গল্পঃ অবশেষে তুমি
পর্ব : ৬
কলমেঃ Asma Aktar Urmi
নেহালকে দেখার পর থেকে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। ভয় না-কি অন্য কিছু বুঝতে পারছি না। নিজেকে নিজে বোঝার চেষ্টা করলাম।
ও যদি আবার আমাকে তুলে নিয়ে যায়?
এখন আর কোনো পিছুটান নেই। আমাকে মেরে ফেললেও কেউ কাঁদবে না। তাছাড়া এখন আমি সেই বাচ্চা মেয়েও নই যে কিছু করতে পারবো না।
আমি তো ওকে ভয় পাচ্ছি না। তাহলে এত অস্থিরতা কিসের?
ও যদি আমার সামনে এসে প্রশ্ন করে আমি কেন এমন করলাম তাহলে? কি জবাব দেবো আমি? নাহ্ বুঝতে পারছি না। এটাই অস্থিরতার কারণ।
ওর জন্য বাবা-মা মারা গেছেন। এর জন্য কি ওকে এত বড়ো শাস্তি দেওয়া ঠিক হলো? ওর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে ওকে এভাবে আঘাত দেওয়া ঠিক হয়েছে? ও তো আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল। আমিও তো এক সময় ওকে ভালোবেসেছিলাম! আমি কি এখনো ওকে ভালোবাসি?
বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। শিমুদের বাসায় উঠেছি আমি আর ক্রিস্টি। আমরা হোটেলে থাকতে চেয়েছিলাম, শিমু থাকতে দিলো না। কিন্তু এখানে তো অন্য সমস্যা হচ্ছে। নেহাল সেই আগের মতো শিমুদের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাকে দেখলে তবেই যায়। এ তো আরেক বিপদ। বাসায় শিমুদের আত্মীয়রা এসেছেন। ওনারা কি ভাববেন? ওকে এখান থেকে সরাতে হলে আমাকে ওর সাথে কথা বলতে হবে। আমার জন্য শিমুর সম্মান নষ্ট হোক এটা আমি চাই না।
সেই দুপুর থেকে নেহাল দাঁড়িয়ে আছে। একটা চিরকুটে লিখলাম, “কাল ভোর ছয়টায় পাশের পার্কে আসবো। এখান থেকে যান প্লিজ”
চিরকুটটা শিমুর ভাগ্নের হাতে দিয়ে বললাম নেহালকে দিতে। ও চিরকুটটা নেহালকে দিলো। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে আছি। লেখাটা পড়ে নেহাল জানালার দিকে তাকালো। হাত দিয়ে ইশারা করলো আমি সত্যিই আসবো কি-না। আমি ইশারায় আস্বস্ত করলাম যে আসবো। তারপর ও চলে গেল।
ক্রিস্টি আর শিমুকে জানালাম ব্যাপারটা।
– তুই তো জানিস ও এলাকার নামকরা গুন্ডা। আমাদের বাড়ির কেউ যদি তোকে ওর সাথে কথা বলতে দেখে তাহলে কি ভাববে?(শিমু)
– জানি। তাই তো ভোরে দেখা করতে চাইছি। বাড়ির সবাই বিয়ের কাজ গভীর রাত পর্যন্ত করছে। এত সকালে কেউ ঘুম থেকে উঠবে না। আমি ওর সাথে কথা না বলা পর্যন্ত এভাবে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
– But if he wants revenge? What if he harms you?(ক্রিস্টি)
– আমি বলি কি তুই ক্রিস্টিকে সাথে নিয়ে যা। আমি নিজেই যেতাম। কিন্তু বুঝতে পারছিস তো। আমাকে ওর সাথে কেউ দেখলে…. (শিমু)
– ঠিক আছে, ক্রিস্টিকে সাথে নিয়েই যাব।
