ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৩
__________🖌️নাজনীন নাহার
২৮.০৩.২০২২
আজকে আমার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা ছিল। আমার স্বামী রাশেদের আমাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাবার কথা ছিল। আমি মাত্র পনেরো বিশ দিন হলো ঢাকায় এসেছি। একা কোথাও যাইনি। কিচ্ছু ঠিকমতো চিনি না। এমন অবস্থায় আমার স্বামী রাশেদ গত রাতে বাসায় ফিরলেন না। আমি ভয় আর দুশ্চিন্তায় নাজেহাল হয়ে রইলাম সারাটা রাত। সকাল দশটায় আমার পরীক্ষার টাইম ছিল। আমি আমার স্বামীর বিপদের ভয়ে কাঁদছিলাম। আমি আমার ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবার কষ্টে কাঁদছিলাম। বেলা প্রায় বারোটায় আমার স্বামীর খালাতো ভাই এসে জানালো আমার স্বামী রাশেদ ঠিক আছে। আমার শ্বাশুড়ির অসুখ শুনে রাতেই আমাকে না বলে বাড়ি চলে গেছে। কথাটা শুনে আমি ধপাশ করে বসে পড়লাম। আমার স্বামীর প্রহসন কিংবা সত্য অসত্যের দোলাচলে আমি ঘুরপাক খেতে লাগলাম।
আমার কাছে কেবলই মনে হলো আমি একটা ভয়ানক ষড়যন্ত্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমি একটা অন্ধকার গর্তের তলদেশে কুয়াশাচ্ছন্ন গাঢ় অন্ধকারের শীতার্ত প্রান্তরে হারিয়ে যাচ্ছি। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। আমি তলিয়ে যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছি জানি না। কিন্তু যাচ্ছি। আমাকে কেউ যেতে বাধ্য করছে। না না কোনো তাড়া নেই যেন। কেবল একটা নিয়মের আবর্তে আমি অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। আমি কেমন এই তলিয়ে যাওয়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। নেই কোনো প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ। আমার যেন কোনো চাহিদাও নেই। আমাকে কেউ একজন পরিচালনা করছে। কে?
নিয়তি!
আমার জন্ম!
সমাজ, সভ্যতা!
নাকি একটা শক্তিশালী অদৃশ্য হাত কিংবা ইশারা!
এর শুরু কোথায়!
কোথায় শেষ!
কী লাভ তাদের!
আচ্ছা আমি কী মানুষ!
নাকি গিনিপিগ!
সেই কবে থেকে আমি ছুটছি! আমার তো তেমন কিছু মনেও নেই!
লেখাপড়া করে জানতে পেরেছি যে আমি আমার পিতার শরীর থেকে শুক্রাণুর বেশে ছুটেছি মায়ের গর্ভাশয়ে। বায়োলজির বিশ্লেষণে দেখেছি পিতার কোটি কোটি শুক্রাণুর দৌড়ে শামিল হয়ে একটি শুক্রাণু জিতে যায়। জিতে গিয়ে মায়ের শরীরের ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় ভ্রুণ। তার মানে আমার বাবার শরীর থেকে এভাবেই ভাসতে ভাসতে কিংবা তলিয়ে যেতে যেতে নির্বোধ আমি মায়ের শরীরে আশ্রয় নিয়েছি। আমি তো নির্বোধই ছিলাম আমার জন্মের পূর্বে। আমার বোধের পূর্বে! আমার বা আপনার কী ঠিক ঠিক মনে আছে! শুক্রাণুর দৌড়ে আপনার বা আমার ফিলিং কীরকম ছিল! মায়ের ডিম্বনুর সাথে মিলেমিশে ভ্রুণ তৈরি হওয়ার সময়ের আমাদের অনুভূতি কেমন ছিল! কেমন করে মায়ের শরীর থেকে রক্ত কণিকা নিয়ে আমি বড়ো হচ্ছিলাম!
