কোনো_এক_শ্রাবণে
পর্ব-০৯
শাহাজাদী মাহাপারা (জোহুরা খাতুন)
সকাল থেকেই বাসায় ধুম পরেছে রান্নার।সালেহা আসবে ওর বর আর বোনের মেয়েকে নিয়ে। স্মরণেরদেরও আসার কথা।যদিও রুবাবা এই কথাটা সবার থেকে চেপে গিয়েছেন। মূলত নিপা আর দোলার বিয়ে উপলক্ষেই আসবে সবাই।প্রথমে একই দিনে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।কিন্তু বাগড়া দিলো আবরারের ফরেন ট্রিপ। তাই বিয়েটা পেছাতে হলো। তবে বেশিদিন না দোলার বিয়ের ১৫ দিন পরেই নিপার বিয়ে। মাহাপারাতো বিয়ের কথা শুনতেই পারে না।সে সময় নিয়েছে।কত সময় তার লাগবে আল্লাহ মালুম। স্মরণরা এলে ও কেমন করে রিয়েক্ট করবে তা নিয়েও রুবাবা টেনশনে আছে। আবার দোলা বাসায় এনে জুটাচ্ছে আরেক ঝামেলা। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস অতি সন্তপর্ণে গোপন করলেন রুবাবা।
নিপা তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো দোলার রুমের পাশের ছোট রুমটা খোলা।এ বাড়িতে উপর নিচে মিলিয়ে মোট আটটা ঘর। দোলা আর মাহাপারা এক কামরাতেই থাকে। মাহাপারা রাতে একা ঘুমাতে ভয় পায়। আর নিপা আলাদা রুমে থাকে।নাফি স্টাডির সাথেই নিজের জন্য বিশাল রুম করেছে। রুবাবা আর শফিক নিচতলায় এক রুমে থাকে। আর বাকি ঘর গুলো খালিই পরে থাকে। নসীমা যদিও রাতে রান্না ঘরের পাশের রুমে থাকে। আর ড্রাইভার কামাল বাহিরের সার্ভেন্ট কোয়াটারে থাকে।শফিক সাহেবের বাবা বহু যত্নে এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন ভাইদের সাথে নিয়ে থাকতে যদিও সময়ের সাথে সব বদলেছে।এখন সবাই আলাদা।সব রুম গুলোই প্রসস্থ। নিপা সামনে হেঁটে দোলার রুমের দিকে এগুলো।
নসীমা আপা এই রুমটা কার জন্য পরিষ্কার করছেন? কেউ কি আসবে?
-হ। খালাম্মায় কইছে আজকে বড়াপার বান্ধবী থাকতে আসবে এই বাসায়।তাই তার জন্য সব ঠিক করতেছি।
– আচ্ছা।কিছু লাগলে আমাকে বলো।
– না মেজাপা কিছু লাগবেনা সব কাম হইয়া গেছে।
– ঠিকাছে আমি তাহলে একটু বের হচ্ছি। আম্মা কি তার রুমে?
– খালাম্মা রান্না ঘরে।
– আচ্ছা।
নিপা নিচে নেমেই রান্নাঘরে গেলো। রুবাবা রান্না করছে। নিপা রুবাবার থেকে অনুমতি নিয়ে বেড়িয়ে পরলো বাসা থেকে।হাটতে হাটতে মেইন গেইটের সামনে এসে রিক্সা নিলো।উদ্দেশ্য ধানমন্ডি লেক।
——————————————————————-
হাসপাতালের ডিসচার্জের কাজ সেরে নিয়েছে নাফি। দোলা সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। জাদিদ আর দোলা এক গাড়িতে মাহাপারা আর বেয়াজিদ নাফির গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছে সুপার শপের জন্য। ড্রাইভার গত রাতেই চলে গিয়েছিলো। তাই আর তাকে ডাকেনি। আর নাফি কামালকে নিয়ে ঋতু আর ঋজু সমেত বাড়ি ফিরবে।যদিও নাফি এখনো ঋতুকে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।
নাফি কেবিনে গিয়ে ঋতুকে উদ্দেশ্য করে বললো
-আপনি রেডি?
