📚গল্পটা আমাদের
আপনিতেই আমরা
পর্ব-৪
# লেখনীতে- মারজানা দীনা
রাত ৯ টা বাজে।খাবার টেবিলে ইতোমধ্যে বাড়ীর ছেলেরা খেতে বসেছেন।মা চাচি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন।
দাদি সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছিলেন।আমি তখন সবে মাত্র ঘর থেকে বের হয়ে আসছি।
কি রে ছুটকি কেমন আছিস?( ফারাজ ভাইয়া)
আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া।
হুম হুম দেখায় যাচ্ছে দিনে দিনে মোটা হয়ে যাচ্ছিস রে বোইনা(জিহাদ)
ঐ তোর চোখ না চুলা কোনদিক থেকে আমারে মোটা মনে হয়? উইষ্ঠা খাবিনি?
দেখলা ফারদিন ভাইয়া ভালা কথার দাম নাই দাম নাই কি যে দিন পড়ছে ভাবতেই অবাক লাগে গো অবাক লাগে!!(জিহাদ)
তো তোরে ভাবতে কইছে কেডা আমি কইছি নাকি তুই নিজের ভুরিতে চোখ দে পেটুক একটা হুহ্…
আহা জিহাদ এভাবে বলিস না জানিসই তো বাচ্চা মানুষ দেখ গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে পরে আবার চকলেট নিয়ে না দৌড়াইতে হয়!!(ফারদিন ভাইয়া)
ভাইয়াাাা তুমিও!! কেউ ভালো না তোমরা হুম!!
আমি কথাটা বলতেই সবাই হাসতে শুরু করল।তবে চাচিরা বরাবরের মতই চুপ।শুধু দাদি বললেন_
কি শুরু করেছিস তোরা খেতে বসে এই মেয়ের সাথে এত কথা কিসের!!!
ব্যাস আরকি সবাই আবার চুপ।নিরবতার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল।
আনু দেখ তো এসময় আবার কে এলো?(আমার মা)
দেখছি মা।
দরজা খুলতেই দেখা পেলাম এক অগোছালো মানবমূর্তির।মনে হলো আমি হারিয়ে গেছি এটা কিভাবে সম্ভব বিকেল পর্যন্তও তো জানতাম মানুষটা সিলেটে তাহলে এখন এখানে কীভাবে….
ভাঁজ পরা শার্ট, গোটানো হাতা, ফর্মাল প্যান্ট যেটাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূলিকণা, এলোমেলো চুল, লাল হয়ে যাওয়া চক্ষু জোড়া কেনো জানি থমকে উঠলাম।অজানা ভীতি গুলো আকড়ে ধরলো কিছু কি হয়েছে? এমন অবস্থা কেনো? মানুষটা সবসময় পরিপাটি থাকতেই পছন্দ করেন তার এই অবস্থা।
কি রে আনু হাওয়া হয়ে গেলি নাকি কে এসেছে? এমন মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
হা হ্যাঁ..
কি হা হা করছিস দেখি সরতো। আরেহ্ বাবা তুমি! সবঠিক আছে তো? তুমি না সিলেটে গিয়েছিলে? তাহলে..
আসসালামু আলাইকুম, মা।জ্বী সব ঠিক আছে।আসলে কাজ শেষ তো তাই এসে পড়লাম আরকি।
ওহ্ আচ্ছা। এমা মেয়ের কান্ড দেখছো এখনো তোমারে দাঁড়ায়ে রাখছে। জার্নি করে এসেছো দেখেই মনে হচ্ছে ক্লান্ত আসো বাবা ভিতরে এসে ফ্রেশ হয়ে নাও।
জ্বী, মা।
বলেই তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে আমার ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। আর আমি তখনো হতবুদ্ধির মতো স্থির আছি।কিছুই যেনো বোধগম্য হচ্ছে না।
আনু!! কিরে তোর আবার কি হলো যা যা তাড়াতাড়ি ঘরে যা দেখ জামাইয়ের কিছু লাগে নাকি।তুই কি জানতিস যে আসবে?