আমার কিন্তু কিচ্ছু মনে নেই। আমার এখনও মনে হচ্ছে আমার সাথে আমার জীবনে যা যা ঘটতেছে এতে আমার কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই।
নিয়ন্ত্রণ যখন নেই।তখন কেন আমি আমাকে সাজাতে চেষ্টা করি! কেন তবে স্বপ্ন সাজাই! আমার বড়ো ভাইটার উপর কিন্তু আমার বাবা-মায়ের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ আমরা একই বাবার শুক্রাণু থেকে তৈরি। আমরা একই রকম দৌড়ে জিতে একই মায়ের গর্ভে এসেছি। আমরা একই ভাবে মায়ের থেকে তৈরি হয়েছি। শুধু গঠনে তিনি পুরুষ আর আমি নারী। অথচ স্বাধীনতায় তিনি আর আমি বহুদূরের যাত্রী।
আমি আসলে জানি না আপনারা যারা মেয়ে জন্ম পেয়েছেন। আপনাদের কারোর মনে হয় কিনা জানি না।কিন্তু আমার খুব মনে হয়। আমার মনে হয় বাবার এক বিন্দু শুক্রাণুকে পুরোপুরি একটি মানবের রূপে গঠন করে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন মায়ের শরীর।গঠনের ক্ষেত্রে লাগে মায়ের শরীরের রক্ত ও খাদ্য। মায়ের হায়েজ তখন বন্ধ হয়ে সেই রক্তের সাথে আরও প্রয়োজনীয় উপাদানে তৈরি হয় মানব শিশু। তাহলে কেন বলা হয় বাবার রক্ত! বাবার বংশ! হয়তো অনেকেরই আমার ভাবনাটা ভালো লাগবে না। লাগতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মানব মস্তিষ্কে নানাবিধ প্রশ্ন থাকে। সব প্রশ্নের উত্তর কী সবাই পায়! পায় না। কিংবা যে উত্তরটা পায় তা সকলের কাছে কী মান্য হয়! হয় না। সেখানেও মানুষ মেনে নেয় মানিয়ে নেয়।মানিয়ে নেয় সমাজ, সম্মান, আইন, বিচার, ধর্ম, ও ক্ষমতার দাপটে। আর এই দাপটের শিকার নারীরাই বেশি।
আমি বলছিলাম আমার তলিয়ে যাওয়ার কথা। আমার জন্ম রহস্যের কথা। আমার বেঁচে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ার কথা। এরকম কী শুধু আমার সাথেই হচ্ছে! নাকি আপনাদের সাথেও।
এই যে আমার বাবা-মায়ের একটা স্বচ্ছল সুন্দর পরিবারে আমরা ছয়টি ভাইবোনের আগমন হলো। আমরা তো সুন্দরভাবে বড়ো হচ্ছিলাম। বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের নিয়ে। বাবার ইনকাম আরও ভালো হতে লাগল।সব স্বাভাবিক ছিল। কে যেন কোথা থেকে এই স্বাভাবিকতা বানচাল করতে শুরু করলেন।কে সে! আল্লাহ নাকি নিয়তি নাকি নিজেরাই! কেউ কী জানেন ঠিকঠাক! আমি জানি না। আমার আব্বা সব ফেলে হজ্জ করতে চলে গেলেন। আব্বা তো একটা ভালো কাজে গেলেন। সবাই তখন বললেন আব্বা আল্লাহর রাস্তায় চলে গেলেন। আব্বা একা তার একটা মানসিক শান্তি, একটা ধর্মীয় দায়িত্ব ও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন। কিন্তু আমার মায়ের যে কান্না শুরু হলো!আমরা আব্বাকে আর আগের মতো কাছে পেলাম না।মা তার স্বামীকেও আগের মতো পেলো না আর। আব্বার বিজনেস তার বন্ধু কব্জা করে নিলেন। আমার আব্বা ফিরে এসে আর বিজনেস করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। জমি বিক্রি করে করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে লাগলেন। বিয়ে দিতে লাগলেন। দুনিয়াবি সব ছেড়ে আখেরাতের জন্য নিবেদিত হয়ে গেলেন। এর প্রভাব পড়তে থাকল আমাদের পরিবার ও জীবনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও স্বপ্ন হারানোতে। আমার বাবা একটা ঘোরে নিজের মতো ঘুরছেন। আব্বা তার মতে মা’কেও ঘুরাচ্ছেন। মা এর বিপক্ষে গেলে আল্লাহর বিপক্ষে চলে যাওয়া হবে। আব্বা নিজের মতো ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করছেন আর নিজের মতো ব্যাবহার করছেন। ব্যাবহার করছেন তার নিজের ও পরিবারের সকলের জীবনে। আমার মেজো বোনকে ক্লাস টেনে উঠতেই বিয়ে দিয়ে দিলেন আব্বা। আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন শেষ করে দিলেন।আমাকেও বিয়ে দিলেন। আমি তারপরও আমার স্বপ্ন রক্ষার চেষ্টা করে গেলাম। আমি এরপরও আমার স্বামীর ভালোবাসায় সব গুছিয়ে চলছিলাম। মানিয়ে চলছিলাম। স্বপ্ন দেখে চলছিলাম।
অথচ কী অদ্ভুত একটা অবস্থা! আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ হলো ঠিক আমার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে। এগুলো কে করাচ্ছে! কে সে! সে কেন চাচ্ছেন না আমি আর লেখাপড়া করি! আমার মা অবশ্য এটারও একটা দারুণ সমাধান বলেছেন, আল্লাহ যা করেন সকলের ভালোর জন্য করেন। আলহামদুলিল্লা আমি খুশি। কিন্তু কথা হলো আমার সাথে যা যা হচ্ছে এসব কী আল্লাহ করাচ্ছেন! পবিত্র কুরআনে পাকে আল্লাহ বলেছেন তিনি দয়াময় তিনি মেহেরবান।তিনি রাহমানির রাহিম। তাহলে কেন আমার উপর রহমত করলেন না।
ও আচ্ছা তিনি রহমত করেছেন। কিন্তু আমার স্বামী শ্বশুর এরা চায়নি। তাহলে তাদেরকে কে চালায়! ও আচ্ছা! শয়তান চালাতে পারে তাই না!
