গল্পঃ অবশেষে তুমি পর্ব – ৪

গল্পঃ অবশেষে তুমি
পর্ব – ৪
কলমেঃ Asma Aktar Urmi

নেহাল বারবার কল দিচ্ছে। হয়তো ডিভোর্স লেটার পেয়ে গেছে তাই এভাবে পাগলের মতো কল দিচ্ছে। কিন্তু এখন রিসিভ করা যাবে না। কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চাই না আমি। ভালোভাবে ইংল্যান্ড পৌঁছাতে পারলেই হলো।

টেক অফের সময় হয়ে গেছে। এখন একটা এসএমএস দেওয়া যায়। এতবার কল দিচ্ছে একবার ধরবো? না না, কথা বলা যাবে না। যদি কান্নাকাটি করে? নিশ্চয়ই করছে। আমি যদি ওর কান্না সহ্য করতে না পারি তাহলে শেষ মূহুর্তে হেরে যাব। বাবার হত্যার প্রতিশোধ আর নেওয়া হবে না। নেহাল আমার বাবাকে হত্যা করেছে। আর মা? মাকেও খুন করেছে। আমাকে এতিম করেছে ও। আমার পুরো পৃথিবী জুড়ে আমার বাবা ছিলেন। নিজের জীবনটা বাবার জন্য উৎসর্গ করেছিলাম আমি। বাবার খুশির জন্য সব করেছি। আর সেই প্রাণপ্রিয় বাবা-মা কে আমি নেহালের জন্য হারিয়েছি।

এসএমএস করলাম ওকে, “আমি ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছি। আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না। তোমার জন্য আমি এতিম হয়েছি। এ জীবনে আর আমাদের দেখা হবে না।”

ও রিপ্লাই দিলো, “প্লিজ একবার ফোনটা ধরো। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও। আমিও তো এতিম। তাহলে আমি কেন তোমাকে এতিম বানাব। তোমার বাবা-মা যে আমারও বাবা-মা ছিলেন।”

“তোমার বাবা-মাকে বাইরের মানুষ মেরেছিল। তাই আপজন আঘাত করলে কেমন লাগে সেটা তুমি বোঝোনি। কিন্তু তোমার জন্য আমি এতিম হয়েছি। আমার ভালোবাসাকে খুন করেছো তুমি। যখনই তোমায় ভালোবাসতে শুরু করেছি, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, তখনই সব শেষ করে দিলে তুমি। আমার জীবনে তুমিই প্রথম পুরুষ। তোমাকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম। সব শেষ করে দিয়েছো তুমি। তাই এবার তুমিও বুঝবে আপনজন আঘাত করলে কেমন লাগে। বিদায়।”

মেসেজটা দিয়ে ফোন বন্ধ করে ফেললাম। জানি ও অনেক মেসেজ দিবে। হয়তো ইমোশনাল কথা বলবে, মায়ায় জড়ানোর চেষ্টা করবে। আমি এসব কিছুই চাই না। আমি শুধু চাই প্রতিশোধ।

দু’মাস হলো এখানে এসেছি। সবার সাথে কমিউনিকেট করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। যতই ইংরেজি বুঝি না কেন, এত বছরের অভ্যাস তো এক নিমেষেই যাবে না। মাতৃভাষায় কথা বলার সুখই আলাদা।

একজন বন্ধু আর একজন বান্ধবী পেয়েছি এখানে এসে। শুভ আর ক্রিস্টি। শুভ বাংলাদেশ থেকে এসেছে। ক্রিস্টি এখানের নাগরিক। ওরা দুজন খুব হেল্পফুল। আসার পর মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওরাই আমাকে সব দিক থেকে সাহায্য করেছে। ক্রিস্টি মাঝে মাঝে আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ওকে আমার অতীত সম্পর্কে কিছুই বলিনি। তবে ও এটা বুঝে যে আমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। এক ধরনের মাইন্ড রিডার ক্রিস্টি। মুখ দেখলেই মনের ব্যপারে বুঝতে পারে। শিমুর সাথে কথা হয় ভিডিও কলে। ও মাঝে মাঝে নেহালের ব্যাপারে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি ও যদি নেহালকে নিয়ে কথা বলে তাহলে আমি ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবো। তাই এখন আর কিছু বলে না।

দেখতে দেখতে দু’বছর হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই জীবন চলছে। শুধু একাকীত্বটা খুব বেশি গ্রাস করে মাঝে মাঝে। একটা পার্ট টাইম জব নিয়েছি নিজের খরচ চালানোর জন্য। আমাকে টাকা পাঠানোর মতো কেউ নেই। বাবা-মা মারা যাবার পর সব আত্মীয়রা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কেউ আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে নি। তাদের ভাষ্যমতে আমি নষ্টা মেয়ে। কখনো কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকাইনি পর্যন্ত। তবুও নেহালের ভুলের কারণে এসব হলো। নেহাল নামক চরিত্রটাই আমার জীবনে একটা ভুল।

কলিং বেল বাজছে। দরজার সামনে ক্রিস্টি দাঁড়িয়ে। এসে ভালো করেছে। একা একা খারাপ লাগছিল।
দুজন কফি বানিয়ে গল্প করতে লাগলাম।

– So, what have you decided? (Cristy)

– You mean?(আমি)

– What will you do after completing study?

