কৌমুদিনী পর্ব-৪

0
2212

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া মেঘলা
#পর্বঃচার

অম্বরটা তখন আবেদনময়ী হয়ে রয়েছে৷ এই বুঝি কাউকে আবেদন করছে নিজের প্রণয়ের৷ বেহায়া অম্বরটা কেড়ে নিচ্ছে সবার নজর নিজের পানে৷ ধুসর মেঘে ছেয়ে আছে অন্তরিক্ষ৷ নীলাভ-সাদা অন্তরিক্ষ ধুসর মেঘে ঢাকলেও মন্দ লাগে না৷ এই বুঝি মেঘ গুলো প্রেমময়ী বর্ষন হয়ে নামবে ধরনিতে৷ শ্রেয়াস নিজের কক্ষে বসে ল্যাপটপ নামক যন্ত্রটি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো আর কিছুক্ষণ পর পর পাখির ডাকে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে আসছে৷
অসভ্য পাখি দুটো সকাল থেকে চন্দ্র চন্দ্র করে বেরাচ্ছে৷ হঠাৎ শিঞ্জিনীর শব্দে ল্যাপটপ নামক যন্ত্রটি থেকে ধ্যান জ্ঞান সরলো৷ দৃষ্টি সরালো৷ কক্ষের দরজার পানে তাকালো৷
মেয়েটা কি মহলে এসেছে? নিজের কোল থেকে ল্যাপটপ টা সরিয়ে উঠলো সবে বাড়িতে এসেছিলো আজকাল সব দিক প্রায় তারই সামলাতে হচ্ছে৷ রাজ্যের কাজ তার ঘাড়ে ফের এই শিঞ্জিনীর শব্দ মহা উত্যক্ত করছে তাকে৷ মেয়ে অবাধ্য তার কথা শুনবে না এই মেয়েকে কারা গৃহে বন্ধি করে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে ভাবলো শ্রেয়াস৷ ল্যাপটপ নামক যন্ত্রটি বন্ধ করে
উঠে দাঁড়ালো সে অতঃপর শব্দ ধ্বনি অনুসরণ করে এগোলো নিজের চৌকাঠের সামনে আসতেই একজন দাসী সামনে এসে বলে,
” আপনার কিছু প্রয়োজন জনাব?”
শ্রেয়াস শব্দ অনুসরণ করে সে দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,
” চন্দ্রিকা৷ চন্দ্রিকাকে প্রয়োজন৷”
নিজের কথায় নিকেই অবাক হলো সে৷ শ্রেয়াসের এহেন কথায় দাসী ভরকানো নয়নে শ্রেয়সের পানে তাকালো৷ কথা ঘুরাতে একই ভঙ্গিতে শ্রেয়াস বললো,
“কিছু প্রয়োজন নেই, আপনি আসতে পারেন এখন৷ ”
বলে শব্দ অনুসরণ করে সে দিকে এগোলো ফের৷ অতঃপর মহলের ছোট ছাদে পাওয়া গেলো চন্দ্রিকা কে৷
এ ছাদটা মিফতা আর চন্দ্রিকার প্রিয় জায়গা অবসর সময় এখানেই কাটাতো দু’জন কিন্তু আজ? আজ ভিন্ন একজন আছে একজন নেই৷
পাখি দুটো এক খাচায় চন্দ্রিকার পাশেই৷ চন্দ্রিকা মেয়েটা পাখি দুটোর সাথে কথপোকথনে মেতে আছে তখন৷ দুটো পাখি এক খাচায় দেখে ব্রু কুচকালো শ্রেয়াস৷ মেয়েটা কি বোনের পাখিটা নিয়ে যাবে নাকি?
শ্রেয়াস এসে পিছনে দাড়ালো তখন৷
“আপনি এখানে?”
হঠাৎ চন্দ্রিকা কথায় থমকালো শ্রেয়াস৷ এটা বুঝলো কি করে ও এখানে আছে? ও তো শব্দ করেনি? মেয়েটা এখনো শ্রেয়াসের পানে তাকায়নি পাখি দুটোর দিকেই তার দৃষ্টি৷ উলটো ঘুরেই আছে এখনো৷

