#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৮)
সিজন ২
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৮.
ইদের জন্য মেহজা একটা মেরুন জর্জেটের থ্রী পিস নিয়েছে। খুব সুন্দর কারুকাজ করা থ্রী পিসটি। আর ওড়নাটি অসম্ভব সুন্দর। হুট করে মাথায় তুলে দিলে মনে হবে বিয়ের কনে। বেলা এগারোটার মধ্যে সে তৈরি হয়ে কিছুটা পায়েস আর বেশ অনেকটা নুডুলস খেয়ে রওনা হয় ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অনা আর প্রথি সহ সে আজ ঢাকা শহর ঘুরবে। অবশ্য প্ল্যানটা হঠাৎ করেই করা হয়েছে। যার ফলে তার বাবা-মা আগে থেকে জানতেন না। তাই তো মেহজাকে যেতে দিতে চাইছিল না। পরবর্তীতে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাসায় ফেরার শপথ গ্রহণ করেই তাকে বিদায় দেয়।
নিচে আগে থেকেই প্রথি অপেক্ষা করছিল। প্রথি তার বাবাকে বহু কষ্টে ম্যানেজ করে তারপর তার বাবার গাড়িটা নিয়ে আসে। আজ এই গাড়িতে করেই ঘোরাঘুরি করবে। রিকশা চড়েই ঘোরা যায় তবে প্রচণ্ড গরমে সেই সৎসাহস তাদের কারোই হয়নি। গাড়িতে উঠে মেহজা বলল,
-‘বাব্বাহ! কীভাবে সম্ভব হলো হ্যাঁ? তোমার বাবার এই বিএমডব্লিউ অবশেষে আমাদের করুণা করলো! ভাই সিরিয়াসলি, অনেক শখ ছিল এইটাতে ওঠার।’
প্রথি বেশ ভাব নিয়ে বলল,
-‘হুম হুম। কোনো ব্যাপার না। আমার জন্যই তোর এই শখ পূরণ হইসে। তাছাড়া আমি ছাড়া আর আছেই বা কে? আমি পূরণ করব না তো কী তোর জামাই করবে! আরে জামাইর উপর ভরসা নাই। তাদের বউয়ের থেকেও গাড়ি বেশি প্রিয়। আমার পাপাকেই দ্যাখ! আম্মু এতবার করে বলছে গতকাল রাতে সিমি আন্টিদের বাসায় যাওয়ার সময় যে গাড়িটা সাথে দিতে। পাপা একটুও রাজি হয়নাই। তারপর দুই পক্ষে লেগে গেল ঝ’গ’ড়া! আম্মু রা’গ করে রুমে এসে সেই পার্টিতে যাওয়ার শাড়ি পড়েই ঘুমিয়ে গিয়েছে। আর এখন আমি এত রকম যু’দ্ধ করে নিলাম আম্মু আরো বেশি যেন রে’গে গিয়েছে। পাপাকে কতক্ষণ পরপরই খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। সেই এক কথা, ‘নিজের মেয়ের কদর সবাই করে, পরের মেয়ের দিকে কেউ চেয়েও তাকায়না।’ বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া হাসতে হাসতে কা’হিল। তবে ওই ব’দমা’ইশ দুটো আম্মুকে আরো বেশি উ’সকাচ্ছে। কী জানি বাসার আবহাওয়া এখন কেমন!’
-‘আঙ্কেলকে যদি আজ না খেতে দেয়?’