– haven’t thought yet.

– হেই ঠুমি বাংলাডেশে ব্যাক খরার খটা বাবছো না থো?

ক্রিস্টি আমার কাছ থেকে ভাঙা ভাঙা বাংলা শিখেছে। কিন্তু ওদের একসন্টে ত, থ, দ, ধ এসব উচ্চারণ করতে পারে না।

– আরে না।

– টোমাকে একানেই টাকটে হবে। আমার বেবীডের আন্টি লাগবে। ঠুমি না টাকলে ওরা আন্টি ডাকবে খাকে।

– ওকে বাবা আমি এখানেই থাকবো। আগে বিয়ে তো করো।

– Yeah me and john have decided to get married.

– Wow congratulations!

– Thanks dear

– শুভকে ইনভাইট করবে না?

– Of course. He is our best friend

কিছুদিন পর ক্রিস্টির বিয়ে হয়ে গেল। খুব একা একা লাগে। আগে ক্রিস্টি সময় পেলেই চলে আসতো। আমিও ওর বাড়িতে চলে যেতাম। এখন সেটা সম্ভব না। ক্রিস্টি জানে আমি একা একা বোর হব। তাই ও বার বার বলেছে সময় পেলেই ওর কাছে যেতে। কিন্তু ওরা নিউ কাপল। যখন তখন যাওয়াটা মানায় না।

নেহালের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। আমি কি ওকে মিস করি? হয়তো করি, হয়তো না। এসব নিয়ে ভাবার ইচ্ছে নেই। আমি ওকে ঘৃণা করি। যখন ওর কথা বেশি মনে পড়ে বাবার ছবি দেখি। তখনই আবার ওকে ঘৃণা করতে শুরু করি।

বিকেলে পার্কে আসলাম। ঘরে বসে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সারাক্ষণ পুরোনো কথা মনে পড়ে। সেদিন যখন আমি আর নেহাল বাবার বাসায় গেলাম সেখানে কেউ ছিল না। পাশের বাসয় যখন জিজ্ঞেস করলাম ওরা বললো আমাকে নেহাল তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মা কয়েকদিন বাসায় এসেছিল কিন্তু পরে আর কেউ বাবা মাকে দেখেনি। কয়েকজন লোক এসে নাকি বাসার আসবাবপত্র সব নিয়ে গেছে। ওরা জিজ্ঞেস করতেই বলেছে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তো এসব শুনে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির।

– কেঁদো না প্লিজ(নেহাল)

– খবরদার আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না। আপনার জন্য এসব হয়েছে।

– হ্যাঁ আমার জন্য হয়েছে। তুমি দেখো বাবা ঠিক সুস্থ আছেন। ওনারা হয়তো তোমার কোনো খোঁজ না পেয়ে গ্রামে চলে গেছেন।

– তাহলে আমি গ্রামে যাবো। বাবাকে দেখবো।

– হ্যাঁ চলো, আমরা গ্রামে যাবো।

আমরা দুজন গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।

– কি এত ভাবছো শুনি!(শুভ)

– আরে তুমি কখন এলে!

– এসেছি অনেকক্ষণ। কিন্তু তুমি তো বুঝতেই পারোনি। একমনে এত কি ভাবছো?

– তেমন কিছু না।

– তুমি সব সময় সব কথা চেপে রাখো কেন বলোতো। মনের কথা না বললে মন হালকা হয় না।

– মন!!

– কিছু বললে?

– না কিছু না। তুমি এখানে কি করছো?

– আমি তো প্রায়ই বিকেলে এখানে আসি। খোলা হাওয়ায় হাঁটতে ভালো লাগে।

– (আমিও একসময় খোলা হাওয়ায় কারও পাশাপাশি হাঁটতাম)

– কি হলো চুপ কেন?

– কিছু না। কফি খাবে?

– মন্দ হয় না।

– চলো।

ক্রিস্টির বিয়ে হয়ে যাওয়াতে এখন শুভর সাথে একটু বেশিই সময় কাটানো হয়। আর কোনো বন্ধু নেই এখানে। মাত্র দুমাস বাকি পরীক্ষার। শুভর সাথে ছিলাম তখনই শিমু মেসেজ দেয়।

– বিজি আছিস?

