||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ২০||

||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ২০||

“শেষমেশ মায়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে করলেন দিয়ান রহমান দিব্য।”

ফেইসবুকে ঢুকে একটা ধাক্কা খায় দিব্য। তার আর প্রহেলিকে নিয়ে নানা রকম নেতিবাচক কথা ছড়িয়ে আছে। মিডিয়ার নিউজের মন্তব্যের বক্স ভরে আছে খারাপ মন্তব্যে। মাথাটা ধরে যায়। রাগে গা কাঁপছে তার। মানুষ এত কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কীভাবে করে! নিজেকে সামলে ফেইসবুক থেকে বেরিয়ে আসে। এই মিডিয়ার একটা কর্মকর্তাকেও সে ছাড়বে না।

নাহিয়ান সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি। প্রহেলিকে সে কিছুতেই সুখে থাকতে দেবে না। তার ভালোবাসাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিব্যকে বেছে নিয়েছে! এটার শাস্তি প্রহেলি একা নয় দিব্যকেও পেতে হবে। এমন শাস্তি দেবে যে দিব্যের শোকে আজীবন কান্না করবে সে। জেদ মানুষকে ভুল, শুদ্ধের মধ্যকার পার্থক্য ভুলিয়ে দেয়। নাহিয়ানও এখন তাই করছে।

প্রহেলিকে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠায়, “দিব্যকে কীভাবে বাঁচাও দেখে নেব আমি। আজ থেকে ধ্বংসের খেলায় নেমে গেলাম। যার দ্বারপ্রান্তে দিব্য দাঁড়িয়ে।”

মেসেজ পাওয়া মাত্র প্রহেলি তাকে ব্লক করে দেয়। দিব্যের কিছু হবে না তো! চিন্তা আর ভয় দুটোই বেড়ে যায়। দিব্যকে কিছুই বলে না সে। বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। এসব সাতপাঁচ ভাবনা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।

সকালের নাস্তা তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়৷ সবাই তার রান্নার তারিফ করে। এমনকি দিব্যের মা ফাহিমা বেগমও। ছেলের বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে খুশি খুশি হয়ে গেছেন তিনি। কথায় আছে মানুষের মনের রাস্তা পেটের মধ্য দিয়ে যায় এই কথাটা আজ সত্যিকার অর্থে বাস্তবে প্রকাশ পেল। উপহারস্বরুপ তাকে স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দেন।

সোহেল রহমান বললেন, “আমি আগামীকাল সারপ্রাইজ দেব তোমাদের দু’জনকে। আজকের দিন অপেক্ষা করো। কিন্তু দিব্য তুই বউমার জন্য কিছু আনিসনি?”

দিব্য খাওয়া বন্ধ করে বলল, “না তো কী দেব আবার!”

বলেই আবার খেতে শুরু করে। বিয়ের রাতেই সে প্রহেলিকে একটা উপহার দিতে চেয়েছিল কিন্তু সুযোগের অভাবে সেটা দিতে পারেনি। আজ সেটা তাকে দেবে। নিজের আনা উপহার পকেটেই রেখে দেয়। সবার সামনে দিতে চায় না।

প্রহেলি জন্য গলার চেইন এনেছে। রুমে এসে বের করে কয়েকবার চোখ বুলায়। দেখেই চোখের সাথে মনের মধ্যেও একটা শান্তি পাচ্ছে। লকেটে ProDib লেখা। দু’জনের নামের অক্ষর যুক্ত করে বানিয়েছে। দু’জনকে যেন খোদা দু’জনের জন্যেই বানিয়েছেন।

রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে সে রুমে আসতেই দিব্য তাকে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়।

“কী হলো? এভাবে কেউ টেনে আনে?”

“আমি আনি। এই যে আনলাম। এবার চুপ করে দাঁড়াও।”

প্রহেলি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় তার পেছিনে দিব্যকে দেখতে পাচ্ছে। সে হাতের চেইনটা তার গলায় পরিয়ে দেওয়ার জন্য খোলা চুল একপাশে নিয়ে রাখে। তারপর চেইন পরিয়ে দেয়। প্রহেলির মুখে আনন্দ ফুটে উঠে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা দেখা যায়। দিব্য আচমকা তার পিঠে আলতো করে ঠোঁটের উষ্ণতা মেখে দেয়। কেঁপে উঠে উলটো দিকে ফিরে আয়নার সাথে মিশে যায় প্রহেলি।

“ক…কী করছিস!”, দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে সে।

দিব্য কাছে এসে বলল, “কেন করতে পারি না? আমার বুঝি অধিকার নেই? আমি তো বারবার ছুঁয়ে দিতে চাই। সময়ে, অসময়ে ছুঁয়ে দিতে চাই।”

“ক’টাদিনই তো চাইলাম। ভালো না বেসে কী শরীর ছুঁয়ে দেওয়াটাই জরুরি হয়ে…”, বলতে বলতেই থেমে যায় প্রহেলি।

