গল্পঃবসন্ত এসে গেছে লেখাঃনুশরাত জেরিন ৯.১০.১১

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
৯.১০.১১
পর্বঃ৯

অপুর এমন সাহসীকতায় নোমান অবাক হয়,কিন্তু সেটা কিছু সময়ের জন্যই।পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নেয়।
নরম সুরে বলে,

—তুমি বানিয়েছো?

অপু অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।নোমানের এমন নরম সুর শুনে ভয় পায়।ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজায়।এমন নিস্তব্ধতা যে ঝড়ের পূর্বলক্ষন সেটা উপলব্ধি করে।

নোমান এবার চিৎকার করে বলে,

—স্পিক আপ।

অপু দ্রুততার সাথে মাথা নাড়ে।ভয়ে এতো জোরে মাথা নাড়ে যেনো মাথা খুলে এক্ষুনি পরে যাবে।

নোমান মাথা নাড়ানো দেখে এগিয়ে আসে।
আরো জোরে চিৎকার করে বলে,

—কেনো বানিয়েছো আমার কফি?কেনো বানিয়েছো?
বউ সাজতে গেছিলে?আমার বউ সাজতে চাও?ছোটলোকের মেয়ে হয়ে এতোবড় স্পর্ধা?আরে বাবা না বললে তো তোমাকে বিয়ে করা দুর তোমার মতো মেয়ের দিকে আমি নোমান খান ফিরেও তাকাইনা।

বাবাকে পটিয়ে আমার গলায় ঝুলেছো তুমি,সেকথা আমি জানিনা ভেবেছো?
কি ভেবেছোটা কি?আমি তোমাকে,তোমার মতো থার্ড ক্লাস মেয়েকে মেনে নেবো?নেভার।

অপু স্তব্ধ হয়,বাকরুদ্ধ হয়ে পাশের সোফায় ঠাস করে বসে পরে।
তার হাত পা কাপে।লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চায়।
চারদেয়ালের মাঝে এসব বললে যতোটুকু না খারাপ লাগতো তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগে রুজি আর নয়নার সামনে বলায়।
যদিও ব্যাপারটা খারাপ লাগা না,ব্যাপারটা হচ্ছে আত্মসম্মানের।
অপু কাঠ হয়ে নিচের দিকে চোখ রেখে বসে থাকে।চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় অশ্রুবিন্দু ঝরে পরে।

নোমান সেদিকে তাকায়না।গটগট করে হেটে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।রুজি আর নয়না তাড়াহুড়ো করে ফ্লোর থেকে কাঁচের টুকরো তুলে পরিস্কার করে।
অপুকে নিজের মতো একা থাকতে দিয়ে তারাও বেরিয়ে যায়।

অপু নির্বাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে।
পরক্ষনে কান্নায় ভেঙে পরে।
কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে যায়।
অপু জানতো তার ভাগ্যটা খারাপ,তার সাথে এযাবত কোন ভাল ঘটনা ঘটে না।
খারাপ ভাগ্যটাকে মেনেও নিয়েছিলো অপু।তাই বলে এতোটা খারাপ ভাগ্য তার সেটা অপু বুঝতে পারেনি।

নোমানের কান্ডকালাপ শুনে আরমান খান অপুর রুমে আসেন।অপুকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে তার খারাপ লাগে।
ভাবে মেয়েটার জিবন তিনি নিজে হাতে নষ্ট করছেন নাতো?কিন্তু নোমান?সেতো খারাপ না?উপরে খারাপ হওয়ার এক খোলস লাগিয়ে ঘোরে সে।কিন্তু ভেতরটা?ভেতরের মনটা যে তার নরম।
ছেলেটা ছোটবেলা থেকে ভালবাসাহীন থেকে থেকে এরকম রুক্ষ, শক্ত তৈরি হয়েছে।
আবার নতুন করে কেউ ভালবেসে তাকে আপন করলে সে কি ঠিক হবেনা?অপু কি পারবেনা নোমানের রাগী,রুক্ষ খোলসটাকে ভেঙে গুঁড়ো গুড়ো করতে?
নাকি নিজেই ভেঙে যাবে?

