গল্পঃ অবশেষে তুমি পর্ব – ৭(শেষপর্ব)

গল্পঃ অবশেষে তুমি
পর্ব – ৭(শেষপর্ব)
কলমেঃ Asma Aktar Urmi

শিমুদের বাসার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালাম।

– এখন আসছি(আমি)।

– একা একাই যাবে?(নেহাল)।

– একা যাব কেন? ক্রিস্টি আছে সাথে।

– না মানে বলছিলাম…..

– কি?

– আমি সাথে আসি?

– আমি রাস্তা চিনি।

– সেটা আমি জানি। তবুও আসি?

– আপনি এলাকার যথেষ্ট নামী মানুষ। শিমুর বাসার কেউ আমাকে আপনার সাথে দেখলে খারাপ ভাববে। আমাকে খারাপ ভাবলে সমস্যা নেই। কিন্তু আমার জন্য শিমুকে খারাপ বললে আমি সেটা মানতে পারবো না।

– আমি ভালো হয়ে গিয়েছিলাম নিসা। ৫টি বছর আমি সাধারণ একজন ভালো মানুষ হয়ে ছিলাম। শুধু অপেক্ষা করেছি তোমার পড়াশোনা শেষ হলে তুমি ঘরে ফিরে আসবে। দুজনের ছোট্ট একটা সংসার হবে। ঘরজুড়ে ছোট্ট একটি পরী খেলা করবে। আধো আধো বোলে আমাকে বাবা বলে ডাকবে। তুমি যেটা চেয়েছিলে আমি তোমায় দিয়েছিলাম। তুমি চেয়েছ হোস্টেলে থেকে পড়বে। আমি বাঁধা দেই নি। কারণ তোমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো তারাও তোমার স্বপ্ন পূরণ করতেন। তাদের অবর্তমানে তোমার স্বপ্ন ভাঙতে চাইনি। তুমি যা বলেছো মেনে নিয়েছি। তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাইতে না সেটাও মেনে নিয়েছি। ভেবেছি আমার সাথে দেখা করে তোমার পড়াশোনা নষ্ট করার দরকার নেই। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিছুই পূরণ হয়নি।

কথাগুলো বলতে বলতে নেহালের গলাটা ধরে গেল। আমার চোখে কখন জল এলো বুঝতেই পারি নি। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। সেদিন ওকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। ওর সাথে বসে সমঝোতা করা উচিত ছিল। নিজের প্রতিশোধের জন্য একজন মানুষের এত স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছি আমি।

– দোষ কি আমার একার ছিল? কেন করেছিলাম আমি এসব?

– আমি তো নিজের দোষ স্বীকার করছি। ক্ষমাও চাইছি।

– আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে।

– আমি সাথে আসি? ওদের বাসার সামনে যাব না।

– আচ্ছা চলুন।

সামান্য একটু রাস্তা। ১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছি। ক্রিস্টি পেছনে।
শিমুর বাসার কিছুদূরে এসে নেহাল দাঁড়িয়ে গেল। আমরা চলে আসলাম। পুরোটা সময় ক্রিস্টি মুচকি মুচকি হেসেছে।

বাসায় ফিরতেই ক্রিস্টি শিমুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগল।

– I told you she still loves him(ক্রিস্টি)

– Really?(শিমু)

– I’ve seen today. How romantic!

– আমি বলেছিলাম না? এতদিনের রাগ পুষে রেখেছে। রাগ কমে গেলেই দু’জন এক হয়ে যাবে। এখন দেখলে তো?

– কি হচ্ছে এসব?(আমি)

– কি আর হবে? পুরোনো গাছে নতুন করে ফুল ফুটেছে সেটাই বলছি(শিমু)

– আমি কি বলেছি যে আমি ওকে ভালোবাসি?

