গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ১০
আজকের আকাশ বড্ড সুন্দর। চারপাশে রয়েছে আনন্দের মেলা। আনন্দ যেন ছিটকে এসে গায়ে পড়ছে সবার। স্পন্দন কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ সে হাঁটতে বের হয়নি। টমি পাশে এসে ঘেউঘেউ করছে। মৃদু হেসে টমির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল স্পন্দন,
–” টমি আজ আমি ভীষণ খুশি। খুশি হবার কারণ তো তোকে রাতেই বলেছি। জানিস এতদিন পর মনের ভিতরের জমে থাকা তীব্র আগুন নিভানোর উপায় আমি পেয়ে গেছি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। খুব তাড়াতাড়ি আমার হাসি ভয়ানক হাসিতে রূপান্তরিত হবে। হাহাহা।”
শুভ্রতা ভোরের আলোর সাথে দেখা করতে এসেছিল। স্পন্দনের কথা শোনে সন্দিহান নজরে বলল,
–” কি করবেন আপনি? তাছাড়া কিসের উপায় পেয়েছেন?”
শুভ্রতাকে দেখে মুচকি হাসলো স্পন্দন। শুভ্রতার এক ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে মুখটা সামনে বিড়বিড় করে বলল সে,
–” এখন থেকে তুমি আমার চাচাতো বোন। ভাবছি চাচাতো বোনকে তো কেউ আর আপনি বলে সম্মেধন করে না। তাও আবার আমার থেকে তুমি অনেক ছোট। তুমি মনে হয় আমার থেকে আট দশ বছরের ছোট হবে সেই হিসেবে তুমি আমার পিচ্চি। শুধু পিচ্চি না ভীষণ পিচ্চি। আচ্ছা ভাবছি এখন থেকে তুই করে বলব। নাহ এখন বলব না কিছুদিন পর থেকে। কারণ এখন আমি চাই না সবাই তোমার সত্যিটা জানুক বিশেষ করে আব্বু। উনি জানলেই তোমাকে সোজা ঘর থেকে বের করে দিবে। এক মুহূর্তেও রাখবে না। আর রাখবেই বা কেন? যে মায়ের গর্ভে জন্মেছ তাকে আমাদের পরিবারে কেউ জীবনেও মানবে না। তোমার মা নারী নামের কলঙ্ক। তোমার মায়ের কারণেই আমি এখন সব মেয়েকেই ঘৃনা করি। মনে হয় এই বুঝি তোমার মায়ের জিরক্স কপি।”
–” তাহলে আমাকে কেন দেখতে পাচ্ছেন? বের করে দিচ্ছেন না কেন? আমি তো সেই মায়ের সন্তান।”
শুভ্রতার ঠোঁট জোড়ায় স্পন্দন আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
–” শশশশশশশ। তোমার মুখে আমার চাচ্চুর সুন্দর মুখটি প্রকাশ পায় তাই তোমাকে বের করবো না। হাজার হোক ওনলি ওয়ান চাচাতো বোন। চাচাতো বোনের সাথে প্রেম করতে নাকি ভীষণ ভালো লাগে। করবে প্রেম আমার সাথে?”
