কেন এমন হয়
পর্ব – ৮
শাপলা কার সাথে কথা বলছে জানার জন্য আস্তে আস্তে চোরের মতো শাপলার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো মফিজ।
‘-আপনি যেই ভাবে বলছেন সেই ভাবেই করতেছি।
-একটু একটু কথা কয়।
-অনেক আদর করে।
-আমি সামনে থাকি না।
-হু, আচ্ছা।’
মফিজ শুধু শাপলার কথাগুলোই শুনতে পেলো অপর প্রান্তে কে বুঝতে পারলো না, হঠাৎ তার মাথা গরম হয়ে গেল।
পেছনে ঘুরতেই মফিজের সাথে ধাক্কা লাগল শাপলার।
—কার লগে লুকাইয়া লুকাইয়া কথা কও?
—কি মনে হয়?আমারে সন্দেহ কর?
—সন্দেহ করার মত কাজ করলে সন্দেহ করমু না?
—এত সন্দেহ মনে তাইলে আমারে রাখছ ক্যান?
উত্তর না দিয়ে মফিজ , শাপলার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে দেখলো। নূরজাহানের কল দেখে মুহূর্তের মধ্যে মফিজের চেহারার রং বদলে যায়।আল্লাদে গদগদ হয়ে যায়।
—খালাম্মার সাথে কথা কও,তাতে লুকানোর কি হইলো?
—আমারে সন্দেহ কর ,এইটাই বড় কথা এখন।এত দিনেও আমারে চিনলা না!আর কোনদিন চিনবা?আমার সাথে কোন কথা বলবা না। তোমার কোন কথার উত্তর দিমু না।
এই বার মফিজ বৌয়ের রাগ ভাঙাতে জড়িয়ে ধরে বলে-
—ভয় পাই বৌ, খুব ভয় পাই তোমারে হারাইয়া ফেলার , ভয় পাই।
—এই জন্য এমন খারাপ ব্যবহার করবা?এত দিনেও যদি আমারে না চিন,আর কবে চিনবা,আমার উপরে বিশ্বাস আসবো আর কবে?
—আর এমন করমু না।
—এমনি কথা বহুবার বলছ।আর একবার এমন করলে খালাম্মার কাছে নালিশ জানামু।
—আচ্ছা ঠিক আছে।এই বার বল কি ব্যপার, খালাম্মার সাথে লুকাইয়া কথা কও?
—আমারে খালাম্মা একটা বিশেষ দায়িত্ব দিয়া পাঠাইছে , ভাইজান আর হিয়া ভাবির উপরে নজর রাখতে।
—এর মানে কি,তারা জামাই-বৌ তাদের উপরে নজর রাখনের কি হইলো?
—তারা তো দুইজন কথাই বলতে চায় না। খালাম্মা বলছে দুইজন যেন কথা বলতে বাধ্য হয় এমন অবস্থা তৈরি করতে।
—কেমনে?
—এই দেখলা না আজকে ভাইজান অফিস যাওয়ার সময় আমরা কেউ কাছে ছিলাম না, ভাইজান জিজ্ঞেস করতেছিল কি লাগবে তখন ভাবি বের হয়ে আসতে বাধ্য হইছে। এমনি কইরা যেন কথা বলে আর তাদের সম্পর্কটা যেন স্বাভাবিক হয়, এইটার ব্যবস্থা করা। এরপর একদিন তাদের দুইজনের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা লাগবে বেড়াইতে। খালাম্মা তাই বলছে। এখন যাই তো ভাবিরে বলি ভাবী মোবাইল ধরে না কেন, খালাম্মা মোবাইলে পাইতেছেনা। খালাম্মারে যেন একটা ফোন করে।
মফিজ ছাড়তে চায় না ,শাপলা কৃত্রিম রাগ দোখিয়ে চলে যায়।
শাপশা গিয়ে দেখে, হিয়া আহনাফকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করছে।
—বাবাটা উঠে না কেন? অনেক বেলা হলো যে।এত বেলা করে ঘুম ভেঙ্গলে স্কুলে যাবে কিভাবে?
—খামমনি আর একটু ঘুমাতে দাও।
হিয়া আহনাফকে সুড়সুড়ি দিয়ে উঠাতে চেষ্টা করতে লাগলো,আর আহনাফও এক সময় উঠে বসে হাসতে লাগলো।
এই সব দেখে শাপলা ভুলে গেল কি বলতে এসেছে।
আহনাফের স্কুল পাঁচ মাস গ্যাপ হয়ে গেল। কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে থাকবে নাকি অন্য কোন স্কুলে দিতে হবে,দিলে কোন স্কুল ভালো হবে এ সব নিয়ে কথা বলতে হবে আহনাফের বাবার সাথে।
আহনাফ নিজের খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে বাবুর একটা খেলনা হাতে নিয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগলো।হিয়া এই ব্যাপারটা খেয়াল করে শাপলা কে বলল বাবুর সব খেলনা স্টোররুমে রেখে দিতে।
কাজ সেরে শাপলার মনে পরল মোবাইলের কথা।
—ভাবি খালাম্মা আপনারে ফোন করতে বলছিল, রিং হয় আপনে ধরেন নাই।
হিয়া মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল অনেকগুলি মিসড কল।
ওর মা, শাশুড়ি, আদনান আর ওর বান্ধবী মেহেনূর কল দিয়েছিল।
মোবাইলটা নিয়ে বসলো একে একে সবাইকে ফোন করার জন্য।
মায়ের সঙ্গে কথা বলে, শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলল।
পরে আদনানকে কল করলো।
আদনান মনে হয় ফোনের কাছেই ছিল একটা রিং হতেই ধরে ফেলল-অস্থির হয়ে বলল-
—অনেক বার কল দিলাম ধরো না কি ব্যাপার? কল ধরছো না দেখে এখনই অফিস থেকে বের হতে চেয়েছিলাম বাসায় আসার জন্য।
—মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল তাই শুনতে পাইনি। জরুরী কিছু বলবেন?
