ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৪
__________🖌️নাজনীন নাহার
৩০.০৩.২০২২
আমি আমার স্বামী রাশেদকে কিছু উচিত ও যৌক্তিক কথা বলে নিজেই উঠে গিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। বেশ কিছুক্ষণ আমি দাঁড়িয়েছিলাম অন্ধকারের শরীর ধরে। আমি রাশেদকে এতোগুলা কথা বলার পরও আমার ঠিক শান্তি হচ্ছিল না। কেমন করে শান্তি হবে! আমি যে আমার প্রায় সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি। আমার এখন খুব আমার বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।বাবার কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে। আব্বা আপনি কী জানেন আপনার সিদ্ধান্তগুলো আমাকে কতটা পোড়ায়! আপনি কী জানেন আব্বা আমি আপনাকে হয়তো কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না। আব্বা আপনি আখেরাতে আপনার বেহেশতে যাওয়ার জন্য এইসবকিছু করছেন আব্বা। আব্বা সন্তানের জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়ে কী কোনো বাবা বেহেশতে যেতে পারে! কী জানি!
আমার জন্য তো দুনিয়ায় প্রতিটি মুহূর্তই অস্থির নরকের মতো লাগছে।
রাগে দুঃখে আমার সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছিল। আমি কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না আমার বর্তমান পরিস্থিতির সাথে। আমার খুব বেশি চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। পুরোটা ঘুমন্ত শহরকে কাঁপিয়ে দিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। হে আল্লাহ! আপনি কেন আমার মধ্যে এমন একটা স্বপ্ন বুনতে দিয়েছিলেন আমাকে! কেন আমাকে আমার ছোট বোনটার মতো লেখাপড়া বিমুখ করলেন না!কেন আল্লাহ! কেন!
কেন আমাদের অনেক বাবা-মা নিজেদের মতো করে সন্তানের জীবন চিন্তা করে। নিজেদের মতো পরিকল্পনা করে ফেলে। ছেলেমেয়েদেরকে নিজেদের পছন্দ মতো পড়াশোনার সাবজেক্ট পছন্দ করায়। বিয়ে দিয়ে দেয় নিজেদের পছন্দে আর ইচ্ছায়! আবার কেন অনেক ছেলেমেয়েরাও নিজেদের মন মতো যা খুশি তাই করে ফেলে। কেন এমন হয়! কেন একটা পরিবার সকলের মতামত ও ইচ্ছে নিয়ে নিজেরা ঠাণ্ডা মাথায় একসাথে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় না। কেন সকলে সকলের বন্ধু হয় না! কেন সকলে সকলের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে যৌক্তিক ও শান্তিময় একটা সমাধানে যায় না!
কেন বেশির ভাগ বাবাদের মধ্যে এতো বেশি ইগো থাকে! কেনইবা অনেক সন্তানরা বাবা-মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে নিজেরা ভুল করে! একটা পরিবার কেন একটা আত্মা হয়ে বসবাস করে না! কেন পরিবারের এক একজনের ভুল সিদ্ধান্তে এক একজন ব্যক্তি মানুষটা সারাটা জীবন ধুঁকে ধুঁকে মরে!আমিও কেন আজ ধুঁকে ধুঁকে মরছি! খুব অন্যায় তো কিছু চাইনি বাবা-মা ও পরবর্তীতে প্রিয় স্বামীর কাছে!
আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। আমার আর ঘুম আসছিল না। আমি বারান্দার গ্রিলের কাছ ঘেঁষে একটা প্লাস্টিকের টুলে বসে পড়লাম। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে খুব মনোযোগের সাথে আমার খোলা চোখে গাঢ় করে তাকিয়ে থেকে আলো খুঁজতে লাগলাম। আমি জানি এই ঘনো অন্ধকারে আমি কোনো আলো পাবো না। তেমনি আমার জীবনেও আর পরিপূর্ণ আলো আসবে না। হয় মৃত্যুতে জীবনের সকল গ্লানি মুছে দিতে হবে। নয়তো আজীবন অন্ধকার আর অপূর্ণতার দহনের সাথে কম্প্রোমাইজ করে বেঁচে থাকতে হবে।
নাহ্ আমি পারব না। এভাবে আমি বাঁচতে পারব না। আমাকে লেখাপড়া করতেই হবে। আমি ঠিক এভাবে ফুরিয়ে যাবার জন্য পৃথিবীতে আসিনি। আমি আগামীকালই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলতে যাব। রাশেদকে বলব। ও না নিয়ে গেলে একাই যাব।
আমি সিদ্ধান্তটা নেয়ার পরে মনটা একটু শান্ত হলো। আমার মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রাত প্রায় শেষের দিকে। ভাবলাম একটু বিছানায় যাই।ঘুমাই। উঠে দাঁড়াতেই মাথায় একটা চক্কর দিলো। সামলে নিয়ে দেয়াল ধরে ধরে হাঁটছিলাম। কিন্তু বিছানার কাছে পৌঁছানোর আগেই মাথা ঘুরে ধপাস করে পড়ে গেলাম।
আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমার মাথার কাছে আমার শ্বাশুড়ি ও রাশেদকে দেখতে পেলাম। আমি উঠতে যেতেই আবারও বালিশের উপর মাথাটা পড়ে গেল। টের পেলাম আমার মাথা ও মাথার চুলগুলো খুব ভেজা। আমি হাত দিয়ে চুলগুলো ধরে দেখছিলাম। মনে হচ্ছে আমার মাথায় পানি দেয়া হয়েছে। রাশেদ তার একটা হাত আমার কপালে দিয়ে রেখেছে। আমার কেমন ভালো লাগছে না। ভীষণ ভারি লাগছে রাশেদের হাত আর আমার মাথাটাও। আমার শ্বাশুড়ি জিজ্ঞেস করল।
———-সেজো বউ তুমি কীভাবে পড়লা! কী হইছিল তোমার! এই জুয়ান বয়সে কেমনে বেহুঁশ হও বুঝি না।
আমি এমন কথার জবাবে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।
রাশেদ একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল।
——- নাও এই শরবতটা খাও। আর ডিমটা খেয়ে নাও।এখন কী উঠতে পারবা?
রাশেদের কথায় আমার কী বলা উচিত আমি তাও বুঝতে পারছিলাম না। আমি চুপ করেই রইলাম।
—-সেজো বউ উঠো কিছু খাও।
আমি উঠতে চেষ্টা করতেই রাশেদ আমাকে পেছনে হাত দিয়ে ধরে নিজের বুকের কাছে আমার পিঠ ও মাথা হেলান দিয়ে ধরে রাখল। আমি ওর হাতের গ্লাস থেকে এক চুমুক লেবু চিনির শরবত খেলাম। আমার কেমন একটা অচেনা আর অচৈতন্য ভাব লাগছে। আমার যেন কোনো শক্তি নেই। একটা ঘোরের মতো লাগছে। এরপর রাশেদ ডিম এগিয়ে দিলে একটু একটু করে অর্ধেকটা ডিম খেলাম।সাথে সাথেই আমার বমি আসতে লাগল। আমি রাশেদকে ধরে ধরে বাথরুমে ঢুকে বমি করে দিলাম। আমি বাথরুমের ফ্লোরেই বসে পড়লাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
সারাটাদিন এভাবেই বিছানা আর বমি করে কাটল আমার। বিকেলে রাশেদ আমাকে বাসার কাছেই একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা করে আমার ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট করাতে দিলো। রাশেদ ও আমাকে ডাক্তার মৌখিক ভাবে জানিয়ে দিলো আমার সিমটমস প্রেগনেন্সির। তার মানে আমি হয়তো মা হচ্ছি।
আমার তেমন কোনো ফিলিংস হলো না এতে। কারণ আমার মাথা ও শরীরের কোনো নিয়ন্ত্রণ আমি পাচ্ছিলাম না ঠিকঠাক। কোনোরকমে বাসায় আসলাম। ডাক্তার আমার জন্য কিছু ভিটামিনস আর বমির ওষুধ দিয়ে দিলো। আমার শ্বাশুড়ি আর দেবর মিলে আজকে রান্না করেছে।বমির ওষুধ খাওয়ার পরে কিছুটা ভালো লাগছিল শরীর।
