ক্যামেলিয়া পর্ব-১১

0
4124

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১১

(২৮)

“আমি নিয়াজ চৌধুরী,মরহুম আজমল শিকদার এর বড় জামাতা। মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলছি,

যদি আপনারা কেউ আমার মরহুম শ্বশুরের কাছে কোনো প্রকার ঋণের দাবীদার থেকে থাকেন তবে আপনারা আমাদের জানাতে পারেন।আমরা তার ঋণ শোধ করবো।”

মাথায় কাপড় দিয়ে কাঁঠাল গাছে হেলান দিয়ে পাথরের মতোন দাঁড়িয়ে আছে জাফরিন। সে জানে তার বাবার কাছে কেউ কোনো ঋণ নেই।শুধু সে নয় এই কথাটা সকলেই জানে।তবুও জিজ্ঞেস করাটা তাদের কর্তব্যের মাঝে পড়ে বলেই জিজ্ঞেস করা হলো। ইমাম সাহেব পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন সকলের উদ্দেশ্যে।
সবাই না করলেও এগিয়ে এলো আশার বাবা। সে এগিয়ে এসে ইমাম সাহেব কে বললেন,

“তার ঋণ নাই কিন্তু সে আমাদের সাথে যে বেঈমানী করছে এটাও কি ফয়সালা এখন করা যেতে পারে?”

তার কথায় ভিতরে চমকে উঠলো ইমাম সাহেব। এতদিন শুনেছে ওরা কি কি করেছে আজ কি লাশ দাফনে বাধা দেওয়ার পায়তারা করছে তারা?
বয়স্ক ইমাম সাহেব বিজ্ঞ মানুষ। স্মিত হাসি ফুটে থাকে তার অধরে। দৃষ্টি অধিকাংশ সময় নিচের দিকেই রাখে। তিনি মানেন একজন নারীর যেমন পর্দা মেনে চলা উচিৎ, পুরুষের উচিৎ তার দৃষ্টিকে সংযত করে চলা।কিন্তু এবার সে আশার বাবার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,

” মরহুমের ঈমানী, বেঈমানী কাজের হিসেব আল্লাহ্ তালা অবশ্যই নিবেন। প্রতিটা কাজের জবাবদিহী সে করবে কিন্তু আমরা এখানে তার ঋণের কথা বলছি।আপনি কি তার কাছে ইহজাগতিক কিছু মানে টাকা পয়সার পাওনাদার।”

“ওভাবে না পাইলেও তো পাই।এই যে এত সহায় সম্পত্তি সব বৌ আর মেয়েগো দিছে। আমাদের ঠকায়নি?”

“জি না। সে তার নিজের সম্পত্তি তার কন্যাদের ভাগ করে দিয়েছেন।আপনাদের অংশ আপনাদের দিয়েছেন।”

“কিন্তু এখন যে কোম্পানি থেকে টাকা পাবো?ওগুলা?ওইগুলায় আমাদের হক নাই?”

“সে যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তার সেই অন্যায়ের ভাগ নিবেন?তার যদি কোনো ঋণ থেকে থাকে তবে সেই ঋণ শোধের দায়িত্ব নিবেন?”

“তা নিবো কেন? ”

“অন্যায়ের ভাগ তার কন্যারা নিবে। তার কন্যারা সকল কিছুই মেনে নিবে।তার স্ত্রী তার ঋণ শোধের দায়িত্ব নিবে। যদি কেউ এসব দায়িত্ব না নিতে পারে তবে মরহুমের প্রতি তার কোনো দায়িত্ব থাকবে না।”

আশার বাবা এ যাবত সময় ইমাম সাহেবের সাথে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন।খুব একটা সুবিধা না করতে পেরে চলে এলেন সেখান থেকে।
ইমাম সাহেব এবার জাফরিন ও তার বোনদের বললেন,

“মা পৃথিবীতে কারোর বাবা মা চিরজীবী হয় না।আমরাও একদিন চলে যাবো।এবার আপনারা শক্ত হোন।আপনার বাবাকে খাস নিয়তে মাফ দিন।আমরা তাকে জানাযায় নিয়ে যাবো।”