– সব কথা বলতে হয় না। তোর চোখ মুখের খুশিই বলে দিচ্ছে তুই ওকে ভালোবাসিস।

– এটা তোর বিয়ের খুশি।

– হুম হুম বুঝেছি। এখন চল ব্রেকফাস্ট করবি। তারপর আবার পার্লারে যেতে হবে।

– এত সকালে?

– সকাল আর কোথায়। খাওয়া দাওয়া করে রেডি হয়ে যেতে সময় লাগবে। তুই যাচ্ছিস তো?

– না বাবা, আমার বোরিং লাগে। তোরা যা।

– আরে চল। এখন তো তোরও সময়।

– শিমু বেশি হচ্ছে কিন্তু।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তুই সত্যিই যাবি না?

– না, তোরা যা।

– ক্রিস্টি তুমি যাবে?

– Parlour? Of course. I like make up.

– তাহলে চলো। ও একা বসে থাকবে।

নাস্তা শেষে ওরা চলে গেল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। রাতে ঘুমাইনি। এক মগ কফি লাগবে এখন। রান্নাঘরে কেউ আছে না-কি কে জানে। মেহমানকে কফি বানাতে দেখলে কে কি ভাববে? যা ভাবার ভাবুক। এখন মাথাটা ঠিক করতে হলে কফি লাগবে। রান্নাঘরে এলাম। নাহ কেউ নেই। ভালো হয়েছে। কেউ না থাকলে নিজের রাজত্ব মনে হয়।

খুব গরম চা কফি খাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। কম তাপমাত্রায় এলে তবেই খেতে পারি। কফি হালকা ঠান্ডা হওয়ার জন্য টেবিলে রাখলাম। এসব কি করলাম আমি? এতদিনের জমানো রাগ এক নিমেষেই শেষ করে দিলাম। ভেবেছিলাম নেহালকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না। কিন্তু ওর মায়াভরা মলিন মুখটা আমাকে ক্ষমা করতে বাধ্য করলো। কত সহজে আমি ওর কথা মেনে নিলাম। আজ আর রাগ হচ্ছে না ওর ওপর। ওকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে। ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার। মেসেজ ওপেন করলাম।

– ওদের সাথে গেলেই পারতে।

– কাদের সাথে? কে আপনি? (রিপ্লাই দিলাম)

– শিমুর কথা বলছি। পার্লারে গেলে পারতে।

– নাম্বার পেলেন কোথায়?

– বাতাসে।

– আমার এবং আমার নাম্বার দুটোরই ওজন আছে। আমরা বাতাসে ভাসি না। আমার পার্লার বোরিং লাগে।

– কেমন ওজন সে তো দেখেছি। ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে।

– মোটেও না।

– চেহারার যা অবস্থা করেছো…. পার্লারে গিয়ে ঠিক করে এসো।

– এখন কি পঁচা লাগছে?

– পঁচা না। তবে আগে আরো ভালো লাগতো।

– এখন বয়স হয়েছে। বুড়ি হয়েছি।

– ২৭ বছরের বুড়ি।

– আমার বয়সের হিসাবও আছে দেখছি।

– সে তো আছেই।

– কিন্তু আমি তো আপনার বয়স জানি না।

– বলো কি?

– কখনও প্রয়োজন হয়নি তাই জিজ্ঞেস করা হয়নি।

– তা-ও ঠিক।

– আপনি আমার বয়স জানলেন কিভাবে?

– তোমার বিয়ের কার্ডে দেখেছিলাম।

– আমারটা যখন জানেন এবার আপনারটাও বলে দিন।

– পাগল!

– কেন? বললে কি সমস্যা?

– তারপর যদি দেখো আমার বয়স অনেক বেশি তখন যদি রিজেক্ট করে দাও?

– আমি সিলেক্ট করলাম কখন?

– সে যা-ই হোক। আমি কিন্তু বিয়েতে আসছি।

– কি বলেন? শিমু জানে?

