গল্পঃ প্রেমমোহ লেখিকাঃফারজানা আফরোজ পর্বঃ ৩

গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ৩

মিসেস সাবিনা বেগমের কথা শোনে কান্না করতে থাকে শুভ্রতা। শুভ্রতার কান্না স্পন্দনের কাছে ন্যাকামি ছাড়া অন্য কিছু মনে হলো না। মিসেস সাবিনা বেগম শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,

–” বলো মা কি হয়েছে তোমার?”

–” আজ আমার বিয়ের বয়স এগারোদিন। গতকাল আমার হাজব্যান্ড বাইক অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। উনার মৃত্যুর জন্য দায়ী নাকি আমি সেইকারণে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়। ছোট বেলায় আমার আব্বু আম্মু মারা যান আমি মামা মামীর কাছে ছিলাম এতদিন। কিন্তু উনারাও আমাকে তাদের বাসায় জায়গা দিবে না। এখন বলুন আন্টি সুইসাইড ছাড়া আমার হাতে আর কোনো রাস্তা আছে? ছোট থেকেই কষ্ট সহ্য করে আসছি আর নিতে পারছি না আমি।”

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো শুভ্রতা। মিসেস সাবিনা বেগমের চোখেও পানি। শুধু পানি নেই স্পন্দনের চোখে। সে বিরক্তি সহকারে কথাগুলো শুনছে। তার কাছে এই কান্না অভিনয় ছাড়া আর কিছু নয়।

মিসেস সাবিনা বেগম শুভ্রতাকে বুঝাতে লাগলেন,

–” মা, সুইসাইড কোনো সমাধান নয় বরং অভিশাপ। দুনিয়ার সামান্য কষ্ট যদি সহ্য করতে না পারো তাহলে পরকালের কষ্ট কিভাবে সহ্য করবে? ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ ও অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ হওয়া সত্ত্বেও এমন অনেক লোক আছে, যারা জীবনযাপনের কঠিন দুঃখ-দুর্দশা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে পরিত্রাণের জন্য অথবা জেদের বশবর্তী হয়ে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। কিন্তু ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর ওপর ভরসা ও দৃঢ় আস্থা থাকলে কারও আত্মহত্যার মতো ক্লেশকর পথে পা বাড়াতে হয় না। আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন এবং আত্মহত্যার পরিণামে কঠোর শাস্তির বর্ণনা দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)
অথচ আজকাল আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এমন প্রবণতা বেশি। বখাটেদের উৎপাতের কারণে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, আবার মা-বাবার সামান্য বকুনির কারণেও আত্মহননের মতো ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক বিপর্যয়, মানসিক অশান্তি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গেও জড়িত আছে আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনা। এসব আত্মহত্যার পেছনে কাজ করে প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপ। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে তা সহ্য করতে না পেরেই আত্মহননের মধ্য দিয়ে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা মুক্তি খোঁজে। আত্মহত্যার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করে, সে-ও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষ পান করতে থাকবে। আর যেকোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেট ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামি বিধানে আত্মহত্যা নাজায়েজ; এর প্রতিফল চিরস্থায়ী জাহান্নাম। যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, সে শুধু তার নিজের ওপরই জুলুম করে না বরং এতে মা-বাবা, ভাইবোনসহ আত্মীয়-পরিজন সবাই খুব কষ্ট পায় এবং অত্যন্ত বিচলিতবোধ করে। যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে এ এক বিরাট অন্যায়। কারণ, এর দ্বারা আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়মের বরখেলাপ হয়ে যায়। তাই এমন কুচিন্তা থেকে সতর্ক থাকা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। নবী করিম (সা.) আত্মহত্যার শাস্তি ঘোষণা করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যেই জিনিস দ্বারা আত্মহত্যা করে, কেয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস দ্বারাই শাস্তি দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে, সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে, সে দোজখেও সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে।’ (নাসাঈ, তিরমিজি)।

যখন নিজেকে অসহায় ও আশাহত মনে হয় এবং আত্মহত্যার কুচিন্তা মনে আসে, তখন মনে করতে হবে এখন কুমন্ত্রণাদাতা শয়তানের দুরভিসন্ধি এসেছে। তাই এসব মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে অবশ্যই দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। বিপদে ধৈর্যধারণে অবিচল থেকে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার প্রেরণা তিনিই মানুষকে দান করেছেন। কখনো আত্মহত্যার কথা মনে এলে ফেতনা থেকে নিজকে রক্ষাকল্পে নামাজের মাধ্যমে বিনীতভাবে আল্লাহর দয়া ও সাহায্য কামনা করা উচিত। মুসলিম পরিবার ও সমাজজীবনে আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে সর্বস্তরের নর-নারী ও সন্তানসন্ততির বেঁচে থাকার জন্য ইসলামের বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা। 😊
দুনিয়ার কষ্ট তো ক্ষণস্থায়ী কিন্তু মিত্যুর পর যে আরেকটা জীবন আছে, পরকাল জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নাই। ক্ষণস্থায়ী জীবনের কষ্টের জন্য পরকাল কেন নষ্ট করবে মা? সুইসাইড যারা করে তারা জীবনেও জান্নাতবাসী হবে না। আমি চাইনা তোমার ফুলের মত জীবনটা একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য নষ্ট হোক।”

শুভ্রতা এক মনে কথাগুলো শুনলো। আসলেই তো সে অনেক বড় ভুল করতে চেয়েছিল। যে ভুলের ক্ষমা কখনো হয় না। মিসেস সাবিনা বেগমের কথায় সে যেন আজ নিজের মাকে খুঁজে পেয়েছে। স্পন্দন মায়ের কথা শোনার পর শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,

