ক্যামেলিয়া পর্ব-১৯

0
4103

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৯

সূচনার বাবা-মা জাফরিনের বিরুদ্ধে দেওয়া স্টেটমেন্ট তুলে নিয়েছে এটা শুনে একদফা বিরক্ত হলেন বড় আপার শাশুড়ি। তিনি ইচ্ছে করে সেদিন বার বার ছোটো ছেলের সাথে জাফরিনের নামটা নিয়েছেন। যেন হুট করে কোনো ব্যক্তি শুনে এটাই ধারণা করতে বাধ্য হয় যে জাফরিনের সাথে সূচনার স্বামীর অনৈতিক সম্পর্ক ছিল।যেটা সহ্য না করতে পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে।যেহেতু জাফরিনের আগেও বিয়ে ভেঙেছে তাই মানুষকে এটা বিশ্বাস করানো সব থেকে বেশি সহজ ছিল।এমনটা হয়েও ছিল কিন্তু নিজ বড় ছেলের কারণে আজ ছোটো ভাইয়ের ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে গেল।সে তো নিজেরটা ভালোই বুঝে নিয়েছে। লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি পেয়েছে শ্বশুর বাড়ি থেকে।কিন্তু যেই ছোটো ভাইটা একটু সুখের মুখ দেখবে তখন বড় ভাই নিজের আপন ভাইয়ের শত্রু হয়ে গেল। ছোটো ভাই যদি টাকা পয়সার সঠিক ব্যবহার করে তার থেকে বেশি টাকার মালিক হয়, এই কারণেই সে নিজের শালিকে তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিলো না বলে তীব্র ধারণা নিয়ে বসে আছেন বড় আপার একমাত্র শাশুড়ি। জাফরিনের অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে সেটা তিনি জানতে পারেন বেলা দশটার দিকে।কিন্তু তার মাথায় বাঁজ পড়লো সেই সময় যখন তিনি জানতে পারলেন,
যদি তারা লিখিত না দিতো তাহলে জাফরিন বিদেশ যেতে পারতো না,যতদিন না কেস চলতো।এমনটা শুনে তার জ্ঞান যায় যায় অবস্থা হয়ে গেল।এতক্ষণে তো সবাই বেরিয়েও গেছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ছোটো ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না আটকে রাখতে পারলো না সে। আঁচলে মুখ ডেকে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো তার জনম দুঃখী ছেলের জন্য।বড় আপা তার জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে যেতেই সেগুলো নিয়ে যেতে বলল।তাকে আরো কড়া ভাবে হুমকি দিয়ে বলল,

“আমার সংসারের তুমি এতবড় ক্ষতি করবা জানলে কোনো দিন তোমারে এই সংসারে আমি আনতাম না।তুমি আমার ঘরের ধারে কাছে আসবে না।যদি আসো তাহলে আমি গলায় দড়ি দিমু।”

(৪৫)
গ্রামবাসী প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে আজ মাশহুদের সাথে মাষ্টারের মেয়ের বিয়ের জন্য।কেউ কেউ ঝামেলায় জড়াতে চায় নি,কারণ তারা দেখেছে ওই বাড়ির সামনে যে কয়জন কালো পোশাকধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে নিয়মিত পুলিশ যোগাযোগ রাখছে।তাছাড়া ছেলেটাকে দেখেও মনে হয় না যে সে এত সহজে সবার কথা মেনে নিয়ে বিয়ে করবে।এই মাষ্টারের উপকার করতে গিয়ে শেষ মেষ বিপদে পড়বে না কি?এর চেয়ে ভালো দূর থেকে তামাশা দেখবে, আর যদি সত্যি লাভবান হওয়া যায় তবে শেষ সময়ে গিয়ে দাঁড়াবে তাদের কাছে।দলের নেতা বার বার সবাইকে বুঝিয়ে সে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। কাকে কী বলতে হবে,কে কী করবে।তারা সবাই যখন বাড়িতে প্রবেশ করল তখন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাষ্টার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

“আরে আপনারা সবাই?কোনো প্রয়োজনে?”
“প্রয়োজন তো অনেক মাষ্টার। কিন্তু কথা হইলো তোমার বাড়িতে এক যুবক পোলা দেখি,সে কে?”