– হ্যাঁ জানে।

– কিন্তু সবাই আপনাকে দেখলে……

– তুমি চিন্তা করো না। ব্যবস্থা করা আছে।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে। শিমুকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। সবাই মিলে ওকে হলুদ দিচ্ছে। আমার চোখটা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

– এই নিসা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?(শিমু)

– কিছু না (আমি)।

– এখানে আয়।

– আসছি।

– বস এখানে।

শিমুকে হলুদ লাগিয়ে দিলাম। ও আমার কপালে একটু হলুদ দিয়ে দিলো। পেছন থেকে কে যেন আমার গালে হলুদ দিলো। তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। অবাক করা বিষয়! কেউ নেই তাহলে হলুদ দিলো কে? পাশ থেকে শিমু মুচকি হাসছে।

– তুই করেছিস এটা তাই না?(আমি)

– আমি না(শিমু)

– হ্যাঁ তুই। তা নাহলে কে হলুদ দিলো?

– সত্যি আমি দেই নি।

ও আবারও মুচকি হাসছে। ফোনে মেসেজ এলো।

– ওকে বকছো কেন? কাজটা আমি করেছি।

– চোরের মতো কাজ করেন কেন? সাহস থাকলে সামনে এসে দিন।

– সাহস আছে আর সামনে গিয়েই দিয়েছি।

– কই আমি তো দেখলাম না।

– অন্য বেশে আছি তাই দেখো নি।

– মানে কি? কোন বেশে আছেন?

– যেভাবেই থাকি না কেন, তোমাকে কিন্তু বেশ লাগছিল।

– কখন?

– ওই যে, একটু পর পর এদিক সেদিক তাকিয়ে আমাকে খুঁজছিলে।

– কে বলল আপনাকে খুঁজছি? আমার কি আর কোনো কাজ নেই?

– সকাল থেকেই আমি তোমার আশে পাশে ঘুরছি। তোমার চোখ কখন কোথায় সেটা ভালোভাবেই দেখেছি।

– আমি মোটেও কাউকে খুঁজি নি।

– জানি জানি।

– সামনে আসুন।

– সামনে আসলে আমাকে হলুদ মেখে দিতে হবে।

– আচ্ছা দিব। এবার আসুন।

শরবত শরবত!!(ওয়েটার)

– আরে আপনাকে কতবার বললাম শরবত খাব না আর আপনি……….

হা হয়ে গেলাম। এটা ওয়েটার না। ওয়েটার সেজে নেহাল এসেছে। নকল দাঁড়ি পরেছে, চেনাই যাচ্ছে না।

– আপনি? এভাবে?

– জি ম্যাডাম। সকাল থেকে তুমি আমাকে অনেকবার দেখেছো।

– কিন্তু আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।

– চেনা যাবে না তাই তো এভাবে এসেছি। দাও তো এবার হলুদ মেখে দাও।

আলতো করে হলুদ মেখে দিলাম। ও আমার আরেক গালে হলুদ মেখে দিলো। শিমু আর ক্রিস্টি এসব দেখে হাসছে। ক্রিস্টি খুব আনন্দ করছে। ওদের কালচার আর আমাদের কালচার আলাদা। তবে বাংলাদেশে বিয়েতে হই-হুল্লোড় একটু বেশিই হয়। পেছন থেকে কেউ একজন আমার চোখ ধরলো।

– কে?(আমি)

– ভেবে দেখো।

– শুভ?

– হ্যাঁ শুভ।

– এভাবে সবার সামনে কি করছো?

– আরে আমরা বন্ধু। এসব কোনো ব্যাপার না।

আমি আশেপাশে দেখছি। নেহাল দেখেছে কি-না। ওর যা রাগ। কখন আবার শুভকে পেটাতে শুরু করে। ওকে রাগাতে চাচ্ছি না। তাছাড়া ওর খারাপ লাগে এমন কিছুও করতে ইচ্ছে করছে না।

– এদিক ওদিক কি দেখছো?

– না কিছু না। তুমি কখন এসেছো?