-জ্বি।
ঋতু মোটা তোয়ালেতে পেঁচিয়ে নিয়েছে ঋজুকে।
গাড়িতে উঠতেই কামাল ইস্কাটনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।ঋতু জিজ্ঞেস করলো –
– আমরা এদিকে যাচ্ছি কেনো? আমার বাসাতো মালিবাগের দিকে।
বেশি না ১০মিনিট এর মধ্যেই পৌঁছে গেলো ওরা বাসায়।
ঋতু গাড়ি থেকে নামতেই অবাক চোখে চেয়ে রইলো সামনের সাদা রঙের বাড়ি।না জাহাজ বাড়িটার দিকে। নাফি ঋতুকে নিয়ে ভিতরের দিকে অগ্রসর হলো। বিস্ময়ে ঋতু স্তব্ধ হয়ে আছে।সে এখানে কেনো সে প্রশ্ন করতেও ভুলে গিয়েছে।
——————————————————————-
নসীমা দরজা খুলে দিতেই দেখলো নাফি দাঁড়িয়ে তার পেছনে একটা মেয়ে হাতে বাচ্চা। একটা মলিন সুতি শাড়ি পরা। চুলগুলো খোপা করা। চোখের নিচে কালি পরে দেবে গিয়েছে। গায়ের রং ফর্সাও না শ্যামলাও না। সুন্দরী।
নাফিকে বাচ্চা সহ মেয়ের সাথে দেখেই নসীমার গগন বিদারী চিৎকার খালাম্মাআআআআ…… চিৎকার শুনেই রুবাবা বেড়িয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। বাহিরে থাকা কামালও দৌড়ে এলো।
খালাম্মাগো দেহেন দেহেন ভাইজান কারে জানি বিয়া কইরা নিয়াইছে দেহেন মহিলার হাতে বাচ্চা। হায় হায়রে। ভাইজান আপনে এডা কি করলেন? হায় আল্লাহগো….
নসীমাকে ধমকে উঠলেন রুবাবা। নাফির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন এই বাচ্চা কার? নাফি নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো –
আমার মা।
রুবাবা স্থির থাকতে চেষ্টা করলেন। আমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাই আম্মা। এই বাচ্চাটাও আমারই হবে। ওর নাম ঋতু। এখন থেকে এখানেই থাকবে।নাফির এমন নির্বিকার ভাবে বলা কথা শুনে ঋতুও যারপরনাই অবাক হলো। নাফিকে কিছু বলতে যাবার আগেই পেছন থেকে দোলা জাদিদ আর তার মেয়ে হুমায়রর সহ বাসায় ঢুকলো।
– মা এ ঋতু আমার বান্ধবী।যার কথা রাতে বলেছিলাম তোমায়। ওর বরটা ভালো না মা। বাকি কথা তোমাকে পরে বলবো। এখন খেতে দাও ক্ষুধা পেয়েছে সবার।
– নানু আমি নাস্তা করে আসিনি।তুমি কি আমাকে খায়িয়ে দিবে প্লিজ? দাদুকে আসতে বলেছিলাম কিন্তু তিনি এলেন না।চলো যাই।
– রুবাবা আটকে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে জাদিদের মেয়ের হাত ধরে ভিতরে গেলেন।নসীমাকে বললেন খাবার সাজাতে। শাড়ির আঁচলে নাক মুছে নসীমা রান্না ঘরে গেলো।
– ভাই তুই কি করতে যাচ্ছিলি? মাথাটা গেছে? উফফ
– আপনারা আমাকে একটু খুলে বলবেন প্লিজ কি হচ্ছে এখানে? আমি এখানে কেনো? আর নাফি সাহেব এটা আপনার বাসা? আমি আম্মার কাছে যাবো উনি হয়তো চিন্তা করছেন আমাকে ওখানেই দিয়ে আসুন প্লিজ।
নাফি একপলক দোলার দিকে তাকালো।তারপর ঋতুর দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস নিলো –
ঋতু আপনার হাজব্যান্ড গতকাল রাতে ফোন ধরেছিলেন এবং আপনি সেখানে গেলে আপনাকে আপনার সন্তান সহ জ্যান্ত কবর দিবেন জানিয়েছেন।আপনার শাশুড়ীও বলেছেন আপনাকে ওনার থেকে দূরে রাখতে।তাই আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি এবং আম্মাকে বলা আমার এখনের কথা গুলোও শতভাগ সত্য। আমি আপনাকে ভালোবাসি। বলেই নাফি ধপ করে সোফায় বসে পরলো। এক নিশ্বাসে সব বলে সে ক্লান্ত। দোলা আর জাদিদ পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।
– ব্যাটা জীবনে প্রথম বার কোনো মেয়ের কাছে কনফেস করলি।(জাদিদ)
নাফির কথা শুনে ঋতু বললো আমাকে কোথায় থাকতে হবে? নাফি মেরুদন্ড সোজা করে বসলো। ঋতুর ঠান্ডা চাহনি দেখেই বুঝে নিলো তার মনে কি চলছে। দোলাকে ইশারা করতেই দোলা তাকে দোতালার রুমটাতে নিয়ে গেলো।
——————————————————————-
নিজের আলমারি থেকে শাড়ি আর পেটিকোট নিয়ে পাশের রুমে যাওয়ার সময় দেখলো রুবাবা দাঁড়িয়ে।
– কিছু বলবে মা?