হু.. না মা আমি তো জানতাম না।
হো তা জানবি কেনো? জামাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার সময় কই।এমনে এমনে বলি দেখিস এই মাইয়ার সংসার হইবো না।জামাইয়ের প্রতি কেউ এমন উদাসীন হয়।( আমার দাদী)
দাদীর কথা নিরবে শ্রবণ করে ঘরের দিকে পথ ধরলাম।দরজার কাছে গিয়েও ভেতরে যেতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করতেই মানুষটার অগোছালো মূর্তির দর্শণ পেলাম।তাৎক্ষণিকভাবে এমন কিছু আন্দাজ করলাম যা তখনও চোখে পড়ে নাই।আবারো বিপরীত দিকে জিহাদের ঘরের দিকে ছুট দিলাম ফাস্টএইড বক্স টা আনতে।বুঝতে পারছিলাম না চোখ কেনো ঝাপসা হতে শুরু করল।
ঘরে ঢুকতেই দেখলাম তিনি বেডে বসে আছেন।মাথা নিচু করে।আমি তার পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম।তার পায়ে হাত দিতেই সে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলো।আমি সেদিকে মন না দিয়ে তার প্যান্টের পা উঠিয়ে ভাঁজকরে ক্ষতস্থান পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়লাম। বেশ অনেকটা কেটে গেছে কিছুটা গভীরও মনে হচ্ছে ভারী কিছুর আঘাত পেয়েছেন।টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পরলো অক্ষিকোটর হতে।
তিনি তখনো আমার দিকে তাকিয়েই আছেন।আমার হাত কাঁপছিলো ঠিকমত করতে পারছিলাম না।
আহ্…(নিচুস্বরে)
কি হলো? বেশি ব্যাথা পেয়েছেন? লাগছে তাই না? আমিও না কি বোকা করতেই পারছি না ডাক্তারের কাছে যেতে হবে চলেন চলেন তাহলে..
হয়েছে তো এত অস্থির হওয়ার মত কিছু হয় নি। সামান্য ক্ষতই তো ঠিক…
ঐ আপনার চোখ ঠিক আছে এটা সামান্য ক্ষত হাঁ আপনার কাছে এটা সামান্য মনে হচ্ছে। কতটা কেটে গেছে আর আপনি বলছেন সামান্য ডাক্তার দেখাতে হবে না হলে ইনফেক….বলতে পারলাম না ফুঁপিয়ে উঠলাম
তিল আপনি কি জানেন আপনাকে এই মুহূর্তে কতটা অনিন্দ্য লাগছে!!টুপটুপ করে গড়িয়ে পরা অশ্রু বিন্দু লাল হয়ে যাওয়া নাসিকা তিরতির করে কাঁপতে থাকা অধর যুগল ধরার সবচেয়ে সুন্দরতম দর্শন।।
হু…. কি বলছেন আপ..
একদম ঠিক বলেছি। আমার হাতদুটো তার হাতের মাঝে নিয়ে বললেন _
মাঝে মাঝে এমন ক্ষত পাওয়াটাও সৌভাগ্যের বিষয় যার দরুন এত সুন্দর একটি মুহূর্তের সৃষ্টি হতে পারে।কোনো এক রমণীর নিরব অশ্রুর কারণ হয়ে তার প্রত্যক্ষ অবলোকনের সুযোগ পাওয়া টাও পরম সৌভাগ্যের বিষয়।
সৌভাগ্য…
হুমম।মাত্র ১ মিনিট ১২ সেকেন্ডের দৃষ্টিপাতেই যে নারী আড়ালে লুকানো ক্ষতস্থানের উপলব্ধি করতে পারে ব্যস্ত হয়ে পরে সেটার যত্নের প্রতি মুখশ্রীতে ফুটে উঠা অতি সূক্ষ্ম বেদনার চিহ্ন নজরে পড়তেই অক্ষিকোটেরর বারিপাতের সূচনা হয় সে নারীর একমাত্র অধিকারী হতে পারা যে খুবই সুখকর।
কেনো জানি না তার এমন অনুভূতি মিশ্রিত আবেগময় বাক্য গুলোর সামনে আমি সর্বদা বাক্যহীন হয়ে পড়ি।এতটা ক্ষত নিয়েও নিভৃতে প্রেমিকরূপে স্ত্রীরূপী নিশ্চুপ প্রেমিকার অদ্ভুত সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করার মধ্যেও আমি অভিভূত হয়ে পড়ি।
আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ক্ষতস্থানগুলো নিয়ে।শুধু পায়ে না হাতেও বেশ কয়েক জায়গায় কেটে ছিঁড়ে গেছে।সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে যখন ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছিলাম ঠিক তখনই শুনতে পেলাম_
অসুস্থ সন্তানের শুশ্রূষায় নিয়োজিত মা আর অর্ধাঙ্গের ব্যাথায় কাতর নারী এদের চেয়ে উত্তম বৈদ্য আছে কি!!!
নিশ্চুপ আর নিরবতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত আমার এই স্বল্পভাষী মানুষটাকে আজ বড় অচেনা মনে হতে হতেও হচ্ছে না।হয়ত জড়তা নিয়ে শামুকের যেই খোলসের আবরণে নিজেকে আবৃত করে রেখেছিলেন তা অনাবৃত হচ্ছে। মনে পড়ে গেলো সেইদিনের কথা যেদিন আমিও নিজেকে খোলসের আবরণ থেকে অনাবৃত করণের মাধ্যমে সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম তার অনুভূতির গভীরতার।
আপনি….
#চলবে
কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন।আর হ্যাঁ ছোট হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে সুঃখিত😌
ভুল- ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।