– একটু।

– আচ্ছা ফ্রি হয়ে কল দিস।

মনে হলো ইমপরট্যান্ট কিছু বলবে। কফিটা শেষ করেই চলে যাব।

– আমাকে যেতে হবে।

– আরে এইতো কফিশপে আসলাম। অনেকদিন পর দেখা আরেকটু গল্প করি (শু্ভ)

– শুভ, তিন দিন পর দেখা হয়েছে। অনেকদিন না।

– ওই তিনদিন-ই অনেকদিন।

– হাহাহা মাত্র তিনদিন বুঝি অনেকদিন?

– সে তুমি বুঝবে না।

– (আমি সবই বুঝি শুভ। কিন্তু সব বুঝেও প্রকাশ করতে নেই) সে যা-ই হোক। আমি যাচ্ছি। একটা জরুরী কাজ আছে।

– কোথায় যাবে? আমি ড্রপ করে দেই?

– লাগবে না, আসছি।

বাসায় ফিরে শিমুকে কল দিলাম।

– ভিডিওতে আয় (শিমু)

ভিডিও অন করলাম। ও একটা ছেলের ছবি দেখালো।

– উনি কে?

– বল কে হতে পারে?

– উঁহু বুঝতে পারছি না। বল না কে?

– তোর হবু দুলাভাই।

– মানে?

– মানে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসের ২০ তারিখ।

বিয়ের কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমনই একদিনে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শিমুকে বুঝতে দিলাম না।

– ওয়াও কংগ্রাচুলেশনস।

– থ্যাংকস। তুই কিন্তু আসছিস।

– আমি?

– তো কি তোর ভূত আসবে? দেখ আমি কোনো বাহানা শুনতে চাইনা। তুই আসবি ব্যাস। তোর যদি থাকতে সমস্যা হয় তবে কয়েকদিন পরই চলে যাস। তবু তোকে এটেন্ড করতেই হবে।

– কিন্তু শিমু আমার দুমাস পর এক্সাম। এখন গিয়ে আবার আসতে ১০-১৫ দিন তো লাগবেই। পড়ার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

– এবার কি হবে?

– কি আর হবে। তুই বিয়ের পিড়িতে বসে যা। তোর পুচকু হলে আমি এসে দোয়া করবো।

– ফাজলামো ছাড়। তুই না এলে হবে না। আচ্ছা ডেট পিছিয়ে দিলে আসতে পারবি?

– কতদিন পিছাবি?

– তোর পরীক্ষা পর্যন্ত।

– বলিস কি এতদিন? আমার একার জন্য ডেট পেছাবি? এটা ঠিক হবে না।

– আরে বাবা মাত্র তো কথা পাকা হয়েছে। এখনও কাউকে ইনভাইট করিনি। তাই ডেট পেছানো যাবে।

ভেবেছিলাম পরীক্ষার বাহানায় হলেও যেতে হবে না। কিন্তু এ তো পিছুই ছাড়ছে না। আমি চাই না দেশে ফিরে কোনো রকম পুরোনো স্মৃতির সম্মুখীন হই।

– ঠিক আছে, আসবো।

– শিওর তো? পরে যদি মত বদলাস তাহলে আমার মুখ আর কখনও দেখবি না।

– এই কি বলিস। তুই ছাড়া আমার আছে কে বল।

– মনে থাকে যেন। এখন রাখছি।

পাগলীটা আমাকে নিয়েই ছাড়বে। ও এটা বুঝছে না আমি ওখানে গেলে আমার মনের অবস্থা কেমন হবে। তবুও ওর খুশির জন্য যেতে হবে।

পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। শুভ দেখা করতে বলেছিল। আজ সময় করে আসলাম দেখা করতে। কত তাড়াতাড়ি সময় চলে যায়। দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল।

– সরি একটু লেট হয়ে গেল(শুভ)।

– নো প্রবলেম (আমি)।

– অনেকক্ষণ এসেছো?

– কিছুক্ষণ।

– আসার সময় এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। ওকে একটা জবের ব্যাপারে বলেছিলাম। সেই বিষয়ে কথা বললাম। আচ্ছা তোমার কি ইচ্ছা? আগের পার্ট টাইম জবটাই করবে না-কি অন্য কোথাও চেষ্টা করবে?

– আগে দেশ থেকে ঘুরে আসি তারপর দেখা যাবে।

– তুমি দেশে যাচ্ছো?

– হ্যাঁ।

– কই, আমাকে বলো নি তো?

– বলা হয়নি। আজই বলবো ভেবেছিলাম। বান্ধবীর বিয়ে। ও খুব করে বলেছে। না গেলে কষ্ট পাবে।

– তুমি যখন যাচ্ছো আমিও যাবো।

– আমি গেলে তোমাকে কেন যেতে হবে?

– তুমি যাচ্ছো তাই আমারও যেতে ইচ্ছে করছে। ফ্লাইট কবে তোমার?

– পাঁচদিন পর।

– আমিও যাবার ব্যবস্থা করছি।

– তোমার যেমন ইচ্ছা! আমি ক্রিস্টির সাথে দেখা করবো। ওকেও বলা হয়নি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here