আরমান খান আর ভাবতে পারেননা।
দরজার কাছ থেকে আবার নিজের রুমে ফিরে আসেন।
অপুর সামনে তার দাঁড়াতে ইচ্ছে করেনা।মেয়েটার এমন অবস্থার কারন হিসেবে নিজেকে দোষী মনে হয় তার।

দুপুর পর্যন্ত নিজের ঘরে থম মেরে বসে থাকে অপু।নোমানও আর রুমে আসেনা।
সকালের নাস্তা করে সে অফিসে চলে যায়।
এদিকে তার উপর অভিমান করে যে একজন না খেয়ে বসে আছে সে দিকে তার কোন হুশ নেই।

নোমানের কথাগুলো খুব আত্মসম্মানে লাগে অপুর।রাগ হয় নোমানের ওপর।
তারচেয়েও বেশি রাগ হয় আরমান খানের ওপর।
উনি কেনো ছেলেকে জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলেন?তাহলে তো এমন পরিস্থিতিতে অপুকে পরতে হতোনা।
ঠিক তখনি খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে রুমে ঢোকেন আরমান খান।
মুখে তার অনুতাপের ছাপ স্পষ্ঠ।
প্লেট টা এগিয়ে এনে অপুর পাশের টেবিলে রাখেন তিনি।নিজে বসেন অপুর পাশে।
মাথা নিচু করে বলেন,

—বুড়ো বাপটার ওপর রাগ করেছিস মা?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি অপুর উত্তরের অপেক্ষা করেন। অপুর উত্তর না পেয়ে বড়সড় নিশ্বাস ছাড়েন।
হাতটা নিয়ে অপুর মাথায় রেখে কন্ঠে আকুলতা মিশিয়ে বলেন,

—আমার ছেলেটা খারাপ নারে মা।ও উপর উপরেই ওমন,কিন্তু ভেতর থেকে খুব নরম মনের মানুষ ও।

অপু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়।আরমান খান সেদিকে দেখে বলেন,

—আমার দোষেই ছেলেটার এমন দষা জানিস মা।ছোটবেলা থেকে অযত্ন, অবহেলায় ধীরে ধীরে ও এমন হয়ে গেছে।
আমার বর্তমান স্ত্রী রিচি একজন বিদেশি মেয়ে।
নোমানের মা বেচে থাকতেই তার সাথে আমি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছিলাম।
তার জন্য আমি আজও নিজের চোখে নিজেকে অপরাধী ভাবি।
নোমানের মা মারা যাওয়ার পর আমি রিচিকে বিয়ে করি।রিচি তখন নোমানের সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে।
যে বয়সটায় ওর ভালবাসা পেয়ে হেসে খেলে বড় হওয়ার কথা ছিলো,সে বয়সটায় ও পেয়েছে সবার কাছ থেকে তিক্ততা।
কি নিদারুণ স্ট্রাগল করে ও বড় হয়েছে।
আমি বাবা হয়েও ওর পাশে থাকতে পারিনি।
তুই বল মা,নোমানের জায়গা তুই থাকলে কি এমন স্বভাবের তৈরি হতিনা?বল?

অপু মাথা নাড়ে।সত্যি সে এতো কিছু ভাবেনি।
আরমান খান প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা ভাত অপুর মুখের সামনে আনেন।

—খেয়ে নে তো মা,সারাবেলা না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবি তো।তখন এই বুড়ো বাপকে কে দেখবে?

অপু আরমান খানের কথা শুনে মুচকি হাসে।ঝটপট হা করে।

খাবার খেয়ে অপু নিচে নামে।রুজি খালা আর নয়নার সাথে হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে।
কিছুক্ষণ একা একা ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখে।
সারাটাদিন এভাবেই পার হয় অপুর।
রাতে সবাই খেয়ে নিলেও অপু খায়না।
সে নোমানের জন্য অপেক্ষা করে।ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা বেজে যায়।তবু নোমান আসেনা।
অপু ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে ঘুমে ঢোলে।

কলিং বেলের শব্দে চকিত দৃষ্টিতে তাকায়।
হুড়মুড় করে উঠে দৌড়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়।
নিজের দিকে তাকিয়ে শাড়ি ঠিক করে।
দরজা খুলে দেখে সামনে নোমান দাড়িয়ে আছে।
তার চোখ লাল।
অপু ভেবে পায়না লোকটার চোখ সবসময় লাল থাকে কেনো?
সবসময় রেগে থাকে সেইজন্য? নাকি তার চোখই লাল?