-এই কাপড়গুলো নে। পুরোনো যদিও তবুও তোর বান্ধবী পরে আরাম পাবে। আর নাফির কতগুলো কাপড় বের করেছি ছোট বেলার ওগুলোও নসীমাকে আনতে বলেছি।চল আমিও যাচ্ছি তোর সাথে।
দোলা তার মায়ের দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সে দৃষ্টিতে আছে শ্রদ্ধা, মায়া আর অফুরন্ত ভালোবাসা। তার গর্ভুধারীনি।সবার সব কিছুর খেয়াল রাখেন।
রুবাবা আর দোলা ঋতুর ঘরে ঢুকে দেখলো ঋতু বিছানার উপর বহু কষ্টে বসেছে। রুবাবা ঋতুর কাছে গিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিলেন। আদর করলেন। দোলা বললো ওর নাম নির্ভান মাহমুদ ঋজু। রুবাবা নাম শুনে হাসলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন নাফির নাম নির্ভান রাখবেন যদিও নাফির স্বর্গীয় দাদী তার নাতির নাম মাহমুদুর আহমেদ নাফি রেখেছেন। দোলাকে গিজার অন করতে বললেন বাথরুমের। নসীমাকে হট ওয়াটার ব্যাগ আনতে বললেন। দোলাকে বললেন ঋতুকে বাথরুমে নিয়ে যেতে গোসলের জন্য। বেচারী ক্লান্ত খুব। রুবাবার দেয়া কাপড় মুলত ঢোলা কামিজ আর পায়জামা। তিনি ঋজুকে কোলে নিয়ে বসে রইলেন। জাদিদের মেয়ে হুমায়রা চলে এসেছে।
-ছোট বাবুটা কে?
– এইটা একটা ছোট ভাইয়া। ওর নাম ঋজু।
– হাই ঋজু আমি হুমায়রা। তুমি কেমন আছো?
রুবাবা হেসে উঠলেন।ঋজু মহাসয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাড়ি দেখিয়ে হাসছেন। জেনো তিনিও এই ছোট্ট কথোপকথন শুনেছেন।
– ও কথা বলা শিখেনি
শিখলে তোমার সাথেও কথা বলবে।
– আচ্ছা।
হুমায়রা ঋজুর দিকে তাকিয়ে রইলো। ঋতু বের হতেই রুবাবা দোলাকে বললো ওর জন্য খাবার নিয়ে আসতে।
-ঋজুকে হবার পর গোসল করানো হয়েছিলো।
-জ্বি নার্স বলেছেন গোসল করিয়েছে।
– রুবাবা মাথা নাড়লেন। হালকা গরম পানিতে পাতলা কাপড় ভিজিয়ে ঋজুর শরীর মুছিয়ে দিলেন। নাফির ছোটবেলার নরম তোয়ালে দিয়ে ঋজুর শরীর পেচিয়ে দিলেন পাও কপালে কাজলের ফোটা দিয়ে দিলেন।
মাহাপারা আর বেয়াজিদ বাসায় এলো বড় একটা দোলনা নিয়ে। ঋতুর রুমে সেই দোলনা রাখা হলো। ঋতুর যাবতীয় ওষুধ পত্রও কিনে এনেছে তারা আসার সময়। সবাই বাচ্চাকে নিয়ে মেতে আছে। ঋতু মনে মনে ভাবছে শুধু মাত্র বাবা মায়ের একটা ভুলের মাশুল হিসেবে তার জীবনটা এই পর্যায়ে। এই পরিবারটা কত হাসিখুশি। কে বলবে তারা আজ প্রথম এসেছে এখানে।তার ছোট্ট রুমটায় সবাই বসা বাসার। জাদিদ, নাফি নাস্তা করে খেয়ে ঋজুকে দেখতে চলে এসেছে। রুবাবার কোলে ঋজুকে দেখে বেশ খুশি সে। আশা করা যায় সব ঠিক যাবে।
————_—————-_-
দেখতে দেখতে দোলার বিয়ের দিনও এগিয়ে এলো। বাণীহালে এখন তোরজোর চলছে এই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ের। যদিও বড় মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে।
আমার শ্যাম যদি হইতো মাথার কেশ
তারে দর্পন ধরি রূপ নিহারি দর্পন ধরি রূপ নিহারি লা লালা লা লা
