#গল্প_গোধূলি_বেলায়_তুমি
#Writer_Ritu_Bonna
#পর্ব_২০
.
.
এইটুকু বলতেই আভিয়ানের চোখ দিয়ে আবারও পানি পরতে শুরু করে। পুরোনো ক্ষত আবারও বুকের ভিতরটা বিষিয়ে দিচ্ছে। সব কিছু তার কাছে বিষাদময় লাগছে। আদ্রিজার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে ভাবতেই পারেনি যে মানুষটার হাসি মুখের পিছনে এতটা কষ্ট জমিয়ে রেখেছিল।প্রিয় মানুষটির কষ্টে তারও কষ্ট হচ্ছে,,,,,,,
আভিয়ান নিজের চোখের পানি মুছে আবারও বলা শুরু করে,,,,, মার মৃত্যুর প্রায় এক মাস পরে বাবা কিছুটা স্বাভাবিক হয়।বাবা কাউকে তেমন সময় দিতেন না। সব সময় ব্যবসা নিয়ে থাকতেন। আমাদের দুই – ভাই বোনকে আদর করার মতো ওনার কাছে সময় ছিল না। রাতে যখন বাড়িতে আসতেন তখন আমরা ঘুমিয়ে যেতাম আর খুব ভোরেই চলে যেতেন।হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমাদের টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না। কিন্তু টাকা দিয়েই কি সব হয় বলো? আমাদের জন্য অবশ্যই সব সময়ের জন্য আয়া ঠিক করে রাখা ছিল কিন্তু মা – বাবার অভাব কি কখনো অন্য কেউ পূরন করতে পারে বলো?? আমি একটু হলেও বুঝতাম কিন্তু আমার বোন অবন্তী সে তো অনেক ছোট ছিল তার পক্ষে কি এত জটিলটা বুঝা সম্ভব ছিল। মা মারা গেছে আর বাবা থাকতেও নেই এমন একটি পরিবেশে আমরা দুই ভাই-বোন যে কতটা কষ্টে বড় হয়েছি তা শুধু আমরাই বুঝি। মাকে দেওয়া কথা আমি রাখি। নিজের বোনের কাছে আমি তার সব হয়ে উঠি। বাবার আদর – স্নেহ আর মার ভালোবাসা আমি তাকে একাই দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার কাছে আমার বোনই একমাত্র সব কিছু ছিল।
তাকে আমি কখনো মা – বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। নিজের সবটা দিয়ে আমি তাকে আগলে রাখি। কিন্তু আমার যে ভালোবাসার দরকার ছিল তা,,, আমি তো কখনো তা পাই নি। কত রাত আমি নির্ঘুমে কাটিয়ে তা শুধু আমিই জানি। কান্না করে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছি। মার কথা মনে করে কান্না করেছি। গভীর রাতে বাবার বিছানার পাশে বসে থেকে বাবাকে দেখেছি।এভাবেই সময় কাটতে লাগলো। সব সময় মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতাম যাতে কেউ কখনো আমার মনের কষ্টটা বুঝতে না পারে। কেউ যাতে আমাকে সহানুভূতি দেখাতে না পারে। অবশ্য মায়ের মৃত্যুর পরে মামনি আমাদের সাথে কয়েক দিন ছিল। আমার মায়ের একমাত্র বোন নাম নিলীমা, ওনাকে আমরা ছোট থেকেই মামনি বলে ডাকতাম আমাদের ওনার নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন।কিন্তু ওনার নিজের সংসার ফেলে তো আর সব সময় আমাদের সাথে থাকতে পারতেন না। বেশির ভাগ সময় আমরা তিন জনই থাকতাম। মামনি মাঝে মাঝে এসে আমাদের সাথে থাকতেন।
এভাবেই কেটে যায় ১৫ টি বছর। আমার পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ব্যবসাও দেখা শোনা করতাম। বাবার ও তো বয়স হয়েছিল তিনি একা আর কতো সামলাবে বলো। বোনও আমার বড় হয়ে উঠেছে। তাকে নিয়ে আমার সব সময়ই চিন্তা হতো। সে যে বড্ড সহজ সরল ছিল। মানুষের অভিনয়কেই সে সত্যি ভেবে নিতো। আর এটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কলেজে এক অনুষ্ঠানে তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। সেদিন থেকে তোমাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করি। আর সময়ের সাথে সাথে তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলো। আমাদের বিয়েও ঠিক হয়। সব কিছু ঠিকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় আবার সব কিছু তছনছ করে দেয়। আমার ভাগ্যে যে সুখ সয় না তা আবারও প্রমান হয়ে যায়। তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলি। নিজেই এমন নাটক করি যাতে তুমি বাধ্য হও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে।
আভিয়ান আর কথা বলতে পারছে না।কথাগুলো যেন তার গলায় ধলা পাকিয়ে আছে। পুরনো সব ক্ষতগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বুকের ভিতরের অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। শত কষ্টেও ছেলেদের চোখ দিয়ে পানি বের হয় না। তারা নিজেদের ঠিক রাখতে পারে কিন্তু আভিয়ান নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আদ্রিজা শান্তনা দেওয়ার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না।আভিয়ানের কষ্টের কাছে তার কষ্ট তার কিছুই মনে হচ্ছেনা।কাউকে যদি নির্স্বাথ ভাবে ভালোবাসা যায় তবে সেই মানুষের কষ্টের কাছে সব সময় নিজের কষ্ট তুচ্ছ মনে হবে। তার মনের ভিতরে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আভিয়ান তো কখনো বলে নি তার কোন বোন আছে তবে। কেন এটা সে আমার কাছ থেকে গোপন করলো। আমি তো জানতাম তার শুধু বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। আর কি এমন হয়েছিল যে বিয়ের আগেই দিন যে তাকে বিয়ের দিন এমনটা করতে বাধ্য করেছিল?