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ১০

অপুকে হা করে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নোমান সতর্কতামূলক কাশি দেয়।
অপু হতচকিত হয়ে ওঠে।
চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে দাড়ায়।
নোমান গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

—সামনে থেকে সরো।

অপু কথাটা বুঝে ওঠে না।মাথা উচু করে নোমানের চোখের দিকে তাকায়।
নোমান বিরক্ত হয়।ভাবে মেয়েটা কি বয়রা নাকি?
জোরে বলে ওঠে,

—কি হলো সরো,দরজার সামনে থেকে সরে দাড়াও।
দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিতরে যাবো কি করে।

অপু তার বোকামো বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াতে যায়,তাড়াহুড়ো করার ফলে শাড়িতে পা বেধে পরে যেতে যায়।
নোমান তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে অপুকে আগলে ধরে।নিচে পরা থেকে বাচায়।
অপু চোখমুখ বুজে ভয়ে বিরবির করে।
নোমানের শার্ট খামচে ধরে।

নোমান বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে শার্ট ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।
এমন মায়াবী মুখশ্রী দেখে কেমন যেন সব ওলট পালট লাগে নোমানের।
গোলাপী ঠোঁট দুটো বিরবির করায় কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে।
একটু ছুয়ে দেওয়ার আশায় নোমান হাত বাড়ায়।
পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নেয়।
সে কোন মেয়ের পাতানো ফাঁদে পা দিতে চায়না।বাবা যে ভুল করেছিলো সে ভুল নোমান করতে চায়না।
মেয়েরা যে মায়া দিয়ে বশ করে সেকথা মনে গেথে রেখেছে যে নোমান।

অপুকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ায় সে।
অপুও সোজা হয়।
ভয়ে ভয়ে নোমানের দিকে তাকায় তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য কিন্তু তার আর সুযোগ হয়না।
নোমান অপুকে ছেড়ে হাটা শুরু করে।
অপু মনের ভেতর হাজার পরিমান সাহস সঞ্চয় করে বলে,

—এই যে শুনছেন?

নোমান থমকায়।তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে।
ডাকটার ভেতর একটা বউ বউ আভাস পায় সে।
পেছন ফিরে ঘুরে দাড়ায়।
অপু কিছু বলার আগেই গম্ভীর হয়ে বলে,

—এভাবে আমাকে কখনো ডাকবেনা।

অপু অবাক হয়।সে আবার কিভাবে ডাকলো?

—কিভাবে?

—এখন যেভাবে ডাকলে,সেইভাবে।

—কেনো?

নোমান এবার রাগী গলায় ধমকে ওঠে।

—ডাকবেনা মানে ডাকবেনা,আমি বলেছি তাই।

অপু ঘাড় কাত করে।

—আর কথায় কথায় এমন মাথা নাড়িয়ে জবাব দেবেনা।

অপু আবার ঘাড় নাড়ায়। পরক্ষনে জিভে কামড় দেয়।
নোমান বলে,

—কি জন্য ডেকেছিলে?

অপু আমতাআমতা করে,
—মানে আপনি ডিনার করবেন না?

নোমান রাগী চোখে তাকায়।অপু ভয়ে গুটিশুটি মেরে যায়।

—আমার ব্যাপারে তোমার না ভাবলেও চলবে।

কথাটা বলে নোমান দাড়ায় না।সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।

অপু দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডাইনিং এ আসে।
সব খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখে।
এতক্ষণ ধরে বসে থাকতে থাকতে খাওয়ার ইচ্ছেটা তার মরে গেছে।

রুমে ফিরে যাওয়ার পথে রুপু থমকে দাড়ায়।
আরমান খানের ঘর থেকে চাপা চিৎকারের আওয়াজ আসে।
নোমানের গলা শুনেই অপু চিনতে পারে।
অপু বোঝে আরমান খান কিছু বোঝাচ্ছে নোমানকে।
কিন্তু নোমান বুঝছেনা।
অপু দাড়ায়না,সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়ায়।
কারো কথা আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি শোনার মেয়ে অপু নয়।
হাটতে গিয়ে একটা কথা কানে আসে, পা যেনো আপনাআপনি থেমে যায়।