সেখানেও তো তাহলে ঝামেলা আছে। কারণ আমি বলব তাদেরকে শয়তান চালিত করছে। তারা বলবেন আমাকে শয়তান চালিত করছে। বলবেন আমি কেবল দুনিয়াবি মোহের পেছনে ছুটছি। এখন আমি যদি বলি তারা কেন ছেলের বউদের দিয়ে সারাদিন সংসারের সকল কাজ করিয়ে নিজেরা বসে বসে খায়! যেখানে স্বয়ং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী প্রতিটি স্বামী তার স্ত্রী ও সন্তানের খাবারের ও যত্নের ব্যবস্থা করবে। স্ত্রীর ইচ্ছে হলে সংসারে কাজ করবে নয়তো নয়। এটা কেন তারা মানছেন না! কেন যুগের পর যুগ সমাজের কর্তা পুরুষরা আল্লাহর সঠিক বিধান পালন না করে নারীদেরকে দাসী বাদী বানিয়ে রাখছে সামাজিক নিয়মের অবয়বে! কেন সকলে আমার লেখাপড়ার বিরুদ্ধে!
তারা হয়তো বলবে। আমি যেহেতু আল্লাহর সকল বিধান ঠিকমতো পালন করি না তাই আমার জীবনে এতো দহন, এতো অপমান এতো স্বপ্নভঙ্গ। নয়তো এসবই আমার জন্য আল্লাহর পরীক্ষা। আমি তো তাহলে বলব। তারা কী সবাই তাদের জীবন বিধান, আচরণ, ব্যাবহার, সিদ্ধান্ত সব আল্লাহর সবগুলো সঠিক বিধান ও সিদ্ধান্ত মেনে করে! যদি না করে!
তার মানে তারা ও আমি সমান। যদি সমান হই।তাহলে তারা গায়ের জোর খাটিয়ে কেন ধর্মীয় লেবাসে অধর্ম করে বেড়াচ্ছেন! কেন বারংবার নারীকে দমিয়ে রাখার জন্য ধর্মের ভুল ব্যাখা দিচ্ছে! এর জন্য যে পাপ তাদের হবে তার শাস্তির খবর কী তাদের আত্মা জানে না!
আমার জন্য আগামীতে আরও কী কী আছে জানি না। আমি একটা অস্থির জটিলতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। তাইতো আমার মন ও মস্তিষ্কে নানাবিধ প্রশ্ন ঘুরছে। ঘুরছি আমি আমার নারী জীবনের অসহ্য দহনের বৃত্তান্তে।
আমার খালাতো দেবর জাভেদের সাথে আমার আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। সে কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল। আমি দরজাটা বন্ধ করে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকলাম। আজ আর আমার কান্না এলো না এখন। আমি কেমন স্থবির হয়ে গেলাম। আমি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমার ডাক্তারি পড়া হলো না। আগামী বছর আমি কী আবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ডাক্তারি পড়তে পারব! হয়তো পারব।হয়তো পারব না।
আমার শ্বাশুড়ি আম্মা আসলেই কেমন আছেন! আহা! আমি কেবল আমার দিকটাই ভাবলাম। ওইদিকে রাশেদের মনের অবস্থা কী! আমার শ্বাশুড়ির শরীরের অবস্থা কী! আচ্ছা ওরা বাড়ি যখন গেলোই তাহলে আমাকে তো নিয়ে যেতে পারত। রাশেদ কবে আসবে! আমি একা কীভাবে থাকব! যাক অন্তত রাশেদের খবর তো পেলাম।
আমি গোসল করে আসলাম। খাবার খেতে বসে আবারও বমি বমি লাগছে। কী হলো আমার! একটু খেয়ে উঠে গেলাম। আমার বইখাতা গুলোর কাছে গেলাম। ভাবলাম আমি কী এখন জেনারেল লাইনে পড়াশোনাটা করব! রাশেদ কী আমাকে সাপোর্ট দেবে! কী জানি!
এভাবেই একটা ভয়ানক অস্থিরতায় সারাটাদিন চলে গেল। রাত বাড়তে লাগল। আমার একাকিত্ব, আমার ভয় আমাকে ভীষণ আতঙ্কিত করে ফেলল। আমার কেবলই মনে হলো আমি নিশ্চিত নির্বাসনে আছি। আমার কোথাও কেউ নেই। আমার এতোদিনের চেনা ঘর, চেনা মানুষ আমার বাবা-মা ভাই বোন আমার সকল প্রিয়জনরা কোথায়! আমি কী আবারও সবাইকে দেখতে পাবো!
আমার খুব কান্না পেল। কেন আব্বা আমাকে অচেনা অজানা মানুষদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন! কেন দিলেন! এখন যদি তাদের এই মেয়েটা মরে যায়! এই মানুষগুলো যদি আর এই বাসায় ফিরে না আসে! রাশেদ নামের মানুষটা যদি জীবনে আর আমার কাছে না আসে! আচ্ছা আমি কোথায় যাব! বাবা-মায়ের কাছে! আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছি তাদের কাছে আর যাব না। তখন তো আমার কাছে রাশেদ ছিল।আমার ভালোবাসার মানুষ রাশেদ। মনটা কিছুটা শান্ত হলো। শুনতে পেলাম ফজরের আজান হচ্ছে।
অজু করে এসে নামাজ পড়ে আমার শ্বাশুড়ির জন্য দোয়া করলাম। ভয়ে আমি সারারাত রুমের লাইট জ্বালিয়েই রেখেছিলাম। বাইরে একটু একটু আলো ফুটছে। আমার ক্লান্ত শরীরে ঘুমের নেশা জড়িয়ে ধরল। লাইট অফ করে বাসার সব জানলার পর্দাগুলো টেনে দিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। কে এলো এতো সকালে! আমি উঠে গিয়ে দরজার এপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলাম।
— কে কে আপনি?