আদ্রিজা আভিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,,, আপনার যে বোন আছে তা তো কোনদিন বলেন নি? তাছাড়া আমিও তো আপনাদের বাড়িতে দুই – একবার এসেছি তখন তো কাউকে দেখি নি?
আভিয়ান চোখের পানি মুছে নিজেকে ঠিক করে বলে,,, আজকে আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। আমি তোমাকে নিজের বোনের বিষয়ে কিছু বলেনি তার কারণ ছিল আমি তোমাকে বিয়ের পরে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।আর তুমি যখন বাড়িতে এসেছিলে সেদিন সে তার বান্ধবীর বাড়িতে ছিল তাই দেখতে পায় নি। আসলে আমার বোনই বলেছিল যে সে তোমাকে চমকে দিতে চায় বিয়ের দিন। তাই আমি যখন তাকে বলি সব সে বলে তোমাকে যাতে কিছু না বলি,,,,,
আদ্রিজা নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,, ওহ আচ্ছা। তবে এখন আপনার বাবা আর বোন কোথায়? কত দিন হয়ে গেছে তাদের তো এখনো দেখি নি?
আভিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,,, তারা নেই।
আদ্রিজা অবাক হয়ে বলে,,, নেই মানে?
নেই মানে তারা চিরকালের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছে,,,,,,,
নিজের প্রিয় মানুষটির এত দুঃখের কথা শুনে আদ্রিজার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠছে। খুব খারাপ লাগছে তার। তার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। নিরবে কান্না করছে সে?অশ্রু ভেজা কন্ঠে সে বলে,,,
সেদিন কি হয়েছিল যার জন্য আপনি বাধ্য হয়েছিলেন আমার সাথে এত জগন্য একটা নাটক করতে?
আদ্রিজার কথা শুনে আভিয়ানের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে নিজের হাতে তা মুছে দীর্ঘশ্বা ফেলে আবার বলা শুরু করলো,,,,,,, বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু রাতে আমি যা শুনলাম তাতে আমার পুরো দুনিয়া ওলট – পালট হয়ে গেলো। বোনের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই তার কান্নার আওয়াজে আমি থমকে যাই। আমি শুনতে পাই সে কান্না করতে করতে কারো সাথে কথা বলছে,,, কি হয়েছে তা বুঝার জন্য আমি দরজার পাশে লুকিয়ে যাই,,,,,
অবন্তী- তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। প্লিজ আমার সাথে তুমি এমনটা করো না। আমি যে তোমার বাচ্চার মা হতে চলেছি। এখন আমি কি করবো বলো ,,,,,
প্লিজ আমার কথাটা শুনো। আমাকে বিয়ে করে নাও। প্লিজ আমাকে তুমি ধোকা দিও না তবে আমি বাঁচতে পারবো না। প্লিজ সাফিন ফোনটা কেটো না,,,,৷
সাফিন নামটা শুনে আমার নিশ্বাস ভারি হয়ে গেলো। ওই পাশ থেকে কি বললো তা আমি শুনতে পাই নি। আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রুমের ভিতরে ঢুকি।
আমাকে দেখেই অবন্তীর হাত থেকে ফোনটা পরে যায়। তার চোখ- মুখ কান্না করার ফলে ফোলে গেছে। মুখে তার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।নিজের বোনকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কষ্টে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। যার চোখে আমি এক ফোঁটা অশ্রু সহ্য করতে পারি না তাকে এই অবস্থায় দেখে আমার পুরো দুনিয়ায় এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে উঠেছিল। আমি নিজেকে ঠিক রেখে তার মাথায় হাত রেখে বললাম,,, কি হয়েছে আমাকে খোলে বলো??
আমার কথা শুনে অবন্তী আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করা শুরু করলো। কান্না করতে করতে তার ছেঁচকি উঠে গেছে। আমি তাকে শান্তনা দিয়ে বললাম,,, কান্না থামা কি হয়েছে আমাকে খোলে বল্? আমি সব ঠিক করে দিবো। তুই কোন চিন্তা করিস্ না। নিজের ভাইয়ের উপর একটু বিশ্বাস রাখ্,,,,,,
…..
..
.
চলবে,,,,