গাংচিল পর্ব-২২ শেষ পর্ব

0
1242

#গাংচিল
#অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)

মৌপ্রিয়া খেয়াল করলো তার গাল ভিজে গেছে। ঠিক কতোদিন পর কাঁদছে জানা নেই। তবে সে কাঁদছে। আজ বুকফেটে বিষাদ সিন্ধু মুক্তি পাচ্ছে। সে কাঁদছে। কাঁদছে তার সীমান্তের জন্য____________________

১১.
“বসন্তের প্রথম সপ্তাহ,
শীতের ক্ষরতা কেটে আম গাছটায় নতুন পাতার জন্ম হচ্ছে। রুক্ষ্ণ পরিবেশটা সতেজ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের স্প্রিং অর্থাৎ বসন্ত খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমার কেনো জানে বসন্তটা ভালো লাগে না। যে মানুষের অন্তরেই শীতলতা বিরাজমান তার মনে বসন্ত ঠায় পাবে কিভাবে। ব্যাপারটা অবাককর কিন্তু সত্যি। রাসেল ভাই এর চলে যাবার পর আমার জীবনটা অনেক অংশেই বদলে গেছে। আমার জীবনের উষ্ণতাকে কেড়ে দিয়ে এক রুক্ষ্ণ শীতলতার জন্ম দিয়েছে তার সাথে বিচ্ছেদ। আমার হৃদমন্দিরের দরজায় বড় তালা ঝুলিয়েছি আমি। তার সাথে কাটানো সেই ক্ষুদ্র জীবনের হাসি, কান্নার মূহুর্তগুলোই আমার বাঁচার একমাত্র মাধ্যম। এটা ভাবার কোনো মানে নেই যে আমি হাসতে ভুলে গেছি। না আমি হাসতে ভুলি নি; তবে আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। আমার বুকের ভেতর জমাট বাধা কান্নাগুলো পাথর হয়ে গেছে। এককোনে জন্ম নেওয়া ভালোবাসার ফুলটা বাঁচার আর্জি জানাচ্ছে। কিন্তু আমি তাকে তোল্লাই করছি না। কেনো করবো? যে মানুষটার জন্য এই ফুলের পরিচর্যা করতাম সে তো নেই। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেদিন যদি তিনি একটু আমার উপর বিশ্বাস রাখতেন তাহলে হয়তো এই বিয়োগটা হতো না। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরিবারের খুশির জন্য, আমার খুশির জন্য। আমাকে অন্য পুরুষের আলিঙ্গনে দেখতে পারবেননা বলে নিজেই পাড়ি দেন অজানাতে। অথচ আমি তো সেদিন বিয়েটাই করিনি। বিয়ের আসর থেকে চলে এসেছিলাম তার জন্য। কিন্তু হয়তো আমার সময়ের হিসেবটা ভুল ছিলো। মানুষটা ততক্ষনে চলে গেছে বহুদূর। আমি জানি না রাসেল ভাই বেঁচে আছেন কিনা, তিনি ভালো আছেন কিনা! তবে এটুকু জানি আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষটি ঐ নাক উঁচু, খিটখিটে, জীরাফটাই ছিলো, আছে এবং থাকবে। আমার ভাবনায় ছেদ করলো বাবা। ভারী কন্ঠে বললেন,
“মৌ মা, তুমি কি ব্যাস্ত?”
“না তো বাবা, কিছু বলবে?”
“স্টাডিতে একটু আসো। তোমার সাথে দেখা করবে বলে একটা যুবক এসেছে।“
“আমার সাথে কেনো?”
“সেটা তো বলতে পারবো না, তবে সে বলছিলো তোমার সাথে চট্টগ্রামের ক্যাম্পে দেখা হয়েছে। বন্যা পীড়িতদের সেবা করার সময় সেই ব্যাক্তি তোমাকে দেখেছিলো। খুব কৃতজ্ঞ তোমার কাছে সে।“

বাবার কথায় বুঝলাম যুবকটি হয়তো, “সুবোধপুর” গ্রামের কেউ। আমি ওড়নাটা ঠিক করে বললাম,
“চলো”

বাবার পিছু পিছু গেলাম স্টাডিরুমে। একটা সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত যুবক আমাদের দিকে পিঠ করে বসে আছে। লোকটাকে পেছন থেকে দেখেই আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো। শীতল হৃদয়ে হুটকরে একরাশ আশা জড়ো হলো। আমি জানি এগুলো মিথ্যে তবুও মন মানতে নারাজ। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। বাবা আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি ধীর স্বরে বললাম,
“কে?”