—ইলোরা দরজা খোলো।
রাশেদ! রাশেদের গলার শব্দ পেয়ে আমি হুড়মুড় করে দরজা খুলে দিলাম। আমি মাত্র বিছানা থেকে উঠে এসেছি। মাথায় কাপড় ছিলো না। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেবর যে রাশেদের সাথে আছে তা আমি বুঝতেই পারিনি। নিজে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার শ্বশুর আব্বা বলে ফেললেন।
— নাউজুবিল্লাহ!
আমি সাথে সাথে মাথায় কাপড় দিয়ে ইতস্তত সরে এলাম। সবাই বাসায় ঢুকল। রাশেদের কণ্ঠ।
——ইলোরা এই ভর দুপুর বেলা সারাঘর এতো অন্ধকার করে রেখেছ কেন!
দুপুর! আমি তো জানি সকাল। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর আড়াইটা। তাড়াতাড়ি করে ঘরের সব জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিলাম। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সালাম করলাম। নিজে ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকলাম। বের হতেই আমার শ্বাশুড়ির কণ্ঠ।
— বউ তুমি আজকে রান্না করো নাই! তুমি মনে হয় ঘুমাইয়া ছিলা! তোমার বাপ মায়ে কী তোমাকে কিছুই শিখায় নাই!
—ভাবি মনে হয় বেশি আরামে থাইকা রাত দিনের তফাৎ ভুলে গেছে।
—ইলোরা এদিকে আসো।
বলে রাশেদ আমাকে আমাদের রুমে নিয়ে এলো। গলা নামিয়ে কিন্তু গলায় ভয়ঙ্কর তেজ নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
—–তুমি কিছু রান্না করো নাই কেন! আমরা কী এখন সবাই না খেয়ে থাকব!
তখনই শ্বশুরের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
—–সেজো বউ পানি দাও। নাকি পানিও নাই!
আমার যে কী অবস্থা যাচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিকে আমার নিজের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। আমি আসলে ফজরের নামাজ পড়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি তো জানি না ওরা সবাই আসবে। আমার কী করা উচিত! কী বলা উচিত! আমি যদি এখন উচিত কথা বলি তাহলে একটা তুলকালাম ঘটনা ঘটবে। আর কিছু বলার মতো ঠিকঠাক দিশাও আমার নেই। এতোগুলা মানুষ আমার প্রতিপক্ষ! এতোগুলা মানুষের আক্রমণ আমাকে কেমন বিদিশা করে দিল।তারপরেও আমি কারও কোনো কথার জবাব না দিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকলাম। প্রথমে এক চুলায় ভাত বসালাম। তারপর আরেকটা চুলায় ডিম সিদ্ধ বসালাম।
আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল। হঠাৎ মেহমান আসলে মা কী করতেন সেই দৃশ্য দেখলাম। আমি আজকে আমার মায়ের রূপ ধারণ করলাম। ডাল ভিজিয়ে রেখে পেঁয়াজ রসুন কাটলাম। একঘন্টার মধ্যে আমি টেবিলে ভাত, ডিম ভুনা আর ডাল দিয়ে সবাইকে খেতে বসালাম। তারা সবাই খাচ্ছে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমাকে কেউ খাবারের কথা বলছে না। ডাইনিং টেবিলটা চার চেয়ারের। আমি দাঁড়িয়ে আছি। তারা সবাই খাচ্ছে আর রাতে কে কী খাবে তার মেনু বলে দিচ্ছে আমাকে।
আমার নিজেকে এই মুহূর্তে একজন ভৃত্য ছাড়া কিছুই মনে হলো না। আমার মাথা ও পেট গুলিয়ে বমি আসছিল। কিন্তু আমি টেবিলের পাশ থেকে সরতে পারছিলাম না। মুরব্বিরা খাচ্ছে। সরে গেলে যদি আবার দোষ হয়! আমার চোখ দিয়ে অটোমেটিক পানি গড়াচ্ছিল। কারও আমার মুখের দিকে চোখ পড়ছিল না। মনে মনে আমার উপলব্ধিতে আমি আমার রাশেদকে একটু একটু করে হারাতে লাগলাম। আমার কাছে রাশেদ এক অচেনা মানুষ হয়ে যেতে লাগল। আমার দেবর খেয়ে উঠে গেল।আমি ওর খালি প্লেটটা তুলে নিয়ে একরকম পালিয়ে এলাম রান্না ঘরে।
বড়ো করে শ্বাস নিলাম। বমি আসলে হা করে বড়ো করে শ্বাস নিলে বমি ভাব কিছুটা কমে আসে। ছোটবেলায় যখন ঢাকায় আসতাম তখন পেট্রোলের গন্ধে আমার খুব বমি বমি লাগত। মা তখন এভাবে আমাকে শ্বাস নেয়া শিখিয়েছিলেন। হা করে বড়ো করে শ্বাস নিয়ে পেটের মধ্যে শ্বাসটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হয়।বার কয়েক এভাবে শ্বাসের প্রাকটিস করলে বমি ভাব কমে আর অনেকটা আরাম হয় ।আমি তাই করলাম।একটু রিলিফ লাগল।তারপর রান্না ঘরের হাউস এর ট্যাপ থেকেই উপুড় হয়ে চোখে মুখে পানি দিলাম। খেতে একেবারেই ইচ্ছে হলো না। কিন্তু আমাকে যে অনেক কাজ করতে হবে। রাতের রান্না করতে হবে।
মা সব সময় বলতেন কখনও কখনও শরীর ও মনের যুদ্ধটা ঠিকঠাক করার জন্য পেটের (পাকস্থলীর) শক্তিটা জরুরি। তাই টেবিল গুছিয়ে খেতে বসলাম। রাশেদ আর মাসুদ ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রাশেদ বাইরে চলে গেলে মাসুদ দরজা বন্ধ করে ভেতরের ঘরে চলে গেল। নিজেকে একটু গুছিয়ে উঠা আমিটার আবারও বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে কান্না পেল। রাশেদ আমাকে না বলে চলে গেল!
