||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ১৮||
“এত ভালোবেসেও আমার আর তোমাকে পাওয়া হলো না চন্দ্রমল্লিকা…”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষীণ গলায় বলল দিব্য। যাতে কেউ শুনতে না পায়।
প্রহেলিকে সম্পূর্ণ ঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। পূজা রুমটা তন্নতন্ন করে খুঁজলো কিন্তু পেলো না। প্রহেলির মা, বাবা আর ভাই অপরাধীর মতো বসে আছে। কোনো জবাব নেই তাদের কাছে। দিব্যের মা চেঁচিয়ে বললেন, “আমি কত করে না করেছিলাম করিস না বিয়ে এই মেয়েকে। তখন আমার কথা শুনলি না। এখন দেখ সবার মুখে চুনকালি দিয়ে মেয়েটা পালিয়ে গেল তো! ওই ছেলেটা সত্যিই বলছিল। তুই তোর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলি।”
দিব্য কারো কথাই কানে নিচ্ছে না। সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার ভালোবাসা যে হেরে যাচ্ছে। নিচের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ ঘরে নীরবতা ছেয়ে যায়। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। দিব্যের নীরবতাকে সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে স্কুল জীবনের সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে করছে। সেই ছোট্ট প্রহেলির কথা ভাবছে। দুষ্টুমি করে বেড়ানো মেয়েটা কেমন নীরব হয়ে গেছে। আগের সেই চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটাকে সে ভীষণ করে ভালোবাসে। চোখ খুলে পায়েলের শব্দে। দিব্যের ঠোঁটের কোণে হাসি। চোখ খুলে দরজার দিকে তাকাতেই প্রহেলিকে দেখলো দু’হাতে বিয়ের লেহেঙ্গা পা থেকে কিছুটা উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা পেরিয়ে লেহেঙ্গা ছেড়ে দেয়। ওমনি মেঝে ছুঁয়ে যায় সেটা। কী সুন্দর সাজিয়েছে নিজেকে! নাকের বড় নথটা আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এত সুন্দর মেয়েকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
পূজা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলি তুই? সবাই তোকে খুঁজে খুঁজে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।”
প্রহেলি দিব্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে গিয়েছিলাম। নতুন জীবনের শুরু কোনো পিছুটান রেখে করতে চাই না আমি।”
পূজা আর কোনো প্রশ্ন করে না। দিব্যের মা কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে সে বলে, “তাকে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। যা জানার আমি জেনে নেব। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”
কবুল বলে বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নেয় তারা। প্রহেলি জানে না তার জন্য সামনে কী আছে কিন্তু সে নাহিয়ানকে পেছনে ফেলে এসেছে৷ আর তাকে সামনে টেনে নিয়ে যেতে চায় না। যে মানুষ একবার ঠকাতে পারে সে আরেকবার ঠকাবে না তার কোনো ঠিক নেই। নাহিয়ান তো তাকে ভালোইবাসেনি। এখন আবার ভালোবাসার দাবী করছে। প্রহেলি তার সামনে তার দেওয়া সব চিঠি পুড়িয়ে এসেছে। বলে এসেছে আর কোনোদিন যাতে তার সামনে না আসে। নাহিয়ান তাকে সহজে ছেড়ে যাবে কী না সেটা জানে না কিন্তু সে তাকে ছেড়ে এসেছে।
সারাটা দিন নাহিয়ান ঘর থেকে বেরোয় না। ঘরের ভেতর জিনিসপত্র ভাংচুর করে। প্রহেলির উপর যতটা রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে নিজের উপর। প্রহেলিকে হারানোর পর বুঝতে পেরেছে সে তাকে কতটা ভালোবেসেছিল। কিন্তু তার ভালোবাসাটা বোঝাতে পারেনি। মানুষ বারবার বিশ্বাস করে না। একবার ঠকে গেলে সেখান থেকে বিশ্বাস সহজেই উঠে যায়। নাহিয়ানও নিজের বিশ্বাস হারিয়েছে। হাজার চাইলেও সে আর প্রহেলিকে পাবে না।
দিব্যের বাড়িতে ঢুকে চমকে উঠে প্রহেলি। কোনো বাগানবাড়িতে এসে গেছে মনে হচ্ছে। রাজপ্রাসাদের থেকে কম সুন্দর নয় এই বাড়ি। সরু পাকা ছোট্ট একটা রাস্তা। তার দু’পাশে সবুজ ঘাস। রাস্তাটা ঘরের প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তার এক প্রান্তে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান আর কিছু চেয়ার টেবিল সাজানো। অন্য প্রান্তে গাড়ি দাঁড় করানো। গাড়ি গিয়ে একদম ঘরের প্রবেশদ্বারের কাছে থামে। প্রহেলির লেহেঙ্গা দু’দিকে তুলে ধরে সামনে পা বাড়াতেই দিব্য তাকে কোলে তুলে নেয়। হঠাৎ পরিস্থিতি বুঝে উঠতে না পেরে ভয় পেয়ে যায় সে। দিব্যের কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে শেরওয়ানি ধরে।
খালি গলায় ঢোক গিলে বলল, “এসব কী হচ্ছে! সবাই দেখছে। খারাপ লাগছে বিষয়টা।”
দিব্য ক্ষীণ হেসে চোখ মেরে বলল, “বলেছিলাম না, কোলে করে নিয়ে যাব? সেটাই তো করছি। তাছাড়া তোমাকে কোলে নিয়ে মনে হচ্ছে এবার চলতে আনন্দ পাবো। এতদিন জীবনটা বেশ হালকা ছিল এখন ভরে উঠেছে।”
ঘরের ভেতর মেহমান গিজগিজ করছে। সবার মাঝখানে এভাবেই তাকে নিয়ে নিজের রুমের ভেতর যায়। একসাথে সকলে করতালি দিয়ে উঠে। লজ্জায় তাকাতে পারছে না প্রহেলি। দিব্য মাঝপথে আর কোথাও থামে না। একদম নিজের রুমে গিয়ে থামে। চারদিকে বকুল ফুলে সাজানো বিছানায় তাকে বসিয়ে দেয়। চারপাশে কেবল মোমবাতি জ্বলছে। আর কোনো আলো নেই। নড়েচড়ে বসে প্রহেলি। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে তার। দিব্য মেঝেতে তার পায়ের কাছে বসে বলল, “অবশেষে তুমি আমার!”