আমার প্রতি রাশেদের যত্ন আরও বেড়ে গেল। নিজে ভাত মেখে আমাকে খাইয়ে দিলো। ঘুমাতে বলল। নিজে সারাদিন বাসায় থাকল। আমারও কেমন ঘুম পাচ্ছিল।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আমাকে সারারাত রাশেদ ওর বুকের মধ্যে আগলে রাখল। আমি একটু নড়াচড়া করলেই সে উঠে বসে পড়ে। আমার কেমন অসার লাগছে শরীর। পরের দিন দুপুরে রাশেদ রিপোর্ট নিয়ে এলো। সাথে করে নিয়ে এলো অনেক মিষ্টি আর ফল। আমার শরীর আজকে কিছুটা ভালো। আমি ডাইনিং এ বসে রাশেদের এতো কেয়ার আর ভালোবাসার রহস্য ভাবছিলাম। মনে হলো হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হয়তো সত্যি সত্যি রাশেদ আমাকে খুব ভালোবাসে। রাশেদকে বলতে হবে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথাটা।
আমি কিছু বলার আগেই রাশেদ আমার খুব কাছে এসে বলল।
——এই নাও তোমার রিপোর্ট। আর শোনো আমার জন্য একটা ভালো খবর আছে। আমি বাবা হবো।
বলেই এদিক ওদিক তাকিয়ে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো।
আমার কাছে ফলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল।
—–বেশি বেশি করে ফল খাবা। বেশি বেশি খাবার খাবা। ডাক্তার বলেছে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এক মাস পরে তোমাকে নিয়ে যেতে। এখন থেকে প্রতিমাসে তোমার চেকআপে যেতে হবে। ইলোরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি ইলোরা।
আমার মাথায় প্রেগন্যান্সি, বাচ্চা আর রাশেদের আদর, ভালোবাসা এসব কিছুই আলাদা প্রভাব ফেলল না। আমি আমার মাথায় চলতে থাকা সেই লেখাপড়ার পোকার কামড়টাই শুধু ফিল করছি। তাই রাশেদের হাতের উপর আমার হাতটা রেখে বললাম।
——কালকে আমাকে নিয়ে একটু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলো। দেখি সময় আছে কিনা!আমি ফরম উঠাব।আমি পরীক্ষা দিব। আমি পড়াশোনা করব রাশেদ।
—তোমার এই শরীর নিয়ে আবারও পাগলামি করছ ইলোরা!
——এটা কেন পাগলামি হবে রাশেদ! আমি তোমার সংসার করব,বাচ্চা পালব আর লেখাপড়া করব। কত মেয়েরাই তো করছে। আমি ঠিক পারব। তুমি না করো না। আমি তো তোমার কাছে খুব বেশি কিছু চাই না।
পেছনেই যে আমার শ্বশুর আব্বা এসে দাঁড়িয়েছিল তা আমি বুঝতে পারনি। তিনি হাঁক ছেড়ে উঠলেন।
—– রাশেদ তোমার শ্বশুরকে খবর দাও। তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করো সে কী তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে! নাকি কলেজে ভর্তি করেছে!
আমি বুঝলাম না। এই মেয়ে এই বাড়িতে আাসার পর থেকে তোমার মাথা বিগড়াইতেছে কেন এতো!বিয়ে দেয়ার আগে কী ওর বাবা-মা ওরে কিছু আদব লেহাজ শিখিয়ে দেয় নাই!
রাশেদ খুব দ্রুত তার বাবার কাছে চলে গেল। এরমধ্যেই আমার শ্বাশুড়ি ও দেবর চলে এলো পাশের রুম থেকে। রাশেদ কাচুমাচু করে আমার শ্বশুরকে সামলাচ্ছে।
—-ঠিক আছে আব্বা বলব বলব। আপনি শান্ত হন। বসেন আব্বা। একটা ভালো খবর আছে।
——কীসের আর ভালো খবর! তোমার বিয়ের পর থেকে তো কেবলই খারাপ খবর!
—–আপনি ঠিকই বলছেন।আমার রাশেদের বিয়ের পর থাইকা কেবল অশান্তি আর অসুখ বিসুখ লাইগা আছে। আজকে রাশেদ অসুস্থ। কালকে তার বউ অসুস্থ। জুয়ান মাইয়া এত্ত অসুখ থাকবে কেন!
—–মা আপনি আবার কী শুরু করলেন! শুনেন এদিকে আসেন বসেন। ডাক্তার বলল আপনাগো নাতি হইব। ইলোরার রিপোর্ট আনলাম। ডাক্তার বলল ইলোরার…
——তাইলে তো ভালো খবর। কিন্তু তোমার বউ যা শুরু করছে! বাচ্চা হওয়ার খবর হওয়ার আগেই বিছনায়। আমি বুঝি না তোমার বউয়েরে কী তার মায়ে কিছুই শিখাইয়া দেয় নাই! কিছু খাওয়ায় নাই! এখনই যেমনে শরীর ছাইড়া দিলো সামনে কী করব!
