ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ২০

0
606

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ২০
__________🖌️নাজনীন নাহার
০৯.০৪.২০২২

আমার নতুন এক জীবন শুরু হলো বিয়ের বিশ একুশ বছর পর। এখানেও কিছু সুখ আর কিছু অসুখের সমারোহ।
আমি ইলোরা। আমার স্বামী রাশেদ। জন্ম থেকে আমি ইলোরা নামেই বড়ো হয়েছি। বিয়ের পরে প্রিয় স্বামী তার প্রণয়ের বায়না ছলে আমার নামের সাথে তার নাম যুক্ত করে আমাকে আরও বেশি তার ভালোবাসায় বেঁধে নিলো। কিংবা আমিও যে সত্যি সত্যি তাকে অনেক বেশি ভালোবাসি তার একটা লিখিত দলিল বানিয়ে নিলো আমার কাছ থেকে। কেন রে ভাই! মেয়েরা কেন স্বামীর নাম বহন করবে! তাহলে ছেলেদেরও তো বহন করা উচিত! আহা ভালোটা তো তারাও বাসে নিজেদের স্ত্রীকে! বর্তমানে আমার ভোটার আইডি কার্ডের নাম ইলোরা রাশেদ। আমার হাসবেন্ডের নামটাও যদি আমার মতো হতো রাশেদ ইলোরা।কী এমন যেতো আসত!
আবদারটা বিয়ের পরপরই করা উচিত ছিলো আমার।এখন বড্ড দেরি হয়ে গেল।

আমার নামের ঘটনাটা ঘটেছিল যেদিন আমি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলে ফিলাপ করছিলাম সেদিন। রাশেদ আমার কাছে আহ্লাদী গলায় আবদার করল। আমি যেন ওর নামটা আমার নামের সাথে যুক্ত রাখি। যেহেতু রাশেদই ছিলো আমার একমাত্র ভালোবাসা। তাই সাতপাঁচ না ভেবে আমি ইলোরা সেদিন থেকে কাগজে পত্রে ইলোরা রাশেদ হয়ে গেলাম। পরিপূর্ণ ভাবে আমি আমার আমার নাম পরিচয়েও ভালোবাসার মানুষটার হয়ে গেলাম।

এখন বুঝি রাশেদের এই প্রণয় আবদারের রহস্য! বুঝতে পারি দাম্পত্য সম্পর্কের অনেক রকম মিঠা ও তিতা প্রহসন! একটি মেয়ের জীবনে বিয়ে মানে নিজের বাসা বাড়ি পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।নিজের ঘর, আলমারি, পড়ার টেবিল। ছোট বড়ো ড্রয়ার।লুকোনো কিছু একান্ত গোপন স্মৃতি। কিছু ভালোলাগা। বুকের কাছে রেখে ঘুমানো নরম বালিশটাও। সব সব পরিবর্তন হয়ে যায়। পরিবর্তন হয়ে যায় কারও কারও নাম পরিচয়টাও!

প্রায় বিশ বছর পেরিয়ে যাওয়া সংসার আমার। আমার সন্তানেরা এখন মোটামুটি বড়ো হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে মুনিয়ার সাথে বসে বসে আমি ছবি আঁকতে শুরু করলাম। প্রতি শুক্রবার মুনিয়াকে আমি চারুকলায় নিয়ে যাই। সব মায়েরা বাচ্চাদের ক্লাসে দিয়ে এদিক সেদিন ঘুরে বেড়ায় আর বসে গল্প করে। আমি মুনিয়া ও অনান্য বাচ্চাদের পাশে ঘুরে ঘুরে ওদের ছবি আঁকা দেখি। চারুকলার কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের সকল বাচ্চাদেরকে ছবি আঁকা শেখায়। আমি গিয়ে ছবি আঁকার বিষয়ে ওদের সাথে কথা বলি।
আঁকাআঁকির বিষয়ে ওদের কাছে একটা বেসিক বিষয় আমি শিখলাম তা হলো। বাচ্চারা নিজের মতো যা দেখে তা আঁকুক। কোনো ধরা বাঁধা ফর্মুলায় ওরা বাচ্চাদেরকে ফেলতে চায় না শুরুতে। আমারও ঠিক ওই শিশু বেলায় চলে যেতে ইচ্ছে করল। আমারও ওখানেই বাচ্চাদের সাথে ছবি আঁকতে বসে পড়তে ইচ্ছে হলো। রংতুলি, পেন্সিল ও চারুকলার প্রকৃতি আমাকে খুব ডাকছিল। কিন্তু বিষয়টি বেমানান। আমি তাই মনে মনে আঁকতে লাগলাম বাচ্চাদের দেখে দেখে।

