কেন এমন হয় পর্ব – ১৭

কেন এমন হয়

পর্ব – ১৭

—আমি কি বেশি দেরি করে ফেললাম?
—না না, আমি এই কিছুক্ষণ হলো এসেছি।
—তুমি এত ব্যস্ত একজন নামকরা উকিল , তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলছি না তো?
—আরে না না ।তোমার সাথে কথা বলাটা আমার স্বার্থেই খুব প্রয়োজন। তোমার কেইসটা আমাকে জিততেই হবে ।সে জন্য আরো ইনফরমেশন দরকার। তোমার নিজেকে ব্লেইম দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছি।এ সব ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াও তো।মাথা তুলে নিজের মতো বাচঁতে শিখো।
—কি আর বাঁচবো,মরেই তো আছি।এমন স্বামী থাকলে মানুষ বেঁচে থাকেও লাশ হয়ে বেঁচে থাকে। স্বামীর কথা বাদ দিলাম কিন্তু আমার মেয়েদের জীবনটা এমন হলো কেন বলতে পার?
—আহ্হা সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না তো।আচ্ছা নিরা আর নিপা এখন কেমন আছে?
—নিরু আর বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে,এখন বাসাতেই আছে।
নিপার ও অনেক ইনপ্রুভ হচ্ছে। চিন্তা করছি নিরুকে ঢাকায় নিয়ে আসবো কিনা।এই সময়ে ওর খুব যত্নের প্রয়োজন। কিন্তু যদি ওরা আসতে দিতে না চায় নিরুকে?
—ওটা নিয়ে চিন্তা করো না।আমি ব্যবস্থা করব,নিরার স্বামী নিজেই নিয়ে আসবে।
—উকিল সোহরাব হোসেন এই নামটা দেখে কখনো কল্পনাও করিনি এই ব্যক্তি আমার ক্লাসমেট সবুজ, তুমি হতে পার!
—তুমি তো আমাকে দেখেও চিনতে পারনি।পরিচয় না দিলে চিনতেও না।
—আসলে, আশপাশের সব মুখ যখন অপরিচিত তখন দুরের অপরিচিতদের মাঝে পরিচিত মুখ খোঁজা ভুলে গিয়েছি সেই কবে!আমাকে চিনলে কিভাবে?
—তোমার খুব একটা পরিবর্তন হয় নি।তাই চিনতেও অসুবিধা হয়নি।
আচ্ছা আমাদের ক্লাসের জমিরকে মনে আছে তোমার?আরে যেই ছেলেটা আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল?
মনে পরছে না?
—ও মনে পড়েছে।কি বোকাই না ছিলে তুমি সবুজ,এখন আইনের মারপ্যাচে এত পারদর্শী হলে কি করে?
সবুজ হো হো করে হাসতে লাগলেন।
—আসলেই ,আমাকে কি বোকাটাই না বানিয়েছিল।
জমির আমার সাথে দুষ্টুমি করার উদ্দেশ্যে, আমাকে বাহক বানিয়ে তোমার কাছে প্রেমপত্র পাঠিয়েছিল।

—আমি তো অবাক।প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি নিজেই লিখেছ,খুলে লিখা দেখেই চিনতে পারলাম, ক্লাসের সবচেয়ে ফাজিল ছেলের কাজ এটা।জব্বার স্যার বোর্ডের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে ডেকে লিখাতেন।এ জন্য সবার হাতের লিখা আমি ভালোভাবে চিনতাম।
যদি হাতের লিখাটা না চিনতে পারতাম তাহলে তোমার খবর ছিল। এলাকার কেউ তো সাহস পেতো না আমাদের বাড়ির মেয়েদের উপর চোখ তুলে তাকাতে।তোমরা নতুন এসেছিলে তাই জানতে না।

আরো অনেক প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথার পর দুজন বিদায় নিলেন।

স্কুল, কলেজের ক্লাসমেটরা কে কোথায় আছে কিছুই মায়া জানেন না।আসলে সবুজ নামের কারো অস্তিত্বই ছিল না তার স্মৃতিতে।তবে এত বছর পর সবুজের দেখা পেয়ে মনে হলো -ভরসা করার মত কেউ একজন অন্তত আছে।

মায়াদের সময় গ্রামের স্কুলে কোন ছেলের সাথে কথা বলা তো দুরে থাক চোখাচোখি হলেও ছিল লজ্জার। মেয়েরা সবাই কমন রুমে থাকতো।ক্লাস শুরুর আগে স্যার এসে কমন রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েরা স্যারের পেছনে পেছনে ক্লাস রুমে ঢুকতো আবার ক্লাস শেষে স্যারের পেছনে পেছনে বেরিয়ে কমন রুমে বসে পরবর্তী ক্লাসের অপেক্ষা করতো।এভাবেই ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেনের মেয়েরা প্রত্যেকটা ক্লাস করতো। ছেলেরা ক্লাসেই থাকতো।মায়াদের ক্লাসে তখন মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল সাতচল্লিশ জন। সবুজ ক্লাস নাইনে এসে ভর্তি হয়েছিল।