—–মা সব ঠিক হয়ে যাবে। নিন মিষ্টি খান। আব্বা আপনিও নিন। মাসুদ নে নে তুইও খা।
আমার কেমন আবারও মাথাটা ঘুরছিল। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আমার জন্মটা কেন হয়েছে! আমি এই মানুষগুলোর সাথে কতটা লড়াই করব! কেন লড়াই করব! কেন মেয়েদের বিয়ে হয়! কেন নিজের চেনা ঘর পরিবার ছেড়ে অসহায়ের মতো পরাশ্রয়ী হয় মেয়েরা! আমি এখানে কেমন করে থাকব! কেমন করে বাঁচব আমি! আমি কী একটা মানুষ! আমার কেন কেবলই মরে যেতে ইচ্ছে করে!আমি এসব ভাবতে ভাবতে চেয়ার সহ পড়ে যাচ্ছিলাম। পড়তে পড়তে মনে হলো রাশেদের হাত আমাকে ধরে ফেলল।
আবারও আমার জ্ঞান ফিরে এলো। আবারও আমি আলো দেখলাম। আবারও আমার স্বামীর মুখটা দেখলাম। আবারও আমার চোখের কোল বেয়ে পানি পড়ছে।আমি ফিল করলাম আমার তলপেটে কেমন একটা চিনচিনে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। আমার একটা হাত পেটের উপর চলে গেল। সাথে সাথে আমার রাশেদের কথাটা মনে পড়ল। ডাক্তার বলেছে রাশেদ বাবা হবে। তার মানে আমি মা হব।আমার পেটে আমার সন্তান। আমার নিজের কেউ। রাশেদের কেউ আমার মধ্যে!
আমার বাচ্চা আমার কেউ। আমার শরীরের মধ্যে কেউ। আমার খুব ভালো লাগতে শুরু করল। আমার মধ্যে এই প্রথম মাতৃত্বের অনুভব প্রগাঢ় হলো। রাশেদ আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি আস্তে করে রাশেদকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। আমার সন্তানকে আমি স্বাধীনতা দিব। আমার সন্তানকে আমি সুশিক্ষা দিব।আমার সন্তানকে আমি মানুষ বোধে মানুষ করব ইনশাআল্লা।
মোটামুটি তিন দিনের মধ্যেই আমার শরীর বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠল। আমি এখন আর নিজের লেখাপড়ার কথা বলি না। রাশেদ তার আগের রান্না করে দেয়ার পুরানো বুয়াকে খবর দিয়ে আনল। আমিও যেহেতু বেশ কিছুটা সুস্থ হচ্ছি। তাই আমি মনের জোরটা আরও বাড়িয়ে নিলাম। ভাবলাম বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই লেখাপড়া করা যাবে। মা আর ছেলে একসাথে লেখাপড়া করব। আচ্ছা ছেলে কেন! আমার যদি মেয়ে হয়!
না না আমি মেয়ে চাই না আমার জন্য। আমি ছেলে চাই। এমন একটা পরিবারে মেয়ে সন্তান নিয়ে আমি সেই সন্তানের স্বাধীনতার লড়াই লড়তে পারব না। আমি ছেলে চাই। আমি আল্লাহকে প্রতি ওয়াক্তের নামাজের পরে জায়নামাজে সিজদায় পড়ে নিজের জন্য ছেলে সন্তান চাইতে লাগলাম। আল্লাহকে যুক্তি দিয়ে দিয়ে বুঝাতে লাগলাম আমি কেন ছেলে চাই।
আমি আমার জীবনের দহন সত্য ভোগ করে করে একটা মেয়ে ও ছেলে জীবনের বৈষম্য দেখেছি। আমাদের সমাজে আমার সময়ে একটা ছেলে দশটা রাত ঘরের বাইরে কাটালে কোনো ইজ্জত বা চরিত্র যায় না। কিন্তু একটা মেয়ে একটা রাত বাইরে কাটালে ইজ্জত ও চরিত্র যায়।
অধিকাংশের মুখে শুনবেন।
আরে ছেলেরা উঠতি বয়সে দু’টারটা প্রেম করবেই। এটা কোনো বিষয় না।
বলবে পুরুষ মানুষ একটু এরকমই হবে।
আপনারাই দেখুন কত সহজে পুরুষরা বেশ্যা পাড়ায় যায়। এটা কত স্বাভাবিক করে নেই আমরা। পুরুষ মানুষ একটু আধটু মদ বিড়ি খাবেই! দুইটা বিয়ে কোনো ব্যাপারই না পুরুষ মানুষের জন্য।
ছেলেরা একটু ওইরকমই হয় ইত্যাদি।
তাহলে আমি কেন এই সমাজে আমার পেটে মেয়ে সন্তান চাইব! যেখানে যখন তখন কন্যাশিশু, মেয়েরা ও নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়! যেই সমাজে ও পরিবারে মেয়েদের মতামতের গুরুত্ব নেই। মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে বাবা-মা দায়মুক্ত হয়ে যায় যেই সমাজে! অধিকাংশ স্বামীরা যেখানে ছলচাতুরী করে স্ত্রীর সাথে !
