#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া মেঘলা
#পর্বঃতিন
৪
অম্বর তখন আঁধার কাটিয়ে স্নিগ্ধ আলো ফুটছে৷ আকাশটা অর্ধ আলো অর্ধ আঁধারের সংমিশ্রণ৷ পাখিরা নীর ছেড়ে বেড়িয়ে ডানা ঝাপটালো৷ তাদের যেন কেউ আটকে রেখেছিলো ছাড়া পেয়ে প্রান পেলো যেন৷
নামাজ শেষে আহসান মীর বাগানে বেঞ্চিতে বসে চা পান করছে৷ এ চা কে নাকি গ্রীন টি বলে গত তিন বছর যাবত এ গ্রীন টি নামক অত্যাচার টা সহ্য করতে হচ্ছে তাঁর৷ ছেলের আদেশ আর স্ত্রীর জোরাজোরিতে পান করতেই হয়৷ ছেলেই লন্ডন থেকে চা টা পাঠাতো এ চা টা খেলে নাকি সুস্থ থাকে শরীর? আহসান সাহেবের তো মনে হয় চা টা খেলে সকালটাই বিস্বাদময় হয়ে উঠে৷
সোনালী রোদ্দুর দরনি জুরে উঁকি দিচ্ছে চিকচিকে রোদ নাকে মুখে পড়তে চোখ মুখ কুচকে এলো আহসান মীরের৷ সামনে বসে আছে স্ত্রী মেহনুবা৷ মুখ কালো করে বসে আছে মন তার অপ্রসন্নতায় ঘেড়া মেয়েটাকে ছুতে ইচ্ছে করছে দেখতে ইচ্ছে করছে তার ৷ কিন্তু এহেন ইচ্ছে পুরনো করবে সে কি করে?
তা হয় কি? কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে গেছে তার তা দেখে বুক ভারি হলো আহসান মীরের৷নিশ্বাসে নিশ্বাসে কষ্ট অনুভব করলো৷ বুকটা ফের খালি খালি অনুভব করলো৷ পানিতে টইটম্বুর হলো নেত্রকোণ পরক্ষণে শ্বাস টানলো নিয়ন্ত্রণ করলো নিজেকে৷ ফের তার দাম্ভিকতার পরিচয় করালো স্ত্রীকে৷
শক্ত কন্ঠে বললো,
❝ যা হওয়ার হয়েছে৷ যার আয়ু ফুরিয়ে গেছে সে থাকবে নাকি দুনিয়ায়? আমার সামনে কাদবেনা মেহনুবা৷ কান্না আমার অসহ্য লাগে৷ ❞
স্বামীর কথায় কয়েক ফোটা পানি ফের গড়িয়ে পরলো স্বাভাবিক ভাবেই তাকালো লোকটার দিকে৷ এমন কেন লোকটা? তার কি কষ্ট হয় না মেয়েটার জন্য? মেয়েটা যে তার প্রান ছিলো তাহলে কান্নায় বিরক্ত হচ্ছে কেন?
মেহনুবা বেগম স্বামীর দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উগ্র কন্ঠে বলে,
❝ ফের পাষাণের প্রমান দিলেন আপনি নবাব৷ রাজ বংশের রক্ত বইছে না আপনার দেহে৷ পাষাণ তো হবেনি৷ লোপ পেয়েছে আপনার জ্ঞান৷ মানুসিক বিশ্রাম দরকার৷❞
বলে উঠলো স্বামীর সামনে থেকে৷ কয়েক কদম এগোলো মহলে প্রবেশ করার জন্য ঠিক তখনি আহসান মীর আহত কন্ঠে বলেন,
❝ আমার আম্মাজান নিদ্রায় আচ্ছন্ন মেহনুবা৷ শান্তির নিদ্রায় আচ্ছন্ন৷ আমাদের কান্নায় তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটবে ক্ষুন্ন হবে তার মন৷ পাপ বাড়বে৷ ❞
স্বামীর কথার সাথে সাথেই ঢুকরে কেঁদে উঠলো মেহনুবা৷ দাঁড়ালো না আর এক প্রকার দৌড়ে মহলে প্রবেশ করলো৷
আহসান মীর উঠার জন্য পা বাড়াবে এর আগেই তার সামনে উপস্থিত হলেন “এস আই শাহনেওয়াজ৷ ” তার এস আই পরিচয় টা বাদেও আরেকটা পরিচয় রয়েছে শ্রেয়াসের বন্ধু৷
আহসান সাহেব এতো সকালে শাহনেওয়াজ কে ইউনিফর্মে তার বাড়িতে দেখে ক্ষানিকটা অবাক হলেন৷ গম্ভীর মুখেই প্রশ্ন ছুড়লেন শাহনেওয়াজ কে,
❝ অফিসার আপনি এখানে? দরকার ছিলো কোনো?❞
শাহনেওয়াজ কে আপনি বলায় অবাক হলো না সে৷ এ লোকটাকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয়৷ তার ব্যাবহার তাকে মুগ্ধ করে ছেলের বন্ধু হিসেবে এলে তাকে আবার তুমি তুমি করে বলেন৷ আর ইউনিফর্মে আসলে আপনি করে৷
