গাঙচিল পর্ব_০৭

0
1351

#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল ||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____০৭

অহি প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়ছে।রোদ্দুরের দিকে চেয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

—“আপনি বাবার মাথা ন্যাঁড়া করে দিলেন কেন?”

রোদ্দুর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।জলিল মোল্লার ছিপের কাছে কিছু চুল রয়েছে।সে মনোযোগ সহকারে ছিপের চুলগুলো কেটে জলিলের গা থেকে ঝেরে দিল।মাথার চুল কাটা কমপ্লিট!জলিল মোল্লাকে মোঘলদের সম্রাটের মতো লাগছে।সে অহির দিকে চেয়ে হেসে বলল,

—“মিস!রেগে যাচ্ছেন কেন?আমার তো কোনো দোষ নেই।আপনার বাবা সকাল সকাল বায়না ধরলো চুল কেটে দিতে।থানায় কিছুদিন থেকে নাকি তার মাথায় উকুন হয়েছে।সারা রাত মাথা চুলকেছে।উকুনের যন্ত্রণায় ঘুম পাড়তে পারেনি।আমি আবার খুবই দয়ালু মানুষ।চাচাজীর জন্য কষ্ট হলো।মনে হলো চাচাজী কে ন্যাঁড়া করে দেয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব!তাই করে দিলাম!”

—“তাই বলে আপনি সত্যি সত্যি……. ”

অহি রেগে জলিলকে ডাক দিল!

—“বাবা!”

জলিল উঠে দাঁড়ালো।গা থেকে আলগা চুলগুলো ঝেরে হাসিমুখে অহির দিকে তাকালো।জলিলকে ন্যাঁড়া মাথায় অদ্ভুত লাগছে।তিনি তার সম্পূর্ণ টাক মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

—“চুলগুলো বড্ড জ্বালাতন করছিল রে মা!”

—“বাবা!তুমি কেমন যেন হয়ে গেছো!”

রোদ্দুর জলিলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,

—“এসব বয়সের দোষ।তোমার না মানে আপনার বয়স হলে আপনিও পাল্টে যাবেন।তখন সিংহী থেকে ইঁদুর হয়ে যাবেন।”

অহি আর কিছু বলল না।রেগে রান্নাঘরে চলে গেল।রান্নাঘরে রেখা নিঃশব্দে রান্না করছে।বড় একটা কড়াইতে ডাল নাড়ছে।কিন্তু বিন্দুমাত্র শব্দ হচ্ছে না।অহি অবাক হলো না।তার মা সবসময় এভাবে নিঃশব্দে কাজ করে।

অহি চুপচাপ প্লাস্টিকের বোলে রাখা আধাসিদ্ধ ময়দা দিয়ে রুটি বেলতে শুরু করলো।

১১.

কিছুক্ষণ পর অহি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসলো।চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো কেউ আছে কি না।তার বাবা বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে।ফেরেনি এখনো।একটু পর পর তার বাবা তার ন্যাঁড়া মাথায় হাত বুলাচ্ছে এবং তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাজটা করে ভীষণ মজা পাচ্ছে সে।

শফিক নিজের রুমে কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত!অহি রোদ্দুরকে খুঁজলো।বাইরে নেই!তার মানে নিশ্চিত তার রুমে বসে আছে।সে নিজের রুমের দরজা সম্পূর্ণ খুলে ভেতরে ঢুকলো।

রোদ্দুর রুমে নেই।ওয়াশরুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।হয়তো ওয়াশরুমের দেয়ালে দেয়ালে চুমু খাচ্ছে।কি জঘন্য মানুষ।অহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার পাল্লা একটা ভারী জিনিস দিয়ে সম্পূর্ণ ফাঁকা করে রাখলো।যাতে বাইরে থেকে সব দেখা যায়।

দরজার মৃদু শব্দে রোদ্দুর চেঁচিয়ে বললো,

—“কে?চাচাজী?”