তার চোখে জল। প্রহেলি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে৷ এই মানুষটার ভালোবাসার মূল্য সে কী কোনোদিন দিতে পারবে।
দিব্য তার পায়ের উপর দু’হাত রেখে কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে একটু চিমটি কাটো না। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রহেলি। এমন আবদার সে কোনোদিন শুনেনি।
“প্লিজ প্লিজ কাটো না চিমটি।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাও, “সত্যি চিমটি কাটবো?”
দিব্য উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, “হ্যাঁ প্লিজ। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যে চাঁদকে এতদিন দূর থেকেই দেখে এসেছি সে চাঁদ আজ আমার ঘর আলোকিত করতে নিচে নেমে এসেছে।”
প্রহেলি ভয়ে ভয়ে দিব্যের গালে চিমটি কাটে। “আউ!”, বলে মৃদুস্বরে শব্দ করে উঠে দিব্য। অবশেষে তার বিশ্বাস হয়েছে। আসলেই তার চন্দ্রমল্লিকা তার কাছেই আছে।
দোলা এসে সোজা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। প্রহেলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। লজ্জার উপর লজ্জা পাচ্ছে সে।
দোলা দিব্যকে মেঝে থেকে টেনে তুলে বলল, “এসব প্রেম, সোহাগ পরে হবে আগে চলো এখনো সবার সাথে পরিচয় এবং ছবি তোলা বাকি। সাংবাদিকেরাও এসে ভিড় করেছে। বাগানে বসিয়েছি তাদের।”
“তুই তো বেশি পেকে গিয়েছিস!”, বলেই কান মলে দিল দোলার।
“আহ! ভাইয়া ব্যথা পাচ্ছি। আর পাকার সময়ই এখন, তো পাকবো না?”
তাদের কথা শেষ না হতেই ঘরের ভেতর হুড়মুড়িয়ে কিছু ছেলে-মেয়ে ঢুকে পড়ে। ভাবি ভাবি ডেকে কয়েকজন সেল্ফি তুলে নেয়। দোলা তাদেরকে থামিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কনফারেন্সে নিয়ে যায়৷ দিব্য প্রহেলির একটা হাত নিজের হাতে নেয়। অন্য হাতে তার লেহেঙ্গা ধরে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ ফটোসেশান শেষে তাকে চেয়ার টেনে বসায়। সাংবাদিকরা একের পর এক ছবি ক্লিক করে যাচ্ছে। সেই সাথে দিব্যকে করছে অজস্র প্রশ্ন। প্রহেলি নীরবে বসে আছে৷ এসব কিছু তার জন্য নতুন। মনে হচ্ছে যেন কোনো চিড়িয়াখানায় বসে আছে সে। আর তাকে দেখতে পর্যটক ভিড় জমিয়েছে। তার মাথায় এসব কিছুই ঢুকছে না। মাঝেমধ্যে দু’একটা কথা তাকেও বলতে হয়। যদিও বেশ অগোছালোভাবে কথা বলেছে সে তবু দিব্য সবকিছু সামলে নিয়েছে।
সবার সাথে পরিচয় শেষে একগাদা উপহার নিয়ে রুমে ফিরে আসে প্রহেলি। রাতে কনের জন্য খাবার নিয়ে মেয়ে বাড়ি থেকে কেউ আসতে হয়। প্রান্ত টিফিন নিয়ে এসেছে। এমনকি সকালের নাস্তার জন্য বিভিন্ন জিনিস এনে দিয়ে চলে গেছে সে। ক্ষুধায় পেট গুড়গুড় শব্দ করছে প্রহেলির। সারাদিনে কিছুই খায়নি। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না সে। তখনই দিব্য রুমের ভেতর এসে ঢুকে। প্রহেলি এখনো লেহেঙ্গা পরে বিছানার কোনায় বসে আছে। দিব্যকে দেখতেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠে। এই ছেলেকে সে বিয়ে তো করে নিলো এখন বাসর সে কীভাবে করবে! এই কথা তো আগে ভাবেনি সে। ভয়ে গলার পানি শুকিয়ে এসেছে তার।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা
[বিঃদ্রঃ দুঃখিত এত দেরিতে গল্প দেওয়ার জন্য। সারাদিন ব্যস্ততায় লিখতে পারিনি তাও এখন লিখে ছোট্ট একটা পর্ব নিয়ে এলাম। আচ্ছা, দিব্যের মায়ের কী কোনো নাম দিয়েছিলাম? আমি ভুলে গেছি। কাহিনীর সারসংক্ষেপে নাম লিখতেও মনে ছিল না। এখন বেশ সমস্যায় পড়ে গেছি। আবার আগের পর্বগুলো পড়ে নাম খুঁজে বের করা কষ্ট অনেক। কারো জানা থাকলে একটু জানাবেন আমাকে। ধন্যবাদ সবাইকে।]