শাহনেওয়াজ স্বভাব সুলভ ভাবেই উত্তর দিলো,
❝ জনাব আমি রাফসানের ব্যাপারে কিছু আলাপ করতে এসেছি৷ আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি কি বলতে পারি?❞
রাফসানের কথা শুনে ভুরু যুগল কুচকে এলো তার রাফন তো মিফতা যেদিন গত হলো সেদিন রাফসান ও গত হলো তাহলে আবার কিসের আলাপ? সে বললেন,
❝ রাফসানের ব্যাপারে? রাফসানের ব্যাপারে কি কথা অফিসার?❞
শাহনেওয়াজ এবার আর ভনিতা না করে বলেই ফেললো,
❝ নবাব রাফসানের মৃত্যুটা অদ্ভুত লাগেনি আপনার? মনে হয়নি ইচ্ছাকৃত ঘটানো ঘটনা? গ্রামের ভেতরের বড় রাস্তাটা দিয়ে ট্রাক ঢুকেই না বললেই চলে, গ্রামের রাস্তায় ট্রাকই বা ঢুকতে যাবে কেন? সে রাস্তায় রাফসানের এক্সিডেন্ট হলো৷ যদিও ঠিক সময় তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিলো তাহলে আশংকামুক্ত হওয়ার পর ফের মৃত্যু ঘটে কি করে? কাকতালীয় ধরে নিলেও এক্সিডেন্টের ব্যাপারটায় ঘাপলা রয়েছে৷ কেউ ইচ্ছে করে খুন করতে চাইনি তো? আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে গ্রামের মানুষকে জিগ্যাসাবাদ করতাম৷❞
আহসান মীর শুনলেন কথা গুলো মেয়ের ভাবনায় এতটা মত্ত্ব ছিলো এ নিয়ে ভাবেনি৷ ‘খুন’ ফের খুন কথাটা উঠে এলো৷ আচ্ছা এক দিনে দু-জনেরই মৃত্যু ঘটলো ব্যাপার টা আদৌ কি কাকতালীয়? এর মাঝে অন্য কিছু নেই তো? সে থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
❝ খুন? খুন কে করতে যাবে? ❞
শাহনেওয়াজ কপাল চুলকে বলেন,
❝ ব্যাপারটা আমায় রাফসানের বোন জামাই জানায়৷ আমি শুধু আপনার অনুমতি নিতে এসেছি৷ আপনি অনুমতি দিলে আমি ওপর মহল থেকে অনুমতি নিয়ে ইনভেস্টিগেশিন শুরু করবো৷ ❞
আহসান মীর সম্মতি জানালেন৷ শাহনেওয়াজ ফিরে যেতে নিয়েও ফের পিছন ফিরলো অতঃপর সন্দিহান কন্ঠে বললো,
❝ রাজকুমারী মিফতার মৃত্যুর সাথে রাফসানের মৃত্যুর কোন ভাবে জড়িয়ে নেই তো জনাব?❞
আহসান মীর শাহনেওয়াজ এর পানে পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন৷ ভাবনা টা তার মাথায় আসছে বারংবার৷ কি বলবে? আচ্ছা যদি ভাবনাটাই সত্যি হয়? পরক্ষণে আবার ভাবলো না রাজকুমারী মিফতাকে কেন কেউ খুন করবে? সে তো স্ট্রোক করেছে৷
৫
গ্রাম পরিদর্শন করে মহলে প্রবেশ করলো শ্রেয়াস৷ মূলত শরীর চর্চা করতে বেরিয়েছিলো যাকে সাহেবি ভাষায় মর্নিং ওয়াক বলা হয়৷ সে উছিলায় গ্রাম পরিদর্শন টা হয়ে গেলো৷
প্রতি ভোরে গ্রাম পরিদর্শনের কাজটা আহসান মীর করতেন কিন্তু এখন শ্রেয়াস রয়েছে আস্তে আস্তে এক এক করে রাজ্যের সব দায়িত্ব শ্রেয়াসের কাধে তুলে দিবে৷ সব কাজে পারদর্শী হওয়ার পর তাকে নবাবের আসনে বসাবে৷ রাজ্যাভিষেক হওয়ার পর বড় নবাব হবেন “রৌজাফ শ্রেয়াস৷”৷ আজকাল আহসান মীর মহল আর রাজ্য সামলাতে হিমশিম খায় প্রায়৷ চন্দ্রিকা থাকায় তার সুবিধা হয় মেয়েটার গুন রয়েছে সব রকমের৷ একজন ছেলের থেকেও বেশি৷
শ্রেয়াস মহলে ঢুকতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খায়৷ ধাক্কা লাগার সাথে সাথে সে ব্যাক্তিটি অন্য দিকে সরে যায় টু-শব্দ করে না মুখ দিয়ে ওরনাটা ঠিক করে জড়ায় শরীরে মাথায়৷