দীর্ঘ শ্বাস ফেলার ভঙ্গিতে মাষ্টার বললেন,

“সে তো পরিচয় দিতেছে আমার বাবার নাতী হিসেবে।মানে আমার বাপে না কী বিদেশে আরেকটা বিয়ে করেছে, সেখানের ঘরে যে ছেলে হইছে তার ছেলে।”

“কোন বিদেশি মানুষ কি কইলো আর বিশ্বাস করে নিছো?মাষ্টার তোমারে বুদ্ধিমান জানতাম।তুমি এতবড় একটা ভুল কেমনে করলা?আর এই ছেলেরে তুমি বাড়িতে থাকতে দিছো যখন ঘরে তোমার যুবতি মেয়ে আছে। না এটা মেনে নেওয়া যায় না।”

“ভাই আপনাগো পায়ে ধরি,আমার মেয়েরে এমন অপবাদ দিয়েন না।ওর বিয়ে শাদী হবে না।আর আমরা তো ওই ছেলের সাথে বিদেশ যাইতেছি।”

“বিদেশ যাইতেছো যাও। আমাগোর কোনো আপত্তি নাই।কিন্তু এই ভাবে অবিবাহিত মেয়েকে সাথে নিয়ে ওই ছেলের সাথে যাবা, এটা তে আমাগোর আপত্তি আছে।কী বলো সবাই?”

ভিতর বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে।এমন কথা শুনে চিন্তার ভাঁজ পড়ল বাড়ির গিন্নির কপালে।মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,

“আপনারা কী বলতে চাইতেছেন?”

“ভাবী সাব আমরা চাইতেছি ওই পোলায় যেহেতু আপনাদের নিয়ে বিদেশ যাইতেই চাইছে তাহলে ক্যান আপনার মেয়ে সুচিত্রা কে বিয়ে করেই নিয়ে যাক।আমরা গ্রামবাসীরাও একটু শান্তি পাব আর পাঁচ গ্রামের মানুষ কিছু বলার আগে ভেবে-চিন্তে বলবে।আরে কে আছিস যা ওই ছেলেরে ডাক দিয়ে নিয়ে আয়।”

কথপোকথন সবটাই বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো এমিলি।নিজের গায়ে শাল জড়িয়ে সে বেরিয়ে এলো মাশহুদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর থেকে।এ সময়টুক সে ছিল মাশহুদের স্পর্শের সাথে।যে মেয়েটা তার সাথে ছায়ার মতোন থাকে কিন্তু তাকে স্পর্শ অবধি করতে পারে না সেই মেয়ের মনের ভিতরের অস্থিরতা অন্য কোনো মানুষ আন্দাজ করতে পারে না।গতকাল রাতেই মাশহুদ বেরিয়ে গেছে এই বাড়ি থেকে।তার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন পুরো পরিবার নিয়ে যথাযথ সময়ে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করার।মাশহুদের মনে হচ্ছিলো জাফরিন নামক মেয়েটা আবারো কোনো বিপদে পড়বে। এ সময়টা তার কাছেই থাকাটা শ্রেয়।যে অবধি তাকে নিয়ে স্পেনের মাটিতে না নামছে সে অবধি দ্বিতীয় কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না।এমিলি এসে দাঁড়াতেই একদল ফিনফিনে বাতাস এসে লাগল তার গায়ে।মন খারাপ তীব্র হলো।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ চক্রান্ত করে বসেছে মাশহুদের বিপক্ষে?জোড়ে শ্বাস টেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় এমিলি।
এরপর আধো ভাঙ্গা বাংলা ভাষায় বলল,