–” তারমানে আমি এখন ওই লতিফ ভাইকে শাস্তি দিতে পারবো না। ওকে সমস্যা নেই তো মিসেস বিধবা কখন বের হবেন আমাদের বাসা থেকে। আমি নিজের লোক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে আমার বাসায় এলাউ করি না। সো এখন খাওয়া দাওয়া শেষ বের হোন তাছাড়া আমার প্রচুর কাজ এইখানে বসে টাইম নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।”

শুভ্রতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিসেস সাবিনা বেগম তেজী গলায় বলে উঠলেন,

–” স্পন্দন তুই দিনদিন অমানুষে পরিণত হচ্ছিস। কেউ কাউকে এইভাবে বিধবা বলে? মুখের ভাষা ঠিক কর তা-নাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”

–” তোমাকে আমি খুব ভালোভাবে জানি আম্মু। থাক সেসব কথা এখন এই মেয়েকে বলো কখন বিদায় হবে আমার বাসা থেকে।”

–” শুভ্রতা এইখানেই থাকবে। যতদিন না পর্যন্ত ওর নিজস্ব মাথা রাখার জায়গা না হয় সে এইখানেই থাকবে।”

স্পন্দন আর কথা না বাড়িয়ে রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। মায়ের এই সিদ্ধান্ত সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কিন্তু বাহিরের মানুষের সামনে মায়ের সিদ্ধান্ত না মানিলে মায়ের অসম্মান হবে তাই সে কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো।

মেঝ ভাইকে রাগান্বিত হয়ে যেতে দেখে ঢুক গিললো দিয়া। ভয়ে ভয়ে গেস্ট রুমে প্রবেশ করে শুভ্রতাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,

–” হ্যালো আপু, আমি দিয়া তুমি?”

–” শুভ্রতা।”

–” ওয়াও কি কিউট নাম তোমার।”

শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মিসেস সাবিনা বেগম দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–” তোর একটা জামা শুভ্রতাকে দে বিকালে না হয় ওকে নিয়ে শপিং এ যাবি।”

শুভ্রতা মাথা নিচু করে বলল,

–” আমি সাদা রঙ ছাড়া অন্য রঙের জামা পড়বো না আন্টি।”

–” মা, এখন এইসব মানা হয় না। স্বামী থাকা কিংবা মারা যাওয়াতে একজন মেয়ের সাজতে বারণ নেই। একজন মেয়ে তার ইচ্ছা মত সাজতে পারে কিন্তু স্বামীর মঙ্গল অমঙ্গলের জন্য সাজা এইটা ঠিক নয় মা।”

–” আন্টি সাজ জিনিসটা আমার বরাবরই অপছন্দ। তাছাড়া আমি সাদা রঙ বেশি ভালোবাসি। সমস্যা নেই আমি শাড়িতেই থাকতে পারবো।”

শুভ্রতার সাথে কথায় না পেরে হার মানলেন মিসেস সাবিনা বেগম। দিয়া উৎসুক কণ্ঠে বলল,

–” আম্মু আমার একটা সাদা জামা আছে তবে হালকা গোলাপী। ওইটা পড়বে আপু?”

শুভ্রতা মাথা উপর নিচ করে বুঝালো সে পড়বে। কারণ শাড়ি থেকে ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে। এই শাড়ি পরে আর থাকা সম্ভব নয় তার। দিয়া তার জামা আনতে তার রুমে চলে গেল।

–” শুভ্রতা তুমি বরং দিয়ার জন্য অপেক্ষা করো। আমি রুমে যাচ্ছি তোমার আঙ্কেল আর দিয়ার বড় ভাই বের হবে এখন।”

–” আচ্ছা আন্টি।”

স্পন্দন নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে টমিকে ডাকলো। একদম কালো কুচকুচে একটি কুকুর দৌড়ে এসে স্পন্দনের সামনে দাঁড়ালো। স্পন্দন টমিকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। টমি ওর পুরো শরীর জিব্বা দিয়ে আদর করে ঘেউ ঘেউ করলো কিছুক্ষণ।

–” কি হলো মহারাজের আজকে? এত আদর কেন করছিস? কিছু চাই তোর?”

–” ঘেউঘেউ।”

–” ছিঃ টমি যেখানে আমি সিঙ্গেল সেখানে তুই বউ চাচ্ছিস। আশা করিনি তোর কাছ থেকে।”

–” ঘেউঘেউ।”

–” তোকে বিয়ারের বোতল কিনে দিতে হবে তাও পাঁচটা? ছ্যাঁকা খাইছিস?”

–” ঘেউঘেউ ঘেউঘেউ।”

–” পাশের বিল্ডিং এর একটি বিড়ালের প্রেমে? কুকুর জাতির নাম বদনাম করবি তুই। কুকুর হয়ে কিনা বিড়ালের প্রেমে তোকে তো নোবেল দেওয়া উচিৎ।”

টমি কোল থেকে নেমে নিজের জায়গায় গিয়ে চুপটি মেরে বসে রইলো। স্পন্দন তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

দিয়া, শুভ্রতা এবং কাজের মহিলা অর্থাৎ টুনির মা একসাথে ফ্লোরে বসে আছে। দিয়ার হাতে আপেল সে কামড় দিচ্ছে আর কথা বলছে। শুভ্রতা টুনির মাকে সাহায্য করছে। টুনির মা চালের ধান খুঁজছে। দিয়া ভ্রু জোড়া নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

–” একটু আগে তো খেলাম তাহলে এখন আবার এইসব কাজ কেন করছো টুনির মা?”

–” দুপুরে খাবেন না ছোট আফা?”

–” ওহহ সরি ভুলেই গিয়েছিলাম দুপুরে যে খেতে হবে। ওয়েট আমিও তোমাকে সাহায্য করছি।”

চলবে,..?

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেইক করা হয়নি।😕

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here