যুবকটি পেছনে ফিরলো। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি স্তব্ধ, পা জোড়া মাটিকে আকড়ে ধরলো। দৃষ্টি অজান্তেই ঝাপসা হয়ে গেলো। ছয় মাসের শীতলতা যেনো গলতে লাগলো মোমের মতো আমার চোখ বিশ্বাস করতে চাইছেনা। আমার সামনে আমার হৃদমন্দিরের সেই দেবতা দাঁড়িয়ে আছে। আমার সামনে রাসেল ভাই দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থেকে অস্পষ্টস্বরে বেড়িয়ে এলো,
“রাসেল ভাই?”

রাসেল ভাই তার ভুবন ভূলানো হাসি হাসলেন। এগিয়ে এলেন আমার কাছে। মুখশ্রী আলতো হাতে স্পর্শ করলেন। আমি কেঁপে উঠলাম। তারপর তিনি আবেগ জড়ানো কন্ঠে বললেন,
“কাজললতা, আমি ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য”

★★★

হাসপাতালের সাদা বিছানায় শায়িত যুবক বইটা বন্ধ করলো। বই এর নামটা আবারো দেখে নিলো সে; “গাংচিল”। যুবকের মুখে তৃপ্তির হাসি, সে বইটা আবারো খুললো। আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলো উৎসর্গের পাতাটি। সেখানে লেখা,

“উৎসর্গ
আমার জলসমুদ্রের মাঝের ক্ষণস্থায়ী গাংচিল তিনি।
আমার জীবন কে নতুন দিক দেখিয়ে হারিয়ে গেছেন দূরঅজানায়।
তার নামটি বললে পৃথিবী জেনে যাবে, তাই আমার লুকায়িত প্রকোষ্ঠেই থাক।
শুধু বললো, আমি অপেক্ষায় আছি শুধু তার জন্য।“

লাইনকটি পড়ে তার ঠোঁট বিস্তৃত হলো। হাসিটা চোখে প্রতিবিম্ব ফেলছে। এরমাঝেই এক কৃষ্ণ যুবকের আগমন ঘটলো। পরণে সাদা কোর্ট। কালো হলেও লোকটা দেখতে বেশ সুদর্শন। সে এই হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তার। লোকটির নাম “সুব্রমান্নিয়াম চাইতাইন্নিয়া”। তামিল নামটা উচ্চারণ করতে কষ্টই হয়।লোকটি হিন্দি পারেন না, তামিলে কথা বলেন। কিন্তু শায়িত যুবক তামিলের ত টাও পারেনা। তাই তাদের কথাগুলো ইংলিশেই হয়। সে গুলোকে বাংলায় ট্রান্সলেট করলে যা দাঁড়ায় তা হলো,
“কি মিষ্টার ইসলাম? এখন শরীর কেমন?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো।“
“কোথাও কোনো অস্বস্তিতো নেই?”
“না, ডাক্তার। আমার রিপোর্ট কি এসে পড়েছে।“

এবার ডাক্তার সুব্রমান্নিয়াম কিঞ্চিত হাসেন তারপর বলেন,
“বাড়ি যাবার খুব তাড়া বুঝি?”
“জ্বী, সেটা তো থাকবে। একজন যে আমার অপেক্ষায় আছে।“
“গার্লফ্রেন্ড।“
“আজ্ঞেনা”
“তাহলে?”
“আমার হৃদয়ের মাঝে বিস্তারকারী মহারানী, আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ নারী।“

ডাক্তার সুব্রমান্নিয়াম কি বুঝলেন জানা নেই। তবে একটা স্বচ্ছ হাসি হাসলেন। যুবক এবার বাহিরের দিকে তাকালো। বসন্ত সত্যিই এসে গেছে। ঝরাপাতার বদলে নতুন সজীবতায় সাজছে প্রকৃতি। হাসপাতালের জানালা দিয়ে আকাশটা বড্ড ছোট মনে হয়। সে অপেক্ষায় রয়েছে, কবে এই জানালার শিকল ভেঙ্গে প্রকৃতিতে আবারো পা রাখবে________________

গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে মৌপ্রিয়া। আজ অনেক বেশি ক্লান্ত সে। অবশেষে বইমেলার দিন চলে এসেছে সন্নিকটে। প্রস্তুতি চলছে সেই সাতদিনের। মৌপ্রিয়ার
বইটা অবশেষে বের হচ্ছে। বেশ ভালো মার্কেটিং করেছে অনুপমা প্রকাশনী। পাঁচশত বই ছাঁপিয়ে ছিলো তার মাঝে দুশত এর বেশি বিক্রয় হয়েছে প্রিঅর্ডারে। এখন বই মেলার অপেক্ষা, এবার হয়তো তাকে হতাশ হতে হবে না। বইটা নিয়ে সবাই খুব ভালো রিভিউও দিয়েছে। একটু আগেও একটা লাইভ করে এসেছে সে। লাইভটা ছিলো প্রকাশনী থেকে। সূবর্ণার বাসায় বই এর কপি পাঠানো হয়েছে। বইটা তারও বেশ মনে ধরেছে। মায়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে বেশ তৃপ্তি হাসি ফুটে উঠলো মৌপ্রিয়ার মুখে। আজকাল অনুপমা প্রকাশনীর সাথেই অতঃপ্রতভাবে জড়িয়েছে সে। সামনের বইগুলোও এই প্রকাশনী থেকেই বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। যতই হোক, প্রকাশনীর সাথে যে তার হৃদয়ের টান। এখন আর পান্ডুলিপি নিয়ে তিয়াশাকে যন্ত্রণা করেনা মৌ, তিয়াশা মন দিয়ে তার সংসার করছে। এইতো গত সপ্তাহেই সে এবং অন্তু গিয়েছে হানিমুনে। তিয়াশার জীবনটা অবশেষে রঙ্গিন হতে লেগেছে। ভাবতেই ভালো লাগে। একা একা কতই না কষ্ট করতো মেয়েটা।
জীবনের অনেক অগোছালো অংশগুলো এখন সসজ্জিত হয়ে উঠেছে। ভেবেই ভালো লাগে মৌপ্রিয়ার। কিন্তু এখনো একটা এলোমেলো অংশ এলোমেলোই রয়েছে। তা হলো তার মাস্টারমশাই। লোকটা কোথায় যে আছে তা এখনো জানে না মৌপ্রিয়া। দেখতে দেখতে কত গুলো মাস পেরিয়ে গেলো। সেই বৃষ্টিস্নাত গোধূলীটাই ছিলো তাদের শেষ দেখা। এরপর হাজার খুজেও তাকে পায় নি মৌপ্রিয়া। হৃদয়ের একটা অংশ কেমন যেনো হাহাকার করে। আচ্ছা লোকটা কি বেঁচে আছে। গাড়ির ব্রেক কষাতে স্বম্বিত ফিরে তার। বাড়ি চলে এসেছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আছে। কলিংবেল বাজাতেই নীলু দরজা খুলে। মেয়েটার উজ্জ্বলমুখখানা দেখে মাথা থেকে সবচিন্তা ঝেড়ে ফেলে মৌপ্রিয়া। ব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে বলে,
“বাবা কোথায়?”
“খালু জানে এস্টাডিরুমে। আপনের জন্য বয়ে রইছে।“
“আমার জন্য কেনো?”

নীলু হাসতে হাসতে বলে,
“যায়ে দেখেন কি এককান্ড করছে খালুজান”

নীলুর হাসির রহস্য অজানা মৌপ্রিয়ার। সে পা বাড়ায় স্টাডির দিকে। স্টাডি রুমে যেতেই মৌপ্রিয়া দেখে তার বাবা মোটা বইয়ের মাঝে মুখগুজে বসে রয়েছেন। ইফতেকার সাহেবের সামনে বসতে বসতে মৌপ্রিয়া বলে,
“নীলু বললো, তুমি নাকি আমার অপেক্ষায় বসে আছো?”
“তুই এসেছিস। যাক ভালো ই হলো। বেশ ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে তোর সাথে। বয় বয় সামনে বয়।“
“বলো কি কাজ?”
“আমি তোর জন্য নতুন “স্টেনোগ্রাফার” খুজেছি, তোর রুমেই বসে আছে ছেলেটা।“

