#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৩
(৩৩)
ফোনকল রিসিভ করে নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জাফরিন।আজ পুরো দিন বাসায় অনেক মানুষ ছিল।চারিদিকে এখনো খাবারের গন্ধ। এঁটো খাবার গুলো যেখানে ফেলা হয়েছে সেখানে কুকুদের একটা দল ঝগড়া বাধিয়েছে। কেউ একজন লাঠি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তাদের মারতে। জাফরিন না করেছে। তাদের খেতে দিতে বলেছে সে। প্রতিটি প্রাণীর রিজিক নির্দিষ্ট থাকে। তাদের এখানে রিজিক আছে বলেই এসেছে।
বুড়ো লোকটা জাফিরিনের কথায় নিজের মুখটা বিক্রিত করলো।মনে মনে বিচ্ছিরি রকমের গালি দিয়ে সে মনে মনে বলল,
” বাপ মরছে কয়দিন তো, তাই এত আল্লাহ আল্লাহ করতাছোস, কুত্তার প্রতিও দরদ দেখাইতাছোস। যৌবনে যখন টান দিব তখন কুত্তার প্রতিও মায়া ফুরাবো।”
জাফরিন বুঝতে পারলো লোকটা তার কথাতে নারাজ। সেখান থেকে চলে এলো সে। কারণ কল কেটে গেছে।ঘরের বারান্দাতে আসতেই তার ফুপুর সাথে দেখা হলো।সে একটা বিচার নিয়ে এসেছে। আজ এত মানুষ খেয়েছে অথচ তার বড় মেয়ের জামাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের শালার বন্ধু এক টুকরো হাড়ের মাংস দিতে বলেছিল। কেন দেওয়া হয়নি তাকে?এই নিয়ে তার মেয়ের জামাই ভীষণ রাগ করেছেন। সে এখনো খায় নি।এত এত মানুষের সামনে তার মেয়ের জামাই ছোটো হলো না?
যদি অপমান করার ইচ্ছাই থাকে তবে কেন দাওয়াত করে আনা হয়েছে।
ফুপুর কথা শুনে তিন বোন বেশ কাতর চোখে তাকিয়ে রইল।তিন বোনের চোখেই পানি ছলছল করে উঠছে। নিশ্চয়ই তাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে বাবার বলা সেই কথাগুলো।
বছর দুয়েক পূর্বে তাদের বাবা যখন ছুটিতে এসেছিলেন তখন তার বোন ভাগ্নিদের সমেত সবাইকে দাওয়াত করে আনেন। কোরবানির ঈদে তাদের ভাগে পাওয়া সম্পূর্ণ মাংস চড়িয়ে দেওয়া হয় বড় বড় পাতিলে।ঈদের পর দিন থেকেই চলে অতিথি আপ্যায়ন। তখন সবাই কতই না সম্মান করতো জাফরিনদের। এই ফুপু চাচারাই তাদের মা ছাড়া কথা বলতেন না।
ফুপুরা আসার সময় কত কিছু নিয়ে আসতেন।কারোর বাড়ির গাছের আম বা কারোর বাড়ির নারিকেল।নিজ হাতে বানানো পিঠা কিংবা নানার ধরনের খাবার।
দাওয়াতের পর যখন সবাই যার যার মতন চলে গিয়েছিল তখন জাফরিনের বেশ মন খারাপ হয়েছিল। বাবার পাশে বসে বলেছিল,
“আব্বা আর দুই দিন ওদের থাকতে বলতেন।সবাই কত ভালো।”
বড় দুই বোন সায় দিয়েছিল কিন্তু আজমল সাহেব তিন মেয়েকে কাছে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিলেন তার পাশে।
হাসতে হাসতে বলেছিলেন,
“তোমাদের তিন বোনের দরদ তত দিন যত দিন আমি জীবিত আছি। আমার মৃত্যুর পর দেখতে পারবা দিন দুনিয়া কতটা কষ্টের। এই আত্মার আত্মীয়রা কতটা ভালো।
আরে মা এরা তো ওমন করবে যে আমার চল্লিশার দাওয়াতে এসে বলবে ওমুকে খায়নি তমুকে হাড্ডি খায় না তাকে হাড্ডি কেন দিলো কিংবা আমি দ্বিতীয় বার দই চাইলাম দিলো না।”
কন্যাত্রয়ী একে অপরের দিকে তাকালো।এখন অবধি তাদের খাওয়া হয়নি।তারা জানেও না কি হচ্ছে অপর দিকে। পুরো দিন বিভিন্ন মানুষ এসেছে তাদের স্বান্তনার বাণী শুনিয়েছেন তারা মাথা নিচু করে শুনেছে। অথচ কেউ তো জিজ্ঞেস করলো না তারা খেয়েছে কি না।বাড়ির গেটের দিকের ঘরটায় দই পাতা হয়েছে। মণ দুই দুধ কিনে এনে নিজ হাতে পাতা দই।দই যাতে দ্রুত হয় এজন্য খড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল।ফুপুর অনুরোধে বড় আপা গিয়ে তার সেই দুলাভাইয়ের হাতে ধরে অন্যের পক্ষ হয়ে মাফ চাইলেন। জাফরিন বিষয় টা নিতে পারবে না বলেই মেঝ আপা তাকে কিছু জানায়নি।তারা দুই বোন আপাতত কোনো ঝামেলা বা কথা চায় না। এইটুক না করলে তার ফুপুও খাবে না অপর দিকে কথার পর কথা সৃষ্টি হবেই।ইউভান পাশে বসিয়ে জাফরিনের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলো। সেই মুহুর্তে তার ফোনে কল এলে জনসমাগম এড়াতে সে কিছুটা দূরে চলে যায়।
সবাই খাবার টেবিলে বসার পর একজন কে পাঠানো হলো দই আনতে। সে দই নিয়ে ফিরে আসার মিনিট দশেক পরেই ঘরে জ্বলে উঠলো আগুন।