অহি বিছানায় বসে ক্ষীণ স্বরে বলল,

—“বাবা বাজারে!”

—“অজান্তা!তোমার ব্রাশ খুঁজে পাচ্ছি না তো।রাতে যেটা দিয়ে আমিও ব্রাশ করলাম।সেটা কই?”

অহি একটা হাই তুলল।তার ঘুম ঘুম পাচ্ছে।এত সকাল সকাল আবার ঘুম পাচ্ছে কেন?মাত্রই না উঠলো!

রোদ্দুর আবার বলল,

—“অজান্তা চলে গেছো?ব্রাশ খুঁজে পাচ্ছি না।কোথায় গেল বলো তো?”

—“ফেলে দিয়েছি।আমার টেবিলের উপরের জানালা দিয়ে।”

—“ও মাই গড!কেন?”

অহি এগিয়ে ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে বলল,

—“আপনি একটা পাগল!উন্মাদ!আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন।জীবনে শুনেছেন একজনের ব্রাশ দিয়ে আরেকজন ব্রাশ করে?ছি!ইয়াক থু!”

রোদ্দুর অবাক হয়ে বলল,

—“অদ্ভুত!এভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে?ব্রাশই তো!দুদিন পর যে গন্ধযুক্ত মুখ নিয়ে, দাঁত পরিষ্কার না করেই চুমু খাবে তখন কি হবে?আমি ঠিক করে রেখেছি,বিয়ের পর আমরা এক ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করবো।ওয়াশরুমে একটা ব্রাশ থাকবে।ওয়ান এন্ড অনলি পিস ব্রাশ!বুঝতে পেরেছো?”

—“ওগুলো আপনার চিন্তাতেই থাকবে।বাস্তবে হবে না কখনো!”

রোদ্দুর ফ্যানাযুক্ত মুখে বের হয়ে আসলো।অহি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।এই ছেলে কথায় কথায় ওয়াশরুম থেকে বের হয় কেন?

—“আপনি কি গাধা?”

রোদ্দুর মৃদু ধমক দিয়ে বলল,

—“চুপ!এত যাচ্ছে তাই মনে করো কেন আমাকে?তোমাকে কিন্তু কঠিন শাস্তি দিবো এরকম ব্যবহার করলে।”

অহি গলার স্বর নামিয়ে বলল,

—“চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকে যান। ফ্রেশ হয়ে তারপর বের হবেন।”

রোদ্দুর এক হাতে চোখের পাশের সাবানের ফ্যানা মুছলো।টিপটিপ চোখে এগিয়ে একদম অহির কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল।মুখটা কাছে এনে বলল,

—“দেখো তো,গন্ধ বের হয়েছে কি না?ব্রাশ ফেলে দিয়েছো এখন দাঁত পরিষ্কার করবো কি দিয়ে?”

অহির নাকে লাক্সের গন্ধ এলো।সাবানের গন্ধ।গতকাল রাতেই সে নতুন সাবান বের করে ওয়াশরুমে রেখেছে।সে দু পা পিছিয়ে বলল,

—“ড্রেনের পঁচা গন্ধ আসছে!”

রোদ্দুর কিছু বলল না।সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতেই অহির বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো।রোদ্দুর কি করতে চাইছে?কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রোদ্দুর যখন তার বুকের সাথে বুক লাগিয়ে দাঁড়াল,সে এক ঝটকায় সরে গিয়ে বিছানাতে বসলো।চকিতেই দু চোখ দরজার বাইরে চলে গেল।খোলা দরজা দিয়ে যদি কেউ দেখে ফেলে?সে বেরিয়ে যেতে নিতেই রোদ্দুর তার পথ আগলে দাঁড়ালো।

রোদ্দুর দরজার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল।তার গায়ে সে কালকের জলপাই রঙা শার্ট,কালো প্যান্ট!তাকে কেমন ছবির মতো লাগছে।ছবি কি কথা বলে?রোদ্দুর তো বলছে।

রোদ্দুর অহির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস শব্দে বলল,

—“দরজা বন্ধ করি অজান্তা?”

