ক্যামেলিয়া পর্ব-৪

0
5132

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৪

(১০)

ঈশানের সম্মুখে বসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে জাফরিন। স্টেজে ঈশানের পাশেই বসে আছে কাজী সাহেব।জাফরিনের দুই পাশে বসেছে তার দুই মামা।পিছনে দাঁড়িয়ে আছে দুলাভাই এবং মামাতো ভাইয়েরা। তাদের উপস্থিতিতে পরিবেশে পিন পতন নীরবতা বজায় রাখছে সবাই।
কাজী সাহেব দুজনের সম্মতি চাইলে জাফরিন বিনা বাক্য ব্যয় করে সম্মতি জানালো।তার পক্ষ থেকে ওয়ালিয়া হয়ে সম্মতি জানালো তার বড় মামা অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ ইয়াকুব।
জাফরিনের স্বাক্ষর নেওয়ার পর কাজী সাহেব তার খাতাটা এগিয়ে দিলেন ঈশানের দিকে। ইশান স্বাক্ষর করে দিতেই তাদের কাবিন বাতিল হলো।কাজী ডেকে এনে যেভাবে কাবিন করা হয়েছিল, কাজীর উপস্থিতিতেই সেই কাবিন বাতিল করলেন জাফরিনের পরিবার। ঈশানের বাবা অবশ্য গতকালকের জন্য মাফ চাইছিলেন কিন্তু তার কথায় কেউ কান দেয়নি।
কাবিন বাতিল হবার পর ইয়াকুব সাহেব তার ছেলে এবং ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

“জাফরিনকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো।”

তার রাশভারী কণ্ঠ যেন বজ্রের মতোন লাগছিল।চেয়ার ছেড়ে উঠতেই জাফরিন পুনরায় ফিরে এলো তার মামার কাছে। মামাকে কানে কানে কিছু একটা বলতেই তার মামা ঈশানের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন

“আপনি বসুন এখানে, বার বার ছেলেকে বিয়ে বাড়িতে এনে বৌ ছাড়া চলে যেতে আপনার একটুও সম্মানে লাগছে না?আপনার হয়তো সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের এলাকার, আমাদের মেয়ের একটা সম্মান আছে। আপনি আজ এখান থেকে এভাবে যেতে পারবেন না।”

“আপনি কী আমাদের জিম্মি করবেন?আমি থানায় কল দিবো।”

“আপনার দেওয়ার দরকার নেই। থানার ওসি আমার ভায়রাভাই।তাকে আমিই কল দিচ্ছি আসার জন্য।”

পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে তিনি তার ছেলেদের বললেন,

“জাফরিনের মতো এই মেয়েটাও তোমাদের বোনের মতোন।গতকাল বরযাত্রী তাকে রেখে চলে গেছে বলে তোমরা ভাইয়েরা অস্থির হয়ে আজকেই দেশে এসেছো, এটাও তোমাদের বোন।এখন তোমরা উপস্থিত, কী করবে তোমরা?”

ইয়াকুব সাহেবের বড় ছেলে বাবার সামনে মাথা নিচু করে বলল,

“বাবা, বিয়ে দেওয়া কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু বিয়ের পর এই ছেলে যে ওকে ছেড়ে দিবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয় বিয়েও করতে পারে। তবে হ্যাঁ আমরা মেয়ের পরিবারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জেনে তাদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে পারি।”

জাফরিন দাঁড়িয়ে ছিল তার ছোটো মামা এবং বড় আপার পাশে। আশার বাবা এসে তার দুই হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” মা আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ এখানে। তুই তো শহরে মানুষ। পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারিস। আমার মেয়েটা এমন না। ও এসব সইতে পারবে না।কাল সকাল হলেই যখন আশেপাশের মানুষ বলবে কাল ওর বিয়ে ভাংছে, ও মুখ দেখাতে পারবে না। ওর গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।”