আমার স্বামী আমার সাথে কত বড়ো একটা অন্যায় করল। তারপরও তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমিই যেন অপরাধী।
আমি খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই খুব ক্লান্তি লাগছিল। তবুও ঘর বিছানা টেবিল গুছিয়ে থালাবাসন ধুয়ে রান্নাঘর গুছিয়ে ফ্রিজ থেকে মুরগী আর মশলা বের করে রেখে গোসলে গেলাম। গোসল থেকে বের হতেই আম্মা ডেকে উঠলেন।
—-সোজো বউ চা দাও।
ভেজা চুলেই মাথায় কাপড় দিয়ে আবারও রান্নাঘরে ঢুকলাম। চা করে বিস্কুট সহ ট্রে নিয়ে শ্বাশুড়ির রুমে ঢুকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম। আম্মা আপনার শরীর এখন কেমন!
—আমার শরীরের আবার কী হইলো! আমি তো ভালোই আছি।
তাকিয়ে দেখলাম আমার দেবরের চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমি যা বুঝবার তা কিছুটা বুঝতে পারলাম। তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম।
—সারাদিনের বাসের ধকল গেল আপনার তাই জিজ্ঞেস করলাম। যাই মা নামাজ পড়ে রান্না বসাব।
—–মুরগির মাংসে কিন্তু আলু দিও। আর কালিজিরা ভর্তা করে দিও। ওই দেখো ওই পুটলির মধ্যে কালিজিরা আনছি। তুমি কী কালিজিরা ভর্তা করতে পারো?
— পারব আম্মা।
—বেশি করে রসুন দিও। রসুনেই কালিজিরা ভর্তার মজা।
–আচ্ছা আম্মা।
আমি কালোজিরা নিয়ে চলে আসলাম। নিজের রুমের দরজাটা চাপিয়ে রেখে বিছানায় একটু গা পেতেছি। ভাবছিলাম প্রিয় মানুষের মিথ্যেগুলো প্রমাণিত হয়ে গেলে তাদের অবস্থানে কী রকম পরিবর্তন আসে মনের মধ্যে। আমার রাশেদ। আমার প্রিয় স্বামী। আমার ভালোবাসার মানুষটা। কী হতো আমাকে তার মনের ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো খুলে বললে! বড়োজোর আমি খুব কান্নাকাটি করতাম। খুব কষ্ট পেতাম। তবুও তো রাশেদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারতাম সারাটা জীবন। চোখের কোন থেকে কেন যে যখন তখন পিরপির করে পানি পড়ে! এই দুঃখ কান্নার জল কেন এতোটা সরল!
দরজায় ঠকঠক শব্দ।
—কে?
– আমি মাসুদ।
–আসেন।
দ্রুত উঠে বসে গায়ের আর মাথার কাপড় গুছিয়ে বসলাম।
—–আপনার বইগুলো ওই রুমে পড়ে ছিল। এই নিন আপনার বই খাতা। এগুলো দিয়ে এখন আর কী করবেন! সের দরে বিক্রি করে দিন।
—–বাঃ ভাই আপনি তো দেখছি সবসময় অন্যের উপকার করার তালেই থাকেন। তা আমি কী আজকে আপনার কথার জবাব দিতে পারব! নাকি আবার জবাব দিলে আমার দোষ হয়ে যাবে ভাই! আগে আপনার অনুমতি নিয়ে নেই। নইলে তো আবার আপনার ভাইয়ের কাছে গিয়ে আমার নামে নালিশ করবেন।
—–এভাবে কথা বলছেন কেন আপনি!