মুনিয়ার জন্য ড্রয়িং খাতা রং পেন্সিল কিনে নেই। আমার জন্যও কিনে নেই। আমি মেয়ের সাথে বসে বসে আঁকাতে শুরু করলাম। আমার খুব ভালো লাগতে লাগল এই নতুন রঙের ভুবন। রং গুলো আমার সাথে যেন কথা বলছে। আমাকে ভালোবাসছে। আমিও ভালোবাসতে শুরু করলাম ভীষণ।
সংসারের সকল কাজ করে। ছেলেমেয়েকে সময় দিয়ে। আমি নিজের জন্য একটু সময় করে নেই। আমি আঁকি। মুনিয়া দেখে। ভীষণ খুশি হয়। আমার বয়স যেন পাঁচ ছয় বছরে নেমে এলো। আমি আমার জন্য একটা দারুণ সুন্দর জগত গড়ে নিতে লাগলাম।
আমার বিশ্বাস মানুষের মনের বয়স ইচ্ছের সাথে কমে বাড়ে। আমারও তাই হলো। একদিন আমার বড়ো ছেলে ইফতি আমার আঁকা কিছু ছবি দেখে ফেলল।

সে তো ভীষণ ভীষণ খুশি। মায়ের কাজ দেখে সে ভীষণ প্রাউড। তখনই আমাকে বলল।
—-মা তোমাকে আমি একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেই। তুমি তোমার আঁকা ছবিগুলো পোস্ট করবা। একটা পেইজও খুলে দেব তোমাকে।
—–না না বাবা! এগুলো তোমার বাবা পছন্দ করবে না। আর আমি ওসব চালাতেও পারি না। আমার অনেক ভয় করে।
—- মা ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমাকে শেখাব। একদম ইজি। এসো চলো কম্পিউটারে তোমাকে দেখিয়ে দেই।
—-না বাবা না! তোমার বাবা আমাকে কম্পিউটারের সামনে দেখলে বিরক্ত হবে।আবার কোনো গেঞ্জাম হোক আমি চাই না।
—-বাবা তোমার এই কাজগুলো এখনও দেখেনি! আজকেই বাবাকে দেখাব। তুমি দেখবা মা বাবা কেমন চমকে যাবে। তুমি একটা জিনিয়াস মা। তুমি দারুণ সুন্দর আঁকো।
—ইফতি! সোনা বাবা আমার। তুমি তোমার বাবাকে দেখাইও না। ও আমাকে এসব নিয়ে বাজে কথা বললে আমার অনেক খারাপ লাগবে। দরকার হয় আমি আঁকব না।কিন্তু আমি খারাপ কথা ও আচরণ আর নিতে পারব না সোনা।
—-আচ্ছা দেখা যাবে।
এই নাও তোমার ফেসবুক আইডি। ইলোরা রাশেদ। তোমার সাথে কথা বলতে বলতেই খুলে ফেললাম। এখন এমনি ফুলের ছবি দিলাম। রাতে বাবা ফিরলে বাবার মোবাইল থেকে তোমার ছবি নিয়ে সেট করে দিব।
—-তুমি কী পাগল হয়েছ জান বাচ্চা! আমার এসব দরকার নেই।
—-দরকার আছে মা। এখানে বসো তো। এই যে আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি এভাবে। হুম এভাবে। গুড গার্ল। ঠিক এভাবে পিসি অন করবা। তারপর টাইপ করতে তোমার কিবোর্ড লাগবে। এই দেখো এভাবে টাইপ করবা। এই যে এটা সিফট বাটন, এটা এনটার। এনটার চেপে চেপে সামনে পেছনে উপর নিচে যাবা। এভাবে স্পেস নিবা।এটা ডিলিট বাটন।
এবার মাউসটা ধরো তো মা। হুম এভাবে। জাস্ট খুব সফট করে ধরবা আর হালকা ভাবে মুভ করবা।
—-আমার হবে না বাবা। আমি তো কার্সরটাই ঠিকমতো যায়গায় রাখতে পারি না। দেখো দেখো কী লাফায়!
—-হা হা হা হা মা তুমি তো পুরাই একটা বাচ্চা। হবে হবে সব হবে। হুম রিলাক্স আম্মাজান রিলাক্স। এইতো তুমি পেরে গেছ।
আজকে থেকে তুমি রেগুলার প্রাকটিস করবা। ওয়েট ওয়েট ওয়েট মা।
এই দেখো গুগল লেখা। হুম এটা।এটাতে ক্লিক করো। এবার আর্ট লিখে সার্চ দাও। দেখো মা কত কী!
—– আরে! এতোকিছু এর মধ্যে! ইস কী সুন্দর সব।
—-জি আমার আম্মাজান। এখন তোমার হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী। তুমি যা চাইবে তাই পাবে। যা পড়তে চাইবে তাই পড়তে পারবে। যা শুনতে চাইবে তাই শুনতে পারবে।
আমার চোখ জোড়া চকচক করে উঠল। আমি তেমন কিছু না বুঝেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
—- বাবা আমি কী ডাক্তারিও পড়তে পারব!
আমার ছেলে সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরল। পারবে মা পাড়বে। তবে চিকিৎসা করতে পারবে না সেভাবে। তোমার ডাক্তারির স্বপ্ন ইনশাআল্লাহ আমি পূরণ করব মা। তুমি হবে একজন পৃথিবী বিখ্যাত ডাক্তারের মা।
আমার চোখে পানি চিকচিক করছিল।আমার বুঝদার ছেলেটা আমার মুড চেঞ্জ করার জন্য কম্পিউটারে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে দিল।
আয় তব সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান….
চোখ মুছে হেসে ফেললাম। ছেলেকে বললাম।
—-তুমি রবীন্দ্র সংগীত শোনো!
—-শুনি তবে তেমন একটা ভালো লাগে না। অনেক বেশি স্লো। আর সব কথা ও ভাবের অর্থও বুঝি না।তবে তুমি যে খুব পছন্দ করো মা। তুমি যেগুলো একা একা গাও। আমি মাঝে মাঝে সেগুলো শুনি এখানে আর বোঝার চেষ্টা করি।
—-ও মা! সে কী! আমি আবার কখন গাইলাম আর তুমি মনে রাখলে!
—-ছোটবেলা থেকেই তো! রাতে যখন ইলেকট্রিসিটি চলে যেত।আবার যখন বৃষ্টি হতো। বাবা বাসায় না থাকলে তুমি তো অনেক সময় জানালার কাছে বসে বসে গাইতে। এখনও তো গুনগুন করো।