বড় আপা শেষ বারের মতো বাবার চেহারা দেখতে চাইলেন।কিন্তু এবার সে কাঁদলেন না, জ্ঞান হারালেন না।স্বল্প সময় কিন্তু দীর্ঘ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন তার বাবাকে। তার ত্রিশ বছরের জীবনে সে তার বাবাকে সব থেকে বেশি ভালোবেসেছে। আব্বা ডাকটা শুধু নিজের বাবার জন্যই ছিল তার। মানুষ শখ, আহ্লাদ করে নিজের সন্তানকে আব্বা ডাকে কিন্তু সে কখনো ডাকেনি।বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বিরবির করে বলল,

“আব্বা, আমি শক্ত আছি।আপনি চিন্তা করবেন না।আমি থাকতে আমার দুই বোন আর মায়ের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।আপনি না বলতেন আমরা আপনার কন্যা না, আপনার জান্নাত। আমি চাই আপনার সাথে আমার জান্নাতেই দেখা হোক।আজকে আপনার সামনে প্রতিজ্ঞা করতেছি আমি পূর্ণ পর্দা করবো। সব মেনে চলবো যাতে আমার জন্য আপনাকে কোনো হিসেব না দিতে হয়।”

লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় বড় আপা দুই হাতে দুই বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।দুই বোনের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

“আব্বার জন্য নামাজে দোয়া করবি তোরা। সন্তানের দোয়া যে বাবা মায়ের কাজে আসে।এছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।”

(২৯)

দেশের বাইরে অনেক লাশ দাফন দেখেছে মাশহুদ। অধিকাংশই ছিল খ্রিস্টধর্মীয়। তাদের কফিন বন্দী করে দাফন করানো হয়। অথচ আজ প্রথমবার সে দেখছে মুসলিম কাউকে জানাজা পড়তে। আপন মানুষের মৃত্যুতে কেউ এতটা কাঁদে তার জানা ছিল না।
আজ অবধি তার কোনো আপনজন মারা যায়নি বলেই কী সে কষ্টটা অনুভব করতে পারছে না?
চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে সে তাকিয়ে আছে খাটিয়ার দিকে। শুভ্র সাদা পাঞ্জাবী, পায়জামা পরণে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে লাশের পাশে। মাথায় ছোট্ট টুপি।গোটা গোটা হাত দিয়ে সে লাশের উপরে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো।এরপর সে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নিলো।
এমিলি মাশহুদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

“স্যার, এবার আমরা ফিরবো?এখানে আমাদের আর কোনো কাজ নেই। আমরা এখানে না এলেও চলতো।”

“কীসের প্রয়োজন আছে আর নেই এটা কি আমি বুঝি না মিস?”

“সরি স্যার।”

“খোঁজ নিন আমার দাদার বাড়ি কোথায় ছিল।”

“জি স্যার।আধ ঘন্টা সময় লাগতে পারে।”

“যত দ্রুত সম্ভব করুন।মনে রাখবেন দাদা যেন না জানে এবং আজমল সাহেবের পরিবারের সাথে কথা বলার ব্যাপারে ব্যবস্থা করুন।”

জাফরিনের সামনে তার মা বসে আছে। কেউ তাকে পুনরায় গোসল করিয়ে সাদা কাপড় পরিয়েছে। তার দেহের সকল গয়না খুলে নিয়েছে। এই শোকের মাঝেও মায়ের চেহারা দেখে চৈতন্য ফিরে পেল।দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলল,

“মায়ের গয়না কই?”

“তোমার বড় চাচীর কাছে।”

“খুলেছে ক্যান?”

“এটাই নিয়ম।”

“হাদিসে নেই।আমার মায়ের মানসিক অবস্থার সাথে এমন তামাশা না করলে চলছে না?”