“দুঃখিত, আপনারা স্যারকে পাবেন না।ইতিমধ্যে স্যার বেরিয়ে গেছেন এবং আমাকে বলে গেছেন আমিও যেন খুব দ্রুত আপনাদের নিয়ে রওনা হই।তাই আপনাদের অনুরোধ করবো ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যে তৈরী হয়ে আমাকে জানাতে।”

গ্রামবাসী অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মাষ্টারের মুখের দিকে।তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন নিজ গন্তব্যে।

(৪৬)

মায়ের বুক থেকে জাফরিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে। মেয়েটা আজ মায়ের থেকেও আলাদা হয়ে যাচ্ছে।ভেবেছিল যত রাগ থাকুক না কেন আজ বড় আপা আসবেন, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে,

“যাই হয়েছে থাক, মন খারাপ করিস না৷ আমি তোর ভালো চাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকুক এটাও আমি চাই না।ভালো ভাবে থাকিস বোন।”

কিন্তু এমন কোনো কিছুই হলো না, আপা এলেন না তার সাথে দেখা করতে। দুলাভাই এসে জানালেন যে তার আপা আসার সময় তার জন্য আচার পাঠিয়েছেন।কিন্তু জাফরিন জানে আপা এটা পাঠায়নি, দুলাভাই নিজ থেকেই নিয়ে এসেছেন। এটা নিয়েও তাদের দুজনের মাঝে তর্ক হয়েছে।মেঝ আপা তাকে নতুন একজোড়া দুল দিয়ে বললেন,

“শোনো বোন,পরদেশ তো আমরা জানি না মানুষ কেমন কী হবে। তুমি সাবধানে থাকবে।অন্য দেশের কালচারের সাথে আমাদের কালচার মিলবে না।আর সব থেকে বড় কথা নিজের সম্মান নিজেকে বজায় রাখতে হবে।”

একে একে সবার থেকে বিদায় নেওয়ার পর জাফরিন এগিয়ে গেল ইউভানের দিকে।ইউভান দুহাতে তাকে আগলে নিলো।বুকটা আজ তার ভীষণ খালি হয়ে যাবে।তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“সুযোগ পেলেই আমি যাবো তোর সাথে দেখা করতে। ওখানে আমার এক বন্ধু আছে।আমি তাকে জানিয়েছি, যে কোনো বিপদে তুই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবি।আর হ্যাঁ ওখানে পৌঁছাতেই তুই প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র পেয়ে যাবি।সাবধানে থাকবি।”

সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো জাফরিন।স্পেশাল পারমিশনে ফ্লাইট ফ্লাই করার আগ অবধি তার সাথে থাকবে ইউভান।ওয়েটিং সিটে বসে জাফরিনের দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে সে বলল,
“ভয় পাসনে।আমি জানি তুই কীসের জন্য যাচ্ছিস।তোর ইচ্ছে এবং কাজ সফল ভাবে হোক এটাই কাম্য।”
“বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।আমার তার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট চাই।তুমি কি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?”
“এটা নির্ভর করবে কোম্পানির লোকের উপর। যদি তারা ডাক্তারকেই সরিয়ে দেয় বা ডাক্তার নিজেই তাদের মদদ দেয় তাহলে সম্ভব নয়।”
“আমি সবটা জেনেই ফিরবো।আর না ফিরলে তুমি তো জানোই তোমাকে কী করতে হবে।”
“হাতের যত্ন নিস। এখানে ইনফেকশন হতে দিস না কিন্তু।”

কথাগুলো শেষ করেই শক্ত হাতে জড়িয়ে নিলো তার বোনের হাত। দূর থেকে বসে সবটা দেখে ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাশহুদ।প্রিয় বস্তটার আশেপাশে কাউকে সহ্য না করার এক অসহনীয় অনুভূতি হচ্ছে তার। সে কি সত্যি এই মেয়েটার প্রেমে পড়েছে?

চলবে(এডিট ছাড়া।যারা গল্প পড়েন তাদের রেসপন্স করার অনুরোধ রইল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here