#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৩)
সিজন ২
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৫.
মেহজাদের অ্যাপার্টম্যান্টের ছাদ বিরটা বড়। একপাশে একটা মাঝারি আকৃতির সুইমিংপুল আছে। তবে যারা সাঁতার জানেনা তাদের যেতে মানা করা হয়েছে। মেহজা সাঁতার কা’টতে জানে তবে তেমন একটা ভালো করে পারে না। টিউব লাগে, তাছাড়া এখানে একা এসে সাঁতার কা’টাও ঠিক নয়। সাথে কেউ থাকলে ভালো হতো। আফসোস, তার এখনও কোনো সমবয়সী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়নি যারা এই বিল্ডিং এ থাকে।
এখন বিকেল সাড়ে চারটা। মেহজা একা একা বসে আছে সুইমিংপুল এর ধারের আরাম কেদারায়। আর দৃষ্টি স্বচ্ছ পানিতে। তখনই তার সামনের ছোট সোফাটায় কেউ একজন এসে বসে। মেহজা চোখ তুলে তাকায় দেখতে পায় সেদিনের মেয়েটি, যাকে ইমা ম্যামদের বাসায় দেখেছে সে। মেহজা এটাও জানে ইনি ইমা ম্যামের ছোট বোন এবং পেশায় একজন ডাক্তার(শিশু বিশেষজ্ঞ)। তবে তার নামটা সে মনে করতে পারছেনা। সৌজন্যতার খাতিরে একটা মৃদু হাসি উপহার দিল। মেয়েটিও হাসে, হাসার সাথে সাথে তার সবকটি দাঁত ঝিলিক মেরে ওঠে। দেখতে সুন্দর লাগে। মেহজা মুগ্ধ হয়। এরা ভাই-বোন সবকয়টা অত্যন্ত সুন্দর তো! মেয়েটি বলল,
-‘মেহজা?’
-‘জ্বি।’
-‘আমি ইকরা। তোমাদের উপর তলায় থাকি।’
-‘জানি আপু। আপনাকে দেখেছি আমি। ইমা ম্যামের বোন।’
-‘উহু। ইমা ম্যাম টানা লাগবেনা। সেই কলেজে গেলেই ছাত্রী-শিক্ষিকা সম্পর্ক এখানে তো আপুই বলতে পারো। আর ম্যামের বোন বলে আমাকে আবার ইগনোর করবেনা।’
-‘না না! ইগনোর করব কেন?’
-‘স্টুডেন্টরা নিজেদের স্যার ম্যামদের সাথে সাথে তাদের আত্মীয়দেরও এড়িয়ে চলে এবং সামনে পড়লে অত্যন্ত সম্মান করে আর ফ্রী হয়ে কথা বলতে পারেনা। আমি চাইছিনা তেমন সম্পর্ক আমাদের হোক। এখানে আমরা প্রতিবেশী এটাই বড় কথা।’
ইকরা নামের মেয়েটিকে মেহজার ভালো লাগল খুব। দেখতেও সুন্দর, কথাও সুন্দর। অতঃপর দুজনে গল্প চালায় বেশ কিছুক্ষণ। ভাব হয় তাদের। ফেসবুকে এড হয় এবং ঠিক করে তারা অতি শীঘ্রই সুইমিংপুলে সাঁতার কা’টবে।
——————-
সন্ধ্যার দিকে ইরফান বাসায় ফিরলে বোনদের আর মা’কে একসাথে বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। সচরাচর কারো সময় মিলে না। বিশেষত ইকরার। আজ হঠাৎ তাকে এই সময় আড্ডায় মশগুল দেখে সে একটু প্রসণ্ণ হলো। তবে সে তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই তাদের আলাপচারিতা বন্ধ হলো। একটু ভাববার বিষয়! সে সোফায় বসে ইমার পাশে। গলা থেকে টাই খুলতে খুলতে প্রশ্ন করে,
-‘কী ব্যাপার? চুপ করে গেলে যে সবাই?’
ইমা বলল,
-‘তেমন কিছু না। তুই ইদানিং দেরি করে ফিরছিস যে!’