আমি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে, গালে থুতনিতে অনেকগুলো চুমু খেলাম। এ আমার ছেলে! নিজের এতো লেখাপড়া। এতো কঠিন কঠিন সাবজেক্ট ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজি ম্যাথ নিয়ে ডুবে থাকা ছেলে আমার। তাছাড়া সে তো হার্ড রক হার্ড মেটাল মিউজিকে ডুবে থাকে সেই ছেলেটা মা’কেও এভাবে খেয়াল করে!
এক জন্মে আর কী চাই আমার!

এভাবেই চলতে থাকল ছেলের কাছে মায়ের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। ফেসবুক চালানো, পেইজ অপারেটিং। সাথে নিজের আঁকা ছবির জগত।

একদিন রাশেদ খেয়াল করল আমি কম্পিউটারে বসি। রাশেদ জানতে পারল আমার নামে ফেসবুক খোলা হয়েছে। অবশ্য তেমন বাড়াবাড়ি হতে দিলো না আমার ইফতি। নিজেই বুদ্ধি করে সামলে নিলো নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব নিয়ে। আমি কেমন ভোলাভালার অভিনয় করে নিজের কাজে চলে গেলাম।

আরও একটা কাজ ইফতি আমার জন্য করে দিলো আর তা হলো। ওর নিজের লেখা পড়ার কিছু কিছু ছবি তুলে আনতে হয় কোচিং থেকে। বিষয়টি সত্যি। তাই নিজের প্রয়োজনের প্রায়োরিটি দেখিয়ে আমার জন্য একটা এনড্রয়েড ফোন কিনিয়ে নিলো ওর বাবার কাছ থেকে।
এরপর ফোনের মধ্যে আমার ফেসবুক আইডি একটিভেট করল। আর একটা ইলোরা’স আর্ট নামে পেইজ খুলে দিল।

