ক্যামেলিয়া পর্ব-১৪

0
3925

#ক্যামেলিয়া
#পর্ব-১৪
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৩৪)

মানুষ পোড়ার এতটা বাজে গন্ধ হতে পারে জানা ছিল না গাড়িতে উপস্থিত থাকা কারোর।মেয়েটা এখনো ব্যথায় কাতর। ঝাপটে ধরে আছে এমিলির হাত। মাশহুদ ড্রাইভারকে দ্রুত নিকটস্থ কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল।যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তারা শহরের দিকে যাবে।
এ দেশীয় যে লোকটা তাদের সব দায়িত্ব পালন করছে সে জানালো সদর হাসপাতালে নিতে। ওখানে ডাক্তার পাওয়া যাবে। কিন্তু ওটা তো উল্টো পথে।
মাশহুদ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বলল গাড়ি ঘুরাতে৷
জাফরিনদের বাড়ি পার হওয়ার সময় খেয়াল করলো আগুন নিভেছে। দমকল বাহিনী এসেছে তবে হয়তো তারা এখনো জানে না যে জাফরিন নিখোঁজ। বাড়ির চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছিল।তাদেরকে পাশ কাটিয়েই শা শা করে এগিয়ে গেল তাদের গাড়ি।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলো। ডাক্তার জানালেন রোগীর শারীরিক দুর্বলতা রয়েছে। তার পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রামের প্রয়োজন কিন্তু তার হাতে বেশ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।
এ ক্ষতটা তাকে ভোগাবে। কনুইয়ের নিচ থেকে কবজি অবধি জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে ক্ষত। ভিক্টিমের গায়ে থাকা লিলেনের কামিজের জন্য তার হাতে দ্রুত আগুন লেগে যায়।সে হয়তো আগুন নেভানো বা ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে হাত পরিষ্কার করেছিল।যার কারণে কাপড় চামড়ায় বসে যায় এবং চামড়া সমেত উঠে এসেছে। মাশহুদের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। সে ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

” নিজ থেকে ভালো হবে?”

“উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন।”

” আপনি প্রাথমিক চিকিৎসা দিন।আমরা কিছুক্ষণ পর শহরে ট্রান্সফার করতে চাচ্ছি।”

“আপনাদের ইচ্ছে। তবে আশা করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।”

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর এমিলি এগিয়ে এলো মাশহুদের দিকে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,

“স্যার, মিস শিকদারের জ্ঞান ফিরেছে। সে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।”
“উনি উনার হাতের দাগ দেখেছেন?
হাতের দাগ তো থেকে যাবে।প্লাস্টিকের সার্জারী করালে কি ঠিক হবে?”

“স্যার উনার প্রতি আপনার এত চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

“নেই?তুমি জানো?এই মেয়ের কিছু হলে আমি বা আমার কিছুই থাকবে না।শী ইজ আ প্রফেটেবল প্রজেক্ট ফর মি।যে কোনো মূল্যেই তাকে আমার সুস্থ সবল চাই। উনার সকল কাগজ পত্র রেডি করে ফেল।উনার ফ্যামিলিকে খবর পাঠাও উনি এখানে আছে। এবং খুব দ্রুত যেন সে তার বাবার কর্মস্থলে ফিরে যায়।”

” স্যার, মিস শিকদারের এতটা এএকাডেমিক যোগ্যতা নেই যে সে আমাদের অফিসে জব করবে।”

“আমি বলিনি সে আমাদের সাথেই কাজ করবে। তার লেখাপড়ার জন্যই সে যাবে। বাই দি ওয়ে, তোমাকে বেতন দিয়ে নিশ্চয়ই আমি মুখে মুখে তর্ক করার জন্য রাখিনি।তোমার কাজ আমার সকল কথা অনুসারে কাজ করার। নিজের স্থান ভুলে না যাওয়ার কথাটা মনে রেখো।”

মাশহুদের কথায় হারিকেনের শেষ সলতের মতোন দপ করে নিভে গেল এমিলি।এই ব্যক্তিটা আর যাই বুঝুক মন বুঝে না।যদি বুঝতে পারতো তাহলে আজ এভাবে বলতো না।মাথা নিচু করে সে বলল,

“সরি স্যার। আমি খেয়াল রাখবো।আপনি কি যাবেন মিস শিকদারের সাথে কথা বলতে?”

মাশহুদ তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে।
গাড়ির কাছে এসে সিগারেট ধরিয়ে বেশ কিছু সময় বসে রইল সে। আপাতত তার কিছুটা স্বস্তি হচ্ছে।

দমকল বাহিনীকে কল দিয়ে তারা চলেই যাচ্ছিলো কিন্তু তখন তাদের মাঝে থাকা একজনের দৃষ্টিতে পড়ে কেউ একজন একটা মেয়েকে আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পায়ে সে ওদিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় যে লোক আগুনের কাছাকাছি টেনে নিচ্ছিলো সে দৌড়ে পালাচ্ছে।এরপর সে জাফরিনের চেহারা দেখতে পায়।বাড়িতে তখন বেশ হট্টগোল। এত কিছুর মাঝেই সেই ভদ্রলোক মেয়েটাকে পাঁজা কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। মাশহুদ সমেত বাকীরা তাদের দেখে দৌড়ে গিয়ে উদ্ধার করে দুজনকে।