সাঝ সকাল বেলা নসীমা গুন গুন করে গান গাইছে। হলুদ উপলক্ষে নসীমাকে একটা নতুন শাড়ী দেয়া হয়েছে। বাসার সব মেয়েরা যে রঙের শাড়ী পরবে সেই রঙের সেই রকম দেখতেই শাড়ী দেয়া হয়েছে। ব্যাপারটা সেটা না ব্যাপারটা হলো নসীমা অবাক এবং একি সাথে আপ্লুত কারণ তাকে কেউ আলাদা করে কাজের লোক সম্বধন করেনি বা ওভাবে দেখে নি। খুশিতে নসীমার গলা ধরে আসছে আর বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছে। কামাল একটা গাট্টা দিলো নসীমার মাথায়।
আহ করে উঠলো নসীমা।
– কামাল ভাই আপনে আবার আমারে মারলেন? আপনে কেন মারেন আমারে বার বার? মাথায় মারতে নিষেধ করছিনা?
নসীমার গলা ভেজা।
– তুই খালি সারাক্ষণ কান্দিস কেন? এতো কান্দাকাটি কি ভালো লাগে দেখতে? শোন তোর জন্য একটা জিনিস আনছি।
নসীমার চোখ চকচক করে উঠলো।
-কি আনছেন?
-কামাল হাতের ব্যাগটা থেকে নসীমার জন্য এক গাছি হলুদ কাঁচের চুড়ি আর একজোড়া কানের দুল দিলো তার হাতে।
নসীমা চুড়ি গুলো হাতে নিয়ে গালে ছোঁয়াতেই বেয়াজিদ আর মাহাপারা কেশে উঠলো। কামাল তরিঘরি করে লুঙ্গি সামলে দৌড় দিতে নিয়েও বেয়াজিদের সামনে বাধা পড়লো। লজ্জায় মাথা তুলেও তাকাতে পারছেনা নসীমা, ইশ কি লজ্জা!
কি নসীমা আপা এবার তোমাদের বিয়েটাও সেরে ফেলতে হবে মনে হচ্ছে। একজন তো আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারছোনা দেখছি। সারাক্ষণ দেখা করার বাহানা খুজছো আর ছটফট করেই যাচ্ছো। বেয়াজিদ রসিকতার সুরে বলে উঠলো “এরি নাম প্রেম, এরি নাম ভালোবাসা” হাসির রোল পড়ে গেলো রান্নাঘর জুড়ে। লজ্জায় কোনো রকমে দৌড়ে বের হয়ে গেলো কামাল।
—————————————————————-
রুবাবা দোলার রুমের দিকে যাচ্ছে কিছু মাল সামান নিতে। রুবাবার ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা এসেছে সারা বাড়ি তাদের ছুটো ছুটিতে তটস্থ। এখন তারা নতুন বাবুর সাথে খেলায় ব্যস্ত। রুবাবার বিরক্তি চরমে বাড়ির প্রায় সবাই একটু পর পর ঋতুর রুমে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কাজ রেখে। বিয়ে বাড়ি কত ধরণের কাজ অথচ কেউ গরজেই তুলছে না। অন্যদের কি বলবেন আর! তার নিজের পেটের ছেলেই একটু পর পর বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রুমে যাওয়ার সময় ছেলের রুমের দরজা খোলা পেয়ে উঁকি দিতেই রুবাবা চমকে গেলেন। যত দ্রুত সম্ভব স্থান ত্যাগ করে নিচে নিজের রুমে চলে এলেন। দরজা বন্ধ করে এসি ছেড়ে বিছানার সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে শেষ করলেন। থমথমে ভাব তার মূখমন্ডল জুড়ে। আর কোনো কাজের কথা রুবাবার মাথায় এলো না। থম ধরেই বসে রইলেন।
—————————————————————-
মাহাপারা বসে বসে গেস্টদের লিস্ট তৈরি করছিলো মেলেসা তার পাশে বসা। মাহাপার একটু পর পর তার লোমস দেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেলেসা উল্টো হয়ে মাহাপারর কোলে শুয়ে পরছে আবার উঠে বসছে। হঠাৎ রিউপার্ট দৌড়ে এসে কাগজটা মুখ দিয়ে টেনে ছিড়ে ফেললো। মাহাপারা রেগে বোম। চিৎকার করে উঠল – ইউ স্ক্যাম্বাগ ব্যাড ডগি হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান? ( ইতর পাজি কুকুর কি করলে তুমি এটা?)।