শুভ্রতা রেগে গেলো। আকাশ ছাড়া সে কারো সাথে জড়াতে চায় না। স্পন্দনের সাহস দেখে সে অবাক। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হলেও স্পন্দনকে সে কিছুটা ভালো ভেবে এসেছে কিন্তু আজকের ব্যাবহারের কারণে শুভ্রতা ভীষণভাবে রেগে গিয়েছে।
–” মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। ভুলে যাবেন না আমি বিবাহিত।”
মুখ বাঁকিয়ে বলল স্পন্দন,
–” আমার যদি সমস্যা না থাকে তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়? হ্যাঁ আমি জানি তুমি বিবাহিত কিন্তু তোমার হাজবেন্ড তো নেই তোমাকে একলা রেখে সে পালিয়ে গিয়েছে ওহহ সরি মারা গেছে। দেখো তোমার হাজবেন্ড যদি তোমাকে একটুও ভালোবাসতো তাহলে সে তোমার জন্য কিছু করে যেতো। কারণ মানুষের মৃত্যুর কোনো ঠিকানা নেই। কখন কিভাবে হতে পারে বুঝা যায় না। আর তোমার আকাশ নাকি বাতাস সে তো জানতো তোমাকে কেউ পছন্দ করে না। বিয়ের পরের দিনই তোমার জন্য তার কিছু করা উচিৎ ছিল। আজ যদি সে তোমার জন্য কিছু করে যেত তাহলে সেই বাড়ি থেকে রাত বেড়াতে তোমাকে বের করে দেওয়ার সাহস কেউ পেতো না। ”
স্পন্দনের এই রূপ শুভ্রতাকে বারবার হতাশ করছে। কারণ আকাশের নামে বাজে কথা শুনতে সে ইচ্ছুক না। আকাশ তার জীবনে ছিল একজন ভালো মানুষ। আকাশের মত কেউ কখনো তাকে ভালোবাসতে পারবে না এমনকি সেও পারবে না আকাশের স্থান অন্য কাউকে দেওয়ার জন্য। কঠিন কণ্ঠে স্পন্দনকে বলল শুভ্রতা,
–” শুনুন, আপনি আমাকে এই বাড়িতে এনেছেন পাপ করা থেকে বাঁচিয়েছেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ কিন্তু দয়া করে এমন কোনো কথা বলবেন না যার জন্য আমি আপনাকে হার্ট করে ফেলি। ”
শুভ্রতা চলে গেলো। ভোরের আলো তার আর গায়ে মাখা হলো না। রাগ, ঘৃণা, কষ্ট বুকে নিয়েই সে চলে গেল। স্পন্দনের মুখে মৃদু হাসি। সেতো এইটাই চেয়েছে। শুভ্রতা কান্না করুক। সেও তো খুব কেঁদেছে কিন্তু তার চোখের পানির দাম ছিল না। চাচার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিল তার সাথে থাকার জন্য। স্পন্দনের একমাত্র ভালোবাসার মানুষ তার চাচ্চুই ছিল। চাচার এই অবহেলা তাকে ছোট থেকেই গড়ে তুলেছে পাষাণ। আজ তাকে সবাই রোবট কেন বলে? তার চাচার কারণেই তো। চাচার পাওয়া শাস্তি সন্তান হিসেবে এখন শুভ্রতার পাওয়ার কথা। বাবা মায়ের সম্পত্তি যেমন সন্তান পেয়ে তাকে তাহলে অবশ্য শাস্তি কিংবা কষ্ট অবশ্যই বাবা মায়ের বদলে সন্তান পাবে। টমির দিকে তাকিয়ে ডেভিল হেসে ঠোঁটের কোণায় হালকা কামড়ে বলল,
–” পরবর্তী ধাপ আকাশের বাড়ি খোঁজা। আসল শাস্তি তো ঐটাই হবে প্রিয় চাচাতো বোন।”
–” ঘেউঘেউ।”
সাকিব মুখটা গম্ভীর করে বসে আছে। সে কিছুতেই প্রপোজ করার মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছে না। গুগল,ইউটিউব, ফেসবুক সবকিছু থেকে প্রপোজ সম্পর্কে জেনেছে কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির সামনে সে কিছুতেই বলতে পারছে না। আর্তনাদের কণ্ঠে বারবার বলল,
–” যেদিন থেকে দেখেছি তোমাকে সেদিন থেকেই মনের এক কোনে জায়গা দিয়ে ফেলেছি। তুমি কেন বুঝ না। প্লিজ তোমাকে দেখলে যেন আমি প্রপোজ করার সাহস পাই।”