– এইতো কিছুক্ষণ।

– শিমুর সাথে কথা হয়েছে?

– না। এসেই প্রথমে তোমার সাথে কথা বললাম।

– যার বিয়েতে এসেছো তার খোঁজ না নিয়ে আমার খোঁজ নিচ্ছো?

– যদি বলি তাই!

– এসো শিমু ওখানে আছে।

শিমুর কাছে ওকে নিয়ে গেলাম। শুভ, শিমু আর ক্রিস্টি কথা বলছে। কে যেন পেছন থেকে আমার আঙ্গুলে জোরে একটা চিমটি দিলো।

– উফফ কে রে…

পেছনে ফিরে দেখি নেহাল দাঁড়িয়ে সাপের মত ফোঁসফোঁস করছে। সেরেছে! যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাটাই হয়েছে। এখন?
ও আমার দিকে রাগি একটা চাহনি দিয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগল। ওর চাহনির মানে হলো আমাকে ফলো করো। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো তাই করছি। ও খাবারের পাশে যেখানে লোকজন একটু কম সেখানে দাঁড়ালো। আমি ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম।

– এসব কি হচ্ছে?

– কিসব?

– কে ওই ছেলেটা।

– ও আর আমি একসাথে লন্ডনে পড়াশোনা করেছি।

– তোমার লন্ডনের আর কতজন বন্ধু আছে এখানে?

– আর কেউ নেই। এই দুজনই।

– তুমি আর ওর সাথে কথা বলবে না।

– বললে কি হবে?

এবার আরও রেগে আমার দিকে তাকালো।

– আরে না না, আমি তো মজা করছি। ঠিক আছে আর কথা বলবো না।

খুব হাসি পাচ্ছে। সামান্য একটু চোখ ধরেছে তাতেই গা জ্বলে যাচ্ছে। সারাদিন শুভকে এড়িয়ে চললাম। ও যতই আমার সাথে কথা বলতে চায় আমি কোন না কোন কাজের বাহানা দিয়ে সরে যাই। আর নেহাল শুভর দিকে ভয়ংকর চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওকে চিবিয়ে খাবে। আমি শিওর এটা বিয়ে বাড়ি না হলে কিছু একটা করেই ছাড়তো।

সবার চিল্লাপাল্লায় ঘুমটাও আরামের হলো না।

– এই নিসা ওঠ। ৮টা বাজে।

– আরেকটু ঘুমাতে দে না।

– নাস্তা করে পার্লারে যাব ওঠ।

– আমি তো বলেছি আমার ওসব ভালো লাগে না।

– সোজা কথায় যাচ্ছিস না পরে তো ঠিকই যাবি।

– মানে? পরে কেন যাব?

– সময়মত বুঝবি। আমি গেলাম।

– যা তো।

এর মধ্যে ফোনে কল আসলো। ধুর আরামের ঘুমটাই শেষ করে দিলো এরা।

– হ্যালো…

– অনেক ঘুমিয়েছো। এবার বিছানা ছাড়ো।

– আমি কি আপনার শত্রু?

– কেন?

– যেই দেখলেন একটু আরামে ঘুমাচ্ছি অমনি জ্বালাচ্ছেন।

– আমি আরও একঘন্টা আগে থেকে তোমাকে জাগাতে চাইছিলাম। কিন্তু জাগাইনি। এখন লক্ষী মেয়ের মতো উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করো। তারপর ওদের সাথে পার্লারে যাও।

– আমি কেন যাব?

– কারণ আজ তুমিও সাজবে। আমি দেখবো।

– আপনি তো সাজুগুজু অবস্থায় দেখেছেন। তাও আবার বিয়ের সাজে দেখেছেন।

– ওটা অন্যরকম ছিল। এটা অন্যরকম।

– কেমন?