বিয়ের নামে নিজের ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্যের ঘরে। স্বামীর ঘর নিজের ঘর হয় না অধিকাংশ নারীর!
না না আমি কন্যা সন্তান চাই না আমার। এভাবেই আমি মা হবার জন্য তৈরি হচ্ছি।
বাসায় এখন দুই বেলা আমার সহকারী বুয়া আসে। এক সপ্তাহ চলে গেল। একদিন বিকেলে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি জন্য তাদের রুমে আমি চা নিয়ে গিয়েছি। পাশের কোনো এক বাসা বাড়িতে কেসেট প্লেয়ারে গান বাজিতেছে একটু লাউডে। আমার শ্বশুর খুব বিরক্ত নিয়ে আমাকে খোঁচা দিয়ে বলছে।
—-দেখো দেখো আজকাল ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো আদব লেহাজ নাই। কেমন পরিবার! মুসলমান পরিবারে আবার কেসেট বাজায় কীভাবে! নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ। আমার বাড়িতে আমি কেসেট প্লেয়ার আর টেলিভিশন একদম ঢুকতে দিতাম না।শোনো সেজো বউ। ছোটবেলার থেকে ছেলেমেয়েদের আদবকায়দায় মানুষ করবা।
——জি আব্বা জি আব্বা। আপনি যেভাবে বলবেন ইনশাআল্লা।
এর মধ্যেই আমার শ্বাশুড়ি কথা বলা শুরু করলেন। আমার মনে হলো চান্স পেয়ে আমার শ্বাশুড়িও আমাকে বয়ান দিতে শুরু করলেন।
—— সেজো বউ আমরা কালকে বা পরশুদিন বাড়ি চলে যাব। তোমার যা অবস্থা দেখতেছি তাতে তো মনে হয় তুমি বাচ্চা পালবা কেমনে! সারাদিন ওইভাবে বিছনায় শুইয়া থাইকো না। আমরা এক গাদা পোলাপান পেটে ধরলাম।কই আমাদের তো এমুন দেখি নাই!
একটা পোলাপান হইতেও ডাক্তার লাগে নাই। আর আজকাল যে কী শুরু হইছে!
সামান্য একটু রান্না কইরা খাও।তাও বুয়া লাগে তোমাদের!
কেমনে যে আমার রাশেদের উন্নতি হইব!
—— আম্মা আপনি চিন্তা করবেন না। আপনারা আছেন না! সংসার বাবা মা থাকাটা হলো বরকতময় বিষয়। আপনারা সারাদিন বসে বসে নামাজ কালাম পড়বেন আর আমাদের জন্য দোয়া করবেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আরও দোয়া করবেন আমরাও যেন আপনাদের মতো এভাবেই সন্তানের আদর মায়া আর সেবা নিয়ে বাঁচতে পারি। আপনারা তো জানেন। আল্লাহ বাবা-মায়ের দোয়া কবুল করেন আম্মা।
আব্বা আমি কী ঠিক বলেছি!
—- তুমি শিক্ষিত মেয়ে মাশাআল্লা। তুমি মুরব্বিদের সম্মান বুঝো এইটা খুব ভালো।
—–আব্বা তাহলে এবার বলেন আমার বাবা-মা আমাকে খুব ভালো কিছুই শিখিয়েছে তাই না।
এবার আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিজেদের একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগছে বিষয়টি।আমি আবারও বললাম।
—– আব্বা তাহলে কী এখন আর আমার বাবাকে খবর দেয়ার দরকার আছে! তাকে কী আমার বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে আব্বা! না মানে আপনাদের ছেলে বলছিল আমি যেন আমার বাবাকে ঢাকায় আসার জন্য একটা চিঠি লিখে দেই।আপনার ছেলে পোস্ট করে দিবে।
কথা ঘুরাতে আমার শ্বাশুড়ি বলল।
—– সেজো বউ ফ্রিজে কী ইলিশ মাছ আছে? তোমার শ্বশুর ইলিশ মাছের কথা বলছিল।
—–আছে আম্মা। কীভাবে রান্না করব!