দিব্য মন খারাপ করে না। আসলেই তো তার ভালোবাসাটা আগে জরুরি। যে মনে ভালোবাসা থাকবে সেই মন কেন সেই মনের মানুষটাও সম্পূর্ণ তার হয়ে থাকবে। ভালোবাসায় তো শরীর জরুরি নয় মনটাই আগে জরুরি।

রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলের কোণে বসে আছে প্রহেলি। দিব্য তাকে নিয়ে এসেছে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। সে আসতে চাচ্ছিল না কিন্তু তার কথাও ফেলতে পারলো না। দিব্য তার বন্ধুদের সাথে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ প্রহেলির কানে একটা কথা ভেসে আসে।

“কিরে অবশেষে তুই কি না এই মেয়েকে বিয়ে করলি! তাকে তো তোর বড় বোন মনে হচ্ছে!”

“আরে না, বড় বোন নয়, বল মা ছেলে দেখা যাচ্ছে তাদের।”

একসাথে হাসিতে ফেটে পড়ে দিব্যের বন্ধুরা। প্রহেলি চুপচাপ টেবিলের কোণে বসে সব কথা শুনেও না শোনার ভান করে আছে কিনু দিব্য না শুনে থাকতে পারে না। যে বন্ধু এইসব কথা বলছিল তাদের কলার চেপে ধরে। কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। প্রহেলি দৌড়ে এসে আটকায় তাকে। তার হাতের বাঁধনে শক্ত করে আটকে ধরে।

দিব্য চেঁচিয়ে বলে উঠে, “একদম মুখ সামলে কথা বলবি। লজ্জা করে না তোদের বডি শেইমিং করতে? তোরা না আবার একেক জন ভালো ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছিস! এই তোদের জ্ঞান? তোদের জ্ঞানের পরিধি এত কম হলে মানুষকে কী শিখাবি তোরা?”

সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দিব্য প্রহেলিকে নিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। তেমন কাউকে বিয়েতে দাওয়াত করতে পারেনি। ইচ্ছে ছিল গেট টুগেদার করে সবাইকে তার জীবনসঙ্গিনীকে দেখাতে। যাকে পাওয়ার জন্য সে পাগল প্রেমিক ছিল। আর এখন পাগল স্বামী হয়ে রইবে। কারো কথার ধার ধারে না সে। তাকে নিয়ে কে কী ভাবলো বা কে কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্রহেলিকে নিয়ে কেউ একটা বাজে শব্দ বলতে পারবে না। প্রয়োজনে তাকে খুন করে জেলে যাবে সে। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তার।

প্রহেলির হাত ছুটিয়ে তাদের কাছে তেড়ে গিয়ে বলল, “আমার বউ যেমনই হোক সে আমার কাছে রানীর মতো হয়ে থাকবে। আমি তাকে যে-কোনো রূপে ভালবাসবো। তার জন্য আমি নিজেকে উজাড় করে দিব। কেউ তাকে নিয়ে একটা কথা বললে জিভ ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিব। কথাটা মাথায় রাখিস। তোদের বন্ধু ভেবেছিলাম আজ প্রমাণ করে দিলি তোরা এসবের যোগ্য না।”

হনহনিয়ে প্রহেলির হাত টেনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে সে। প্রহেলির চোখের মণিজোড়া স্থির নিষ্পলক। দিব্যকে এ কোন নতুন রূপে দেখল সে! তাকে কখনো এর রাগতে দেখেনি সে। কান লাল লাল হয়ে আছে। রাগের মধ্যে অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে। কানের পাশ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। গায়ের শার্ট অনেকটাই ভিজে এসেছে। রাস্তার পাশে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ঘুষি মারতে নিলেই প্রহেলি নিজের হাত মধ্যিখানে ঢুকিয়ে দেয়৷ আচমকা এমন কিছু ঘটে যাবে বুঝতেই পারেনি। ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নেয় সে। দিব্য তার হাতটা ধরে পাগলের মতো ঘষতে লাগে।

অস্থির হয়ে বলল, “তুমি এত পাগল কেন! কেন এভাবে হাত ঢুকালে! এখন কত ব্যথা পেলে দেখ! একবার নিজের কথা ভাববে না? এতবড় সাহস কীভাবে হয় নিজেকে কষ্ট দেওয়ার? জানো না, এখন তোমার সাথে আমার সবকিছু জড়িত। তোমার কষ্ট মানেই আমার কষ্ট।”

“তুই কেন ভেতরে আমার জন্য মারপিট করতে গেলি? যা সত্যি তারা তো তাই বলছিল। মিথ্যে কিছুই তো বলেনি। আমি মোটা, বয়সে এমনিতেও তোর থেকে দু’বছরের বড়। মোটা হওয়ায় এখন দশ বছরের বড় দেখা যায়। শরীরের আকার আকৃতি সব নষ্ট হয়ে গেছে। চেহারাতেও সেই লাবণ্যটা আগের মতো নেই। তাহলে কেন এভাবে রিয়েক্ট করলি? আমার জন্য বন্ধুত্বটা নষ্ট হলো না তোদের?” ব্যথা সহ্য করে প্রহেলি বলল।