-‘আরে নাহ! সেটার চিন্তা নেই। আমার বাপ বেশ চালাক। গাড়ির কথা আমাদের আগেই হয়ে গেছিল পাপা কাউরে বলতে মানা করছে। তো তখন কেউ জানত না। আম্মু সকালেই বিরিয়ানি করছিল কারণ আমি বলছি যে বের হবো। তো দুপুরে বাসায় খাব না স্বাভাবিক। আম্মু সেটা মানতে নারাজ। ইদের দিন বলে কথা না খাই কীভাবে! পরে গিয়ে দেখি বিরিয়ানি তৈরি। আমি আর পাপা খেয়ে নিলাম জম্পেশ! সেই খাওয়াতে বিকেল ইজিলি কাটানো যাবে। আর তাছাড়া আরেকটাও সল্যুশন আছে। শোন, এখন বাবা হয়তো বাহিরে বের হয়ে যাবে। বাবার তো প্রচুর বন্ধু। দুই তিনটা গতরাতে দাওয়াত দিসে দুপুরে খাওয়ার। দেখা গেল পাপা সেই দাওয়াত এটেন্ড করতে চলে যাবে। খাওয়ার কোনো সমস্যাই রইল না।’
ওদের কথাবার্তা চলতে থাকল, ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা সেলফি তোলা হলো। অনার বাসা থেকে কিছুদূর হেঁটে গেলে সামনেই একটা বাস স্ট্যান্ড আছে। অনাকে বলেছিল সেখানে অপেক্ষা করতে। তারা গিয়ে দেখল অনা এখনও আসেনি। ত্রিশ সেকেন্ডের ভেতরে অনাকে বেশ তাড়াহুড়ো করে আসতে দেখা গেল। আর স্যরি স্যরি করছিল দেরি হওয়ার জন্য। মেহজা বলতেই যাচ্ছিল সমস্যা নেই তারাও মাত্রই এসেছে কিন্তু প্রথি তাতে বাঁধা দিল। সে বেশ রা’গ দেখিয়ে বলল,
-‘অনা তুই এত লেইট কেন হোস সব সময়? আমরা সেই ত্রিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি। তোর ভাবা উচিত মানুষের জীবনে এক একটা সেকেন্ডও কতটা দরকারি। যদি ত্রিশ সেকেন্ড হতো সেটাও অনেক বেশি সময়। বুঝতে পারছিস?’
অনা বে’কু’বের মতো মাথা নাড়ায়। যার অর্থ সে বুঝতে পেরেছে। প্রথির কথা শুনে তার চোখে মুখে অ’প’রাধবোধ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। প্রথি বলল,
-‘আজ থেকে তুই হলি লেইটলতিফ। ঠিক আছে?’
এবারে অনা চোখ গরম করে তাকায় প্রথির দিকে। মেহজা এসব দেখে বেশ মজা পাচ্ছে।
ঢাকা শহরে ঘোরার অনেক জায়গা আছে। তবে অবাক করা বিষয় তারা কেউ এই মুহূর্তে কোথায় যাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিল না। মেহজা আর প্রথি সেই কখন থেকে বেশ কিছু জায়গা সিলেকশনে লেগে পড়েছে। অনা চুপ ছিল, মূলত প্রথি আর মেহজাকে দেখছিল যে তারা কী ঠিক করে। বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন দেখল কোনো কিছু ঠিক করা যাচ্ছে না তখন অনা বলল,
-‘আমি একটা জায়গা ঠিক করেছি। চল সেখানে যাই।মজা হবে অনেক।’
মেহজা বেশ উৎসুক হয়ে বলল,
-‘কোথায়?’