আমি নেট ঘেঁটে ঘেঁটে বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইনের পেইজ, গ্রুপ, আর্ট পেইজ ও ছবির বিভিন্ন গ্রুপগুলো জয়েন করতে লাগলাম।
আমার আঁকা ছবি ও পোশাকের বিভিন্ন ডিজাইনগুলো এঁকে আমি পোস্ট দিতে থাকলাম বিভিন্ন গ্রুপগুলোতে।
সবাই আমার কাজের খুব এপ্রিশিয়েট করল। লাইক কমেন্ট করে করে আমার কাজের প্রতি আরও আগ্রহ বাড়িয়ে দিলো সবাই। আমার খুব ভালো লাগতে লাগল। শুধু লাইক কমেন্টে কিছু মানুষকে আমি চিনতে থাকলাম। জানতে পারলাম।

আমার ফেসবুক আইডিতে আমি বাচ্চাদের স্কুলের ভাবিদেরকে এড করলাম। আর খুঁজে পেলাম কিছু আত্মীয় স্বজন। বেশ কিছু পরিচিত লোকজন আমি এড করে নিলাম।
এটা করে অবশ্য আমি জীবনের আরও একটা রূঢ় সত্য আবিষ্কার করলাম। তা হলো। শুধুমাত্র মানুষ ছাড়া আমরা যে কোনো বিষয়কেই ভালোবাসা, পরিশ্রম ও মনোযোগ দিব। তা আমাদের নিজের হয়ে কথা বলবে। যেমন আমার আর্টগুলো আমার হয়ে কথা বলতে লাগল।

তবে জীবন, সময়, ঘটনা, ভালোলাগা ও সাফল্য কখনও কখনও খুব সহজ মনে হলেও। এর অন্তরালে কিছু অযথা গ্লানি ওৎ পেতে থাকে। যা আমাদেরকে অযথাই কিছু পীড়ন দেয়। ওই যে আমরা মানুষ এক বিচিত্র প্রাণী!

তাই তো কিছুদিনের মধ্যেই একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। আমি আমার আঁকা কোনো ছবি বা ড্রেসের করা ডিজাইন পোস্ট দিলে অপরিচিত মানুষগুলো বিভিন্ন গ্রুপে যেভাবে কমেন্ট দিয়ে আমাকে উৎসাহ দেয়। সেভাবে আমার আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতরা দেয় না। তারা বরং উল্টো পাল্টা কমেন্ট করে আমাকে বিব্রত করে। যা আমাকে মাঝে মাঝে খুব বিব্রত করে। করে আশাহত। যেমন আমার পোস্টে বেশির ভাগ কাছের মানুষদের কমেন্ট এরকমঃ

–ভাবি এগুলো কি আপনি এঁকেছেন!
—জীবনে তো আপনাকে কখনও আঁকতে দেখি নাই ভাবি!
—ভাবি আপনি তো দেখছি আজকাল ছোট বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন!
—-ভাই এগুলো পছন্দ করে ভাবি? আপনি যে এই বয়সে আঁকাআঁকি করেন!
–একটা কথা বলেন তো আপু এতো সময় কোথায় পান আপনি?
—আচ্ছা আপু একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে। আপনি কী সারাদিন রাতই আঁকাআকি করেন?
আমরা তো রান্না বান্না আর বাচ্চা পেলেই সময় পাই না। আপনি এতো সময় কোথায় পান!
—–ভাবি একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না। ছবিগুলো কী আপনি নিজেই আঁকেন! নাকি কাউকে টাকা দিয়ে আঁকিয়ে নেন। সবার সামনে কমেন্টে তো জিজ্ঞেস করতে পারি না।তাই ইনবক্সে জিজ্ঞেস করলাম।
—-আজকাল তো আপনি সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছেন ভাবি। এখন তো আর আমাদের ফোন টোনই করেন না।

কী আর বলব!
এমন বহু ক্যাটাগরির কমেন্ট আর ইনবক্স মেসেজে আমি বিস্মিত। মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু জবাব লিখে দেই। মনে হয় লিখিঃ
—আপু আপনিই তো আমার স্বামী সংসার সামলান। তাই আমার আর কোনো চিন্তা নেই। সারাদিন শুধু আঁকাআকি করি।
—ভাবি আমি না হয় সেলিব্রিটি! আপনিও তো আমার একটু খোঁজ খবর নিতে পারেন!