মাথা নিচু করে জাফরিন কথাগুলো শুনছিল।আজ সন্ধ্যে বেলাতেও তাকে কত কিছু বলেছে এই লোকটা। আচ্ছা এরা কী কখনো বুঝতে পারবে?কষ্ট জাফরিনেরও হচ্ছে, যে মানুষটাকে সে সারা জীবনের জন্য চেয়েছিল, তাকে নিয়ে সংসার করবে বলে কতই না স্বপ্ন সাজিয়েছিল,তার নামের মেহেদী, হলুদ এখনো তার গায়ে, হাতে লেগে আছে। সেই মানুষের সাথে বিচ্ছেদে তার কেমন লাগছে?
সে নিজেও তো একজন মেয়ে।নিজের কষ্ট গুলোকে লুকাতে জানে বলেই বাইরে শক্ত আবরণ তৈরি করেছে অথচ তার নিজের অন্তর ও পুড়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো কাঁদতো, বাবার মৃত্যু বা বিয়ে ভাঙ্গার পর মানুষের কটু কথা শুনে আত্মঘাতী হওয়ার চিন্তাও করতো। কিন্তু সে এমন নয়, তার কষ্ট হচ্ছে।তবে সে এটাও মানে কান্নাকাটি করে এসবের সমাধান পাওয়া যাবে না।বিপরীতে লোকে পিছনে তাকে নিয়ে তামাশা করবে।

জাফরিন তার চাচার কোনো কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে বাড়ি চলে এলো। সে জানে আশার জীবনের সিদ্ধান্ত আশাকেই নিতে হবে। ক্ষণিকের কষ্ট না কী সারা জীবনের অপমান!

(১১)

বিয়ারের গ্লাসে এমন ভাবে চুমুক দিচ্ছে যেন সে দুধ খাচ্ছে।ছোটো বেলায় যেমন বলা হতো এক চুমুকে শেষ করবে ঠিক তেমনি ভাবে দুই বন্ধু প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ব্যালকনিতে বসে গভীর রাতের শহরকে পর্যবেক্ষণ করছিল মাশহুদ এবং কুঞ্জ ।রাতের আড্ডা জমাতেই তাদের সামনে রয়েছে লো অ্যালকোহলিক বিয়ারের বোতল।কুঞ্জ পেশায় একজন প্রোগ্রামার। যার কাজ বিভিন্ন সফটওয়্যার এবং কোডিং নিয়ে৷ তবে সে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আয়ত্তে নিয়েছে সেটা হলো হ্যাকিং। খুব দ্রুতই সে হ্যাক করতে জানে৷ তবে নিজের এই জ্ঞানের কোনো খারাপ প্রয়োগ সে করেনি।আজ তাকে এখানে নিয়ে আসার আরো একটি কারণ রয়েছে মাশহুদের কাছে৷ কিন্তু কুঞ্জ এই ব্যাপারে একদম নিস্ফল প্রমাণিত হলো।টেবিলের উপর গ্লাস রাখতে রাখতে সে বলল,

“দেখ ভাই, তুই এইভাবে মেয়েটার প্রতি ঝুকে পড়ছিস কেন?এটা কিন্তু ঠিক নয়।”

“আমি কোথায় ঝুকলাম?”

কুঞ্জ ভ্রু-বিলাস করলো। হাতের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে আয়েশ করে বসে বলল,

“মাত্র তিন ঘন্টার মধ্যে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ খুঁজে তাও আবার প্রফেশনাল, তাকে পাঠিয়ে দিলি আজমল সাহেবের বাড়িতে।শুধু মাত্র মেয়েটা আজ কী করছে এটা জানার জন্য৷ এটা কে তোর কী মনে হচ্ছে?”

“কিছুই না।তাদের খবর নিতে চাচ্ছি মাত্র।”

“আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে না।যদি এটাই হয় তবে আজকের বিয়েতে ঝামেলার কী দরকার ছিল?”

“ছিল।কারণ আমি দেখতে চাই এই মেয়েটা কতটা সহ্য করতে পারে। কতটা কষ্ট পেলে সে কাঁদবে। সে কী আদৌও যোগ্য?”