অনা এবার একটু সহজ হয়ে গেল। মুচকি হেসে বলল,
-‘আমার ছোট খালামণির বাসায়।’
অনার কথাটা শুনে মেহজার মুখটা ছোট হয়ে গেল। আর প্রথি ধ’ম’কে বলল,
-‘বেক্কল! খালামণির বাসা? খালামণির বাসায় ঘুরতে যাব? তাহলে তোর খালামণি কেন শুধু? আমার খালামণির বাসাতেও চল, মেহজার খালামণির বাসাতেও চল।’
-‘তুই একটু বেশি করছিস প্রথি! খালামণির বাসা তো ভালোই। ওখানে আশেপাশে ঘোরার জায়গা আছে বেশ। তাছাড়া সকালে খালামণি কল দিয়েছিল। বেশ জোর করেই যেতে বলল আজকে। আমি বলেওছিলাম যে আমরা ঘুরতে যাব। বলল সমস্যা নেই তোদেরকে নিয়ে যেন যাই। আমি তো ভেবেছি যাব না। এখন যেহেতু ঘোরার জন্য আর ভালো জায়গা পাচ্ছিনা তার থেকে ভালো হয় দাওয়াতে যাই। খালামণি চিংড়ীর একটা দারুন আইটেম বানায় যদি কপালে থাকে তো আজ দাওয়াতে গেলে খেতে পারবি।’
মেহজার মন সায় দিচ্ছে না। প্রথিও অযথা কারো উপর বোঝা হতে চায়না। সে মানা করল। অনা শুনতে নারাজ। প্রথি বলল,
-‘অনা শুন, এমন হুটহাট কোথাও যাওয়া ঠিক না। তাছাড়া এটা তোদের ফ্যামিলি টাইম মানে এখানে আমরা টোটালি আনওয়ান্টেড। বুঝতে পারছিস?’
-‘আমি খালামণিকে কল করে জানাই যে আমরা যাচ্ছি।’
ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগছিল না মেহজা আর প্রথির। কিন্তু বোকা অনা তো আর এত কিছু বোঝেনা। সে সোজা তার খালামণিকে কল করল। তারউপর স্পিকার অন করে। খালামণি কল রিসিভ করেই বলতে লাগলেন,
-‘এই অন্না! আর কত দেরি করবি? তোর বান্ধবীদের নিয়ে তোকে আসতে বলছিনা।’
খালামণির কথা শুনে প্রথি আর মেহজা চমকে গেল। তিনি তাদের অলরেডি অতিথি লিস্টে যোগ করেই দিয়েছে। অনা বলল,
-‘খালামণি ওরা আসতে চাইছেনা। আমি তো বলছি কত করে। ধরো এবার তুমি বলো। দেখো শোনে কিনা!’
অনা মেহজার হাতে ফোন দিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে। মেহজা অনিচ্ছাস্বত্তেও সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করে।
-‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি।’
-‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছো!’
-‘আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আপনি কেমন আছেন?’
-‘তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছি কখন থেকে। তাই এখন ভালো নেই। জলদি চলে আসো। তোমরা আসবে ভেবে আমি এক্সট্রা কিছু প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু একটা বাজতে চলল তোমাদের খবর নেই। আসো মা! তাড়াতাড়ি আসো।’
অনা ফোন কেঁড়ে নিয়ে বলল,
-‘আমরা আসছি খালামণি। তুমি চিংড়ীর আইটেমটা আজকে রেখেছ তো? আমি কিন্তু ওদেরকে ওটার লোভ লাগিয়ে দিয়েছি।’
-‘আছে আছে। দেরি করলে পাবিনা। জলদি আয়।’
-‘আচ্ছা।’
প্রথি তব্দা খেয়ে ছিল। কল কাটতে দেখে বলল,
-‘বাহ! তোর খালা এত ভালা! ভাইরে! আমার খালাও ভালো। বাট এতটা ফ্রী না।’
মেহজা বলল,
-‘আমার খালামণিও এত সরল না। খা’রা’প যে সেটা নয় মানে খালামণি… মানে বুঝতেই পারছিস।’
-‘আমার খালামণি বেস্ট! আমি তো সবসময় বলি আমার খালামণির মতো খুব কম মানুষ আছেন। আমাকে বেশ ভালোবাসে।’
মেহজা হেসে বলল,
-‘তা আমরা এখন কোন পথে যাচ্ছি? তুই রাস্তা চিনিস তো!’