– সময়মতো বুঝবে। এখন ঝটপট ওঠো।

কি আর করা! উঠলাম। নাস্তা শেষ করে সবাই পার্লারে আসলাম। উফ এত সময় লাগে কনে সাজাতে? এইজন্যই আমি আসতে চাই না। সাইডে ছোট্ট একটা বেঞ্চির মত আছে। আমি একটু কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। অর্ধেক বসা অর্ধেক শোয়া। ব্যাপার না ঘুমানো যাবে।

– এই নিসা ওঠ। এখানে কেউ ঘুমায়?

– ঘুমাতে দে তো।

– এটা বেডরুম না, পার্লার। ওঠ, এবার তোর সাজার পালা।

– কতবার বললাম আসবো না।

– বলেছিলাম না সোজা কথায় রাজি হচ্ছিস না কিন্তু ঠিকই রাজি হবি।

ঘুম চোখেই চেয়ারে বসলাম। আমাকে কেমন লাগছে সেটাও দেখার সময় নেই, আমি ঘুমে ঢুলছি। সাজানো শেষ হয়ে গেলে আমরা বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠলাম। যখন গাড়ি থামলো গাড়ির ব্রেকে আমার ঘুম ভাঙলো। কিন্তু আমরা কোথায় এসেছি?

– একি শিমু, আমরা কোথায়?

– ভালো করে দেখ।

– আরে এটা তো কাজী অফিস!

– হ্যা কাজী অফিস।

– এখানে বিয়ে করবি করবি কেন? বাড়িতে এত আয়োজন হচ্ছে আর তুই এখানে বিয়ে করবি?

– হ্যাঁ।

– কিন্তু কেন? তুই তো লাভ ম্যারেজ করছিস না যে বাড়ি থেকে মানবে না তাই পালিয়ে বিয়ে করবি।

– তুই না অনেক কথা বলিস। চল ভেতরে।

আমাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখলাম নেহালও আছে।

– আপনিও এখানে? বিয়ের কনে কে বাড়িতে না পাঠিয়ে এখানে আসতে সাহায্য করছেন?

– বিয়ের কনে তো এখানে একজন না, দুজন।

– মানে?

– নিজের চেহারাটা দেখো।

শিমু আমার সামনে আয়না দিলো। হায় আল্লাহ, এইটা কি আমি? মেকাপ দিয়ে পুরা সাদা বানিয়ে দিয়েছে। আমাকে কেন এভাবে সাজালো? তাড়াতাড়ি ব্যাগের মধ্যে মিনি ফেসওয়াশটা খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম।

– এই তুই এটা দিয়ে কি করবি?(শিমু)

– মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হবো। দেখছিস না কেমন লাগছে।

– মোটেও না। খুব সুন্দর লাগছে। আর নতুন বউকে এভাবেই থাকতে হয়।

– নতুন বউ মানে?

– মানে এখানে তোর বিয়ে হবে, আমার না।

– আমার বিয়ে?

– হ্যাঁ তোর। তোদের দুজনকে এভাবে ছন্নছাড়া দেখতে আমাদের আর ভালো লাগছে না। তুইও অনেক কষ্ট পেয়েছিস আর নেহাল ভাইও অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তোদের দুজনের কষ্টের অবসান করতে চাই।

– আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই।

নেহাল এগিয়ে এলো।

– তোমার মন কি চায় নিসা?

– জানি না।

– জানতে হবে নিসা। তুমি কি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করেছো?

– হ্যাঁ।

– একদিন তুমি বলেছিলে আমাকে ছাড়া থাকতে চাও না। আমার সাথে থাকতে চাও। সেটা কি সত্যি ছিল?

