গল্পঃ প্রেমমোহ লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ পর্বঃ ১৯

গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ১৯

জঙ্গলের রাস্তা ধরে বাস চলছে। হঠাৎ করেই বাস থেমে যায়। স্পন্দন উঁকি দিয়ে বাস কন্ট্রাকটরকে জিজ্ঞাসা করলো,

–” কি হয়েছে? থামলো কেন বাস?”

ভীতু কণ্ঠে উত্তর দিল বাস কন্ট্রাকটর,

–” স্যার বাস খারাপ হয়ে গেছে। আপনারা সবাই দয়া করে নেমে পড়ুন। দশ পনেরো মিনিট সময় লাগবে স্যার।”

রাজ্যের বিরক্তি চোখে মুখে প্রকাশ করলো স্পন্দন। অন্তুর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে রইলো। বেচারা অন্তু মুখটা অসহায়ের ভঙ্গীতে বলল,

–” এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি কি জানতাম এমন কিছু ঘটবে?”

–” গাড়ি নিয়ে আসলে এই সমস্যা হতো?”

–” দেখ ভাই আমরা স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছি সেখানে বাসার গাড়ি এলাউ না। এখন চল নেমে গিয়ে জঙ্গলের হাওয়া খেয়ে আসি।”

বাসের সিটে একটা লাত্থি মেরে নেমে পরলো স্পন্দন। চোখে মুখে তার রাগ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। শুভ্রতাও পিছু পিছু নামলো।

নাম না জানা এক গাছের নিচে বসে আছে শুভ্রতা। বাস নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তার ভালোই লাগছে। বাস নষ্ট না হলে হয়তো এই সুন্দর জায়গাটি সে দেখতে পারতো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে, কমলা রঙ ধারণ করেছে সূর্য। কিন্তু সবুজ গাছের আড়ালে এসেই আটকে পড়ছে। সন্ধ্যা হবার জন্য তৈরি হচ্ছে সূর্য। শুভ্রতা মনে মনে দু’আ করছে বাস যেন আজ ঠিক না হয় তাহলে তো সে আজ রাত এইখানেই থাকতে পারবে। জঙ্গলে জোনাকি পোকায় ভরপুর। কৃত্রিম আলো অনেক তো দেখেছে এইবার না হয় প্রাকৃতিক আলোতে মুগ্ধ হবে সে। আনমনে হাঁটতে থাকে শুভ্রতা। নিজের অজান্তেই চলে যেতে লাগলো জঙ্গলের ভিতর। স্পন্দন অন্তুর সাথে আড্ডায় ব্যাস্ত। হঠাৎ তার চোখ জোড়া দেখলো অনেক দূরে শুভ্র রঙের জামা পরিহিতা এক মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পিছন দিকে তার কোনো হুস নেই। মনে হয় কেউ মায়া করেছে তার উপর। সেই মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সে। অন্তুর কাছ থেকে সরে গিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। পিছন থেকে অন্তু বারবার ডেকে যাচ্ছে এই বলে, বাস ছেড়ে দিচ্ছে কোথায় যাচ্ছিস? স্পন্দন এই স্পন্দন।

স্পন্দনের কাছে অন্তুর ডাক নিয়ে কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। সে দৌঁড়ে যাচ্ছে তার প্রিয়সীর কাছে। প্রিয়সী যে একাই হেঁটে যাচ্ছে তাকে ছাড়া গভীর অরণ্যে।

শুকনো পাতার শব্দে জ্ঞান আসলো শুভ্রতার। পায়ের নিচে ছোট বড় মাঝারি আকারের পাতা পরে আছে। পিছন না তাকিয়েই বসে পড়লো পাতার উপরে। দু’হাত ভর্তি পাতাগুলো তুলে মৃদু স্বরে বলল,

–” মামীর কাছে যখন থাকতাম তখন তোর দ্বারাই রান্না করতে হতো আমাকে। গ্যাসে রান্না করতে দিত না যদি গ্যাসের বিল বেশি উঠিয়ে ফেলি। জানিস তখন তোর অভাব প্রচুর বোধ করতাম। দেখ এখন তোরা আমার পায়ের নিচে কত কিন্তু এখন দরকার পড়ছে না। আমি তখন ভাবতাম জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট একটা সংসার তৈরি করবো আমি। তোর খুব হাসি পাচ্ছে আমার কথা শোনে তাই না? আরেহ বোকা জঙ্গল হোক আর রাজমহল হোক সংসার যদি গুছিয়ে রাখা যায় তাহলে সব জায়গাতেই ভালো লাগবে।”

স্পন্দন পিছন থেকে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার কথাগুলো শুনছে। পাতার সাথে যে কেউ কথা বলতে পারে জানা ছিল না স্পন্দনের। পিছন থেকে প্রশ্ন করলো,

–” কেমন স্বপ্ন ছিল তোমার?”