-‘চিনব না কেন? মামা, বসুন্ধরা আবাসিকে চলেন।’
শেষ কথাটা ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল অনা। বসুন্ধরা শুনে মেহজা বেশ চমকে উঠল। মাথায় ইরফান চলে এলো হঠাৎ করেই।
৩৯.
একটা বড় বিল্ডিং এর সামনে তিন বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে। মেহজা বলল,
-‘আমাদের কলোনীর থেকেও বেশ সুন্দর তো!’
-‘হুম। খালামণির বাসাও অনেক সুন্দর।’
প্রথি ধ’মকে বলল,
-‘ফ্লোর নম্বর কত সেটা বল! সেই কখন থেকে বিল্ডিং দেখে যাচ্ছি! পেন্সিল হিল পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা আর।’
-‘স্যরি খেয়াল ছিল না। টেনথ্ ফ্লোর।’
দশ তলায় লিফটে করেই ওঠা হলো। লিফট থেকে বের হয়ে অনা আগে আগে হাঁটে আর বাকি দুজন পেছন পেছন। তারপর J2 লেখা বাসার কলিংবেল বাজায়। একজন বেশ সুন্দর দেখতে হাসিমুখের মহিলা দরজা খোলে। অনা হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-‘ইদ মোবারক খালামণি।’
-‘ইদ মোবারক অন্না।’
অনার খালামণি বুঝতে পেরে অনা প্রথি দুজন সালাম দেয় তাকে আর ইদের শুভেচ্ছা জানায়। তিনি তাদেরও পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। মেহজা খুব বেশিই অবাক হয়। এমন মাটির মানুষ এখনও আছে ভাবতেই সে অবাক হয়। হঠাৎ করে তার মাহিমা বেগমের কথা মনে পড়ে। ওই মানুষটাও তো এমন মমতাময়ী ছিলেন। একদিন কত সুন্দর সম্পর্ক ছিল আর এখন!
অনার খালামণির বাসায় বেশ ভীড়। তবে বড় বাসা হওয়াতে তার আর সমস্যা হচ্ছেনা। অনার মা-বাবা আসেনি। অনা কল করে আসতে বলেছিল কিন্তু অনার মা একটু অসুস্থ্য থাকায় আর আসেনি। অনিক আসবে বলেছে এখনও এসে পৌঁছায়নি।
মেহজা সোফায় বসে ঠান্ডা ঠান্ডা ফ্রেশ অরেঞ্জ জ্যুস খাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ যায় তার বিপরীত সোফায় অর্থাৎ তার সামনের সোফায় বসা এক ভদ্রলোকের দিকে। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন পর পরিচিত একজনকে দেখছে আর হঠাৎ দেখে সে অবাক হয়ে গেছে। মেহজা ভালো করে খেয়াল করার পর বুঝল সে এই লোককে চিনে। মেহজাও এখন লোকটাকে ঠিক একইভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। বাতাসে চেনা চেনা গন্ধ। আরে! হঠাৎ করেই মাথায় চলে এলো লোকটা কে! এ তো করিমউল্লাহ মোরশেদ। ইরফানের ফুপা হোন। ইকরার বিয়েতে পরিচয় হয়েছিল। বাথরুম ঝামেলা ছিল যার। লোকটাও এবার এমন হাসি হাসি মুখ করে ফেলল মনে হয় এবার সেও কনফার্ম করল তাকে। মেহজা ঠোঁটে হাসি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। লোকটার পাশে জায়গা খালি ছিল। মেহজা সেইখানে গিয়ে বসে। তারপর বেশ আনন্দের সহিত বলল,
-‘আঙ্কেল আপনি এখানে? আমাকে চিনেছেন!’
-‘এতক্ষণ চেনার চেষ্টা করছিলাম এখন চিনে ফেললাম। তুমি মেহজা না? ইরফানদের প্রতিবেশী!’