মেয়ের এহেন কান্ডে জেদ বারলো শ্রেয়াসের৷ রাগ হলো৷ মেয়টা আজো উল্টো ঘুরে আছে৷ কি এমন রুপ তার যে আড়ালে থাকে? মেয়েটার মুখশ্রী আজ যে ভাবেই হোক দেখবে সে ৷ মেয়েটা নিজের মুখ দেখায় না কেন? কিন্তু কিছু করবে এর আগেই মেয়েটি তার ভাবনায় পানি ঢেলে পাখির খাঁচা নিয়ে অপর সিড়ির দিকে হাটা দিলো৷
পাখিটি চন্দ্র চন্দ্র বলছে এখনো৷ পাখি টি কি ইচ্ছা করে ওর সামনে মেয়েটির নাম নেয়?
সিড়ি দিয়ে নামবে এর আগেই শ্রেয়াস থামিয়ে বলে,
” রাত বিরাতে ছাদে কি করছিলেন?”
মেয়েটি এবার হাল্কা ঘুরলো অতঃপর উত্তর দিলো,
” রাত আমার পছন্দ তাই সময় দিচ্ছিলাম নিজেকে৷”
বলে ফের হাটা ধরবে তখনই শ্রেয়াস বললো,
” নিজেকে সময় দিতে গিয়ে মানুষের ঘুম কেড়ে নিচ্ছেন মেয়ে আপনি৷ আপনাকে কারা গৃহে বন্ধি করবো আমি৷”
শ্রেয়াসের কথায় হাসলো চন্দ্রিকা নামক মেয়েটি অতঃপর মিনমিনিয়ে বললো,
“আমায় কারা গৃহে বন্ধি করতে গিয়ে আপনি না আমার মায়ায় বন্ধি হয়ে যান জনাব৷”
বুঝলো না চন্দ্রিকার কথা কি বলছে এই মেয়ে? কিসের মায়া? শ্রেয়াস ব্রু কুচকে আশ্চর্য কন্ঠে বললো,
“কিসের মায়া?”
উত্তর দিলো না এ কথার চন্দ্রিকা৷ তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
“আমার জেগে থাকায় কার আবার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো জনাব? আমি তো কাউকে উত্ত্যক্ত করিনি৷ ”
শ্রেয়াস স্বভাব সুলভ কন্ঠে উত্তর দিলো৷
” আপনি করেন নি আপনার পাখি দুটো করেছে৷ পাখি দুটো কে বলে দিবেন মেয়ে, রাত বিরাতে আমাকে উত্ত্যক্ত না করতে৷ জ্যোছনা আমার পছন্দ নয় তারা দুটিতে আমার রাজ্যে চন্দ্রিকার গুঞ্জনে মাতে৷ আমি ব্যাতিত আমার রাজ্যে অন্য কারো গুঞ্জন আমার পছন্দ না৷”
চমদ্রিকা এবার খিলখিলিয়ে শব্দ করে হাসলো৷ তার হাসির ধ্বনি বার বার কানে বাজলো শ্রেয়াসের পছন্দ হলো না হাসিটা৷ ঝিম মেরে আসলো মাথা৷ নেত্র যুগল রক্তিম হলো৷ শ্রেয়াস কিছু বলবে এর আগেই চন্দ্রিকা বলে,
” চন্দ্রের প্রান, আর প্রণয় তো চন্দ্রিকাতেই মত্ত্ব হবে৷ আর বাকি রইলো রাজ্য? সে তো সময়ই বুঝিয়ে দিবে৷ রাজ্য সহ রাজা টা কার৷”
বলেই আর থামলো না হাটা দিলো সামনে৷ শ্রেয়াস এখানেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ এ মেয়ের হেয়ালি কথা বুঝলো না সে৷ কি বললো মেয়েটি? মেয়েটা পাগল নয়তো? কখন কি বলে কে জানে?


মেঘ গুলো তখন বর্ষন হয়ে শীতল করছে পৃথিবী৷ বর্ষনে ধরনি শীতল হলেও শীতল হচ্ছে না রানী মেহনুবা৷ ভিনদেশ থেকে বিলেতি মানুষ এসেছে তাদের নিয়েই বেড়িয়েছে সেই অপরাহ্নে এখনো তাঁর মহলে ফেরার নাম নেই৷
সাথে ছেলেটাও বেড়িয়েছে৷ কি এত কাজ তাদের কে জানে? মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে সে সর্বদা আতংকে থাকে৷ ওরা বাইরে বের হলে মনে হয় এই বুঝি ফের কোন দুঃসংবাদ এলো বলে৷
তার কথা কখনো কেউ মূল্য দেয়নি আজ দিবে কি? দাসী গুলো কয়েকবার খাবার নিয়ে এসেছে কিন্তু প্রতিবারই তাড়িয়ে দিয়েছে৷ কক্ষের দুয়ার বন্ধ করে বসে আছে সে৷