নোমান আরমান খানকে বলছে,

—আমি কালই চলে যাবো,এবং যাবোই।তুমি কোনভাবেই বাধা দিতে পারোনা।
তুমি বলেছিলে তুমি আমার কাছে শুধু একটা জিনিস চাইবে,আর সেটা হচ্ছে আমার বিয়ে।

—তাই বলে বিয়ে করে একটা মেয়েকে তুমি এভাবে ফেলে চলে যাবে?
তুমি আমার সাথে,রিচির সাথে এক বাড়িতে থাকতে চাওনা,ঠিক আছে থেকোনা।আলাদা বাড়িতে থাকো তুমি,সেইখানে চলে যেতে চাইছো?আচ্ছা ঠিক আছে তাও মানলাম।কিন্তু অপুকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।তাকে কেনো সাথে নিবেনা?

নোমান কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দেয়,

—কারন আমার কাজ ছিলো তোমার কথা রাখতে বিয়ে করা।
শেষ!বিয়ে তো করেছি।
এখন এই মেয়েকে নিয়ে তোমরা যা ইচ্ছে করো।

—বললেই তো হয়না নোমান,বিয়ে করছো আর তোমার দায়িত্ব শেষ?মেয়েটার ওপর তোমার কোন দায়িত্ব নেই?

—না।

—নোমান!

—আমার উপর কোন জোর করবেনা বাবা,সে অধিকার তোমার নেই।
বিয়েটা করে শুধুমাত্র বাবা হিসেবে তোমার একটা ইচ্ছে পুরন করেছি।
দ্যাটস্ ইট।

আরমান খান আর কোন কথা খুজে পাননা।
তবু একবার বলেন,

—কিন্তু মেয়েটা…

কথা শেষ হওয়ার আগেই নোমান বলে,

—টাকা দিয়ে বিদেয় করে দাও।
ওসব রাস্তার মেয়েরা টাকা পেলেই খুশি।

অপু আর সেখানে দাড়ায় না।
একছুটে রুমে চলে আসে।
ওয়াশরুমে ঢুকে কল চালু করে।
ডুকরে কেঁদে ওঠে।
বুকের ভারী পাথরের মতো কষ্টগুলো নরম হয়ে পানীয় আকারে চোখ বেয়ে নেমে আসে।
নিজের কাছে এতো ছোট মনে নিজেকে।
জঘন্য কীটের মতো লাগে জিবনটাকে।
ভাবে এক নিমেষে শেষ করে দেয় এই জঘন্য কীটটাকে।
বেসিনের পাশের ব্লেড নিয়ে হাতে নেয়।
একহাত দিয়ে আরেকহাতের শিরা বরাবর ব্লেড তাক করে।
চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয়।
পরক্ষনেই মায়ের মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে।
অপুর কিছু হলে তার মায়ের কি হবে?
মাকে কে দেখবে?
মায়ের জন্যই তো এতো বড় বলিদান দিলো অপু।
নিজেকে নিজে বোঝায় অপু।
তাছাড়া আত্মহত্যা মহাপাপ।
এতো বড় পাপ কেনো করবে অপু?ওই রাগী বদমেজাজি লোকটার জন্য?
নাহ,এমনটা অপু কিছুতেই করবেনা।
ওই লোকটাকে ছাড়াই অপু ভালো থাকবে।খুব খুব ভালো থাকবে।

চোখ মুখে পানি দিয়ে নিজেকে নিজে বুঝ দেয়।
কান্নার ফলে চোখ মুখ ফুলে গেছে।কেমন গুলুমুলু লাগছে দেখতে।
দুহাত দিয়ে চুল ঠিক করে বড় বড় নিশ্বাস নেয়।
নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ১১