—–সরিষা বাটা দিয়া ইলিশ মাছ তোমার শ্বশুরের খুব পছন্দ। রাশেদও খুব পছন্দ করে। ঘরে কী সরিষা আছে?
—-আছে আম্মা। তাইলে আমি রাতে সরিষা ইলিশ রান্না করে দিচ্ছি। আম্মা ইলিশ মাছ আপনি কীভাবে খেতে পছন্দ করেন?
—-আমার আর পছন্দ! বিয়ের পর থেকে নিজের সব পছন্দ শেষ। তোমার শ্বশুর আর নিজের ছেলেপুলের পছন্দের খাওয়াই খাই। ছোটো বেলায় আমার বাপে দূরের হাটের থাইকা ইলিশ মাছ কিননা আনত।বেশিরভাগ সময় রাত হয়ে যেত।আমার মা ওই রাতের বেলায়ই ইলিশ ভাইজা দিত। আমরা ঘুমাইয়া গেলে ডাইকা তুলত। গরম ভাতে গরম ইলিশের ভাজা। আহা কী মজা গো সেজো বউ! আমার বিয়ের পর থেকে তোমার শ্বশুরের পছন্দেই খাই।
—-আম্মা আজকে আমি আব্বার জন্য সরিষা ইলিশ রান্না করব। আর আপনার জন্য দুই টুকরা মাছ ভেজে দিব।
—–না গে সেজো বউ তা লাগব না।
বলেই নিজের খুশিটা ভুলে গিয়ে এজটু ভয় মিশ্রিত চোখে আমার শ্বাশুরের মুখের দিকে তাকাল। আমি বললাম।
—- আম্মা আপনি আব্বা সবাই সবার আলাদা পছন্দে খাবেন মাঝে মাঝে। আবার সবাই একসাথেও খাবেন।আম্মা একটা কথা বলতাম।
—– বলো সেজো বউ।
—- আম্মা আমাকে আর সেজো বউ ডাকবেন না। আমার তো একটা নাম আছে। আপনারা আমার নাম ধরে ডাকবেন। ইলোরা বলে ডাকবেন। আমি আমার নামেই আপনাদের কাছে থাকতে চাই আম্মা। আপনারাও আমার নাম ধরে ডাকলে আমাকে নিজের মেয়ের মতো মনে করবেন। আপন আপন লাগবে।
আমার শ্বাশুড়ি ও শ্বশুর কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তাদের চোখমুখের অবস্থা দেখার মতো ছিল। আমিও তাদেরকে স্পেস দিয়ে চায়ের কাপ ও ট্রে হাতে নিয়ে উঠে চলে এলাম।
আমি নিজে নিজের জীবনের কিছু নিয়ম কানুন শিখে নিচ্ছি প্রতিদিন। আমি আমার মায়ের জীবন যাপন থেকে একটা বিষয় খুব ভালো ভাবেই শিখে নিয়েছি তা হলো। আমি বিয়ে করেছি সংসার করার জন্য। ঝগড়াঝাটি কিংবা রেষারেষি করার জন্য নয়। আমি আরেক বাড়ি থেকে আমার স্বামী ও শ্বশুরের সংসারে এসেছি বলে তারা কথায় কথায় আমাকে ছোট করবে তা আমি বেশিদিন চলতে দেব না। আমি আমার ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা চালাব।
আমি নিজেও তাদের সাথে অযথা তর্ক করব না। আমিও তাদেরকে আমার বাবা-মায়ের মতো সম্মান করার চেষ্টা করব। তাদের প্রতি আমিও একজন যোগ্য সন্তানের মতো দায়িত্ব পালন করব। আমার নিজের বাবা-মায়ের সব কথা ও সিদ্ধান্তও তো আমার মনের মতো হয় না।
এক একটা জীবন ও সম্পর্ক সুন্দর ও সুখের হতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া ও ভালোবাসা থেকে।
আসলে আমি চাইলে কী হবে! কথায় বলে না কুকুরের লেজ সোজা হয় না। আমার তো মনে হয় মহান আল্লাহপাক মানব জাতির মতো এমন বিচিত্র প্রাণী আর কিছুই তৈরি করেননি।
কেন!
আপনারা বিষয়টি টের পান না! টের পান না মানুষের বিচিত্র চরিত্রের!
তাহলে আমিই বলছি শুনুন………
(চলবে)