আমার মনে হয় শুধু কী একজন নারীর জন্য তার স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির লোকজনই পেইনফুল! নাকি এর সাথেও একজন নারীর জন্য অধিকাংশ সময় পেইন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার প্রতিবেশী, তার কলিগ, তার ড্রাইভার, তার এপার্টমেন্টের দারোয়ান, তার নিকটতম বন্ধুটা, তার এমন ধরনের কিছু ওয়েল উইশার ভাবি ও আপুরা। আর কাছের মানুষগুলোই বেশির ভাগ সময় জ্বলে পুড়ে অঙার হয় আর অঙার করেও।

আসলে আমাদের সকলকে সকলের জায়গা থেকে মানবিক হওয়া খুব জরুরি। জরুরি মানুষ হওয়া। আমি আমার ঘর সংসার, স্বামী শ্বশুর এর সাথে মানসিক যুদ্ধটা চালিয়ে চালিয়ে হয়তো মানসিক একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম ঘরের চার দেয়ালে বসে নিজের জন্য একটি নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করে। সেখানেও নিয়মিত আনন্দের সাথে বিতণ্ডা! তার মানে এটুকু বুঝে নিলাম। জীবন আমাকে আপনাকে কাউকেই পরিপূর্ণ করে নিজের মতো করে থাকতে দেবে না। একটা যুদ্ধ আপনাকে আমাকে প্রতিনিয়তই লড়তে হবে। লড়তে হবে বিভিন্ন রূপে!

তবুও এই ফেসবুকিও জগত আমাকে কিছু ভালোবাসার মানুষ দিতে লাগল। লাইক কমেন্ট থেকে আইডিতে এড হওয়া। হাই হ্যালো করতে করতে খুব প্রিয় হওয়া। নিঃস্বার্থ ভাবে আমাকে আর আমার সৃষ্টিকে ভালোবাসা। এভাবে কিছু ভালো মন, ভালো মানের বন্ধুও পেলাম আমি।
আমি আরও বুঝলাম জীবন এটাও। কিছু পাবো কিছু হারাব। কিছু সুখ কিছু দুঃখ। কিছু স্বস্তি আর কিছু বেদনার্ত মাঝরাত আমাদের জীবনের নিয়মিত গল্প হয়েই থাকবে।এটাই জীবন।
তারপরও আমরা সকলে যদি সকলের যায়গা থেকে। সকলের মন ও মস্তিষ্ক থেকে আরও একটু সহজ, সাবলীল করে নিতে পারতাম সকলকে। তাহলেই আমাদের পৃথিবী ও সম্পর্কগুলো আরও অনেকটা আরামদায়ক হতো।

অথচ আমরাই একে অপরের আনন্দগুলোকে যাতনার করে ফেলি। পৃথিবীর কোথাও যেন মানুষের জন্য নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ নেই। আনন্দ পেতে পেতেই নিরানন্দের ধুলিকণা চোখের কোলাজে ঢুকে পড়ে।

সবচেয়ে বড়ো ধুলিকণাটা ঢুকলো আমার স্বামী রাশেদের পক্ষ থেকে। তার বন্ধু ও আত্মীয়রা নাকি আমার এই বয়সে ছবি আঁকাআঁকি নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে। রাশেদ আমাকে পরিষ্কার বলে দিলো। কী দরকার এসবের! কোথায় এখন বয়স হয়েছে আখেরাতের চিন্তা করবা।তা নয়! কেবল দুনিয়াদারির নেশা। খুব শান্ত বচনে রাশেদ বলে আমাকে। আমি তাকিয়ে থাকি।
এছাড়াও বাচ্চাদের ও রাশেদের সাথে আমার কিছু ছবি পোস্ট নিয়েও ঝামেলা শুরু হলো। আমি অসুস্থ হলেও রাশেদ আমাকে বলবে।
—–এজন্যই আমি ফেসবুকে ছবি দিতে নিষেধ করি। তুমি ফেসবুকে ছবি দাও আর সবার নজর লাগে তোমার উপরে।
আমি ওর বাহানা শুনি আর মনে মনে হাসি।
সিদ্ধান্ত নিলাম নাহ্ নিজের আইডিতে আর কোনো পোস্ট দিব না নিজের আঁকা ছবিরও।