আজও অপুর ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে যায়।
অপু উঠে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে।
নিজেকে ইচ্ছে মতো বকে।
আজও তার ফজরের নামাজটা কাজা হয়ে গেলো ভাবতেই কান্না পায়।
ফ্রেশ হয়ে কাজা নামাজটা পরে ঘরে এদিকওদিক উকি দেয়।
নোমানকে দেখতে পায়না,ওয়াশরুমেও নেই তাহলে গেলোটা কোথায়?
এতো সকাল সকাল তো উনি নাকি ঘুম থেকে ওঠেন না।
অপু সারাবাড়িময় খোঁজে নোমানকে,
কিন্তু পায়না।
নিচে নেমে কিচেনে যায়।
কিছুক্ষণ রুজি আর নয়না খালার হাতে হাতে নাস্তা বানায়।
যদিও তারা অপুকে কাজ করতে দিতে চায়নি তবুও অপু জোর করে কাজ করে।
নাস্তা টেবিলে সাজায়।
সবাই ডাইনিং রুমে বসে ব্রেকফাস্ট করে নেয় শুধু নোমান ছাড়া।
সে তার সৎ মা অর্থাৎ মিসেস রিচির সাথে এক টেবিলে বসে খাবেনা।
অপুও খায়না,সে রুজি আর নয়না খালার সাথে খাবে।
সবার খাওয়া শেষ হলে নোমান রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।
সুট কোট পরে অফিসের জন্য একেবারে রেডি হয়ে।
অপু নাস্তা সাজায়,কিন্তু নোমান সেদিকে ফিরেও তাকায়না।
সে গটগট করে হেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
অপুর একবার নোমানকে ডাকতে ইচ্ছে করে।
বলতে ইচ্ছে করে,না খেয়ে যাবেননা।
কিন্তু বলা হয় না।
শুধু শুধু সেধে অপমানিত হতে চায় না অপু।

সারাটাদিন অপুর কাটে ব্যস্ততায়।
মিসেস রিচি অপুকে এই কাজ সেই কাজের আদেশ দিতে দিতে খাটিয়ে মারে।
অপুকে পেয়ে সে বেজায় খুশি।তার মতে রুজি আর নয়নার সাথে নতুন এক কাজের লোক পাওয়া গেছে। নোমানকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে,নোমান যে এ মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে সেকথাও মিসেস রিচি ঠিক বুঝতে পেরেছে।
অপুও কোন বিরোধিতা করেনা।
কাজ করা তার অভ্যাস আছে।
আরমান খান এসবের কিছুই টের পাননা।
বছরের বেশিরভাগ সময়ই তিনি অসুস্থ থাকেন।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়েবিটিস সহ নানা রোগে ভুগছেন তিনি।
আর সাথে তো আছেই অনুতাপের যন্ত্রনা।
এতেই যেনো আরও অসুস্থ হয়ে পরেছেন তিনি।

সারাবেলা কাজ করে বিকেলে অপু রুমে আসে।
বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়।
ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে।
ঘুম ভাঙে ফোনের রিংটোনের শব্দে।
সকালে আরমান খান অপুকে একটি ফোন দিয়েছিলেন।
সেটার শব্দ শুনে অপু হাতে তুলে নেয়।
দেখে ভাইয়ার নামটা জ্বলজ্বল করছে।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে অপু ফোন রিসিভ করে।
বলে,

—হ্যালো,আসসালামু ওয়ালাইকুম।
ভাইয়া?

ওপাশ থেকে ভাইয়ের কথা শুনে থমকে যায় অপু।
অনিক বিরক্তি মাখা স্বরে বলে,

—-উফফ্,বিয়ে দিয়েছি ভাবলাম ঝামেলা গেছে,তা না।প্রতিদিন দিন আমার ফোনের টাকা ফুরিয়ে ঢং করতে হবে।
কই নাও ধরো।

ওপাশ থেকে ভাইয়ের কন্ঠের পরিবর্তে আলেয়া বেগমের কন্ঠ শোনা যায়।বলেন,

—অপু।

অপু উত্তেজিত হয়ে পরে।অতিরিক্ত উত্তেজনায় গলা আটকে আসে।
বলে,

—মা!
তুমি ভালো আছো মা?তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো মা?ওরা কি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে?নাকি একটু দেখাশোনা করে মা?
আর অপারেশন কবে করাবে?