-‘হ্যাঁ। এই তো চিনলেন।’
-‘আহা! চিনব না। তুমি বেশ ভালো মেয়ে। কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখলাম মনে হচ্ছে।’
-‘বছর হয়ে আসছে। আমি বেশ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
-‘ভালো খা’রা’প দুটোই। বয়স হলে তো শরীর আর আগের মতো থাকেনা। বুঝতেই পারছ মামনি।’
মেহজা হেসে দিল। তারপর দুজনে বেশ গল্প জুড়ে দিল। তার মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে বলতে থাকে তারপর পড়াশোনার চাপ সবকিছুই বলে। মেহজার মনে হচ্ছে অনেকদিন পর সে সুন্দর একটা দিন কাটাচ্ছে। বেশ সুন্দর মনের মানুষদের সাথে সে মিশছে। মন খুলে কথা বলছে।
অনিক এসেছে। প্রথির শক্ত মুখটা হঠাৎ করেই কেমন নরম হয়ে গেল। অনার সাথে এতক্ষণ রা’গ দেখালেও এখন বেশ ভালো আচরণ করছে। অনা তো অবাকে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। এত পরিবর্তন হয়ে গেল? হঠাৎ! ব্যাপার কী! পরমুহূর্তেই তার ভাইকে দেখে সে বুঝল আসল ব্যাপার।
মেহজা এখন একা বসে আছে। করিমউল্লাহ মোরশেদ খাবার খেতে ডাইনিং এ গিয়েছেন। মেহজাকেও বলল সাথে যেতে সে বলল অনাদের সাথেই খাবে। মেহজা অনাকে আর প্রথিকে বসে বসে পর্যবেক্ষণ করছে। দুইটার কাজকর্ম দেখে সে অবাক না হয়ে পারছেনা। এই ভালো এই খা’রা’প টাইপ সম্পর্ক তাদের। মেহজার খেয়াল হলো কেউ একজন তার পাশে বসেছে। সেই কেউ একজন কে তা দেখতে পাশ ফিরে তাকাতেই সে দেখতে পেল অয়নকে। দাঁত কেলিয়ে হাসছে ছেলেটা। তবে দেখতে ম’ন্দ লাগছেনা। অয়নকে দেখে সে অবাক হয়নি। চাচার বাসার দাওয়াত খেতে যে সে আসবে তা একদম স্বাভাবিক। অয়ন বলল,
-‘আপনি কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখেন না। এটা কিন্তু মুনাফিকের কাজ।’
কথাটা শুনে মেহজা বেশ অবাক হলো। কথা দিয়ে কথা রাখেনা মানে? কোন কথার কথা বলছে অয়ন? সে আবার কখন কোন কথা দিল?
-‘আপনি কী বলতে চাইছেন? পরিষ্কার করে বললে ভালো হয়। আমি বুঝতে পারছিনা।’
-‘ইদ মোবারক।’
মেহজা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এত কথা বলে এখন বলছে ইদ মোবারক? এটা আগে বলতে মনে ছিল না নাকি সে ইদের শুভেচ্ছা অর্থাৎ ইদ মোবারক দুই তিনটা কথা বলার পর বলে। অয়ন নিজেই বলল,
-‘ওত চমকানোর কিছু নেই। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। দুঃখীত।’
-‘ইদ মোবারক।’
মেহজার মুখে ইদ মোবারক শুনে অয়ন হো হো করে হেসে দিল। মেহজা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তার অয়নের দুঃখীত বলার বিপরীতে ‘কোনো ব্যাপার না’ বলা উচিত ছিল কিন্তু সে নিজেও একইকাজ করে বসল। সে সাফাই দেওয়ার মতো করে বলল,
-‘আসলে আপনি ইদ মোবারক বলেছেন তাই ভদ্রতা করে বললাম।’
-‘আপনিও কী আমার মতো আগে আগে বলতে ভুলে গেছেন?’