এই সব পুরোনো দিনের কথা ভাবছিল আর রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিল মায়া , তখন কোত্থেকে বশির উদয় হলো।বিশ্রি ভাবে হাসতে হাসতে বলল-
—তাই তো বলি এত তেজ কিভাবে হলো? নতুন নাগর জুটছে তোর আর এই জন্যই এত দেমাগ না?এখানে সেখানে প্রেমলীলা করে বেরাস,নষ্ট মেয়ে মানুষ।
একটা কথাও না বলে মায়া চিৎকার দিলেন-
—বাঁচাও বাঁচাও বলে ।
মুহুর্তের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেল। বশির কোন মতে পালিয়ে জান বাঁচালো।
এই রকম নর্দমার কীটের জন্য এই ব্যবস্থাই সবচেয়ে কার্যকর।
এত নোংরা কথা বশিরের মুখ থেকে বের হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যপার।মায়া ভালোভাবেই চিনেন বশিরকে।যে যেই রকম সে অন্যকে তেমনই মনে করে। পার্থক্য হলো নিজের অন্যায় নিজের চোখে ধরা পড়ে না।এই ধরনের লোক অন্যের গায়ে নোংরা গন্ধ লাগতে সব সময় ব্যস্ত থাকে।

মায়া দ্রুত একটা রিকশায় উঠে ভাবতে লাগলেন- বশিরের কাছ থেকে আপাতত ছাড়া পেলেও এখন আরো বেশি চিন্তার কারণ হয়ে গেল।তার মানে হলো বশির তাকে ফলো করছে।এই নিয়ে সবুজের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

মেঘে মেঘে জমতে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে আরজু ভাবে ,’ কেন এমন হলো? ইচ্ছে করলে হিয়া আমার হতে পারতো।’
যত দিন দুঃখ এসে ভর করেনি, ততদিন হিয়াকে এতটা মনে পড়েনি।ভালোই তো ছিল, হঠাৎ কি হয়ে গেল কনার?এই অপমানের জীবন আর ভালো লাগছে না , ইচ্ছে করছে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দুরে কোথাও চলে যায়।যেখানে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। কিছু দুঃখ, কষ্ট ভালোবাসা দিয়েই ভুলিয়ে দিতে হয়।কনা কি সত্যিই আরজুকে ভালোবেসেছে নাকি সবাই ছিল মোহ?
ভাবতে ভাবতে পাশে তাকালো ,একটা রিকশায় হিয়া আর আদনান হেসে হেসে কথা বলছে।দেখে আরজু চমকে উঠলো।আধো আধো আলোতে হিয়াকে অপ্সরার মতো লাগছে, কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছেনা আরজু।খুব সুখেই আছে মনে হচ্ছে হিয়া।তাহলে কি আরজুকে ভুলে গেছে হিয়া।মনে রাখবেই বা কেন?মনে রাখার মতো কারণ ও তো ছিল না।জ্যামে আটকে আছে অনেকক্ষণ। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে একটা ম্যাগাজিনে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো আরজু।

গাড়িতে বসে থাকা লোকটাকে হঠাৎ দেখে হিয়ার মনে হচ্ছিল আরজু।ভালো করে দেখতে যাবে তখন জ্যাম ছুটে গেল।যদি সত্যিই আরজুর দেখা পেতো সোজা গিয়ে ওর কলারটা টেনে ধরতো হিয়া।
শাপলা আর মফিজ আরেক রিকশায়।
শাপলা আর মফিজকে ডাক্তার দেখিয়ে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো হলো কয়েকদিন লাগিয়ে।
আজ যাচ্ছে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখাতে।
আদনান বলল-
—আকাশে মেঘ করছে,বৃষ্টি হবে মনে হয়।
—হোক বৃষ্টি,তাহলে ভিজবো।
—বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে।
—জ্বর আসলে ভালোই হবে।
—কেন?
—জানিনা।
—-এই তো চলে এসেছি।

ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন-
—দুইজনের রিপোর্ট নরমাল। রিপোর্টে কোন সমস্যাই দেখতে পাচ্ছি না।অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর কারো কোন সমস্যা না থাকলেও সন্তান ধারণ করতে দেরি হয়। তবে আমি কিছু কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি, সেগুলো খাবেন।
মফিজ বলল-
—কি ওষুধ ডাক্তার আপা?
—ভিটামিন, আয়রন ট্যাবলেট।আর সব চেয়ে জরুরি ব্যপার হলো আপনাদের কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।
ডাক্তার সব নিয়মকানুন বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দিলেন।