আলেয়া বেগম হেসে ফেলেন।
হাসতে হাসতে বলেন,

—এসব তো তোকে আমার বলার কথা।তার বদলে তুই বলছিস?

অপু কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

—উফ্ বলোনা মা।

—আমি ভালো আছি।কোন অসুবিধা হচ্ছে না আমার।অপারেশন করাবে কিছুদিন পর।
আর তুই?তুই ভালো আছিস তো মা?
ওখানে সবাই কেমন রে?ভালো তো?আর তোর জামাই? সে কেমন?

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলেন,

অনিক এভাবে টাকার জন্য তোকে বিয়ে দিয়ে দেবে আমি ভাবতে পারিনি অপু।আমার ভাবতেও অবাক লাগে ও কি আমার পেটে ছিলো?ও কি সত্যিই আমার সেই অনিক?
নিজের বোনটাকে….

আর কিছু বলতে পারেন না আলেয়া বেগম।মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ফেলেন।
পাশ থেকে ভাবির গলার আওয়াজ শুনতে পায় অপু।সে বলে,

—দেখো গো দেখো,তোমার মা তোমার নামে দুর্নাম শুরু করে দিয়েছে মেয়ের কাছে।
কাদের জন্য দিনরাত খেটে মরছো তুমি?কাদের পেছনে টাকা খরচ করো?
মেয়েটাকে এতো ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে,কোথায়,ছেলের সুনাম করবে তা না।
আরে এতো বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে পারতেন কখনো?

অপু চুপ করে শোনে ফোনের এপাশে বসে।
সে ঠিক বুঝতে পারে তার মা ভালো নেই।
অমানুষদের মাঝে কোন মানুষ ভালো থাকতে পারেনা।
অপু ভাবে তাকে একটা চাকরী জোগাড় করতে হবে।
তাহলে মাকে নিয়ে সে আর তার মা কোথাও থাকতে পারবে আলাদা।
চাকরী না পেলে অপু কোথায় যাবে মাকে নিয়ে?এ বাড়ি থেকেও এখন যেতে পারবেনা সে।
ভাইয়ের সংসারে অপু আর যেতে চায়না।
তারচেয়ে ভালো চাকরীর চেষ্টা করা যাক।

মায়ের সাথে আরেকটু কথা বলে ফোন রাখে অপু।
নিচে নেমে রুজি আর নয়নার সাথে গল্প করে।
রাতে সবাইকে খাইয়ে অপু নোমানের অপেক্ষা করে।
যদিও জানে নোমান এসব পছন্দ করেনা তবুও অপু অপেক্ষা করে।
ঘড়ির কাটা ১০ টা থেকে ১২ টায় পৌছায় তবু নোমান আসেনা।
রুজি ঘুম থেকে উঠে পানি খেতে ডাইনিংয়ে আসে।
দেখে অপু চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে।
সে অপুকে হালকা ধাক্কা দেয়।
বারকয়েক ধাক্কা দেওয়ার পর অপু চোখ খোলে।
নিভুনিভু চোখে রুজি কে দেখে বলে,

—কি হয়েছে খালা?আপনার ছোট স্যার কি এসেছেন?

রুজি টলমলে চোখে অপুর দিকে তাকায়।
বলে,

—ছোট স্যার তো এবাড়িতে আর আসবেন না মা।উনি তো নিজের বাড়িতে চলে গেছেন।

অপু তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়ায়।
তার ঘুম যেন এক নিমিষে সূদুর দেশে পালায়।
কাল রাতের কথাগুলো অপুর মনে পরে।
সারাদিনের ব্যস্তায় অপু সেসব কথা ভুলতে বসেছিলো প্রায়।

নিজের চোখও জলে ভরে ওঠে।
মুচকি হেসে বলে,

—আর আসবেননা একথা কেনো বলেন খালা,উনি অবশ্যই আসবেন।
ঠিক আসবেন।
এটা আমার বিশ্বাস।

রুজি বেগম অবাক দৃষ্টিতে অপুকে দেখে।
চোখে অবহেলার জল আর মুখে বিশ্বাসী হাসি।
কি অদ্ভুত দেখায় অপুকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here