– হ্যাঁ।

– আজ কি তোমার মনে আমার জন্য সেই ফিলিংস আছে নিসা? ভেবে বলো।

– আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। এভাবে হঠাৎ, কাউকে না জানিয়ে……

– কাকে জানাবি? তোর এখানে আছে কে আমরা ছাড়া? তোর যে আত্মীয়রা তোর বিপদে তোর পাশে দাঁড়ায়নি তাদের জানাবি?(শিমু)

– মোটেও না(আমি)।

– তাহলে আর কি ভাববি? আমি যা বুঝি তুই নেহাল ভাইকে ভালোবাসিস। আর সে-ও তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে সেটা তুই নিজেও ভালোভাবেই জানিস।

– শিমু ওকে জোর করো না। ও যদি রাজি না থাকে তাহলে এখানে সময় নষ্ট না করে চলো তোমাদের বাড়িতে যাই। ওখানে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে(নেহাল)

আমার মনে হচ্ছে কি যেন একটা হারিয়ে ফেলবো। কি হারাব সেটা বুঝতে পারছি না। নেহালকে বিয়ে করে আমার মুক্ত জীবন হারাবো? না-কি বিয়ে না করে নেহালকে হারাবো? আমি একটা চেয়ারে বসলাম। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম। আমি নেহালকে চাই। চেয়ার থেকে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

– আমি একবার আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। আর যাব না। আপনার কাছেই থাকব।

বলে কাঁদতে লাগলাম। নেহাল আমার মাথায় হাত রাখলো।

– কাঁদে না পাগলী। আমি জানতাম একদিন তুমি আমার হবে। আমি তোমার অপেক্ষায়ই ছিলাম।

– আমি এক্ষুণি বিয়ে করবো, এক্ষুণি।

– এত জলদি? একটু আগেও বিয়ে করতো চাইছিল না। আর এক্ষুণি করবে(শিমু)।

– এই চুপ। একদম কথা বলবি না।

বিয়েটা হয়ে গেল। আমার মেকাপ মুছে শিমুদের বাড়ি গেলাম। এই বিয়ের সাজে কেউ আমাকে দেখলে পাগল বলবে।

বিয়ে বাড়িতে নেহাল যতটা না আমার আশেপাশে আছে তার চেয়ে বেশি আছে শুভ। আমার পিছুই ছাড়ছে না। আর নেহাল তো এসব দেখে রেগে আগুন। ভাবছি শুভর কপালে দুঃখ আছে। তবে ওকে দু-চারটা দিলে মন্দ হবে না। খুব জ্বালাচ্ছে আমাকে।

শিমুর বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে নেহালকে কানে কানে কি যেন বলল।
ও যাবার পরে ক্রিস্টি, শিমুর অন্য এক বান্ধবী, আমি আর নেহাল একটা গাড়িতে উঠলাম।

– আমরা কোথায় যাচ্ছি?(আমি)

– সারপ্রাইজ (নেহাল)।

– বলুন না!

– শিমু আমাদের জন্য গিফট দিয়েছে। সেটা আনতে যাচ্ছি।

– গিফট মানুষ হাতে দেয়। আর ওর গিফট আনতে গাড়িতে করে যাওয়া লাগবে?

– হয়তো এটা স্পেশাল গিফট।

– আপনি জানেন?

– না। আন্দাজ করলাম। কিন্তু তার আগে একটু কাজ করতে হবে।

– কি কাজ?

– তোমাকে করতে হবে না। তুমি চুপ করে বসে থাকো ওরা দুজন করবে।

ওরা দুজন মিলে আমাকে সাজিয়ে দিলো গাড়ির মধ্যেই। এবার পুরো নতুন বউ লাগছে।
আমরা একটা হোটেলের সামনে নামলাম। ভেতরে গিয়ে নেহাল রুমের চাবি নিলো। আমাদের রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে ওরা দুজন আমাদের “অল দ্যা বেস্ট” বলেই কেটে পড়ল। ভেতরে দেখলাম বেডটা ফুল দিয়ে সাজানো। রুমে কোন বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো নেই। পুরো রুম গোটা ত্রিশেক মোম জ্বেলে আলো করা। খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। নেহাল পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলো।

– এটা আমাদের বাসরঘর বুঝলে। শিমু গিফট করেছে।

– নিজের ঝামেলার মধ্যে আবার বাড়তি ঝামেলা করলো।

– ও তোমাকে খুব ভালোবাসে।

– আমার তো মনে হচ্ছে ওর নেহাল ভাইকেই বেশি ভালোবাসে। কত ভাব দুজনের মধ্যে!