-‘দেরি কখন করলাম? আমি বরং এই কয়দিন তাড়াতাড়ি ফিরছি। আগে এগারোটার আগে আসা হতো!’
-‘সেটা তো তুই জানিস কেন এখন এগারোটার আগে আসিস।’
-‘কেন মানে? আপাতত, এখন আর কোনো গোল মিটিংয়ে বসা হয় না। তাই ফিরে আসি। অফিসের বেশকিছু কাজগুলো বাসায় বসে করি। আবার নির্বাচন আসছে সামনে তখন দেখা গেল সপ্তাহে দুদিন আসা হবে কীনা সন্দেহ আছে!’
-‘আচ্ছা?’
-‘হুম।’
ইকরা বলল,
-‘তুই না নিউ ইয়ার্ক যাওয়ার কথা বলছিলি! যাবিনা?’
-‘বড় আপু তো আসছে। আমার আর তাহলে যাওয়ার কী দরকার!’ –কিছুটা গম্ভীর হয়েই বলল কথাটা।
সবাই হা করে গেল। ইরা আসছে অথচ তারা কিছুই জানেনা। ইরফান মা-বোনদের দিকে খেয়াল করে বুঝতে পারে সে বড় একটা স্পয়লার দিয়ে দিয়েছে। ইরা সারপ্রাইজ দিবে বলেছিল অথচ সে কীভাবে কথাটা বলে দিল! আজকাল মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করছেনা। ব্যাপারটা ভালো না। সে উঠে এলো সেখান থেকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবল কাজের চাপে আসলে মাথা কাজ করছেনা। কাল বিশ্রাম নেওয়া যাক!
ওদিকে মাহিমা বেগম কল করে তার বড় মেয়ের কাছে। সবাই আনন্দে, উচ্ছাসিত হয়ে পড়ছে। ইরার কাছে লিস্ট তৈরি করে দিচ্ছে নিজেদের দরকারি জিনিসের। ইরা প্রথমে ইরফানের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কথা শোনায় পরে সে ও তার আসার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে থাকে সবাইকে। জানা গেল পরশুদিন আসছে সে। আগামীকাল দশটায় ফ্লাইট। মাঝে প্রায় একটাদিন লাগবে আসতে আসতে। তাদের গ্রুপ কলে তারা তাদের সেজো বোন ইনায়া কেও যোগ করে। ইনায়াকে কড়াকড়ি ভাবে বলে দেওয়া হয় সে যেন কাল চলে আসে। ইনায়া চট্টগ্রাম থাকে স্বামী-সন্তান সহ। বড় বোনের আসার সংবাদ শুনে তার নিজস্ব ব্যস্ততার কথা ভুলে গেল। ঝটফট বলে দিল আগামীকাল আসবে সে। ব্যাস আর কী চাই? সবাই হৈ হুল্লোরে মেতে ওঠে।
৬.
সকাল ছয়টা বাজে। মেহজার মা তাকে ডেকে তোলে ঘুম থেকে। নামায পড়তে বলে তিনি বেরিয়ে যান। মেহজা হেলে দুলে উঠে ফ্রেশ হয়ে, অযু করে নামায পড়ে। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আবহাওয়াটা উপভোগ্য দেখে সে ফটাফট এক কাপ চা নিয়ে আসে। চা বানানো ছিল কেন না তার বাবা-মা ভোরে উঠে নামায পড়ে, চা পান করবে তারপর বাহিরে গিয়ে হেঁটে আসে। সবসময় চা বেশি করে বানিয়ে ফ্ল্যাক্সে রেখে দেয়। যার যখন ইচ্ছা হয় তখন সে নেয়।
মেহজার বারান্দায় পুরোটা গ্রিল নেই। এতে স্বচ্ছ আকাশ ভালোভাবে দেখা যায়। আগের ভাড়া বাসার বারান্দা বন্ধ খাঁচার মত ছিল। আর এটা মুক্ত! আহা!