শুভ্রতা এখন এই জগতে নেই। সে বুঝলো না স্পন্দন তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। সেও প্রশ্নের উত্তর দিল,

–” ছোট্ট একটা কুড়েঘর, গোয়াল ঘর, রান্না ঘর, কলপার, টিনের তৈরি বাথরুম। গোলাকার ছোট্ট একটা পুকুর, আশে পাশে নানা ধরনের ফলের গাছ, উঠানে একটা ফুলের বাগান, সেই বাগানে থাকবে সব ধরনের ফুল, পুকুরে থাকবে মাছ, ছোট করে মুরগি এবং হাঁসের ঘর, চাষাবাদের জমি, শাক সবজি সব কিছুই ফলন হবে সেখানে, মাটির চুলো। থাকবে না বিদ্যুৎ সেখানে থাকবে হারিকেনের আলো। রাতে জানালা খুলে দিয়ে প্রাকৃতিক বাতাসের স্পর্শে ঘুমাবো। এক কথায় সব কিছুই থাকবে টাটকা টাটকা।”

স্পন্দন হাসলো শুভ্রতার ইচ্ছা শোনে। খুব অদ্ভুদ লাগলো তার কাছে। আজকাল মেয়েরা চায়, রাজবাড়ীর মত বাড়ি, রানীর মত সাজপোশাক, খাবার দাবার, প্রচুর টাকা।

–” তোমার ইচ্ছা পূরণ করব কী আমি?”

শুভ্রতা চোখ মেলে তাকিয়ে পিছনে ঘুরে স্পন্দনকে দেখে চমকে উঠলো। এই যে কিসব বলছে সে । তারমানে স্পন্দন তার সব কথা শুনেছে? মনে মনে নিজেকে একশোটা বকা দিয়ে স্পন্দনকে বলল,

–” সংসার থাকলে সংসার করার ইচ্ছা মাথায় আসে। এখন যেহেতু সংসার নেই তাহলে সংসারের চিন্তা আমার মাথা নেই। বাই দা ওয়ে, বাস কখন ঠিক হবে?”

শুভ্রতার কথা শোনে হুস আসলো স্পন্দনের। নিজেই পিছনে তাকিয়ে চমকে উঠলো। কোন পথ ধরে সে এসেছে তাই বুঝতে পারছে না। চারদিকে সব জঙ্গলের নাম জানা অজানা গাছে ভর্তি চারপাশ। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল,

–” কোন রাস্তা ধরে এসেছ মনে আছে কিছু?”

স্পন্দনের কথা শোনে তাকালো শুভ্রতা। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে যেতে লাগলো। সে নিজেও চিনতে পারছে না রাস্তা। জঙ্গলটা যে গোলকধাঁধার মত তাদের আটকে ফেলেছে। শুভ্রতার চাহনি দেখে বুঝতে বাকি রইল না স্পন্দনের। শুভ্রতা ভয় পেয়ে দৌঁড়ে দাঁড়ালো স্পন্দনের পাশে। সন্ধ্যা নেমে আসছে, এখন তো জঙ্গলে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর তা হলো সাপ নেমে আসবে। ভয়ে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–” কিভাবে বাসায় ফিরবো আমরা?”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো স্পন্দন,

–” বাসায় ফিরে কি লাভ? তোমার স্বপ্ন পূরণ করো। সংসার তৈরি করো এইখানে। সংসার হবে চাচাতো ভাইবোনের সংসার।”

–” মজা কেন নিচ্ছেন? হ্যাঁ আমার ইচ্ছা জঙ্গলের সংসার করা তাই বলে এই ভয়ানক জঙ্গলের কথা তো বলেনি। স্বাভাবিক ভয়হীন যেসব জঙ্গল আছে আমি সেই জঙ্গলের কথা ভেবেছি তাছাড়া মানসিক প্রস্তুতি তো নেই সংসার করার।”

শুভ্রতার কথা শোনে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো স্পন্দন। এই বিপদের সময়েও তার হাসি পাচ্ছে যাকে বলে ভয়ানক হাসি। শুভ্রতা কণ্ঠ নিচু করে বলল,

–” কিভাবে বাসায় ফিরবো তাহলে?”