অজানা আশংকায় অহির বুক কেঁপে উঠলো।সে বিস্ফারিত নয়নে রোদ্দুরের দিকে চেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

—“ক-কেন?দ-দরজা বন্ধ করবেন কেন?”

—“দরজা বন্ধ করে মানুষ কি করে?”

—“আমায় যেতে দিন!”

রোদ্দুর বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল,

—“তোমায় ধরে রেখেছে কে?চলে যাও!তবে তুমি চাইলে দরজা বন্ধ করতে পারি।তাহলে আমাদের বিয়েটা দ্রুত হয়ে যাবে।”

অহির কানে কিছু ঢুকলো না।তার মস্তিষ্ক বোধ হয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।সে মাতালদের মতো টলতে টলতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।রোদ্দুরকে পাশ কাটিয়ে বের হতে নিতে রোদ্দুর এক টানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।অহির কোমড় জড়িয়ে গলার খোলা অংশে মুখ ডুবাতে অহি সবশক্তি হারিয়ে ফেলল যেন।সে নিস্তেজ হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। রোদ্দুর তাকে ছেড়ে বলল,

—“মুখের ফ্যানা গলায় একটু মুছতে নিয়েছিলাম তাতেই এই অবস্থা?”

সে শিস বাজাতে বাজাতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।ওয়াশরুমে ঢুকেই বড় বড় করে শ্বাস নিল।ও মাই গড!মেয়েটার মধ্যে কি সম্মোহন ক্ষমতা আছে?ধীরে ধীরে তাকে কেমন সম্মোহিত করছে।এই মেয়ে ছাড়া তো তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

সে ট্যাপ ছেড়ে তার নিচে মাথা দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।একসেট এক্সট্রা কাপড় চোপড় সে নিয়েই এসেছে।

১২.

—“ভাইগণ,আপাগণ!!এদিকে আসেন।এদিকে আসেন।আমাদের দোকানে ‘যাহা চাবেন,তাহা পাবেন’!দেখেন থরে থরে জুতো সাজিয়ে রেখেছি।সব ধরনের মাপের আছে।যার যেটা লাগবে নিয়ে যান।কি সুন্দর, ঝকঝকে জুতো।নিয়ে যান!নিয়ে যান!”

জলিল হুংকার দিয়ে দিয়ে সদা বলে যাচ্ছে এসব।তিনি আপাতত বসে আছে লক্ষী বাজারের ফুটপাতে।লাল রঙা ছোট্ট টুলে লুঙ্গি পড়ে বসে আছে।তার সামনে চটের কাগজে আটত্রিশ জোড়া জুতো।বিকেল দুটো থেকে বেঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এখন সাড়ে চারটে বাজে প্রায়।এতক্ষণে দু জোড়া জুতো বিক্রি হয়েছে।

কালো বোরখা পড়া মধ্য বয়স্কা এক মহিলা বাচ্চা দুটো মেয়ের হাত ধরে এটা ওটা কেনাকাটা করছে।জুতোর দোকান পাস করে সামনে এগিয়ে যেতেই তাকে উদ্দেশ্য করে জলিল বলল,

—“নিয়ে যান!নিয়ে যান আপা!এমন জিনিস আর পাইবেন না!”

মহিলাটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে জলিলের দিকে তাকালো।জলিল ইতস্তত অনুভব করছে।দরদাম করে বেচা তার জন্য অসুবিধে মনে হচ্ছে।তাছাড়া সবাই তার ন্যাঁড়া মাথার দিকে অন্য রকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।মহিলাটি বাচ্চা নিয়ে চলে গেল।জলিল অসহায় মুখ নিয়ে অহির দিকে তাকালো।

অহি এতক্ষণ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।সে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এতক্ষণ বাবার দোকানে ক্রেতা হিসেবে অভিনয় করছিল।দোকানে ভিড় জমলে সেদিকে সবার আগ্রহ থাকে।কিন্তু তাদের দোকানে কাস্টমার নেই।সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

—“বাবা!তুমি এমন ভাবে ‘নিয়ে যান!নিয়ে যান!’ করছো,মনে হচ্ছে মাগনা জুতা দিয়ে দিবে।একটু প্রফেশনাল হওয়ার চেষ্টা করো।”

—“আরে ধুর!স্যান্ডেল বিক্রি করার চেয়ে মানুষের চুল কাটা সহজ ছিল।রোদ্দুর বাবাজীবন বলেছিল আমাকে এক সপ্তাহ ট্রেনিং দিয়ে সব শিখিয়ে দিবে।কিন্তু তুই তো তা করতে দিচ্ছিস না অহি।”

অহি বিড়বিড় করে বলল,

—“রোদ্দুর আবার বাবাজীবন হলো কবে থেকে?কি সাংঘাতিক!”

সে বাবার পাশে বসলো।দুজন অল্প বয়সী মেয়ে এসে জুতো নেড়েচেড়ে দেখলো।অহি অত্যন্ত বিনয়ের সহিত দেখালো তাদের।মিনিট পনেরো দরদাম করে,পায়ে ঢুকিয়ে, ময়লা লাগিয়ে জুতা না নিয়েই চলে গেল।অহি চরম বিরক্ত হলো।বেলা পড়ে গেছে। এখানে তার কোনো কাজ নেই।সে চলে যেতে উদ্যত হলো।

বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে রোদ্দুরের কন্ঠ কানে আসলো।

—“চাচাজী!বেচাকেনা কত দূর?”

জলিলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।অহির দিকে চেয়ে বলল,

—“বাবা জীবন এসেছে।বসো!বসো বাবাজীবন!”

অহি কপালের খাদ গভীর করে রোদ্দুরের দিকে তাকালো। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতি যেমন সজীব আর ঝকঝকে হয়,রোদ্দুরকে তেমন লাগছে।ব্রাউন টিশার্ট আর চেক ট্রাউজারে কি স্নিগ্ধ লাগছে মানুষটাকে।অহির কুঁচকানো কপাল শিথিল হলো।

সে বাবার পাশ থেকে সরে এসে বলল,

—“বাবা!তুমি আর তোমার বাবাজীবন সব জুতা বিক্রি করে তবে বাড়িতে ঢুকবে আজ।তা না হলে খবরদার!বাড়িতে ঢুকবে না। ”

অহি রিকশা দেখে রাস্তার অপর পাশে গেল।কিছুদূর হাঁটতে ফোন বেজে উঠলো।ব্যাগ থেকে বের করে হাতে নিতে কেটে গেল।রোদ্দুর ফোন দিয়েছিল।সে পেছন ঘুরে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।এখান থেকে দেখা যাচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ আসলো,

“তাহলে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলে!আহা!কি শান্তি!একটা কথা!জুতো গুলো তোমায় পরার জন্য দিয়েছিলাম।আচ্ছা যাও!বাদ দিলাম।আপাতত বলো, যদি সব জুতো ভালো দামে বিক্রি করি তাহলে কি পুরষ্কার দিবে আমায়?”

অহি উত্তর দিল না।সে ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।রোদ্দুর এক পলক অহির দিকে চেয়ে হাসিমুখে জলিলের পাশে বসে পড়লো।অফিস শেষ করে, মায়ের সাথে দেখা করে,শাওয়ার নিয়ে, ভরপেট খেয়ে সে এখানে এসেছে!একদম ফুল এনার্জি!