মেহজার বারান্দায় দুটো বেতের সিঙ্গেল সোফা আছে। এবং সাথেই আছে একটি সেন্টার টেবিল। তার উপর আছে একটা ছোট্ট ক্যাক্টাস গাছ। মেহজার এই গাছটি ভীষণ প্রিয়। সখ করে এনেছে। তবে রাফসান দেখতে পারেনা। কারণ দুইবার তার হাতে কাঁটা ফুটে। মেহজা সেই কথা মনে করেই হেসে দিল। তখনিই বাম পাশে উপরের দিকে চোখ গেল। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইরফান। বারান্দাটা বেডরুমের নয়। তাদের ফ্যামিলি লিভিং এর। মেহজা এই জায়গাটা ভালো করেই চেনে। ইরফান রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এক মনে আকাশ দেখছে। মেহজা তার দেখাদেখি একবার তাকায় তবে সে বিশেষ কিছু দেখছেনা। রোজকার মতো, তবে সুন্দর। কিন্তু ইরফানের এভাবে চেয়ে থাকাটা আকর্ষণীয় লাগছে। মেহজার মন বলল ইরফান হয়তো কিছু ভাবছে। তবে যাই হোক! লোকটা দেখতে বেশ!
—————–
মেহজার আজ আর পড়তে যেতে ইচ্ছে করছেনা। তাই সে সঠিক সময়ে যায়নি। তবে তার মা কিছুক্ষণ পর পরই এসে বলছে তৈরি হয়ে পড়তে যেতে। ফাঁকিবাজি করলে চলবে না। অগত্যা বহু কষ্টে মনকে প্রথম দিনকার মতো কোনো মতে মানিয়ে ছুট লাগায় উপরতলায়। মনটা ভীষণ খারাপ! তার একদিনও ছুটি নেই কেন? শনিবার হিসেবে কলেজ বন্ধ ছিল কিন্তু এই টিউশনের কোনো বন্ধ হওয়ার নাম গন্ধ নেই। আট-নয় দিনেই হাপিয়ে গেছে সে। বাকি মাস কীভাবে কাটবে?
আজ আর সিঁড়ি ডিঙিয়ে গেল না। লিফট্ এ গেল। তবে অন্যদিনের মতো আজ ইমাদের বাসায় নিরবতা ছিল না। বাচ্চাদের আওয়াজ এবং বেশকিছু গলা শোনা গেল। সে খুশি হয়ে গেল। নিশ্চয়ই মেহমান এসেছে। তবে তো আর পড়তে হবে না! সে উল্টোদিকে হাঁটা ধরে তখনিই পেছন থেকে ভরাট গলায় শোনা যায়,
-‘ইউটার্ন নিচ্ছো যে? আজ পড়বে না!’
মেহজার মনটা বিষিয়ে ওঠে। সে ঘুরে দাঁড়ায়। সদর দরজায় ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ঘরোয়া পোশাক কালো টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার। একদম যেন ম্যান ইন ব্ল্যাক! মেহজা মিনমিন করে বলল,
-‘আজকে তো পড়া হবে না তাই চলে যাচ্ছি ভাইয়া।’
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘পড়ানো হবে না কেন? আর না পড়ানো যদি হয় তো বই খাতা নিয়ে এলে কেন? কী! মেজো আপু মানা করে দিল নাকি!’
-‘না সেটা না। আসলে আমিই চলে যাচ্ছি। আপনাদের বাসায় মেহমান তো। তাই ভাবলাম চলে যাই। এখন সমস্যা হতে পারে।’
-‘বেশি বোঝো নাকি? আর মেহমান দেখলে কোথায়? আমার সেজো আপা এসেছে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। তাই শোরগোল হচ্ছে। নাথিং এলস্। ভেতরে যাও তুমি। আপা যেহেতু বারণ করেনি সেহেতু পড়াবে।’
মেহজা চোখমুখ কুঁচকে ভেতরে গেল। এই লোক আস্ত ভেজাল তো! তবে ভেতরে যেতে যেতে সে শুনতে পেল ইরফান বলছে,
-‘ফাঁকিবাজ একটা।’
হাহ! কী অপমান!
#চলবে।