– হাহাহা সেটাও তো তোমার জন্যই হয়েছে।

– হুম।

– আর পালিয়ে যাবে না তো?

– কখনো না।

নেহাল আমাকে বুকে টেনে নিলো।

আজ আবার এয়ারপোর্টে বসে আছি। তবে আজ একা নই। সাথে আছে নেহাল। আরও আছে শিমু, ওর হাজব্যান্ড আর ক্রিস্টি। আমার কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ আর জিনিসপত্র লন্ডনে আছে। ওগুলো আনতে হবে। তবে নেহাল আমাকে একা যেতে দেবে না। আবার যদি পালাই! ক্রিস্টি বললো আমরা যখন কাজে যাচ্ছি তাহলে আমাদের আর শিমুদের হানিমুনটা ওখানেই হোক। তাই সবাই আজ একসাথে।

কয়েক বছর পর…..

– নাঈম, এই নাঈম।

– উমম।

– ছাড়ো আমাকে, গরম লাগছে।

– ছাড়বো না।

– নেহাল, সরে যাও।

– উমম (নেহাল)

– তুমিও উমম? সরে ঘুমাও বলছি।

– না

– এভাবে ধরে রাখবে?

– হ্যাঁ।

– গরম লাগছে তো!

– না

– নাঈম তুমি সরে ঘুমাও। বিদ্যুৎ নেই। ঘেমে ভিজে গেছি।

– ছাড়বো না।

– দু’জন এভাবে আমার কি অবস্থা করছো জানো? নড়তে পারছি না।

– মামনি তোমার নড়ার দরকার নেই। তুমি ঘুমিয়ে গেলে হাত পা ছুঁড়তে থাকো। এভাবেই তোমাকে সোজা রাখা যাবে।

– এত রাতে ফাজলামো হচ্ছে?

– একদম ঠিক বলেছিস বাবা। এই না হলে আমার ছেলে! (নেহাল)

– আমি গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। তোমরা দুজন এভাবে আমাকে জাপটে ধরে আছো তার উপর ফাজলামো?

– মামনি তুমি তো জানো তোমাকে না ধরে ঘুমালে ঘুম হয় না। আমারও না, বাবারও না।

– তোরা বাপ বেটা মিলে জ্বালিয়ে মারলি আমাকে। গরমের দিনে তো একটু ছাড় দিবি।

– ঘুমের সময় কোনো ছাড় নেই। তুমি ছাড়া আমাদের ঘুম হয় না।

– বাপ আগে থেকেই পাগল ছেলেটাও পাগল হয়েছে। তোরাই ঘুমা আমি জেগে থাকি।

– সমস্যা নেই মামনি। এভাবে ধরে রাখলে তোমারও ঘুম এসে যাবে

– পাজি ছেলে। আয় কোলে আয়।

আমরা অন্য একটা শহরে চলে এসেছিলাম যেখানে নেহালকে কেউ চেনে না। বিদেশ থেকে ডিগ্রি আনার কারণে ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। নতুন জীবন শুরু করলাম আমরা। নেহাল ছোট্ট পরী চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে পরী দিতে পারি নি। দিয়েছি একটা ভূত। মাঝে মাঝে এমনভাবে ভূত সাজে যে দেখলে আমি নিজেই ভয় পাই। সারাদিন হরর মুভি দেখবে আর আমার ওপর অত্যাচার করবে। আর রাত হলে বাবা ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। বান্ধবীরা শুনেছি ওদের বরের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। আর আমার বর আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। তার দেখাদেখি ছেলেটাও অমন হয়েছে। দু’জন দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। আমার ছোট্ট সংসার।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here