মুহুর্তে ভার্সিটির একদল তরুণী দোকানে ভিড় জমালো।রোদ্দুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাদের জুতো দেখাল।

(চলবে)

কিছু কথা!আমার আপন বড় ভাইয়া পুলিশ প্রফেশনে আছে দশ বছর হলো।(ব্যক্তিগত বিষয়ে বলতে চাচ্ছিলাম না।কিছুটা নিরুপায় হয়ে বলছি!)তিনি তার জবের ক্ষেত্রে যেমন স্ট্রিক্ট,জবের বাইরে ততটাই ফানি।জগতের যত উদ্ভট কর্মকান্ড আর চিন্তা ভাবনা সব তার মাথায় এবং সে সেগুলো একমাত্র আমার সাথে শেয়ার করে।আমার বড় ভাই আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ।সে আমার বন্ধুর মতো।আমার বারো বছরের বড় হওয়ার পরো তার সাথে আমার তুই তুকারি সম্পর্ক।(বাইরের মানুষের সামনে না!)সে সারাদিন উল্টা পাল্টা কথা বলে বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষদের পর্যন্ত হাসাতে থাকে।আজও তার প্রিয় টিভি শো হলো গোপাল ভাঁড়,নাট-বল্টু,পঞ্চতন্ত্রের মন্ত্র ইত্যাদি!

তার কর্মকান্ড বলে শেষ করা যাবে না।ছুটিতে যখন বাড়ি আসবে বাস থেকে নেমেই ফোন দিবে।যে আধঘন্টা রিকশায় থাকবে প্রতিটি মিনিট কথা বলবে এবং বাড়ির সবাইকে তার জন্য গেটের বাইরে দাঁড়াতে হবে।একবার কেউ গেটের বাইরে তার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল না বলে সোজা উল্টো ঘুরে ঢাকা চলে গেছিল।বাড়ি এসে হুট করে জোর করে ছোট ভাইকে ন্যাঁড়া করে দিবে,কেঁচি দিয়ে গুছিয়ে আমার চুল কেটে দিবে।উঠোন, ঘর ঝাড়ু দিবে,হুদাই বাড়ির সবচেয়ে বড় গাছটা কেটে ফেলবে!নতুন চারা গাছ লাগাবে।বাচ্চাদের সারি সারি বসিয়ে ওয়াজ করবে।(ওয়াজ পারে না!হুদাই উল্টা পাল্টা যা মাথায় আসে তাই বলে।)বাড়ির সামনের ক্ষেত থেকে শাক তুলতে নিজেই যাবে।পাশের বাড়ির নারকেল গাছ থেকে বড় নারকেলটা চুরি করবে।

একবার তার কি হলো কে জানে।দাঁড়ি রাখবে সে এবং শেভ করা বাদ রেখে দাঁড়ি রেখে দিল।বছর হতে না হতেই তার দাঁড়ি বুক পর্যন্ত হয়ে গেল।তাদের জেলার একদিন জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠালেন।জিজ্ঞেস করলেন এসবের মানে কি?অন্ধকারে তাকে দেখে কোনো এক কয়েদির হার্ট অ্যাটাক উপক্রম।তার কিছুদিন পর ভাই দাঁড়ি কেটে ফেলল।

তার সাথে আমার পুরো ঢাকা শহর ঘোরা শেষ।প্রতিটা জার্নিতে বা যাওয়ার পথে রাস্তায় যা দেখবে সে আমায় ঘুম থেকে টেনে তুলে বলব, খাবে এটা? (সে আমার সাথে তুমি করে বলে।ক্ষেত্রবিশেষে তুই!)আমি প্রতিবারের মতো না জানাতাম।সে সিগারেটের দোকান দেখলেও জিজ্ঞেস করবে,সিগারেট খাবে?একবার আমাকে সদরঘাট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত পায়ে হেঁটে নিয়ে আসলো।উদ্দেশ্য রাস্তার প্রতিটি ইট চেনানো।সেদিন ঢাবির বটতলায় বসে সে তিন গ্লাস আঁখের রস খেয়ে দুই ঘন্টার মতো জিরিয়ে নিল।সেই ফাঁকে আজগুবি সব চিন্তা!ঢাকায় সিদ্ধ ডিম বিক্রি করলে কেমন হয়?স্যান্ডেলের দোকান দিলে কেমন হয়?ঢাকায় কুলি নেই,কুলির কাজ করলে কেমন হয়?আরও কত চিন্তা ভাবনা!আবার হাঁটা শুরু করলো।পাবনা এক আত্মীয় বাড়ি গিয়ে গ্রামের রাস্তায় বাইক চালাতে নিয়ে গরুর দড়ির সাথে পেঁচিয়ে গরুর গায়ের উপর উঠিয়ে দিল একবার।নিজে ছিটকে পঁচা পুকুরে পড়েও তার সে কি হাসি!

