#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান_সুবাসিনী
#পর্ব-৫
(১৩)
আশা নিজের সুখ দেখাতে ব্যস্ত৷ কে বলবে এই মেয়েটার বিয়ে গতকাল কতই না ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিল।জাফরিনের পাশে বসে আশা শাড়ির আঁচল টেনে নিতে নিতে বলল,
“ঈশান খুব ভালো রে।গতকাল যা হয়েছে সব কিছুর জন্য সে মাফ চেয়েছে।”
প্রতিউত্তরে জাফরিন বলল,
“আচ্ছা।”
এরপর বিনাবাক্যে সে চলে এসেছিল ঘরে৷ আশা নিজে থেকেই এসেছিল তার সাথে দেখা করতে। তখন সে বারান্দায় বসেছিল।ঘরে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে।সবার সব কিছু ভুলতে আপাতত। মরহুম বাবার জন্য কিছু আমল করতে করতে হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে।
প্রভাতের মৃদু হাওয়ায় নিজেকে উজার করে দিতে ইচ্ছে করছে জাফরিনের।ফজরের নামাজ আদায় করার পর সে বেরিয়েছে বাড়ির পাশে হাঁটতে। রোদের তেজ এখনো বাড়েনি। প্রভাতের রৌদ্র বিলাশ করতে করতে এসে দাঁড়িয়েছে নিজের বাড়ির শিউলি গাছের তলায়। স্তবকে স্তবকে ফুটে থাকা শিউলি ফুলের গন্ধে বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। ফুলের ভারে গাছটা নুইয়ে পড়েছে। তার পিছন পিছন কখন যে মায়ান এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।মায়ান হচ্ছে বড় আপার বড় ছেলে। এক কথায় খালা ভক্ত ছেলে।বারো বছর বয়সেই শরীরের গড়নের দিক থেকে সে সবার থেকে ভিন্ন।উচ্চতায় প্রায় জাফরিনের সমান।খালামণির পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“আতিন, শিউলি নিবে?”
“না রে। এখন কুড়াতে ইচ্ছে করছে না।”
“তবে আঁচল পেতে দাঁড়াও, আমি গাছ ঝাকি দিয়ে দিচ্ছি।”
মায়ান গাছ ঝাকি দিতেই শিউলি ফুল ঝরে পড়লো জাফরিনের ওড়নায়। নিচে পড়া ফুলগুলো মায়ান কুড়িয়ে তার আঁচলে দিতে দিতে বলল,
“তুমি কাঁদছো না কেন?”
“কেন কাঁদবো?”
” সবাই বলছে তুমি এভাবে থাকলে পাগল হয়ে যাবে।তোমার কান্না করা উচিৎ। কাঁদলে কষ্ট হালকা হবে।”
“আমার তো কোনো কষ্ট নেই মায়ান।আমার যা আছে সব নিয়তি।”
“অন্তত আমাকে মিথ্যে বলো না।তুমি কষ্ট পাচ্ছো কিন্তু নানু বা মায়ের কথা ভেবে কাঁদছো না।তারা ভেঙ্গে পড়বে বলে।”
জাফরিন হাত বাড়িয়ে ভাগ্নের মাথার চুলে লেগে থাকা শিউলি ফুল তুলে নেয় হাতে। সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এক সাথে যদি আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়ি তবে যে সমাজ,মানুষ আমাদের সুযোগ নিবে।বলবে ওদের অভিভাবক নেই,ওদের সাথে অন্যায় করলে প্রতিবাদ করবে কে?কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। আমাদের শক্ত থাকতে হবে অন্তত আব্বার লাশ দেশে আনার আগ অবধি।”
কথা গুলো শেষ করতেই জাফরিন অনুভব করলো কেউ একজন তার মাথায় হাত রেখেছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল তার মামাতো ভাই ইউভান দাঁড়িয়ে আছে।তার দিকে ফিরে তাকালো জাফরিন। ত্রিশ বছর বয়সী ইউভান বর্তমানে ইন্ডিয়াতে ডায়বেটিক ফুট জনিত বিষয়ে কোর্স করছে।বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যাটি বেশি দেখা দিয়েছে সেটা হলো ডায়বেটিক রোগীদের পায়ে নানান ধরনের সমস্যা। পা সব থেকে অবহেলিত অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হলেও যখন সেই পায়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন বুঝে আসে পা কতই গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগ তো আছে কিন্তু নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাক্তার। তাই এই বিষয়ে একটা ভারতে ডিগ্রি নিচ্ছে ইউভান।
এ সময় অবধি জানালার পাশের বিছানায় শুয়ে দূর থেকে জাফরিনের মুখের হাসি দেখছিল ঈশান।আশার ঘর থেকে ওদিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।জাফরিন সচরাচর এমন ভাবে হাসে না।তার এই হাসিতে যেন হাসতে থাকে তার পুরো মুখমণ্ডল। কিন্তু ইউভান কে দেখেই উঠে বসলো সে। জাফরিনের তথাকথিত মামাতো ভাইদের তার একটু বেশিই সন্দেহ হয়। সন্দেহ হওয়ার পিছনে কারণ অবশ্য তারা নিজেই।
আজ অবধি তো ঈশান কখনো তার নিজের ছোটো বোন, আপন বোনকে কখনো হাত খরচ দেয়নি।না দিয়েছে শখের কিছু কিনে নেওয়ার জন্য টাকা।অথচ জাফরিনের মামাতো ভাইগুলো বিশেষ করে ইউভান প্রতি মাসে তাকে কিছু না কিছু বাহানায় হাত খরচ দেয়, তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক অনলাইনে অর্ডার করে দেয়। এমনকি জাফরিনের হাতের ফোনটাও তার কিনে দেওয়া।
যেখানে মানুষ নিজের আপন বোনকে দেয় না, সেখানে কেউ ফুপাতো বোনকে এত কিছু কেন দিবে?