বারবার নিজেকে সাহস দিচ্ছে সাকিব। কিন্তু সে সাহস পাচ্ছে না। একে তো তার এই কথা জানলে তাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। তার বাবা মা তো কিছুতেই তার এই সম্পর্ক মেনে নিবে না। ভেবেছিল মাকে দিয়ে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাবে কিন্তু সেই আশাও কমে গেলো। দরজা বন্ধ করে মেয়েদের মত কান্না করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।
পরের দিন,
শুভ্রতা আজ ভার্সিটি যাবে। ভার্সিটিতে আজ তার প্রথম দিন। মিসেস সাবিনা বেগম স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” শুভ্রতাকে আজ তুই নিয়ে যা স্পন্দন। যেহেতু কাগজপত্র সব তোর কাছে।”
স্পন্দন কিছু বলার আগেই সাকিব চিৎকার করে বলে উঠলো,
–” আম্মু আমি নিয়ে যাব শুভ্রতাকে। জানোই তো তোমার ছোট ছেলে ভীষণ ব্যস্ত। আমিই নিয়ে যাবো।”
গ্লাস হাতে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে স্পন্দন বলল,
–” আমিই নিয়ে যাবো। তোমার বড় ছেলেকে বলে দেও, সে ভর্তির সময় কেন যায়নি? অবশ্যই ভয়ে কিংবা অলসতার জন্য। কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি যেহেতু আমি করেছি তাহলে আমিই জমা দিতে পারবো। তাছাড়া আম্মু তোমার ছেলের বয়স ত্রিশের উপরে হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি বিয়ে করাও ওর জন্য আমি বুড়ো নামক উপাধি পেতে চাই না। নিজে তো বুড়ো হচ্ছেই সাথে আমাকেও বানাচ্ছে। ওর জন্য এখনও আমি বিয়ে করতে পারছি না।”
দিয়া হেসে কুটি কুটি। মিসেস সাবিনা বেগম ছোট ছেলের এমন নির্লজ্জ মার্কা কথা শোনে ভীষণভাবে চমকে উঠলেন। স্পন্দন তো এই ধরনের কথা বলতে পারে না তাহলে কি ছেলে তার প্রেম ট্রেম করছে। হতেই পারে। মেয়ে হয়তো তাড়া দিচ্ছে বিয়ের জন্য তাই ছেলে নির্লজ্জ মার্কা কথা বলছে। মিসেস সাবিনা বেগমের ভাবনার মাঝেই সাকিব তখন রেগে গিয়ে বলল,😡
–” তোকে তো বলেই দিয়েছি তুই বিয়ে কর যখন আমার সময় হবে তখন আমি বিয়ে করবো। কোনো মেয়ে পছন্দ থাকলে বলে দে।”
মিসেস সাবিনা বেগম খাবার টেবিলে এমন ধরনের কথা শুনতে পছন্দ করেন না। আজ স্পন্দনের বাবা না থাকায় বেশ ভালোও হয়েছে। গতকাল রাতে দেরি করে বাসায় আসাতে এখনো ঘুমাচ্ছেন মিস্টার ইশফাক আহমেদ অর্থাৎ স্পন্দনের বাবা। সাবিনা বেগম কড়া গলায় বললেন,
–” খাবার টেবিলে এই ধরনের কথা কেন উঠছে? পাশে ছোট বোনকে দেখতে পাচ্ছো না তোমরা? দিনদিন বেয়াইয়া হয়ে যাচ্ছ দেখছি।”
শান্ত হয়ে গেলো পরিবেশ। শান্তভাবেই খাবার খাওয়া শেষ করে শুভ্রতাকে নিয়ে বের হয়ে পড়লো স্পন্দন। শুভ্রতার ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। সে সাকিবের সাথে আসতে চেয়েছিল কিন্তু স্পন্দনের কারণে পারেনি। বাধ্য হয়ে গাড়িতে বসে চুপ করে বসে আছে। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
–” সাদার মাঝেও বেশ গর্জিয়াস জামা রয়েছে। এখন থেকে ওইগুলো পড়বে। তোমাকে সাদা পোশাকে দেখলে মনে হয় আমি মারা গেছি। বিয়ের আগে আমাকেও মারতে চাও চাচাতো বোন?”
চলবে..?
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।