থাক!তার কথা বলতে নিলে মহাকাব্য হয়ে যাবে।তিনি আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ।পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বোধ হয় এই ভাইটাকে ভালোবাসি।ছোট্টবেলায় মা একটা থাপ্পড় দিয়েছিল আমাকে।বড় ভাই কোলে তুলে নিয়ে তার দূরের এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল।বন্ধুর মা ডিম ভাজি করে ভাত খেতে দিয়েছিল।দিনটি কোনোদিন ভুলবো না।ক্লাস সেভেনে কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে একদিন শাড়ি পড়েছিলাম।বড় ভাই পাঁজা কোল করে বলেছিল, এত বড় হয়ে গেছিস!দিনগুলো সত্যি অনেক রঙিন।তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত স্পেশাল আমার কাছে।আমাকে সহ সবাইকে সদা হাসানো মানুষটা কিন্তু তার জবের ক্ষেত্রেও সফল।প্রতিটি প্যারোড শো তে দক্ষ হিসেবে তাকে নেয়া হয়।ট্রেনিং এ তাকে নেয়া হয়!তার সাথে কর্মরত প্রতিটি মানুষ তাকে ভীষণ পছন্দ করে।

তাই যারা পুলিশ বলতে কঠোর,রাগী,হাসতে বারণ,হাসাতে বারণ,মিশা সওদাগরের মতো বন্দুক নিয়ে ঢুসঢাস গুলি করে দেয়া বোঝেন তাদের জন্য আমার ভাই জলজ্যান্ত উদাহরণ।#গাঙচিল গল্পের রোদ্দুরের ফানি ক্যারেক্টার নিয়ে অনেকের নাকি প্রবলেম হচ্ছে।পুলিশ হয়ে সে কেন ছেলেমানুষী করবে?সে কেন হাসি তামাশা করবে?এসব নাকি তার প্রফেশনের সাথে যাচ্ছে না।তাদের জন্য আমার ভাইয়ের কিছু কথা উল্লেখ করলাম।যে মানুষটা ছোটবেলা থেকে ফানি, হুট করে পুলিশ প্রফেশনে ঢুকে কি নিজেকে চেঞ্জ করে ফেলবে?

এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে: রোদ্দুর হিম চরিত্রটি কি আমার বড় ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি?

উত্তর : অবশ্যই না।রোদ্দুর আমার ভাইয়ের মতো অতোটাও পাগল না।তাছাড়া আমার ভাইয়ের লাভ লাইফ রোদ্দুরের মতো চমৎকার না।রোদ্দুর আমার কল্পনার জগতের একটা চরিত্র।তবে আমি আমার জীবনে ভাইকে প্রচন্ড পছন্দ করি বলে রোদ্দুরের উপর ভাইয়ের কিছুটা আদোল পড়েছে হয়তো।ক্ষ্যাপা,রাগী, জেদি,বদমেজাজি মানুষের চেয়ে বাচ্চা মনের ফানি মানুষ আমার অনেক পছন্দের।সেখান থেকেই রোদ্দুরের সৃষ্টি।যাইহোক,ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here