—-শুধু আপনি বলছ কেন ভাই! বলো এভাবে কথা বলছেন কেন সেজো ভাবি! আর শোনেন ভাই।আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়ো। লেখাপড়া করছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে। তা যেই সাবজেক্টেই পড়ুন না কেন। যদিও সম্পর্কে আমি আপনার বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী। তবুও আদব লেহাজের খেয়াল আমাদের উভয়েরই রাখা উচিত।
—–আপনি অনেক বেশি কথা বলেন।
——আপনি বলেন না! আপনার মনের মধ্যে তো মহা কুটিলতা। মনে আছে ভাই আপনি আমার রেজিষ্ট্রি বিয়ের রাতে আমার কাছে সরি বলেছিলেন আমার অনুমতি না নিয়ে আপনার ভাইয়ের সাথে বিয়ের কারিগর হয়েছিলেন বলে!
সেই আপনার আচরণের সাথে বর্তমান আচরণের এতো পার্থক্য কেন ভাই! তখন ভয় পেয়েছিলেন বুঝি আমাকে নিয়ে। আমি যদি আমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো আপনার ভাইটাকে মন থেকে গ্রহণ না করি।কিংবা খারাপ ব্যাবহার করি।তখন আপনার ভাইটা আপনাকে দোষারোপ করবে। তাই আপনি নিজের গা বাঁচানোর জন্য সেদিন বিনয়ী হয়েছিলেন। আর আজ সব ঠিকঠাক দেখে আপনি কেমন আমাকে আঘাতের পর আঘাত করে যাচ্ছেন আপনার ব্যাবহার দিয়ে!
—-আমি আবার আপনাকে কী করলাম!
—-কী করেননি আপনি! আমি তো পৃথিবীর সকলকে ক্ষমা করতে পারলেও আপনাকে ক্ষমা করতে পারব কিনা জানি না।
এক হলো আপনি আমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছেন আমার বাবার পেছনে দিনের পর দিন লেগে থেকে আমার বিয়ের বিষয়ে।
দুই আপনি আমার ডাক্তারি পড়া নিয়ে গতদিন ও আজ আমাকে কটাক্ষ করেছেন।
আপনার মতো একজন শিক্ষিত মানুষের মানসিকতা কী এমন হওয়ার কথা!
—–আমি আপনাকে এমন কিছুই বলিনি। যা ঠিক তাই বলেছি।
—-তিন আপনি আপনার ভাইয়ের কাছে গিয়ে আমার নামে মিথ্যে নালিশ করে আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন।
কী মনে করেন ভাই মেয়েদেরকে! আপনাদের বেহেশতের হুর!যারা জন্মই নিয়েছে আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য! আর আদি যুগের মতো আপনাদের দাসী গিরি করার জন্য!
——ভাবি আপনি অনেক বেশি কিছু বলে যাচ্ছেন। আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই।
—–তাহলে মিঃ মাসুদ আপনিও শুনে রাখুন আমিও আপনার কটাক্ষ শুনতে বাধ্য নই। আর তাছাড়া আমার শ্বশুর সাহেব বলে দিয়েছেন আপনি আমার মাহরাম পুরুষ নন। তাই আমার আশেপাশে সবসময় মাথা আর চোখ নামিয়ে চলবেন আপনি পুরুষের চোখের ও মনের পর্দার সাথে।
সে কী! যাচ্ছেন কেন! আর একটু শুনে যান। আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হলো মানুষকে মানুষ মনে করতে শেখা। এখন থেকে তা শিখুন আর মানবিক হন। আমার নামে যদি আর কখনো কোনোদিন একটা কথাও নেগেটিভলি পরিবারের অন্য কারও কানে দেন।তাহলে বুঝবেন যে আপনি আপনার মৃত ভাইয়ের গোসত খাচ্ছেন। আর আল্লাহ গীবতকারীকে বেহেশত দিবেন না।
আজকের মতো শেষ কথাটা হলো। আমার ভর্তি পরীক্ষা ও ডাক্তারি পড়া বানচাল করেছেন ঠিক আছে। তাতে কী! আমি আমার দু’টো সার্টিফিকেট আর এই সকল বই খাতা বাঁধাই করে এই বাসাতেই আপনাদের চোখের সামনে আজীবন ঝুলিয়ে রাখব। এটাই হবে আপনাদের জন্য শাস্তি আর আমার জন্য আনন্দ।
আমার দেবর চলে গেলেন।তবে দরজাটা আজকে আর শব্দ করে বাড়ি দিলেন না। আমার কেমন ভীষণ ভালো লাগতে লাগল। মনে হলো নিজের ভেতরের দহন কিছুটা হলেও কমেছে যেন। আমাকে আমার শান্তিটা নিজেই খুঁজে নিতে হবে। আমি যেহেতু বেঁচে থাকব।তাই আমার মেরুদণ্ড সোজা করেই বেঁচে থাকব। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেছেন নিজেকে ভালো রাখতে ও নিজের যত্ন নিতে।
আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে রান্না ঘরে গেলাম।
ভাত, আলু দিয়ে মুরগির মাংস, বেশি করে রসুন দিয়ে কালোজিরা ভর্তা ও কাঁচা পেঁপে কুঁচি করে ভাজি করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে খেতে ডাকলাম। এরমধ্যেই কলিং বেলের শব্দ। রাশেদ বাসায় এলো। তারা সবাই একসাথে খেতে বসলে এখন আর আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি বললাম আম্মা আপনারা খেয়ে নিন। আমার কেমন মাথাটা ঘুরছে। মুখ মাথা ধুয়ে আমি এশার নামাজ পড়ে আসি।এসে সব গোছাব। আমার এরকম কথা শুনে তারা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আমি আস্তে করে চলে এলাম রুমে। দশ মিনিট শুয়ে থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলাম। ততক্ষণে তাদের খাওয়া শেষ।
আমি বেরিয়ে এসে টেবিল পরিষ্কার করে নিজে খেয়ে নিয়ে সব গুছিয়ে রুমে এলাম। রাশেদ তখনও তার বাবা-মায়ের রুমে। আমার মাথায় শুধু রাশেদ ঘুরছে।আমার কাছে রাশেদের জবাবদিহিতা করতেই হবে।
রাত বাড়ছে রাশেদ রুমে আসছে না। এগারোটা দশ।আমি লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ আমার শরীরে হাতের স্পর্শে আমি মোটামুটি চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। সাথে সাথে রাশেদ কথা বলে উঠল।
—–ইলোরা আস্তে! আরে আমি তো!