বেশ ক্লান্ত ছিলো শ্রেয়াস ক্লান্ত শরীরে কারো সাথে ধাক্কা লাগায় বিরক্ত যেন আরো বেশি উপচে পরে৷
কার এত সাহস দেখার জন্য পাশে তাকাতেই দেখে চন্দ্রিকা হেটে চলে যাচ্ছে৷
শ্রেয়াস এবারো বিস্মিত না হয়ে পারলো না৷ ফের সেই মেয়েটি৷ মেয়েটা প্রতিবার ভুল করে কিছুই বলে না আজ ধাক্কা দিয়েও কিছু না বলে বেপরোয়া ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে৷
মেয়েটা ভুল করে কখনো ক্ষমা প্রার্থনা করেন না৷ না কিছু বলেন৷ রাগ হলো এমন বেপরোয়া ভাব দেখে৷ অবাক হয় শ্রেয়াস বার বার মেয়েটার সাহস দেখে৷ এর মাঝেই আহসান মীর এলেন৷ ছেলের রাগী চেহারা দেখে প্রশ্ন ছুড়বে এর আগেই শ্রেয়াস মেয়েটাকে মাঝপথে বাধ সেধে বলেন,
❝ থামুন৷ ❞
হাটা দৃঢ় হলো চন্দ্রিকার থামলো কিন্তু ফিরলেন না পিছনে৷ শ্রেয়াস ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলেন,
❝ কেউ ডাকলে তার দিক তাকিয়ে কথা বলতে হয় তা কি আপনি জানেননা চন্দ্রাবতী? ❞
চন্দ্রিকা না ফিরেই কন্ঠে অধৈর্য্যেতা বজায় রেখে উত্তর দেন,
❝চন্দ্রাবতী নই৷ চন্দ্রিকা৷ আর আমার জানা নেই কেউ ডাকলে যে তার পানে তাকিয়েই কথা বলতে হয়৷ এখন বাকি কথা বলুন৷❞
এবার শ্রেয়াসের রাগ হলো৷ এ মেয়ে এমন কেন? অন্য কেউ তো এমন করে তো দূর ওর সামনে আসেও না৷ অন্তত এ রাজ্যের কারো ওত সাহস নেই৷
শ্রেয়াস বাবার দিকে তাকালেন তাতে আহসান মীর থতমত খেলেন তার বেশ অবগত এ মেয়ে তাকেই ভয় পায় না আবার শ্রেয়াস কে পাবে? অন্য কেউ হলে নির্ঘাত তাকে কারাগৃহে আটকে দিতো আহসান মীর কিন্তু মেয়েটার এহেন আচরণেও তার মনে ধরে৷ মেয়েটা স্পষ্টবাদি কিন্তু মন্দ নয়৷
শ্রেয়াস ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলেন,
❝ মেয়ে আপনার সাহস দেখে বিস্মিত আমি৷ কাউকে ধাক্কা দিলে ক্ষমা চাইতে হয় এ নিশ্চয়ই জানেন?❞
শ্রেয়াসের কথায় স্ব-শব্দে হেসে বলেন,
❝ অপরাধ করিনি আমি জনাব৷ আমি ঠিক ভাবে দেখেই হাটছিলাম আপনি ওই মুঠোফোন নামক যন্ত্রটায় মত্ত্ব ছিলেন৷❞
দমে গেলো শ্রেয়াস৷ চুপসে গেলো৷ অতঃপর একবার বাবার পানে তাকিয়ে আরেকবার পিছনে ঘুরে থাকা চন্দ্রিকার পানে তাকালো৷
মূলত কথাটা বাড়িয়েছিলো মেয়েটার মুখশ্রীটা দেখার জন্য কিন্তু অল্পতেই রাগ উঠে গেলো৷ আজো দেখা হলোবনা মেয়েটাকে৷
তখনকার হাসির শব্দ কানে বাজলো৷ আহসান মীর ছেলের পানে তাকিয়ে ভিতরে চলে গেলেন৷ ইশারা করে ছেলেকে অন্দরে প্রবেশ করতে বললেন যাওয়ার আগে৷
চন্দ্রিকা নামক অবাদ্ধ মেয়েটা ফের হাটা দিলেন তার গন্তব্যে নুপুরের শব্দ ধ্বনি ফের কানে বাজলো শ্রেয়াসের বিরক্ত ফুটলো তার মুখশ্রী খানায় অতঃপর বাধ সেধে বললো,
❝শিঞ্জিনী গুলো খুলে ফেলুন মেয়ে৷ এর শব্দ ধ্বনি আমায় উত্যক্ত করে৷ আমার রাজ্যে শিঞ্জিনী পরা আপনার জন্য নিষিদ্ধ ৷❞
অবাদ্ধ মেয়েটি থামলোনা তবে যেতে যেতেই উত্তর দিলো,
❝ নিষিদ্ধ কাজ গুলো প্রিয় আমার জনাব৷ যা নিষিদ্ধ তা আমি বারংবার হাজারবার করবো৷❞
চলবে,
[ঘটনা মুলক মন্তব্য করবেন ❤️ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন🖤]