#ক্যামেলিয়া
#পর্ব-১২
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৩০)
ঈশানের মুখে এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল জাফরিন। তার কানে শুধু বাজতে থাকলো ঈশানের বলা কথাগুলো।
” সেই দশ লাখ টাকার সাথে আরও পাঁচ লাখ টাকা যুক্ত করে তোমার সম্মান কিনে নিয়েছে তোমার ইউভান।একবার তোমার বাবা দিয়েছে আবার ইউভান গতকাল। কী দামী তোমার সম্মান জাফরিন।এক সম্মান বাঁচাতে দুই জন কত কত টাকা দিয়ে দিলো।”
ফোন হাতে নিয়ে জাফরিন কল দিলো ইউভানকে। ইউভান তখন রান্নার জিনিসপত্র তদারকি নিয়ে ব্যস্ত। জাফরিনের কল পেয়ে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো সে। কল রিসিভ না করে ফোন পকেটে রেখে দিয়ে এগিয়ে এলো ঘরের দিকে।বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল জাফরিন। ইউভানকে দেখেই সে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ফাঁকা ঘরে। দরজা আটকে দেওয়ার আগেই সেখানে ডেকে আনলো তার দুই বোন জামাই এবং মা কে। এরপর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি ঈশানকে টাকা দিয়েছো?”
“কেন?”
“যা জিজ্ঞেস করছি বলো।তুমি কি দিয়েছো?”
” হ্যাঁ।তাতে কি হয়েছে?”
“কেন দিয়েছো?আর বাবা টাকা দিয়েছে সেটা তুমি জানতে?”
“সেটা আমরা সবাই জানতাম।”
বড় আপার কথায় অবাক চোখে তাকালো জাফরিন।সে বাদ দিয়ে সবাই এই কথাটা জানে?রাগে ক্ষোভে সে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। স্বল্প সময় পার হয়ে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলো,
“কেন দেওয়া হয়েছিল টাকা?”
“আব্বা টাকা দিয়েছিল তোদের দু জনের ভিসা জনিত কারণে। যেহেতু তুই ঈশানকে পছন্দ করিস আর এখানে তোর যাওয়াটা জরুরি তাই যখন ঈশান টাকাটা আবদার করে তখন আর না করেন নি আব্বা।”
” কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না বড় আপা।
কিন্তু এখন তো আমি যাচ্ছি না।আর দাদাভাই তুমি?”
“বলতে পারিস তোর সম্মানকে চড়া দামে কিনে নিয়েছি।”
“কীভাবে?”
“সেদিন যখন তুই আমাকে জানিয়েছিলি দশ লাখ টাকার কথা। সেদিন রাতেই ঈশান আমাকে কল দেয়। আমি প্রথমে তাকে কিছুই বলিনি।কিন্তু সে একটা কথা বলে।তোর চাচাদের প্ল্যান সম্পর্কে। প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি।কিন্তু ঈশান বলেছিল এমনটাই হবে। ওর কথায় দুই মন দুই দশা করেও চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার স্ত্রীকে রাতটা থাকার অনুরোধ করা হয়, সাথে আব্বা আম্মাও থাকে।
যেহেতু ও বলেছিল এমন হতে পারে তাই ও আমার সাথে ডিল করে। যদি এমন হয় তবে আমি বিনিময়ে ওকে কি দিবো?
বলতে কোনো বাধা নেই যে ও টাকার জন্য কতটা লোভী একজন মানুষ। এজন্যই সে আমার সাথে ডিল করে লাখ পাঁচেক টাকার। এর বিনিময়ে ওদের সব প্ল্যান সম্পর্কে আমাকে জানাবে।”
“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না দাদাভাই।”
“হয়তো তোর কাছে ছিল না।কিন্তু আমার কাছে ছিল।না হলে এই সময় তুই ওর ঘরের বৌ থাকতি।”
“আইন বলতে কিছুই নেই?”
“গ্রামে কিসের আইন দেখাতি তুই? বুদ্ধি দিয়ে চলতে হয় এখানে। তোর আপন জন যখন শত্রু তখন তারা অবশ্যই জানবে তোর আঘাতের স্থান।তারা নরম জায়গায় আঘাত করতে চেয়েছিল।কতটা সফল হয়েছে সেটাও জানিস তুই।”
“তাই বলে টাকা দিয়ে দিলে?”