–” রাতটা এইখানে থাকতে হবে সকালে বুঝা যাবে কি করতে হবে। তাছাড়া কোনো কিছুতেই তাড়াহুড়ো করতে নেই দেখো না প্রকৃতি তাড়াহুড়ো করে না তবুও তার সব ইচ্ছায় সম্পূর্ণ হয়।”

শুভ্রতা মাথা ঝাঁকালো শুধু। স্পন্দন শুভ্রতার এক হাত ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে আরেকটু সামনে যেতে লাগলো। স্পন্দন সিদ্ধান্ত নিলো এইখানে থাকবে আরো এক মাস। এক মাসে যদি শুভ্রতার সাথে তার হাবভাব ঠিক হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই। তাছাড়া এই এক মাসে সাকিবের থেকে দূরে রাখতে পারবে কিন্তু সমস্যা একটাই, এইখানে থাকার জন্য জায়গা কোথায় পাবে, খাবার কোথায় পাবে? সিনেমাতে সব পাওয়া গেলেও বাস্তবে পাওয়া ভীষণ কষ্টের।😢

অনেক বড় গাছ, নিচে পড়ে আছে অসংখ্য পাতা, স্পন্দন শুভ্রতার হাত ছেড়ে দিয়ে ইশারা করে বলল,

–” পাতাগুলো একত্রে করে কিছুটা উচুঁ করে খাটের মত বানাতে পারবে? দুইজন মিলে করলে ক্লান্ত হবো না।”

–” পারবো কিন্তু যদি পরে যাই?”

–” উচুঁ কেন করছি জানো?”

–” খাট বানানোর জন্য।”

শুভ্রতার বাচ্চা বাচ্চা কথা শোনে হাসতে লাগলো স্পন্দন। পাতা উচুঁ করতে করতেই বলল,

–” আরেহ তেমন না। শুকনো পাতা দেখেই বুঝা যাচ্ছে পরে যাবো। আসলে রাত করে সাপ, কিংবা বিভিন্ন হিংস্র পশু চলাচল করে তাই চারদিকে পাতা দিয়ে বেড়া দিবো তারপর ওই মাঝের ফাঁকা জায়গাতে আমরা ঘুমাবো।”

শুভ্রতা পাতায় হাত দিতে গিয়েও থেমে গেল। তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

–” আমরা মানে কি?”

–” কেন তুমি আলাদা থাকতে চাও? ওকে সমস্যা নেই তাহলে আরেকটি বানাবো তোমার জন্য। তবে রাতে যখন কেউ এসে হানা দিবে ডাকবে না আমাকে।”

ভয় পেয়ে গেল শুভ্রতা। বাচ্চাদের মত মুখ করে বলল,

–” তাহলে পাতার বেড়া বড় করে বানাই? যেন চার পাঁচজনের জায়গা হয়।”

–” বানাতে পারলে বানাও। এমনিতেই ক্ষুধায় পেট জ্বলছে আমার আবার এত শক্তি নেই।”

পাতা দিয়ে দেওয়াল তৈরি করতে অনেকখানি সময় লাগলো তাদের। শুকনো পাতা বারবার ভেঙে নিচে পড়তে লাগলো। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ল দুজন। রাত কয়টা বাজে বলতে পারছে না তারা। তাদের ব্যাগপত্র সব বাসেই। ফোনে এক ফোঁটা নেটওয়ার্ক নেই তাই বন্ধ করে রেখেছে। স্পন্দন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল পাতার দেওয়ালের ভিতর। শুভ্রতা দেখলো খুবই কম জায়গা কিন্তু এখন আরেকটি বানানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয় প্রথম যত সহজ ভেবেছিল এখন বুঝলো তত সহজ নয়। নিরুপায় হয়ে শুয়ে পড়ল স্পন্দনের সাথে। ক্লান্ত হয়ে যাওয়াতে তাদের চোখে রাজ্যর ঘুম। দুজন ঘুমিয়ে পড়ল।

——–

শিয়ালের ডাকে শুভ্রতার ঘুম ভেংগে গেল। আকাশের দিকে তাকাতেই বড় চাঁদ। ভালোই লাগছে শুভ্রতার। কিন্তু শুয়ে থাকতে তার সমস্যা হচ্ছে। চাঁদের আলোতে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে খুঁটিতে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো শুভ্রতা। স্পন্দনের ডান গালে লালচে একটা তিল রয়েছে। শুভ্রতা আগে কখনো দেখেনি তবে আজকে বেচারা খুব কষ্ট করে শুয়ে আছে একদম কোণায়। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবারো ঘুমিয়ে পড়ল শুভ্রতা।

চলবে,..?

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেইক করা হয়নি। খুব শীগ্রই শেষ করে দিবো। হ্যাপি রিডিং🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here