তারপরও বিড়ম্বনা!
কখনও হয়তো একটা রোমান্টিক গান ভালো লাগলে শেয়ার করে রাখি। কখনও কিছু কবিতার আবৃত্তি। কখনও কিছু সুন্দর সুন্দর নীতি বাক্য। কখনও স্যাড গান।

সেখানেও সমস্যা!
—কী ব্যাপার ভাবি! ভাইয়ের সাথে কিছু হলো! এতো দুঃখের গান শেয়ার করলেন!

—কী ভাবি! নতুন করে প্রেমে পড়লেন মনে হয়! আপনি যা সুন্দর এখনও! আমরা মেয়েরাই আপনার প্রেমে পড়ে যাই! আর…..
বাকিটা আর কী বলব!
জাকারবার্গ বাবু ফেসবুক আবিষ্কারের সময় কিন্তু বাঙালিদের কথা মাথায় রাখেননি। এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত।

নিজের আইডিতে পোস্ট করা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে আমার সৃষ্টিতে আরও ডুবে গেলাম। ইদানীং আর আগের মতো বইপড়া হয় না। মাঝে মাঝে এক একটা টপিক মাথায় এলে গুগলে সার্চ দিয়ে পড়ে নেই। আর ছবি আঁকি।
বিভিন্ন ছবি আঁকার পেইজগুলোতে পোস্ট দেয়া আমার অনেকটা নেশা হয়ে গেছে। একদম অপরিচিত মানুষগুলো কমেন্ট বক্সেই মন্তব্য দিয়ে আমার সৃষ্টির প্রতি তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে।
–আজ কী আঁকলেন আপু!
আজকে কখন পোস্ট করবেন?
কেউ কেউ ইনবক্সে জানতে চায়।
—আজকে কিছু আঁকেননি! পোস্ট দিলেন না যে!
ভীষণ ভালো লাগে। ভীষণ অনুপ্রেরণা পাই এই ফেসবুক জগতের নিঃস্বার্থ মানুষগুলোর থেকে। জাকারবার্গকে তখন আবার মনে মনে খুব ধন্যবাদও দেই।

যতই দিন যাচ্ছে রাশেদ বুঝতে পারে আমি নিয়মিত আঁকছি। কী কী আঁকছি তা খুঁটিয়ে দেখে না। তবে আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড ও নিয়ে রেখেছে কৌশল করে। আসলে আমিই দিয়ে রেখেছি। কারণ আমার তেমন কোনো প্রাইভেসি নেই আলাদা করে। আর তাছাড়া সংসারে শান্তিটা আমি খুব পছন্দ করি। আমি আমার স্বামীকে চিনি। তাই রাশেদকে আমিই আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড দিয়ে দিয়েছি ওর নিয়মিত কিউরিওসিটি দেখে।
রাশেদ ইদানীং ফেসবুকের প্রেম নিয়ে। পরকীয়া নিয়ে খুব গল্প করে আমার সাথে।
— জানো ইলোরা কী হয়েছে!
আমি মুখে কিছু বলি না। শুধু আগ্রহ দেখিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
—–আজকে মার্কেটে শুনলাম।অমুক ভাইয়ের বউ দুইটা বাচ্চা রেখে আরেকজনের সাথে চলে গেছে।
—তমুক টিভির নিউজে দেখলাম কীভাবে স্বামীকে নিজের প্রেমিকের জন্য মেরে ফেলেছে মহিলা।
—পেপারে কি এসেছে জানো! স্বামী বিদেশে থাকে।এদিকে তার স্ত্রী…..
আমি বুঝতে পারি তর্ক এড়িয়ে তিনি আমাকে শেখাচ্ছেন। আমি আর ফিরতি কথায় তাকেও বলি না। “আমি তো শুনলাম অমুক পুরুষ পুলিশ অফিসার নিজের স্ত্রীকে ভাড়া করা লোক দিয়ে খুন করেছে নিজের পরকীয়ার জন্য।”
–বিয়ের বিশ বছর পরে ওই যে তোমার অমুক বন্ধু তার বড়ো মেয়ের চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়ো আঠারো বছরের এক মেয়ের সাথে রিলেশন করে সংসার ফেলে চলে গেছে।
আমি আরও অনেক কিছুই বলি না। কারণ মানুষের বেসিক বদলের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ! তাই রাশেদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলানো সম্ভব নয়।