আমি ভয়ে কাঁদছিলাম।কারণ আমি সত্যি ভয় পেয়েছি। রাশেদ লাইট দিলো। আমি কাঁপছিলাম। আসলে গত দু’টো রাতের একাকিত্ব, ভয়, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে আমি এখনও ঠিকঠাক সবকিছুতে স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না।
—–কাঁদছ কেন!এদিকে আসো সোনা বউ!
—কে তোমার সোনা বউ!
—হা হা হা তুমি। এসো বুকে এসো।
—–তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে রাশেদ।
—–এতো রাতে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো। এসো কাছে এসো।
—বাঃ রাশেদ! তোমার বদলে যাওয়াগুলো খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তুমি তো এমন হিপোক্রে… না মানে তুমি তো এমন ছিলে না রাশেদ!
রাশেদের গলার আওয়াজ উপরে উঠে গেল।
—–কী সব বলছ তুমি! একবার ভেবে দেখেছ! নিজের স্বামীর সাথে এভাবে কেউ কথা বলে!
—–গলা নামাও রাশেদ। আমিও তো তোমার সাথে কথা বলছি। কৈ আমার গলা তো উঠছে না। আর স্বামী! স্বামী মানে বোঝো! শুনে ও শিখে রাখো তুমি। একজন নারী শুধু শরীর ও ভাত কাপড়ের জন্য স্বামীর ঘরে আসে না। নারীও মানুষ। তার নিজের সাথে সাথে সবসময় তার সার্বিক অধিকার মানে হকগুলোও সচল থাকে।
—-রাত দুপুরে ফালতু ঝামেলা শুরু করছ। তোমার প্যাঁচাল থামাও।
——মোটেও না। আমি কোনো ঝামেলা বা প্যাঁচাল করছি না। আগে আমাকে বলো তুমি কীভাবে পারলা আমাকে না জানিয়ে এবং আমাকে একা রেখে বাড়ি চলে যেতে! একবারও আমার জন্য তোমার ভয় করেনি! একবারও তোমার মায়া হয়নি আমার জন্য! আমার বাবা তো তোমার কাছে আমাকে সম্মানের সাথে বিয়ে দিয়েছে। আমার সকল প্রকার নিরাপত্তার দায়িত্ব তো তোমার। আল্লাহ একজন স্বামীকে স্ত্রীর বিষয়ে কী কী দায়িত্ব দিয়েছেন তা তোমাকে বিয়ের আগে তোমার বাবা-মা শেখায়নি!
—–খবরদার আমার বাবা-মাকে নিয়ে কোনো কথা বলবে না। আমি এগুলো কোনোভাবেই মেনে নেব না ইলোরা।
——কেন! আমার বাবা-মাকে নিয়ে যখন আমাকে কথা শোনানো হয়।তখন তোমার এই প্রতিবাদ কোথায় ছিলো রাশেদ!
জানো রাশেদ আমরা আসলে নিজেরাই নিজেদের বিচারক হতে পারি। কিন্তু হই না। হতে পারলে আমাদের প্রতিটি জীবন আরও শান্তিময় হতো। শোনো রাশেদ তোমার বাবা-মাকে নিয়ে বললে যেমন তোমার ব্যথা লাগে।আজকে থেকে মনে রাখবা ঠিক তেমনি আমার বাবা-মাকে নিয়ে বললে আমারও ব্যথা লাগে।
—–তুমি কী থামবে! আমি ঘুমাব।
—-থামব রাশেদ। তবে তার আগে আমার কিছু জবাব চাই। কেন তুমি এটা করলে! আরও জবাব দাও কেন তুমি জাভেদকে দিয়ে মিথ্যে বলে পাঠালে!
—–আমি তো জাভেদকে বলে গেছি। জাভেদ তো তোমাকে জানিয়েছে। না বলে তো যাইনি!