সারারাত ঘুম হয়নি। খুব টেনশন হচ্ছে। নেহাল কি বলবে আমাকে? কেমন যেন সংকোচ হচ্ছে। এক প্রকার অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের ভেতর। এতদিন পর ওর সামনে আমি কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবো। এখন ৫ টা বাজে। আধাঘন্টা পর বের হব। ওর চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। আগে চেহারায় একটা মায়া ছিল। এখন সেটা নেই। কেমন জংলী লাগে দেখলে। ও কি আমার উপর খুব রেগে আছে? সেদিন যখন ট্যাক্সিতে ওকে দেখলাম কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিল। ও যদি সত্যিই রেগে থাকতো তবে তো এখানে এসে আমার সাথে জোর করে দেখা করতে পারতো। ও সেটা করে নি। হয়তো রেগে নেই। কিন্তু এটাই বা কিভাবে সম্ভব? আমি যা করেছি তাতে যে কেউ রাগ করবে।
৫:৩০ টা বেজে গেছে। ক্রিস্টি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। আমরা বের হলাম। ভোরের আলো ফুটে গেছে। আজকের হাওয়াটা একটু অন্যরকম লাগছে। যখন নেহালের সাথে খোলা হাওয়ায় শেষ বিকেলে বেড়াতে যেতাম তখন ঠিক এই অনুভূতিটা হতো। মাঝে মাঝে আমরা ভোরেও বের হতাম। ভোরের প্রকৃতি দেখবো বলে। আজ এতদিন পর আবার সেই অনুভূতি? অদ্ভুত!
১৫ মিনিট সময় লাগলো আমাদের পার্কে পৌঁছোতে। ভাবলাম অনেক তাড়াতাড়ি এসে গেছি। কিন্তু এসে দেখলাম আমরা আসার আগেই ও এসে গেছে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।
– বসুন। দাঁড়ানোর কিছু নেই। আমি এমন কোন স্পেশাল মানুষ নই(আমি)।
– আমার কাছে তুমি এখনও সেই স্পেশাল মানুষ(নেহাল)
– (চুপ করে থাকলাম)
– উনি কে?
– আমার ফ্রেন্ড। লন্ডনে আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি।
– ও সিকিউরিটি? হাহাহা আমি তোমার ক্ষতি করব তাই ভেবেছো?
– না তা নয়…..
– ক্ষতি করতে চাইলে তুমি এতদিন হলো এসেছো এর মধ্যেই তোমার ক্ষতি করতে পারতাম। অযথা বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। তাছাড়া বিদেশী একটি মেয়ে যার নিজেরই এখানে সিকিউরিটি কেউ দিতে পারবে না সে তোমাকে বাঁচাবে কিভাবে?
– ও ব্যাস আসতে চাইলো তাই সাথে এনেছি।
– ও তো আমাদের কথা বুঝতে পারবে না তাই না?
– কিছু কিছু বোঝে।
আমি ক্রিস্টির দিকে তাকাতেই ও বুঝে গেল কি বলতে চাইছি। ও কানে ইয়ারফোন দিয়ে দূরে গিয়ে গান শুনছে। আর আমাদের দেখছে নেহাল আমার কোনো ক্ষতি করে কি-না।
– আপনি কি চান?
– নতুন করে সেটা বলে দিতে হবে?
– সব তো শেষ। কিছু বাকি নেই।
– তুমি শেষ করেছিলে। তোমার জন্য একতরফাভাবে শেষ। আমি কিছু শেষ করিনি মিতু। আমি এখনও তোমার জন্য সে আছি যে আগেও ছিলাম। আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করিনি।
– আমি তো সাইন করেছিলাম। আমার জন্য শেষ এটা যখন বুঝতে পারছেন তাহলে তো এটাও বুঝতে পারছেন যে আমার কাছে আপনাকে দেবার মতো কিছুই নেই।
– আপাতত কিছু প্রশ্নের জবাব দাও।
– বলুন।
– কেন এমন করলে?
– সেটা তো বলেই গিয়েছি।
– এক বাক্যে পুরো জীবনের অধ্যায় শেষ করা যায় না নিসা।
– আপনি তো একটি কাজের মাধ্যমেই আমার লাইফ হিস্ট্রি পালটে দিয়েছিলেন। তাহলে আমি একটি বাক্য দিয়ে কেন সব শেষ করতে পারবো না?