ক্রোধে ঈশানের হাত-পা নিশপিশ করছিল।যখন সে দেখতে পেল ইউভান মেয়েটার মাথায় হাত রেখেছে।
রাগের বশে সে আঘাত করে বসলো জানালায়। অথচ তার এমন রাগের কোনো কারণ সে নিজেও খুঁজে পেলো না।
(১৪)
ভালবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।
ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।
কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।
নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।
তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।
রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর কবিতা আপন মনেই আবৃত্তি করছিল মাশহুদ।পার্কিং এ গাড়ি রেখে প্রবেশ করলো ভিতরে। আড্ডা জমিয়েছে ভিন্ন বয়সের মানুষ। ওয়াইনের গ্লাসে চলছে চুমুকের ঝড়। প্রবেশ করতেই তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো তার দাদাসাহেব।আজ তার জন্মদিন৷ জন্মদিন উপলক্ষে তার দাদী পরেছেন জামদানী শাড়ি। অথচ আশেপাশে থাকা প্রতিটি মেয়েই প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় আছে বলেই ধরা চলে। এদের মাঝে দাদীকে এমন অবস্থায় দেখে মাশহুদের অধর প্রসারিত হলো।সে জানে আজকেও তাকে বিয়ের কথা বলা হবে।একজন ছেলে কতকাল একা থাকবে?
পিছন থেকে ছোটো একজোড়া হাত এসে আঁকড়ে ধরেছে মাশহুদের কোমড়। আধো আধো বুলিতে সে বলল,
“হে অল্ড বয়, হাউ আর ইউ?”
“আ’ম ফাইন, ইয়াং ম্যান।”
ছেলেটাকে কোলে তুলে নিতেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো জেনিফার। হালকা বাদামী চুলের এই মেয়েটা সিংগেল মাদার। এদেশে বিয়েটা এতটা প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না কেউ। কারণ প্রতিটি মানুষ এখানে আত্মনির্ভরশীল হতে চায়।জেনিফার দুঃসম্পর্কে চাচাতো বোন হয় মাশহুদের। এক সাথেই লেখাপড়া করেছিল।অথচ কে জানতো এই ফুলের মতোন মেয়েটার ভাগ্যে এতটা কষ্ট!
মাশহুদের ফোন হুট করেই বেজে উঠলো।বাচ্চাটাকে নামিয়ে দিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই অধর পুনরায় প্রসারিত হলো।কারণ স্ক্রিনে ছিল জাফরিনের নাম।
“হ্যালো।”
স্পষ্ট এবং তেজস্বী সুরে জাফরিন ইংরেজিতে বলল,
“আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি।মি.আমজল শিকদারের ছোটো কন্যা। আমি কী জানতে পারি আমার বাবার লাশ আমরা কবে ফেরত পাবো?”
জাফরিনের এমন কণ্ঠ আরো একবার মাশহুদ কে আহত করলো।সে যেন বর্ষার জলে বিলে থাকা কোনো এক সাদা বক। যার পায়ে হুট করেই লেগে গেছে অযাচিত কিছু। নিজের অস্থিরতা এবং পরিচয় গোপন করে সে বলল,
“ম্যাম,কিছু দিন সময় লাগবে।তবে আমরা দ্রুত করার চেষ্টা করবো।”
“আমার নির্দিষ্ট তারিখ জানা প্রয়োজন।”
“কিছু রুলস রয়েছে ম্যাম।সব কমপ্লিট হলেই আমরা আপনাদের জানাবো।আপনি কী মেইলের জবাব দিয়েছেন?”
“জি পাঠিয়ে দিয়েছি।”
জাফরিনের সাথে কথোপকথন শেষ করার পর বেশ সময় চুপ রইল মাশহুদ। এই মেয়েটা কেন নিজের মাঝে নিজেই এক শান্ত সাগর?যে তাকে টানছে চোরাবালির মতোন?
(১৫)
জাফরিনের প্রতি ইউভানের স্নেহ, ভালোবাসা সবটাই বোনের মতোই।কিন্তু এটাকে স্বাভাবিক ভাবে কখনোই নেয়নি জাফরিনের দাদাবাড়ির লোকজন। তারা একে অপরের সাথে আলোচনা করছিল জাফরিনের বাবা যেহেতু তাদের জন্য এত কিছু রেখে গেছে তাই তার মামাতো ভাই বা মামারা জমি,টাকা পয়সার জন্য হলেও তাকে বিয়ে করবে আর যেহেতু জাফরিনের ও তাদের প্রতি একটা আলাদা টান রয়েছে তাই বিয়েতে সে নিজেও অমত করবে না। কিন্তু এই ভাবে তার ভাইয়ের কষ্টের কামাই তো অন্যের ছেলেদের খেতে দেওয়া যাবে না।
জাফরিনদের ভালোর জন্য তারা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিলো,
জাফরিনের যে চাচাতো ভাই ক্লাস এইট পাশ করার পর থেকে বাজারে দোকান করে সেই চাচাতো ভাইয়ের সাথে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিতে হবে। এতে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে আর টাকাও। আর এতে যদি তার মামারা কোনো সমস্যা করতে চায় তবুও তারা মানবে না।প্রয়োজনে তাদের এক ঘরে করেই বিয়েটা তাদের দিবে,এবং ওটা লাশ আসার আগেই।
চলবে(এডিট ছাড়া, যারা গল্প পড়েন তারা রেসপন্স করবেন।আর দেরিতে কেন দিচ্ছি অন্তত এই প্রশ্নটা করবেন না)