—জরুরী কিছু না, আহনাফের খবর নেওয়ার জন্য।
—আহনাফ ভালো আছে, এখন খেলছে। ওর স্কুলের ব্যাপার নিয়ে একটু কথা বলতাম।
—বলো।
—ওর স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায় এতদিন গ্যাপ হয়ে যাওয়ার পরে, এখন আবার ক্লাস শুরু করলে কোন সমস্যা হবে কিনা? আর একটা ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য ও তো চেষ্টা করতে হবে। স্কুলে ফ্রেন্ডের সঙ্গে থাকলে ওর জন্য ভালো হবে।
—আমিও সেটাই ভাবছিলাম। বৃহস্পতিবার কাজের চাপ একটু কম আছে, দেরি করে অফিসে গেলে কোন সমস্যা হবে কিনা দেখি। অফিসে একটু ম্যানেজ করতে পারলে বৃহস্পতিবার স্কুলে যাওয়া যাবে।
—আহনাফের সাথে কথা বলেন।
এরপর বাবা-ছেলের কথা হলো অনেকক্ষণ।
হিয়া ভাবছিল ফোনে কথা বলা কত সহজ। সামনাসামনি কথা বলতে কত জড়তা! এখন থেকে কথা বলতে হলে মোবাইলেই কথা বলা চলবে। চোখে চোখ পড়বে না সহজে সবকিছু বলা হয়ে যাবে।
মেহেনূরকে কল দিল।মেহেনূর খুব উত্তেজিত হয়ে বলল-
—কি রে কল দিলে ধরিস না। কল করিস না। ব্যাপার কি। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল, কি পরীক্ষা দিবি না? মানুষের জীবনে কত অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে, তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে। পরীক্ষাটা না দিলে এক বছর পিছিয়ে যাবি। কষ্ট হলেও পরীক্ষা টা দে । কবে আসবি ঢাকায়?
—আমাকে কথা বলতে দিবি তো? শুধু আপুকে হারানোই না, অনেক বড় ঘটনা ঘটে গেছে এর মধ্যে।
—কি হল আবার?
হিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। আস্তে আস্তে বলল-
—নূর আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
—কোথায়? কার সাথে?কবে হলো বিয়ে? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না।
—জানানোর মত অবস্থা ছিল না?
—কার সাথে, বর কি করে?
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিয়া বলল-
—আদনান ভাইয়ের সাথে।
—এসব কি বলিস? মজা করিস না আমার সাথে।
—মজা করছি না রে । আমি এখন ঢাকায় আপুর বাসাতেই আছি। সম্ভব হয় একবার আসিস।
অপর পাশে আর কোনো কথা শোনা যাচ্ছিল না,মেহেনূর কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। হিয়া এই প্রান্তে থেকেও বুঝতে পারছিল তার বেস্ট ফ্রেন্ডের মন এই কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না, কষ্ট পেয়েছে, এজন্যই সব সময় কথা বলতে থাকা মেয়েটার মুখ এখন বন্ধ।হিয়া লাইনটা কেটে দিল।
নিপা এসে বলল-
—ট্রে,বাটিগুলো নিতে এসেছি।
হিয়া ফ্রিজ থেকে বের করে বাটিতে মিষ্টি ভরতে লাগলো।খালি বাটি তো দেয়া যায় না।
—আরে কিছু দিতে হবে না। বাসায় যেও আহনাফকে নিয়ে।আর কে যেন এসেছে তাকেও নিয়ে যেও। আদনান ভাই কোথায়?
—অফিসে।
—আহনাফ স্কুলে যায়নি? অনেকদিন গ্যাপ হয়ে গেলো।
—কয়েকদিনের মধ্যেই যাবে।
—তুমি হলে যাবে কবে?নাকি এখানেই থাকার ইচ্ছা?
এই কথাটা নিপা কেমন করে যেন খোঁচা দিয়ে বলল, হিয়ার কাছে সেটা মোটেও ভাল লাগলো না।
হিয়া কিছু বলার আগেই শাপলা চলে এলো।সে বলল-
—ভাবি হলে গিয়া থাকলে আহনাফ বাবারে কে দেখবে?আর নিজের সংসারটাই কে সামাল দিবে?
—ভাবি মানে?হিয়া তোমাকে ও ভাবি বলছে কেন?
—কি আশ্চর্য , ভাবিরে ভাবি বলবো না? আমাদের আদনান ভাইয়ের সাথে হিয়া ভাবির বিয়া হইছে।
হিয়া কিছুই খেয়াল করছিল না,সে তার মনের কষ্ট সাগরে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু শাপলা চালাক মেয়ে ,সে সবকিছু খেয়াল করলো।কথাটা শুনে মুহুর্তেই নিপার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কঠিন বজ্রপাতে তার শরীর যেন রক্ত শূন্য হয়ে গেল।এক সময় বোধহীন শরীরটাকে টেনে নিজেই দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল।
চলবে…
ফাহমিদা লাইজু