তাই আমি একদিন ওর পাশে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে বললাম।
—-রাশেদ আমি আমার মোবাইল থেকে ফেসবুকে ঢুকতে পারছি না।
একটু দেখো তো তোমার মোবাইল থেকে পারো কিনা!
—– আমি তো পাসওয়ার্ড জানি না।
বলেই সোজা হয়ে বসল।
বললাম আমি বলছি তুমি ট্রাই করো।
আমি পাসওয়ার্ড বললাম। রাশেদ ওর মোবাইল থেকে লগ ইন করল আমার ফেসবুক আইডি।
এবার আমার শান্তি।
মনে মনে বললাম,
“ভাই এবার তুমিই তোমার বউয়ের পরকীয়ার শানেনজুল দেখো!”
কিছুদিন সে রেগুলার লগ ইন করল আমার আইডি। এরপর থেকে কোনো মজা না পেয়ে এখন কালেভদ্রে লগ ইন করে। আমি বুঝতে পারি।

প্রথম প্রথম রাশেদের সামনে আমার কাজগুলো তেমন একটা আনতাম না। মেয়ের রুমের আলমারিতেই রেখে দিতাম।

ইফতি যখন এইসএসসিতেও বোর্ডসেরাদের রেজাল্টের তালিকায় জায়গা করে নিয়ে। মেডিকেল কলেজে চান্স পেলো। কেন যেন আমার মধ্যে সাহসের দৃঢ়তা কিছুটা বাড়ল। আমি তখন নিজের রুমের ড্রেসিং টেবিল, খাটের পাশে, এখানে সেখানে আমার ডিজাইন ও আঁকা ছবিগুলো কখনও কখনও ছড়িয়ে রাখতাম। ইচ্ছেতেও রাখতাম আবার এমনিতেই থেকে যেত।

একটু একটু করে নিজের ভালোলাগার বিস্তার হতে লাগল আমার। আমি বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইন ও ছবির গ্রুপগুলোতে পোস্ট দিয়ে একটিভ থাকলাম। ইনতিকে কোচিং এ রেখে এমবি কিনে নিয়ে আমি পেইজ ফলোয়ারদের সাথে আর্ট নিয়ে যুক্ত থাকতাম।গুগলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আর্ট এর বিষয়ে পড়াশোনা করতাম। শিখতাম নানান রকম টেকনিকগুলো।
আমার এই নতুন সৃষ্টিশীলতার জীবনটা আমাকে যেন এক নতুন জন্ম এনে দিলো।আমি ইলোরা নিজের একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করে নিতে লাগলাম। বিভিন্ন গ্রুপ থেকে আমাকে ভার্চুয়াল সম্মাননা দিচ্ছে। আমার কাজ ও নামের পরিচিতি ও প্রসারে এই গ্রুপগুলোর ভুমিকা অন্যতম। আমি সবাইকে সম্মান করি।ভালোবাসি। আমার পেইজের পাবলিসিটি বেড়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার ফলোয়ার যুক্ত হচ্ছে। আমি আরও ভালো ভালো কাজ করতে লাগলাম।

এরমধ্যে কয়েকবার রাশেদ আমাকে আঁকতে বারণ করল। তবে তা ততটা জোড়ালো না। মাঝে মাঝে এই শিল্প সংস্কৃতির জগতের বিষয়ে আমাকে নেগেটিভ নিউজ দিয়ে দিয়ে ভয় দেখানো যাকে বলে। আমিও আল্লাহ ভরসা বলে বেশ সুন্দর ভাবেই চলতে লাগলাম। কিন্তু এখানেও কিছু মানসিক চাপ ও গ্লানি আমার জন্য ওৎ পেতে ছিলো। আমি তা বুঝতে পারিনি যে এটা এতোটা ভয়াবহ এক মানসিক পীড়ন হবে আমার জন্য। কিন্তু হতে শুরু করল আমার জন্য।

আমার ফেসবুক ও ইনবক্সে শুরু হলো……..

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here