জাফরিন নিজের গলা থেকে সরু চেইন, কানের দুল আর নাকফুল খুলে মাকে পরিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আম্মা আব্বা আছেন তো।এই যে আমরা, আমরা তিন বোন, আপনি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হোন আম্মা।আব্বা কিন্তু আমাদের দায়িত্ব আপনার হাতে দিয়ে গেছেন।”

মেয়েকে চুপচাপ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন সুফিয়া বেগম।তার বুকে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে কখন জাফরিন ঘুমিয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি।

জাফরিনকে তার সময় দেওয়া হয়েছে। লাশ দাফন করে আসার পর মাশহুদ বসেছিল তাদের সাথে। ঘুম থেকে উঠার পর জাফরিন এসে বসলো তাদের সামনে।
মাশহুদ ইংরেজি ভাষায় বলছিল এবং অন্য একজন বাংলায় ট্রান্সলেশন করছিল।যদিও এটার প্রয়োজন ছিল না।তবুও কেউ বাধা দেয়নি।
মাশহুদ জানালো এমন ভাবে তাদের আশাটা যদিও কোম্পানির কোনো নিয়ম নেই তবুও আজমল সাহেব দীর্ঘ সময় তাদের সাথে কাজ করেছে বলেই তাদের আসা। তারা দুঃখিত যা হয়েছে এসবের জন্য।তাদের পাওনা অর্থ সময় মতো একাউন্টে পৌঁছে যাবে।

এরপর জাফরিনের দিকে তাকিয়ে সে বলল,

“আপনার কী কানাডায় যাওয়ার কথা ছিল?”

জাফরিন সম্মতি জানালে মাশহুদ পুনরায় বলল,

“আপনার জন্য আমাদের বস একটা অফার পাঠিয়েছে। যদিও এটা কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।তবুও আজমল সাহেবকে সম্মান করেই এসব।
আপনার একাডেমিক সকল খরচ আমাদের কোম্পানি বহন করবে এবং আপনি রাজি থাকলে স্পেনের টপ যে কোনো ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর দায়িত্ব আমাদের। এছাড়াও কোম্পানিতে আপনার যোগ্যতা অনুসারে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।”

জাফরিন কিছুই বলল না।তারা জানালো ভেবে জানাবে। মাশহুদ এবং বাকীরা বিদায় নিয়ে চলে এলো। পিছনে ফেলে এলো জাফরিনের সন্দেহ। যার দু চোখ বার বার আটকে যাচ্ছিলো কথা বলা লোকটির কণ্ঠমনির উপর। সে কী লোকটাকে চিনে?

ধীরে ধীরে কেটে গেল দুটো দিন। আজ আজমল।সাহেবের জন্য মানুষ খাওয়ানো হচ্ছে। তাদের মুখে হাসি নেই অথচ বাকী সবাই কত খুশী!
জাফরিন নিজ জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলো নতুন দুলাভাইয়ের সাথে রঙ খেলছে সবাই। তড়িৎ গতিতে সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।সরাসরি ঈশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“আমার বাবার থেকে দশ লাখ টাকা কেন নিয়েছিলে?”

ঈশান চমকালো কিন্তু নিজেকে সামলে বলল,

“সেই দশ লাখ টাকার সাথে আরও পাঁচ লাখ টাকা যুক্ত করে তোমার সম্মান কিনে নিয়েছে তোমার ইউভান।একবার তোমার বাবা দিয়েছে আবার ইউভান গতকাল। কী দামী তোমার সম্মান জাফরিন।এক সম্মান বাঁচাতে দুই জন কত কত টাকা দিয়ে দিলো।”

#চলবে ( এডিট ছাড়া।
যারা গল্প পড়ছেন, তারা অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন।কেনো না আপনারা রেসপন্স করলেই অনেকের টাইমলাইনে পৌঁছে যাবে এবং সবাই পড়তে পারবে। তাই অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন। কষ্ট করে লিখছি কিন্তু আপনাদের জন্য। আর হ্যাঁ আমার নতুন ইবুক “ভালোবাসার রঙ বেরঙ” পেয়ে যাচ্ছেন মাত্র ২০ টাকায়। বিস্তারিত লিংক কমেন্টে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here