মেহজা রে’গে গেল। অপরিচিত লোকের মশকরা তার পছন্দ নয়। অয়নের বাবা তার পরিচিত। সে তাকে পরিচিত মানে। কিন্তু অয়ন তো আর পরিচিত নয় তার কাছে। করিম আঙ্কেলের ছেলে বলে কী সব মজা খাটবে নাকি! একদমই না। ছেলেটা একটু আতেল টাইপ। করিমউল্লাহ মোরশেদ হলেন অনার খালামণির ভাসুর। সেই সুবাদে তারাও আজ এসেছেন দাওয়াত রক্ষা করতে। তাকে দেখে মেহজা খুশি হলেও তার ছেলেটাকে দেখে বেশ বেজার হতে হচ্ছে।
ড্রয়িংরুমে আপাতত অয়ন, অনিক আর অনার খালাতো ভাই নিহাদ ছাড়া আর কোনো ছেলে নেই। নিহাদ অয়নের সমবয়সী। তারা তিনজন এখন একসাথে বসে কথা বলছে। আর অনার খালাতো বোন নেহা আর তারা তিন বান্ধবী এক জায়গায় বসে গল্প করছে। তখনিই অনার খালামণি এসে অয়নকে বললেন,
-‘এই অয়ন? ইরফানরা আসছেনা যে? তুই ডাকিস নাই!’
-‘গিয়েছিলাম তো চাচি। মামানিরা আসতেছে। তৈরি হচ্ছে সবাই। এখান থেকে তাদের ওই বাসায় চলে যাবে। তাই একটু সময় লাগিয়ে গোছগাছ করছে।’
-‘সেটা তো জানি যে তারা চলে যাবে। তবুও খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ইরফানটাকে তো ডেকে আন।’
-‘ভাই তো বাসায় নেই। নিচে কোথাও বন্ধুদের সাথে আছে।’
-‘অনিক তোর ভাই ব্রাদার কোথায়?’
-‘ভাই তো আসতেছে। রবিনরা আসছে তো ওদের সাথে আছে।’
-‘কল কর।’
-‘লাগবেনা চলে আসবে।’
-‘তোরে কল করতে বলছি।’
-‘আচ্ছা।’
অনিক কল দিল। ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেল না তবে অনিক শুধু বলল,
-‘ওকে।’
খালামণি বললেন,
-‘আসছে?’
-‘হুম লিফটে।’
-‘তোরা আয় খেতে বসবি। অন্না? প্রথি আর মেহজাকে নিয়ে আয়।’
মেহজা চুপ হয়ে গেল একদম। কোন ইরফান! অয়নের ভাই ইরফান কে সে চিনে। অনিকের ভাই ব্রাদার ইরফানকেও সে চিনে। বসুন্ধরায় যে এক ইরফান থাকে তাকেও সে চিনে। ঘুরে ফিরে ইরফান সেই একজনই! তার কথা ভাবতেই মেহজার হাত পা এই অ’স’হনী’য় গরমেও ঠান্ডা হয়ে যায়। তখনিই তার হৃদয়কেও শীতল করে দিয়ে বাসায় প্রবেশ করে তার সেই চেনাপরিচিত ইরফান। ইরফান ইয়াজিদ!
৪০.
মেহজাকে দেখে ইরফান ভূ’ত দেখার মত চমকায় না। হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো খুশিও হয় না। একদম অনুভূতিহীন হয়ে বসে থাকে। মেহজা যে আছে সেটা সে বোধহয় বুঝতেই পারছেনা। তার কাছে মেহজার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অনা আর প্রথি দুজনকেই সে ইদের শুভেচ্ছা জানায়। কুশল বিনিময় করে। মেহজার দিকে ফিরেও তাকায়না। মেহজার মনে সেদিন পুনরায় যে ভালোবাসা জেগেছিল তা মুহূর্তেই ধুলোয় মিশে গেল। পরপর দুইবার এমন আ’ঘা’ত পেয়ে তার ছোট্ট মনটা বি’ষি’য়ে উঠল। দুনিয়ার আর সবার এড়িয়ে চলাটা সে হয়তো মানতে পারবে তবে ইরফানের এড়িয়ে চলাটা সে স’হ্য করতে পারবেনা। এই জিনিসটা এতটা ক’ষ্টের!