দিব্যের এসব কথায় কোনো মনোযোগ নেই। প্রহেলিফ হাতে বারবার ফুঁ দিচ্ছে। প্রহেলি তার কাঁধে হাত রেখে আলতো করে গালের নিচে গভীর চুমু খেল। সাথে সাথে সে শান্ত হয়ে আসে। প্রহেলির হাতটা এখনো তার হাতেই রয়েছে। কখনো ভাবেওনি এভাবে মেঘ না চাইতেই সে বৃষ্টি পেয়ে যাবে। দিব্য তার হাতে ব্যথার স্থানে আলতোভাবে ঠোঁটের স্পর্শ করায়। ব্যথায় চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নেয়। তবে তার মুখে লজ্জা ভর করে। মুখ খানিকটা আরক্ত হয়।

“দিনের শুরুটা অসাধারণ ছিল, মধ্যভাগ খারাপ কিন্তু এখন অনেক অনেক বেশি সুখময় শেষটা ইনশাআল্লাহ খুব সুন্দর হবে।”, বলেই দিব্য প্রহেলির কপাল থেকে হাত ছুঁইয়ে থুতনিতে রাখে।

কিছুক্ষণ পর আবারো জিজ্ঞেস করলো, “হাতে ব্যথা পাচ্ছ অনেক না?”

প্রহেলি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে না করে। দিব্যকে সে আর চিন্তিত করতে চাইছে না। কিন্তু ব্যথায় তার হাত টনটন করছে। বিষয়টা দিব্য তার মুখের দিকে তাকিয়েই আঁচ করে। মুখের কথার উপর বিশ্বাস না করে, চোখের ভাষায় উত্তর খুঁজে নেয়। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে কিন্তু বোতলে পানি নেই। দৌড়ে রাস্তার ওপর পাশের দোকানে পানি কিনতে যায়। প্রহেলি তার পিছু পিছু ছুটে।

“দিব্য থাম, আমার কিছুই হয়নি। কেন পাগলামি করছিস।”

আচমকা একটা গাড়ি বেগতিক দিব্যের দিকে তেড়ে আসে। প্রহেলির চোখ যেতেই দৌড়ে যায় দিব্যের কাছে। দিব্যের কিছুই হতে দেবে না সে। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে তাকে দূরে ফেলে দেয়। গাড়িটা প্রহেলিকে টক্কর মেরে হনহনিয়ে চলে যায়। সে ছিঁটকে পড়ে রাস্তার মধ্যে। মাথা খানিকটা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। একটা হাত আর পা অবশ লাগছে তার। চোখে ঝাপসা দেখছে। মনে হচ্ছে এই যাত্রায় বাঁচবে না সে। এই ফাঁকা রাস্তায় তেমন বেশি মানুষজন নেই। দোকানী দৌড়ে এসে দিব্যকে তুলে। গাড়ির নম্বর প্লেট দেখার আগেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

দিব্য প্রহেলির মাথা কোলে তুলে নেয়। চিৎকার করে কান্না করছে।

“এটা কী হয়ে গেল রে! খোদা…! এই প্রহু, এই, এই চোখ খোলা রাখ। একদম বন্ধ করবে না। তোমার কিচ্ছু হবে না। এই আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে কিচ্ছু হতে দিব না।”

দোকানী পুলিশকে কল করে। দিব্য তাকে কোলে করে গাড়িতে তুলে নেয়। দোকানের লোকটা গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। সাথে সাথে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। দিব্য পরিচিত মুখ থাকায় ভর্তি করে দেয় রোগীকে। তাছাড়া দোকানী তাদেরকে জানায় সে পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছে। দিব্য ফ্লোরে বসে চোখের জল মুছছে। রক্তে তার শার্ট লাল হয়ে আছে। কেন যে আজ তাকে নিয়ে বেরিয়েছিল! কেন যে এত রাগ দেখিয়েছিল। সবকিছু তার জন্য হয়েছে।

প্রহেলি আর দিব্যের পরিবারের সবাই কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে যান। প্রহেলির মা-বাবার কান্না যেন ধরছে না। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দুইদিন হলো না একটা অঘটন ঘটে গেল। অপারেশন তখনও চলছে। দোকানের লোকটা দিব্যের কাছে গিয়ে বলল, “ভাইয়া, এই এক্সিডেন্টটা কেউ ইচ্ছাকৃত করেছে। আপনি একটু খোঁজ নিয়ে দেইখেন। আজ পর্যন্ত আমার দোকানের সামনে কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি। শহরের বাইরে ছোট এই রাস্তায় এক্সিডেন্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আমার।”

দোকানীর কথাগুলো দিব্যকে ভাবনায় ফেলে দেয়। আসলেই এটা কোনো চিন্তাভাবনা করে করানো এক্সিডেন্ট নয় তো! উত্তর দিব্যের জানা না থাকলেও প্রহেলির ঠিকই জানা আছে।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here