস্যাটা খুব কাছ থেকে দেখেছি। লোকলজ্জার ভয়ে বাবা সব সময় তটস্থ থাকতেন, জানতে পারলে লোকে আমার মাকে বলবে ‘পাগল’। আমার মায়ের চিকিৎসা সীমাবদ্ধ ছিল হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া খাওয়া।
নিপা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডাক্তার থেমে যাওয়াতে নিপা বলল-
—তারপর কি হলো?
—উনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খুব কষ্ট করে কেটেছে। উনার জীবন যে এলোমেলো হয়ে গেল, কষ্টে কাটছে সে সব কিছুই উনি বুঝতে না। আমাদের ভাই-বোনদের অনেক কষ্ট করে মানুষ হতে হয়েছে।
—এই জন্যই আপনি পাগলদের ডাক্তার হলেন?
—হু।যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছে তারা যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন- যাপন করতে পারে এই উদ্দেশ্যেই এই হাসপাতালটা গড়ে তোলা।
—আপনার বাবা কেমন ছিলেন সেটা তো বললেন না।
—বাবারা যেমন থাকে তেমনই ছিলেন।
নিপা চোখ-মুখ শক্ত করে বলল-
—না সব বাবারা এক রকম হয় না।আমার বাবা একজন জঘন্য লোক।আমার মায়ের সাথে, আমাদের সাথে তার যে কি ভয়ংকর খারাপ ব্যবহার সেটা বলে বোঝানো যাবে না।
—সেটা ঠিক।সব মানুষ এক রকম হয় না।
—বেশির ভাগ পুরুষই খারাপ।
—তোমার ট্রিটমেন্টের জন্য আমার কাছে আসছ কত দিন?
—তিন বছর চার মাস পাঁচ দিন।
আশ্চর্য হয়ে ডাক্তার তাকালেন নিপার দিকে।দিন,মাস সব কিছু মনে রেখেছে নিপা!
—আশ্চর্য হবার কিছু নেই।আমি সবার সাথে মিশি না কথাও বলি না। আঙ্কেল আপনাকে পছন্দ হয়েছিল প্রথমদিন কথা বলেই। আপনার সন্তানেরা অনেক ভাগ্যবান আপনার মত বাবা পেয়ে। আপনাকে খুব পছন্দ করে,ভালোবাসে তাই না?
—হু,বাসে।
ডাক্তার এনামুল এই মেয়েটার প্রতি খুব মমতা অনুভব করেন। তার নিজের একটা মেয়ে থাকলে কেমন হতো জানেন না।কারণ তার কোন মেয়ে নেই। ছেলেরা আছে নিজেদের মত।
—আচ্ছা বলতো আদনান কেমন?
এবার নিপার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল-
—সে সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ।রিয়াকে সে খুব ভালোবাসতো সেটা দেখে প্রথম প্রথম আমার খুব ভালো লাগতো।এই প্রথম দেখলাম আমার বাবার মত ছাড়াও ভালো পুরুষ মানুষ আছে।এত কেয়ারিং ,এত মধুর সম্পর্ক তাদের মধ্যে দেখে খুব অবাক লাগতো।রিয়ার জায়গায় নিজেকে কখন থেকে যে ভাবতে শুরু করলাম সেটা জানি না।সব কিছুতে আমার সাথে আদনানকে কল্পনা করতে লাগলাম। দিন দিন রিয়াকে অসহ্য লাগতে শুরু করলো।আঙ্কেল আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, আর কথা বলতে পারবো না।ঠিক আছে?
—ঠিক আছে।
মায়া এক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত নিপার দিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তা করতে লাগলেন,’ ঘুমিয়ে থাকলে সেই ছোট বেলার নিপুর মত মনে হয়,কি সুন্দর ফুটফুটে একটা মুখ।কেন মেয়েটার জীবনে এমন একটা রোগ হলো।বশির..বশিরই দায়ী এ জন্য।’বশিরের কথা মনে হতেই মায়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।মনে মনে বললেন-‘বশিরকে আমি কোন ভাবেই ছাড়বো না।’
চলবে…
ফাহমিদা লাইজু
১৫তম-পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1208704419644583/