পুরো টিনের ঘরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে ভিতর থেকে।বিকট শব্দ হলো ঘরে। সাথে সাথে পুরো বাড়ির বিদ্যুৎ চলে গেল।আগুনের প্রকোপ থেকে মোটামুটি কেউ টিকতে পারলো না।সব থেকে বেশি আহত হলো জাফরিন। সে দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের পাশটাতেই। আগুনের তাপে গায়ে থাকা জরজটের ওড়না পুড়ে তার হাতের চামড়ার সাথে লেগে গিয়েছিল। সে না বুঝেই হাত থেকে কাপড় সরানোর চেষ্টা করলে তার বা হাতের কনুইয়ের দিকের চামড়াটা বেশ খানি উঠে এলো।
নিজের আঘাতে ক্লান্ত জাফরিন এক পাশে পড়ে গোঙাতে লাগলো।ততক্ষণে হৈচৈ শুরু হয়েছে।বাড়ির পাশে থাকা বালি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা চলছিল।আশার বাবা সেদিক দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো জাফরিন এক পাশে পড়ে আছে। কিন্তু ব্যাথায় কাহিল সে। কাউকে ডাক দিতে গিয়েও সে দিলো না। নিজ হাতেও তাকে ডাকলো না।এই মেয়ের প্রতি তার অনেক দিনের রাগ জমে আছে। এই রাগকে সে দমন করতে পারছে না। তার অবচেতন মন বার বার তাকে একটা আদেশ দিয়ে চলেছে। সে দুই মন দুই দশায় পড়ে রইল
।আর তার সম্মুখে ব্যথায় কাতর জাফরিন।
নিজের চোখের সামনে আগুন দেখে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মাশহুদ। এক সময় নিজ চোখের সামনে মানুষের শিরচ্ছেদ দেখেছে সে।মৃত্যুকে খুব কম ভয়। ওসবের তুলনায় সামান্যতম আগুন দেখে ভিতর ভিতর বেশ অস্থির হয়ে গেল সে। তার মনকে স্থির করতে পারলো না।সে এক বার ভাবছিল তার ভিতরে যাওয়া উচিৎ কিন্তু সে তেমন আঞ্চলিক বাংলা বুঝে না কাকে কি বলবে যদি তাকে কেউ চিনে ফেলে। আবার মনে হচ্ছে এই সময় তার ভিতরে যাওয়া উচিৎ।
অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো এক অস্থিরতা তাকে গ্রাস করে নিলো।মুহুর্তেই সম্ভিৎ ফিরে পেল সে। নেট ঘেটে নাম্বার বের করে কল দিলো ফায়ার সার্ভিসে।
পাঁচ মিনিট পার হলেও যখন আগুন খুব একটা আয়ত্তে এলো না তখন আর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।দ্রুত পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। গেটের কাছাকাছি যেতেই এমিলি পিছন থেকে ডাক দিলো তাকে। সাথে রয়েছে আরো কয়েক জন।
এমিলি বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো মাশহুদকে।
কিছুটা দূরে এসে তাকে অনুনয়ের সুরে বলল,
“স্যার আমাকে ভুল বুঝবেন না কিন্তু এভাবে আপনার ও বাড়িতে যাওয়া উচিত হবে না।আমরা যে কাজের জন্য এসেছি এটাতেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।উনাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ব্যাপারে আমাদের হস্তক্ষেপ উচিৎ হবে না।”
এমিলির কথায় তার বেশ রাগ হলো।সে রেগে তাকে কিছু কথা শোনাতে চাচ্ছিলো কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো এমিলির কথাটা ঠিক আছে। এখন রাত বেশ ভালো হয়েছে। এই মুহুর্তে সে বা তারা যদি বাড়ির ভিতরে যায় তবে সবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। হাতের মুঠ শক্ত করে সে দাঁড়িয়ে রইল দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে।
কিছু সময় পরও যখন দমকল বাহিনী এলো না তখন আর সে অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।
পুরো বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকার কারণে কে কোথায় আছে সেটা কেউ বুঝতে পারছিল না। শুধু মাত্র বাচ্চাদেরকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাফরিনের খবর তখনো কেউ নেয়নি।কিছু সময় পর আশার বাবা ফিরে এলো গেটের দিকটায়। ওদিকে থাকা জিনিসপত্রে তখব দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন।জাফরিনকে সেখানেই পড়ে থাকতে দেখে সে এবার আর পিছপা হলো না।সে এবার প্রায় জ্ঞানহীন জাফরিনকে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল জ্বলন্ত আগুনের দিকে।
অন্তত এই মুখটা কমলে কথা বলার বা প্রতিবাদ করার মুখ থাকবে না।এই এক আগুনে না হয় কিছুটা লাভ হোক।
চলবে(এডিট ছাড়া, যারা গল্প পড়েন অনুরোধ করে রেসপন্স করবেন। কারণ কিছু পাঠক বেশধারী লোক কেন জানি না রিপোর্ট করছে।তাই রেসপন্স করবেন।)