মেলেসাও তার স্বরে চিৎকার করে উঠলো। বেয়াজিদ রুমে এসেই দেখে কি অবস্থা লিস্ট পুরোই দফারফা। রিউপার্টকে ধমক দিতেই সে চুপ করে তার সামনে বসে পড়লো।
– দেখুন আপনার ছেলে এটা কি করেছে? দেখুন? আমার এত কষ্টের লিস্ট পুরোটাই ছিড়ে টুকরো টুকরো অবস্থা।
বেয়াজিদও সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো ল্যাপটপের মতো একটা বস্তু থাকতেও কেনো কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন আপনি? আপনারই দোষ সব কাজ টা যদি মেলেসা করতো? মেলেসা নিজের নাম শুনতে পেয়েই ঘেউ করে উঠলো। মাহপারা লিস্ট বেয়াজিদের হাতে দিয়ে বললো-
নিন তাহলে আপনিই ল্যাপটপে তুলে ফেলুন যত্তসব।
বেয়াজিদ কাগজের ছেড়া টুকরো গুলোর দিকে অসহায় ভাবে চেয়ে রইলো।মাহাপারা বিছানা থেকে নেমে দুলতে দুলতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো আর তার পিছু পিছু মেলেসাও তার ইয়া মোটা লেজ দোয়াতে দোলাতে চলে গেলো।বেয়াজিদ আর রিউপার্ট দুজনেই তাদের গমন পথে চেয়ে রইলো।
—————————————————————-
নিপা ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের কেবিনে বসে আছে। আপার বিয়ে উপলক্ষে সবাই ব্যস্ত।বাবাও ব্যস্ত তাই তাকেই অফিসে হাজিরা দিতে হচ্ছে। কাজ আটকে থাকা চলবে না। কাচের গ্লাসের বাহিরে সব এমপ্লয়িদের দেখা যাচ্ছে ছুটো ছুটি করে কাজ করছে। নতুন প্রজেক্টের কাজ বেস উদ্দমে চলছে। আবারার রুমের দরজা হালকা খুলে কেশে রুমের নিপার দিকে তাকালো। নিপা নির্বকার। আবরার আবার ডাকলো এবারও নিপা নির্বিকার। আবরার এবার ভেতরে গিয়ে নিপার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আবরার হাত নেড়ে নিপা বলে ডাকতেই নিপা চমকে তাকালো। তার চোখের সামনে কানাবাবা। আবরার চশমা খুলে চোখ টিস্যু দিয়ে মুছে নিপার দিকে তাকাতেই নিপা অবাক চোখে চেয়ে রইলো তার সামনে দাড়ানো সুদর্শন ক্যাবলাকান্তের দিকে। হঠাৎ সে লক্ষ করলো আবরারের চোখের দিকে। নীল। আবরারের চোখের লেন্স নীল রঙের।
– আপনি কি লেন্স পরেছেন?
-কই নাতো?!
-তাহলে আপনার চোখ নীল কেনো? আগেতো দেখি নি।
– কারণ আপনি কখনো ভালোভাবে আমার দিকে চোখ তুলে তাকান নি। সবসময় দায়সারা ভাবেই কথা বলেছেন।
নিপা অস্বস্তি বোধ করছে।সত্যিই তো এই মানুষটার সাথেই তার মাসখানেক বাদে বিয়ে হতে যাচ্ছে অথচ এই মানুষটাকে সে খেয়ালই করেনি কখনো।
– চলুন আজ লাঞ্চ একসাথে করা যাক।
– আপনি ঠিক আছেন? শরীর ভালো তো?
নিপা হাসলো মলিন সাধারণ হাসি।তবুও আবরারের বুকে যেয়ে লাগলো হাসিটুকু।
– যাবেন না? ঠিকাছে।
– না না না যাবো, যাবো। আমি যাবোনা মানে? আমার ঘাড় যাবে।
নিপা হাসলো।
– কি কাজে এসেছিলেন?