“আমরা কিন্তু এখনো নিশ্চিত নই, এই সেই ব্যক্তি যে…… ”

“আজমল সাহেবের মেইলের তথ্য রিকোভার করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, বাকীটা সেখানেই জানা যাবে।”

“কোনো একটা অদ্ভুত কারণে আমি মেইল এক্সেস করেও কিছুই পাইনি।তার মেইল বক্স ফাকা ছিল।কেন যেন মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই মেইল এক্সেস করতে দেওয়া হয়েছে।তোর প্রয়োজনীয় কিছুই এখানে নেই।”

কুঞ্জের কথায় মাশহুদের ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না।অন্ধকার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল,

“কারণ আমি নিশ্চিত, এই মেয়েটা সবটা জানে।একমাত্র এই মেয়ের কাছেই রয়েছে আমার সকল ভবিষ্যৎ।”

(১২)

প্রভাতের মখমলি সমীরণ বইছে।শরৎের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে জাফরিনের ঘরে৷ কোর-আন শরীফ তুলে রেখে বারান্দায় বেরিয়ে এলো সে।বারান্দায় বসে আছে তার মামা এবং দুলাভাইয়েরা৷ বড় আপা সবাইকে চা নাস্তা দিলেন।গতকাল রাতে পুলিশের উপস্তিতিতে আশা এবং ঈশানের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়েতে সবাইকে উপস্থিত রেখে কাবিন নামায় উল্লেখ করা হয়েছে তিনটি শর্ত

১.ঈশান কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না কিংবা তালাক দিতে পারবে না।
২.স্ত্রীর মর্যাদা এবং সকল দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৩.যদি কখনো তাকে অসম্মান করা হয় তবে ঈশানের বাবার সকল সম্পত্তি আশার নামে করে দিতে হবে।

এই তিনটে শর্ত মানা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।কারণ এই বিয়ে ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।যদি বিয়ে না করে তবে তাদের তখনি গ্রেফতার করা হতো।
বিয়ের পর যখন জাফরিনকে নিয়ে তার মামা চলে আসছিলেন তখন তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

“গতকাল যদি আমি এখানে থাকতাম তবে নিশ্চিত করতাম আপনাদের হাজত বাস। আমার ভাগ্নী কোনো খেলার পুতুল না।তার বাবা আজ নেই,চাচাদের দায়িত্ব ছিল ওদের মাথার উপর হাত রেখে তাদের শোকে কাতর মনটাকে একটু সমবেদনা জানানো।কিন্তু আফসোস এমন করেন নি।হেনস্থা করতে পিছুপা হয়নি কেউ।কেউ বুঝেনি এই এতিম মেয়েগুলোর মনের অবস্থা,সদ্য বিদবা হওয়া আমার বোনের মনের অবস্থা।”

যাওয়ার সময় ঈশানের বাবার চেহারা ছিল দেখার মতোন।মনে হচ্ছিলো তাকে নিম পাতার রস খেতে দেওয়া হয়েছে।
গত রাতেও প্রচন্ড খারাপ লাগছিল জাফরিনের। আজ তার বাবা মারা যাওয়ার তিন দিন।যদিও লাশ এখনো আসেনি, দাফন হয়নি তবুও কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্র খাওয়ানোর কথা বললো বড় আপা।সবাই সম্মতি জানালেন।

বিকেলবেলা নতুন বৌ নিয়ে বর যাত্রী পুনরায় ফিরে এলো।নিয়ম রক্ষা চলছে, আজ জাফরিনদের বাড়ি তিন দিনের জন্য এতিম বাচ্চা খাওয়াচ্ছে আর অপর দিকে নতুন জামাই আসবে বলে পিঠা পুলি বানানো হচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে ঈশান বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার সময় দেখতে পেল কয়েকটা কুকুরকে খেতে দেওয়া হয়েছে। দেখে বুঝতে পারলো এই কাজটা জাফরিন করেছে। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে ভালো ভাবে তাকাতেই দেখতে পেল প্রত্যেকটা কুকুরের গলায় ঝুলছে টাই।সেগুলো চিনতে অসুবিধা হলো না আশা কিংবা ইশানের।কারণ
এই টাই গুলো জাফরিন কিনেছিল ঈশানের জন্য। তাদের বিয়ের একটা ছোট্ট উপহার হিসেবে যে গুলো বর্তমানে ঝুলছে কুকুরগুলোর গলায়।

চলবে (এডিট ছাড়া। গল্পের সুবিধার্থে কাবিন বা বিয়ে বিষয়ক তথ্যগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য কোনো ভাবে না নেওয়ার অনুরোধ রইল।
আর হ্যাঁ যারা গল্প পড়েন অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন।কারণ গতকাল ফেসবুক সার্ভার ডাউনের কারণে পেজের একদম রিচ নেই)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here