শাপলার মনে হলো তার বুক থেকে কেউ বিশাল একটা পাথর নামিয়ে দিয়েছে।সে ভাবতে লাগল দোষটা যদি তার হতো মফিজ আরেকটা বিয়ে করতো নিশ্চিত। মফিজ ভাবছিল এটা কিভাবে হয়, সমস্যা না থাকলে বাচ্চা হয় না?তবে মফিজ ভাবে সন্তান যে হতেই হবে এমন কোন কথা নেই।শাপলাকে নিয়ে বুড়া বয়স পর্যন্ত বাঁচতে চায় সে। মাঝেমধ্যে শাপলা এত রাগিয়ে দেয় যে মুখ থেকে খারাপ কথা বেরিয়ে যায়। সেদিন রাগে শাপলাকে বাজা মেয়ে মানুষ বলে ফেলেছে।যখন রাগ কমলো তখন বুঝতে পারলো এটা বলা ঠিক হয়নি। শাপলা খুব কষ্ট পেয়েছে।তবে এক উছিলায় ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব হয়ে গেল।এখন আর কেউ কাউকে দোষারোপ করতে পারবেনা।

হিয়া বলল-
—আহনাফের জন্য চিপস নিয়ে যেতে বলেছে। বাসার কাছের দোকান থেকে নিলেই হবে।
—ঠিক আছে। তুমি যে এতটা দায়িত্ব নিয়ে ওদের ডাক্তার দেখালে।আম্মা খুব খুশি হয়েছেন।
—আমি তো এটা করেছি শাপলা ভাবির কথা চিন্তা করে।আর এটা তো একটা চিন্তার কারণ এত দিনেও একটা বাচ্চা হলো না।
হিয়া কি যেন একটা পারফিউম মেখেছে, খুব সুন্দর মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগছে।হিয়ার এত কাছাকাছি বসে আছে আদনানদ তবুও মনে হচ্ছে কত দুরের কেউ।তবে আগে রিকশায় বসলে হিয়া একদম গুটিয়ে রাখতো নিজেকে এখন তেমনটা না, অনেকটাই সহজ হয়ে বসে। মানুষের জন্য ওর অসম্ভব মমতাবোধ।অন্যের দুঃখে ওর মন কেঁদে ওঠে।

—আচ্ছা আম্মা-আব্বা আগামীকাল সকালে চলে যাবেন। আহনাফ আবার কি করে?উনারা এখানে থেকে গেলে সমস্যা কি?
—দেখছো না আব্বা কেমন অস্থির হয়ে যায়।আহনাফের জন্য তাদের যাওয়া এত দিন পেছালো। কোনদিন তাঁরা এতদিন ঢাকায় থাকেননি। তাঁদের নাকি দম বন্ধ হয়ে যায়।
আচ্ছা ,চাচা কবে আসবেন?
—এর মাঝেই আসার কথা ছিল। আব্বা-আম্মা আছেন তাই আসছেন না।এত লোকের নাকি ঘুমাতে সমস্যা হবে।আমি বললাম,কোন সমস্যা হবে না কিন্তু কে শোনে কার কথা।
—আহনাফকে বোঝালেই হবে সিমিরা আসছে অনেক মজা হবে আর আমরা কিছু দিন পর বাড়ি যাবো।
—আচ্ছা ঠিক আছে। আহনাফকে একটা ভর্তি কোচিং এ ভর্তি করাতে হবে। কিছু দিন প্রিপারেশন নিলে ভালো একটা স্কুলে চান্স পেয়ে যাবে।ও খুবই শার্প, খুব তাড়াতাড়ি পড়া বুঝতে পারে।আপু সব সময় বলতো আহনাফের যা হতে মন চায় বড় হয়ে তাই হবে।আমিও ওকে কখনো জোর করবো না।
—তোমরা দুই বোন একই রকম হয়েছ।

দুইজনেই আবার চুপ হয়ে গেল।একটা মানুষের অস্তিত্ব কিভাবে বিলীন হয়ে যায়!তার স্মৃতিগুলো প্রিয় মানুষগুলোকে কষ্ট দেয় বার বার।

আদনান হঠাৎ বলল-
—তোমাদের বাড়িতে রিয়াকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম , তোমার মনে আছে?
—মনে আবার থাকবে না , খুব মনে আছে ,ঐ কথা কি ভোলা যায়?
বলেই হিয়া হাসতে লাগলো। আদনান ও সাথে যোগ দিলো।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

১৬তম-পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1209610792887279/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here