খাবার খেতে বসল তারা সাতজন একসাথে। মেহজার খাবার খেতে ইচ্ছে করছেনা। বাসায় ফিরে যেতে চাইছে সে। কিন্তু সে কথা মুখ ফুটে বলতে পারছেনা। অয়ন বারবার এটা ওটা মেহজার সামনে এগিয়ে দিচ্ছে। দুইবার প্লেটের মধ্যে রোস্টের দুইটা লেগপিস্ তুলে দিয়েছে। লেগপিস্ দুটো এখনও ঠিক একই জায়গায় পড়ে আছে। মেহজা খাচ্ছে না। সে বারবার ইরফানের দিকে আড়চোখে তাকায়। সে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। আশেপাশে কারো খেয়াল নেই। তবে একবার সে কথা বলেছে। যখন অয়ন মেহজাকে গরুর কালাভুনা তুলে দিতে নেয় আর মেহজা স’হ্য করতে না পেরে ক’ড়া গলায় বলে,
-‘আপনি নিজের খাওয়ায় মন দিন। দয়া করে এভাবে বিরক্ত করবেন না।’
অয়ন তা শুনে চুপ করে বসে থাকে। ইরফান তখন গম্ভীর স্বরে বলে,
-‘এত শ্রম যার তার পেছনে ব্যয় না করে যার দরকার তার পেছনে ব্যয় করলে অনেক ভালো হতো। এখানে আরো অনেক মানুষ আছে। ওই একজন আহামরি বিশেষ কেউ নয়।’
মেহজার এত ক’ষ্ট হলো! তখনিই চোখের কোণায় অশ্রুকণা জমতে শুরু করে। সে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে। হাত ধুঁয়ে অনার খালামণির থেকে বিদায় নিতে যায়। তিনি ছাড়ছিল না। কিন্তু মেহজার জোরের সাথে আর পারল না। প্রথি আর অনাকে রেখেই সে চলে এলো। সে যখন লিফটের দিকে যাচ্ছিল তখন কিছু মানুষের কথার আওয়াজ শুনে সিঁড়ির দিকে তাকায়। উপর থেকে কয়েকজন মানুষ নিচে নেমে আসছে। তাদের মেহজা চেনে। ইরফানের বাবা-মা, ইমা আর ইকরা। তারা তাকে দেখার আগেই সে ঝটফট সরে আসে। দ্রুত লিফটে উঠে পড়ে। সে ভাবে, ‘তাহলে সকলে এই বিল্ডিংয়ে থাকে!’
———–
বাসায় ফিরে মেহজা নতুন খবর পায়। যে মেহমানদের আসার কথা ছিল দুপুরে তারা আসবে রাতে। মেহজা পাত্তা দিল না। তার মন ভে’ঙেছে। আর এই অবস্থায় সে অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারে?
সন্ধ্যার দিকে মেহজার মামা আর জেঠার পরিবার হাজির। পরিবার বলতে শুধু মামা-মামি আর জেঠা-জেঠি। মেহজা একটু অবাক না হয়ে পারল না। তাদের আগমনটা অন্যবারের মতোন নয়। সবকিছুই কেমন অন্যরকম।
আটটার দিকে মামি এসে তাকে শাড়ি পড়তে বলে। মেহজা মামির হাতের শাড়ির দিকে তাকায়। মেহজার আত্মা কেঁ’পে ওঠে। কেন যেন সে বাতাসে বিয়ের গন্ধ খুঁজে পায়।
#চলবে।
(কেমন লেগেছে জানাবেন প্লিজ!)