হাতের ফাইলটা আবরার নিপার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো এগুলো একটু দেখে নিবেন। বলেই নিপার উওরের অপেক্ষা না করেই স্থান ত্যাগ করলো। আর কিছুক্ষণ সেখানে দাড়ালে তার হৃৎপিন্ড বের হয়ে আসতো।
নিপা ফাইলটা টেবিলে রেখে উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশটা মেঘ করেছে। এই রোদ, এই বৃষ্টি অবস্থা। সেদিন যদি আবরার আর তার বাবা মিলে তাকে নিলয়ের ব্যাপারে না জানাতো তবে হয়তো সত্যিই বড্ড ভুল করে ফেলতো সে। তবে নিলয়ের কাছে যে ফুটেজ রয়েছে তা যে করেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে। বাবা বলেছেন সে চেষ্টা করছেন তারপর বাকিটা সময়ের উপর। নিলয় গা ঢাকা দিয়েছে। সে এর আগেও বহু মেয়েদের সাথে এমনটা করেছে। কবিতা শুনিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের সমস্ত কিছু আত্মসাৎ করেছে। তার ৪ বছরের এক ছেলে আর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সে এমন করেছে। পুলিশ তাকে খোঁজার সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো নিপার বুক থেকে। সব কিছু উজাড় করে ভালোবেসেছিলো কাউকে জীবনে প্রথম বার। তার জন্য তার ছোট বোন মাহাপারাকেও বলি হতে হয়েছে। অথচ তার পরিণাম এমন হলো। তাদের বোনদের ভাগ্যই হয়তো এমন।
—————————————————————-
জাদিদের পরিবার বলতে তার বাবার বাড়ির লোকেরাই যা এসেছে। জাদিদের মায়েরা ছিলেন দুবোন। বড় বোন রিনা মারা যায় বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে অল্প বয়সে গর্ভ ধারণের জন্য জটিলতা দেখা দেয়। সে থেকেই জাদিদের মা একা। আর জাদিদের বাবার বাড়ির পক্ষ থেকে জাদিদের ফুফু আর জাদিদের বড় চাচা চাচী এবং তাদের বাচ্চারে এসেছেন। আত্মীয় বলতে এ কজনই। যদিও জাদিদের চাচা তার ছোট কন্যার সাথে জাদিদের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কন্যা সেগুড়ে বালি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে বহুদিন আগেই। জাদিদের প্রতিও তার চাপা ক্ষোভ। বিশাল সম্পত্তির মালিক তার ছোট ভাই পুত্র অথচ তাদের একসময় গ্রাহ্যই করেন নি তারা।জাদিদের ফুফু আর চাচীর দোলাকে পছন্দ হয়নি। মাঝে মাঝেই তারা দোলাকে নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা চেয়েছিলেন জাদিদ তাদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করুক। দোলা সেদিক দিয়ে উচ্চ শিক্ষিত, সুন্দর, এবং সম্ভ্রান্ত ঘরের। তবে ওইযে খুত তো থেকেই যায় মেয়ে খাটো আর ডিভোর্সি। ব্যস সারাক্ষণ কানের কাছে লেগেই থাকেন।তাদের উদ্দেশ্য কোনো ভাবে জাদিদের মাকে দূর্বল করে বিয়েতে ভাঙচি দেয়া। যদিও জাদিদের মা এতে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করেন না।
—————————————————————-
বিকেল নাগাদ জাফরের বাসায় একটা চিঠি গেলো। জাফর যদিও বাসায় থাকে না। তবে ভাগ্যক্রমে সেদিন বাসায় ছিলো। এনভলপ টা খুলতেই চিঠি দেখতে পেলো যাতে লেখা ছিলো অতিদ্রুত স্বাক্ষর করে এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবে। আমি আর তোমাকে বা তোমার পরিবারের কারো সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা।
ত্বালাকের কাগজ গুলো দেখেই জাফরের মাথায় হাত। এতো সহজে সে ঋতুকে ছেড়ে দিবে না। কোনোদিন না। কাগজ গুলো হাতে নিয়েই সে ভাবতে থাকলো কি করবে সে? ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় ফন্দি এলো ত্বালাকের জন্য ঋতুর কাছে টাকা চাইবে সে। সে জানে ঋতু কোথায় থাকে। সোনার ডিম দেয়া মুরগীকে এতো সহজে হাত ছাড়া হতে সে কখনোই দিবেনা।
চলবে…!
Shahazadi Mahapara’s Inscription