বেশ উৎসাহিত কন্ঠে কথাটা বললেন, ইফতেকার সাহেব। বাবার মুখে তাজ্জব কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো মৌপ্রিয়া। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“মানে টা কি?”
“মানে আবার কি হবে, লেখিকাদের স্টেনোগ্রাফার প্রয়োজন। তোর বই মাশাআল্লাহ বেশ ভালো করেই বিক্রি হচ্ছে। আমার মনে হয়, সামনে বইমেলাতে আরেকটা ভালো বই লিখতে পারবি। সেজন্যই এইস্টেনোগ্রাফার। যা উপরে যা, ছেলেটা অপেক্ষা করছে।“
“তাই বলে আমার রুমে পাঠিয়ে দিবে? একটা অজানা ছেলেকে?”
“আরে ধুর, ওতো তোর সাথে কাজ করবে। তাইতো সরাসরি তোর রুমে পাঠিয়েছি। তোর বইগুলো পড়লে তোর একটা ধারণা হবে তুই লেখিকা কেমন। যা যা দেরি করিস না।“

মৌপ্রিয়ার রাগ হচ্ছে, কিন্তু রাগ কে দমন করে রাখলো। বাবার সাথে চিৎকার করে লাভ নেই, এই লোক যা ভালো বুঝে তাই করবে। সীমান্তের যাবার পর থেকে লেখায় খিল হারিয়ে ফেলেছে মৌ কথাটা সত্যি। কিন্তু সীমান্তের স্থানে অন্য কারোর সাহায্য সে নিবে না। কেনো নিবে! এই জায়গাটা তো শুধু একজনের, তা হলো এই আবালচন্দ্র মাস্টারমশাই এর। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে ধীর পায়ে হেটে নিজের রুমের কাছে গেলো মৌপ্রিয়া। তখনই একটা মিহি কন্ঠ কানে এলো,
“একজনে ছবি আকে এক মনে
ওরে মন
আর একজনে বসে বসে রং মাখে
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে কোনজনা কোনজনা
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
তোমার ঘরে বাস করে কারাও মন জানো না
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা”¬______

কন্ঠটা খুব চেনা। বুকের মাঝে অসংখ্য আশা এসে ভর করে মৌপ্রিয়ার। মনের ভেতরের মুর্ছা যাওয়া ভালোবাসাটা জীবন্ত হয়ে উঠে। পা জোড়া এগোতে চাইছেনা, এক চিলতে ভয়ও উকি দিচ্ছে। যদি আশাহত হয়, যদি সে যাকে কল্পনা করছে সে না হয়। কি করবে তখন। নিজেকে ভুলভাল বুঝিয়ে শান্ত করে মৌপ্রিয়া। একরাশ সাহস নিয়ে দরজা ঠেলে দেয় সে। মূহুর্তেই স্তব্দ হয়ে যায় সে। শিরদাঁড়া বেয়ে এক অনন্য শিহরণ বয়ে যায়। গলার কাছে সকল অনুভূতিগুলো জড়ো হয়। এ যে তার মনমন্দিরের সেই মানুষটা, যাকে হারিয়েছিলো পাওয়ার আগেই। তার মনের জলসমুদ্রের খাবি খাওয়া গাংচিল। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“সীমান্ত?”

সীমান্ত দৃষ্টি ঘোরায়। বাহিরের আকাশ থেকে দৃষ্টি নিয়ে যায় মৌপ্রিয়ার ভেজা আখিতে। ঠোটে সেই চিরচেনা হাসির প্রলেপ। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে মৌপ্রিয়ার দিকে। দাঁড়ায় তার প্রেয়সীর মুখোমুখি। সময়টা যেনো থমকে গেছে। আলতোহাতে স্পর্শ করে মৌপ্রিয়ার গাল। মৃদু স্বরে আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলে,
“কাজললতা, আমি ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য”

।।সমাপ্ত।।

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here