—-কখন! তোমার দুশ্চিন্তায় আমার জীবনের একটা ভয়ঙ্কর বীভৎস অস্থিরতার রাত পার হবার পরে! আর আমার একটা জীবন ও স্বপ্ন শেষ করা সকাল পার হবার পরে!
—–ও আসতে দেরি করেছে। সকালেই আসার কথা ছিল।
—-আর রাত!
আর একটাও মিথ্যে বলো না রাশেদ। তুমি জবাব দিতে পারবে না রাশেদ। কারণ তুমি আমার সাথে বেঈমানী করেছ। আমি যাতে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে না পারি তার জন্য তুমি পরিকল্পনা করে আমাকে না জানিয়ে একা রেখে আম্মার মিথ্যে অসুখের কথা বলে বাড়ি চলে গেছ। জাভেদকে বলে দিয়েছ সকাল এগারোটা পার করে আমার কাছে খবর দিতে আসতে। যাতে করে আমি জাভেদকে নিয়ে হলেও পরীক্ষা দিতে যেতে না পারি।
—-এসব তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ। আসলে আম্মা…
—-থাক আর মিথ্যে বলো না। আমি আম্মার কাছে জেনেছি তার কিছুই হয়নি। যা করেছ তুমি তোমার ঈমানকে জিজ্ঞেস করো কতটা ঠিক করেছ! কাউকে কথা দিলে কথা রাখতে হয়। ওয়াদার বরখেলাপ আল্লাহ বরদাস্ত করেন না। তুমি কী জানো ওয়াদা বরখেলাপের শাস্তি কী?
—–তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছ ইলোরা! এবার থামো।আমাকে ঘুমাতে দাও।
——তুমি ঘুমাও রাশেদ। তবে আগামীকাল আমার সামনে তুমি আমার শ্বশুর আব্বার কাছ থেকে জেনে নিবা।ওয়াদা বরখেলাপকারীর শাস্তি দুনিয়াতে কী এবং আখেরাতে কী!
আরও জেনে নিবা মিথ্যে বলার দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তি।
আরও জেনে নিবা বিশ্বাস ভঙ্গের শাস্তি।
আরও জেনে নিবা…..
—– হইছে বহুত হইছে! আমি একজন পণ্ডিত বউ বিয়ে করছি। একজন ওলামায়ে কেরাম আসছেন রাত দুপুরে বয়ান দিতে।
—–বহুত এখনও হয়নি রাশেদ! হবে। আগে আমার শ্বশুর আব্বার দেয়া বিধান শুনব। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নেব আমার জীবনের।
শোনো রাশেদ,
তুমি যেমন আমাকে বিয়ে করেছ সুখ শান্তির জন্য। আমার বাবাও তেমনি আমাকে তোমার কাছে বিয়ে দিয়েছে আমার সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য। নিরাপত্তা শুধু শরীরের নয় রাশেদ। নিরাপত্তা মনের ও আত্মসম্মানেরও।
আমি আমার পক্ষ থেকে আমাদের সম্পর্কের সকল দায়িত্ব আমার সাধ্যমতো ঠিকঠাক পালন করেছি ও করছি। তুমিও তোমার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করো। অন্যথায় যা হবে তার জন্য তৈরি থেকো। আজ থেকে নিজের স্ত্রীকে মানুষ মনে করো। দাসী নয়। তুমি তোমার স্ত্রীকে যেভাবে তোমার পরিবারে উপস্থাপন করবে। তোমার পরিবার ঠিক সেভাবেই তাকে গ্রহণ করবে।
——হইছে খুব হইছে।উনি একের পর এক লেকচার শুরু করছে। থামেন এইবার আল্লাহর ওয়াস্তে।
—— এখন কেন আল্লাহকে ডাকছ! তাহলে শুনে রাখো আল্লাহ ছাড়া কেউ আর আমায় থামাতে পারবে না। আজকের মতো আর একটা কথা বলে শেষ করছি। খুব ভালো করে মাথায় কথাটা গেঁথে রাখো আজ থেকে। তুমি যদি আমাকে এক চিমটি ঠকাও বা এক বস্তাও ঠকাও।আমি কিন্তু সবই বুঝে ঠকব। তুমি ভেবো না যে ইলোরা চুপ করে আছে বলে তোমার ঠকানো ও ছলচাতুরীগুলো বুঝে নাই। বা ইলোরা না বুঝেই ঠকছে আর না বুঝেই মেনে নিচ্ছে। তাহলে তা তোমার ভুল ধারণা হবে। আমি ইলেরা তোমার সব ঠকানোটা বুঝেই ঠকব। অতএব তুমিও এরপর থেকে বুঝেই ছল করো আমার সাথে।
ও হ্যাঁ! খুব না বলেছিলে আমাকে। যে আমাকে তুমি খুব ভালোবাসো। ওটাও একটা মিথ্যে। ওটাও একটা বাহানা।আমি আজ থেকে তোমার ভালোবাসাকে আর বিশ্বাস করি না। এবার ঘুমাও তুমি।
আমি নিজেই উঠে গিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিয়ে………
(চলবে)