“টাকা আসবে যাবে কিন্তু তোর আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে তোকে হারিয়ে ফেলতে হতো।”
জোহরের আজানের শব্দ ভেসে আসছে। এখন আর তাদের ঘরে বসে থাকা যাবে না।কারণ নামাজের পরেই মানুষ খেতে চলে আসবে। একে একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও ইউভান পুনরায় ফিরে এলো।ফিরে এসে জাফরিনের মাথায় হাত রেখে বলল,
“তুই যতটা সহজ মনে করছিস জীবনটা এত সহজ নয়।প্রতিটি পদক্ষেপে এখানে লুকিয়ে থাকে বিশ্বাস ঘাতকতা। একটু স্বার্থপর না হলে যে সমাজে টিকে থাকাটা বড়ই কঠিন। মাঝে মধ্যে নিজের জেদ বা সম্মানের বাইরেও বেরিয়ে আসতে হয় কেবল মাত্র নিজেদের নিরাপত্তার জন্য।”
(৩১)
মাশহুদ গত তিন দিন যাবত রয়েছে তার দাদার বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে তার মোটেও ধারনা ছিল না।যেখানে তারা এত সুখে দিন পার করছে সেখানে এই দেশেই দুর্বিষহ দিন পার করছে তাদের পরিবারের একটা অংশ।এখানে এসে তাদের খোজ করতেই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল জীর্ণ
শীর্ণ একটি বাড়ি।বাড়ির সামনেত দেয়ালের রঙটা খসে পড়েছে অনেক আগেই। ভিতর বাড়িতে যখন খবর দেওয়া হলো যে বিদেশ থেকে লোক এসেছে তখন লাঠি ভর করে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসেছেন সবার আগে। তার গায়ে সাদা রঙের শাড়ি।এই শাড়ি মাশহুদ চিনে। জাফরিনের মায়ের গায়ে এমন শাড়ি দেখেছে আজ সে।যতটা তাদের ভাষা থেকে বুঝেছে এটাই দাঁড়ায় যে এমন শাড়ি বিধবা নারী পরেন।
তাকে সালাম দিয়ে পরিচয় দেওয়া হলো যে সে ওমুকের নাতি।ভদ্র মহিলা চোখের চশমাটা ভালো করে মুছে আবার পড়লেন।বয়সের ভাড়ে তার দু চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
দোভাষী লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন কে সে?
পুনরায় জবাব পেলেন মাসুদ সাহেবের নাতী।
ভদ্রমহিলা এবার জিজ্ঞেস করলেন মাসুদ সাহেব জীবিত আছেন কি না?
ঠিক সে সময় গেট খুলে ভিতরে এলেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক।পঞ্চাশের কোঠা ছাড়িয়েছেন তিনি।আসার পর বৃদ্ধা লোকটাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললেন,
“মারুফরে এটা কি কয়? এই ছেলে না কি তোর বাপের নাতী।এত বছর পর তারা কি কয়?”
মাশহুদ অল্প স্বল্প ভাষা যা বুঝে তাতেই সে বুঝতে পারলো এখানে লুকিয়ে আছে তার পরিবারের আরেক অতীত।আর এই ভদ্রমহিলা তার দাদার প্রথম স্ত্রী সুরমা। এই রমনীকেই তার দাদা নদীর সাথে তুলনা করে এবং বলে অতীত জীবন তো সুরমা নদীর মতন।
তাদের সাথে কথা বলার পর সে জানিতে পারলো আজ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পূর্বে তার দাদা এই দেশ ছেড়ে চলে যায়। আর কখনো আসেনি। তখন মাঝে মধ্যে দুই একটা চিঠি দিতো কিন্তু এর পর সেটাও দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সবাই ভেবেছিল সে মারা গেছে এবং এই বৃদ্ধ মহিলা নিজেই একা হাতে মানুষ করে তার ছেলেকে।
সবটা শুনে মাশহুদ তাদের আশ্বস্ত করলো তাদের সব কিছুর দায়িত্ব এবার থেকে তার। খুব দ্রুতই তারা তার সাথেই যাবে তখন না হয় মুখোমুখি হয়েই মাসুদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে কেন এসব লুকোচুরি?
(৩২)
ভালবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।
ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছে পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।
কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।
নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।
তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর কবিতাটা আবৃতি করে চলেছে কেউ একজন। মেয়েটার নাম জানা নেই মাশহুদের। শুধু সে জানে মেয়েটা সম্পর্কে তার চাচাতো বোন হয় এবং সে খুব ভালো রান্না জানে।
ল্যাপটপে বসে মেইল চেক করছিল সে। কবিতাটা শুনেই তার মনে হলো সেই মেয়েটার কথা।যাকে দেখলেই বুকের মাঝে পূর্ণ অনুভব হচ্ছে তার। ফোনের স্ক্রীন লক খুলে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল মাশহুদ।আচমকা তার কেমন তৃষ্ণা পাচ্ছিলো।অধর জোড়া যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
এমিলিকে কল দিয়ে তার গাড়ি বের করতে বলল সে। গুগল ম্যাপের সাহায্যে গ্রামের মেঠো পথ ছাড়িয়ে যখন জাফরিনের বাড়িতে পৌঁছেছে তখন রাত নটা বাজে।
তাদের বাড়ি দেখা যায় এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে কল দিলো জাফরিনকে।কিন্তু কি বলবে সে?
অপর দিকে কল বার কয়েক রিং হওয়ার পর রিসিভ করেছে জাফরিন।কিন্তু হ্যালো আর বলা হলো না। মাশহুদের চোখের সামনেই হুট করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন।আর বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো দম বন্ধ করা আর্তনাদ।
চলবে
( কোভিড ধকল কাটানোর পর সব কিছুই অস্বস্তিতে ভরে গেছে। যেমন বিরক্ত থাকছি মানসিক দিক দিয়ে তেমনি ইদানীং চোখেও কম দেখছি।
যারা গল্প পড়েন তারা দয়া করে রেসপন্স করবেন।কারণ আপনারা রেসপন্স করলেই অনেকেই জানতে পারবে গল্পটা আবার এসেছে।)