অতঃপর সময় নিরূপক যন্ত্রটিতে যখন বারোটা বাজে তখন বাপ ছেলে প্রবেশ করলো মহলে সাথে দেহরক্ষী গুলো৷ ছেলে নিজের কক্ষে গেলো কিন্তু আহসান মীর প্রবেশ করতে পারলো না৷
নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তার রানী৷ কক্ষে নাকি তার প্রবেশ নিষিদ্ধ দাসী গুলো জানালো
তার রানী বেশ চটেছে ভালো করে বুঝলো আহসান মীর৷ সবার সামনে দাম্ভিক শক্ত পোক্ত একজন মানুষ হলেও রানী মেহনুবার সামনে সে নরম৷
দাসী গুলোকে ইশারা করে চলে যেতে বললো৷ নবাবের আদেশে তারা শির নিচু করে স্থান ত্যাগ করলো৷
অতঃপর সে নরম কন্ঠে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,
“রানী দরজা খুলুন৷”
মেহনুবা যখন অতী মাত্রায় রেগে যায় তার রাগ ভাঙাতে আপনি বলেন তাকে৷ কিন্তু এবার খুললো না আহসান মীর ফের বললো,
“আপনার অপেক্ষায় আছি আমি৷ না খোলা পর্যন্ত এখানেই থাকবো আমি৷”
এবারো উত্তর দিলো না রানী৷ ফের কিছু বলবে এর আগেই দরজা খুলে দিলো কক্ষের৷ তা দেখে হাসলো নবাব আহসান মীর৷
দরজা খুলে সরে অন্য দিকে চলে গেলো মেহনুবা৷ রাগ তার কখনি গলে পানিতে পরিনত হয়েছে কিন্তু আপাদত কঠোরতা জারি রাখতে চায়৷
কিন্তু তা এবারো রাখতে পারলো না তার আগেই আহসান মীর শান্ত কন্ঠে বললো,
“ভালোবাসি রানী আপনাকে৷ ”
“বাসি না আমি৷”
রানীর এহেন উত্তরে ফের মুচকি হাসলো আহসান মীর৷ সে জানে এ উত্তরটাই পাবে৷ রানী রেগে থাকলে প্রতিবার এ উত্তরটাই দেয়৷


আকাশ যখন উগ্র রুপ ধারন করেছে সে রুপ দেখায় তখন মত্ত্ব চন্দ্রিকা৷ বর্ষন তার প্রিয় তাই বর্ষনের এক এক ফোটাও নিজের গায়ে মাখতে ভুলে না মেয়েটি৷
বৃষ্টির মাঝেও নিজের বাড়ির ছাদের বেঞ্চিটায় বসে আছে চন্দ্রিকা শরীর তার ভিজে একাকার পাখি দুটো ছাদের ছাউনির নিচে৷
পাখি দুটো তার আর মিফতার প্রান৷ তাই নাম ও রেখেছিলো প্রাণ আর প্রণয়৷ সব সময় নিজের কাছে রাখারই চেষ্টা করে৷ শীতল হয়ে আছে শরীর তাও এখানেই বসে আছে সে৷

মহলে ফিরে রাত্রির ভোজন সেরে সবে এসে বসলো কাউচে শ্রেয়াস নামক পুরুষটি আর তখনই নজর গেলো দু-তলা বাড়ির ছাদে৷ মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজছে এতো রাতে৷ মেয়েটার মাথায় নিশ্চয়ই ব্যামো আছে নয়তো রাত বিরাতে কে ভিজে? অলিন্দে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ৷ শ্রেয়াস পেছনে ফিরে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কে?”
ওপাশ থেকে রাজ প্রহরীর উত্তর এলো,
“ছোট নবাব আমি৷ আসতে পারি?”
প্রতুত্তরে শ্রেয়াস বললো,
“আসুন৷ ”
প্রহরী কক্ষে প্রবেস করতে সঙ্গে সঙ্গে মিনমিনিয়ে বললো,
” এস আই শাহনেওয়াজ দু-দিন যাবত নিখোঁজ জনাব৷ সে দিন মহল থেকে বের হওয়ার পর পাওয়া যাচ্ছে না তাকে৷ ”

চলবে,

  • (আপুর বিয়ে তাই দেরি হচ্ছে দিতে৷ আপনাদের রেসপন্স এর উপর ভিত্তি করে নেক্সট পর্ব দেওয়া হবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here