– যদি আমাকে ডিভোর্স দেবারই ছিল তবে শুরুতেই দিতে পারতে। এত দেরি করলে কেন?
– দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণ, আপনার খুব আপন হয়ে তারপর আপনার থেকে আপনার আপনজনকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম।
– দ্বিতীয়টা?
– শুরুতেই ডিভোর্স দিলে হয়ত আবার আমাকে তুলে নিয়ে আসতেন। তাই ভাবলাম এভাবে থাকাটাই ভালো।
– নিসা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে ওইদিনের পর তোমার বাবা মায়ের অমন অবস্থা হবে। এমনকি আমি পরেও জানতে পারি নি। যদি জানতাম আমি নিজেই তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেতাম।
– হাহাহা তাই নাকি?
– সত্যি বলছি নিসা। তুমি যখন বলেছিলে যে তুমি ওনাদের বোঝাবে যেন আমাকে মাফ করে দেন, সেদিন ভেবেছিলাম এতদিনের এতিম ছেলেটা নতুন করে বাবা-মা পাবে।
– কিন্তু আপনি নিজেই ওনাদের খুন করেছেন।
– আমি খুন করি নি নিসা। এটা শুধু দুর্ঘটনা।
– আমি মানি না।
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যদি মনে করো যে আমি দোষী, তবে আমার ভুলের জন্য যথেষ্ট শাস্তিও দিয়েছ। এবার আমাকে মাফ করে দাও।
– ভেবে দেখি।
– প্লিজ নিসা, আমাকে মাফ করে আমার কাছে ফিরে এসো।
– সেটা সম্ভব না।
– কেন সম্ভব না?
– আমার মনে আপনার জন্য কোন জায়গা নেই।
– তোমার মনে কখনো কি আমার জন্য ভালোবাসা জন্মে নি?
– জন্মেছিল। কিন্তু সেটা পূরণ হবার আগেই আমার ভালোবাসা আপনি মেরে ফেলেছেন।
– আমি ভুল করে ফেলেছি নিসা। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আমার কাছে ফিরে এসো।
বলতে বলতে নিহাল হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো আমার সামনে। এটা দেখে ক্রিস্টি দৌড়ে আসলো।
– আরে এ কি করছেন? লোকে দেখলে কি বলবে?
– লোকে কি বলবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার তোমাকে চাই। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো।
ক্রিস্টি আমার কানে কানে বলল,
– Nisa, forgive him. He really loves you. I can see his love for you in his eyes.
– I can’t understand what should I do now!
– But he still loves you.
– আপনি প্লিজ উঠুন। এমন করবেন না।
– তুমি ক্ষমা না করলে আমি উঠবো না। প্রয়োজনে তোমার পা জড়িয়ে ধরতেও রাজি আছি।
– আরে আরে কি বলেন। ভুলেও এমনটা করবেন না।
– আমি বুঝতে পারছি আমি সেদিন তোমাকে তুলে না আনলে তোমার সাথে এসব ঘটতো না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ। তুমি ক্ষমা না করলে আমি এখান থেকে নড়ব না।
– ঠিক আছে। উঠুন এবার।
– কি ঠিক আছে?
– আপনার কথা মেনে নিলাম।
– ক্ষমা করেছো আমাকে?
– হ্যাঁ।
– সত্যি?
– হ্যাঁ সত্যি।
– তাহলে আমার আঙ্গুল ছুঁয়ে বলো।
নিজের আঙ্গুলটা বাড়িয়ে দিলো। আমি ফিক করে হেসে দিলাম। আগেও এমন করতো। কিছু বিশ্বাস করাতে হলে ওর আঙ্গুল ছুঁয়ে বলতে হতো।
– হাসছো কেন?
– কিছু না। এই আঙ্গুল ছুঁয়ে বললাম। ক্ষমা করে দিলাম। এবার উঠে বসুন।
ও আমার পাশে বেঞ্চে বসলো। কেমন যেন সেই অনিভূতিটা হচ্ছে। একদম সেই অনুভূতি। ওর পাশে হাঁটার, ওর পাশে বসে থাকার সেই পুরোনো অনুভূতি। এটা কিসের আভাস?
চলবে….