ফোন বের করে মাশহুদ কল দিলো তার বন্ধু কুঞ্জকে। এখানে আসার পর গত কয়েক দিনেই বেশ কিছু সত্যের মুখোমুখি হয়েছে সে।
প্রথমত তার দাদাভাইয়ের এখানে আরো একটি পরিবার রয়েছে। স্ত্রী সন্তান রয়েছে। যারা খুব কষ্টে দিন পার করছে।বছর তিনেক পূর্বে বড় তার বাড়ির বড় ছেলে বাড়ি বন্ধক রেখে লাখ ত্রিশ এর মতোন টাকা নিয়ে চলে গেছে কোথাও।
ধার দেনা এবং ফসলি জমি বিক্রি করে অনেকটা ঋণ শোধ করলেও তারা এখনো বেশ বিপদে রয়েছে। এখনো দশ লাখ টাকা ঋণ, শুধু তাই নয় মেয়ের বিয়ের দায় কিংবা বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা সব মিলিয়ে তার দাদার বড় ছেলে বেশ বিপদের মধ্যে রয়েছে সে বুঝতে পারে। গত কাল রাতেও পাওনাদার এসেছিল। তাদের বেশ কড়া ভাষায় কথা শুনিয়েছেন। মাশহুদ তাদের ঋণ শোধ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বৃদ্ধ রাজি হয় নি।যে বাবা তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনি, জন্মের পর থেকেই তার বাবা ডাকটা কেড়ে নিয়েছে সে লোকের টাকা কোন মুখে নিবে?

মাশহুদ তাদের সাথে খুব একটা কথা বলতে পারেনি।ভাষাগত সমস্যার কারণে, কিন্তু ভেবেছিল আজ বলবে অথচ তাও হলো না।

কল রিসিভ করে কুঞ্জ বলল,

” প্রেমিক পুরুষ কি খবর?মমতাজকে নিয়ে ফিরবি কবে?”

“এখানে সমস্যা হচ্ছে।”

সবটা বলার পর কুঞ্জ বলল,

“তবে তো ওদের পরিবারের সবাই নিরাপত্তাহীনতায় আছে।”

“হ্যাঁ,এবার কি করা যায়?”

“শোন তুই ওদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিস না।এতে তোর মোটিভটা সামনে না এলেও হয়তো কেউ ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না।তাছাড়া যা বলেছিস, ওর ফ্যামিলিও খুব একটা ভালো না।”

“আমি চাচ্ছি আমরা পূর্বের প্ল্যান মতোই এগিয়ে যাবো।”

“বেশ তবে তাই হোক।ফিরে আয় তবে আগামীকাল।”

“দিন দুয়েক দেরি হবে। একটা কাজ করতে পারবি আমার জন্য?”

“বলে ফেল।”

“একটা ফ্ল্যাট রেডি করতে হবে।চারজনের জন্য।এটা মাথায় রাখবি বাবা বা দাদা যেন না জানে।এমনকি আমার পরিবারের কেউ নয়।”

“বিয়ে করে বৌ নিয়ে ফিরছিস না কী?”

“ধরে নে তাই।”

(৩৫)

কিছু সময় পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে একে অপরের খোঁজ নিচ্ছিলো।আগুন লেগেছিল খড়ের গাদায় থেকে।রান্নার জন্য আনা বেঁচে পাঠ খড়ি দাঁড় করানো ছিল ঘরের ভিতরে কারেন্টের লাইনের পাশে।প্রথমে খড়ের গাদায় আগুন, ধীরেধীরে পাঠ খড়ি এরপর বিদ্যুৎতের লাইনে গেলে মোটামুটি বিস্ফোরণ ঘটেছে।
ইউভানের বাবার হুট করে মনে হলো তিনি দেখেছিলেন কাউকে সিগারেট হাতে ঘরে যেতে। তার অসাবধানতার কারণেই আজ এত বড় বিপদ এসেছে। কিন্তু জাফরিন যে তাদের সাথে নেই এটা তখনো কেউ খেয়াল করেনি।জাফরিনের মায়ের নাম্বারে কল এলে টনক নড়লো সবার।ইউভানকে নিয়ে দুই দুলাভাই এগিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে তখন কান্নার দমক আরো একবার বেড়ে গেল।একে তো বাড়ির মেয়ে হাসপাতালে, তাদের মনে প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো কে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল,কিংবা কখন নিয়ে গেল?কি হয়েছে মেয়েটার?
যে কল দিয়েছিল সে জানিয়েছে মেয়েটা অজ্ঞান অবস্থায় আছে।
হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করতেই ইউভানদের জানানো হলো যে রোগীকে ইমারজেন্সী থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। জাফরিন তখন দু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কেবিনে সবার পূর্বে প্রবেশ করলেন বড় দুলাভাই। সবার মতেই তিনি একজন বুদ্ধিমান মানুষ যে সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে জানে কিন্তু তিনি নিজেও মেয়েটার হাত দেখে চমকে উঠেছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে জাফরিন তাকিয়ে দেখতে পেল তার ভাইয়েরা এসেছে।
তাদের সাথে এমিলি কিছু সময় পর দেখা করলো।তাদের সাথে এমিলির কি কথা হলো জাফরিন জানে না।
কিছু সময় পর ইউভান এগিয়ে এসে জাফরিনকে বলল,

“তুমি কী দেখেছিলে কে তোমাকে টেনে আগুনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো?”

জাফরিন নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলল,

“দেখেছি দাদাভাই।কিন্তু কী লাভ? সে যে আমার আপন রক্ত।আমার নিজের চাচা।”

চলবে,

(যারা গল্প পড়েন তারা অনুরোধ ক্রমে রেসপন্স করবেন।আমি চেষ্টা করেও নিয়মিত হতে পারছি না।আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here