ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৫
________🖌️নাজনীন নাহার
০১.০৪.২০২২
আমার ছেলের বয়স যখন আট মাস। তখনই আমার স্বামী রাশেদের আচরণে খুব পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। রাশেদ আমাদের প্রতিবেশী মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে ভয়ঙ্কর মানসিক অশান্তিতে ভুগতে লাগলাম। রাশেদকে কীভাবে বলব! সে বিষয়টিতে কীভাবে রিএক্ট করবে! আমি তো এখনও তাদেরকে খুব বাজে কোনো অবস্থায় পাইনি। কিন্তু তাদের ভাব ভঙ্গিমা, রং ঢং হাসি তামাসা আমার ছেলেকে কোলে নেয়া দেয়ার উছিলায় ছোঁয়া ছুঁয়ি এবং তাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের দিওয়ানাপন আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছিল।
একটি গোছানো সংসার আমার।আমার ছেলেটা একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। আমি নিজের সকল স্বপ্ন ও চাওয়া-পাওয়া আমার সন্তান ও স্বামীকে ঘিরে আবর্ত রেখেছি। মানুষটার কথা মতো আমি চলি। সংসার, রান্না বান্না ও সন্তান লালন-পালন সবই তো ঠিকঠাক করে যাচ্ছি।
হুম এটা ঠিক যে আমি ওই মেয়েটার মতো অতটা স্মার্ট লুক নিয়ে চলি না। আমি মেয়েটার চাইতে সৌন্দর্যের বিবেচনায় অনেক বেশি সুন্দর হওয়ার পরেও আমার স্বামী কেন মেয়েটির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে! আমি অতটা সাজগোজ করি না বলে! মেয়েটির মতো খোলামেলা পোশাক পরি না বলে! মেয়েটির মতো কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ি না বলে! মেয়েটির মতো সব ছেলেদের সাথে চোখ আর শরীর নাচিয়ে কথা বলি না বলে! তাহলে কী এগুলোই আমার স্বামীর বেশি পছন্দ! নাকি সে পুরুষ মানুষ তাই অন্য নারীর প্রতি তার আসক্তিটা স্বাভাবিক। সকল পুরুষরাতো বহু নারীর প্রতি আসক্ত হয় না! তাহলে আমার স্বামী কেন হলো!আমি বিষয়টিতে মারাত্মক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করলাম।
আমি তো ভালোই ছিলাম। আমার ছেলেটা মাশাআল্লা বেশ সুস্থ, সুন্দর আর চটপটে হয়েছে। সবাই আদর করে তাকে ইফতি বলে ডাকে। তার পুরো নাম ইফতেখার রাশেদ। আল্লাহর কাছে চাওয়া আমার ছেলে সন্তানের আবদারটা আল্লাহ রেখেছেন। তাইতো আমি আমার সন্তান ইফতিকে পেয়ে আমার স্বামী রাশেদের সব রকম আবদার ও নির্দেশনা আরও বেশি মেনে নিয়ে চলি। তার মধ্যে আমার স্বামী এমন একটা ঘটনায় জড়িয়ে গিয়ে ওর প্রতি আমার বিশ্বাসকে দ্বিতীয়বার গলা টিপে মেরে ফেলল।
মানুষের বিচিত্র চরিত্রের বিচিত্র নমুনাগুলো দেখে দেখে আমি বিষণ্ন হয়ে যেতে লাগলাম। আমার জীবনে কেন একটার পর একটা বীভৎস ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে আমি জানি না। আমাকে আমার বাবার পক্ষ থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া। এতো ভালো রেজাল্ট করার পরেও ডাক্তারি পড়তে না পারা। সব কিছুর দুঃখ দহন তো আমি ভুলেই থাকছি। আমি তো আমার সব দুঃখ ভুলে খুব ভালোবেসেই রাশেদের সাথে গুছিয়ে সংসার করছি।
আমাদের দাম্পত্যের মধ্যে কোনো গ্যাপ তো ছিলো না।মতের কিছু মিল অমিল নিয়ে সকলের মতো স্বাভাবিক জীবনই চলছিল আমাদের। আমি বরং অধিকাংশের চেয়ে বেশি মেনে ও মানিয়ে সংসার করছিলাম রাশেদের সাথে। এবং আমার প্রতিও রাশেদের মনোযোগের ও ওর মতো করে আমাকে ভালোবাসার কমতি ছিল না তেমন। হঠাৎ করেই আমার প্রিয়তম স্বামী রাশেদের এই আচরণ আমার সবকিছু এলোমেলো করে দিতে লাগল। মেয়েটিও যেন রাশেদের জন্য দিওয়ানা হয়ে উঠল। আমার রাশেদের সাথে তার চোখে চোখে, গল্পে কথায় ঢলে ঢলে পড়া। আমার ছেলে ইফতির জন্যও সেই মেয়ের ভালোবাসা যেন নদী নয় সাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ের মতো উথলে পড়তে লাগল। না না মজা করছি না। বিষয়টি ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যেতে লাগল আমার জন্য। আর এটা যে কতটা ভয়াবহ যাতনার বিষয় তা যে সকল মেয়ে বা ছেলের দাম্পত্য জীবনে এমনটা ঘটেছে সেই সকল ভুক্তভোগীরাই কেবল জানে।
আমি যতই তাদের দু’জনের এই বিষয়টি খেয়াল করছি।ততই আমার দহন বাড়ছে। আমি যে কীভাবে বিষয়টির সমাধান করব বুঝতে পারছিলাম না। কোথা থেকে যে মেয়েটা আসল! আর আসল তো কি! সে কেন এভাবে অন্য একজনের স্বামীর প্রেমে পড়বে!
বিয়ের পর থেকে আমার ডাক্তারি পড়তে চাওয়ার বিষয়টি ছাড়া আমার আর আমার স্বামীর মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়নি। সে আমার উপর খুবই খুশি। তাছাড়া আমি প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে তো রাশেদ আমার জন্য আরও বেশি দিওয়ানা হয়ে গেল। আমার পুরো প্রেগন্যান্সির সময়টায় আমার শরীর মোটামুটি ভালোই ছিলো। পাঁচ মাস পার হতেই যখন আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম আমার সন্তানটি ছেলে। আমার মনের জোর আরও এক ধাপ বেড়ে গিয়েছিল। মনে হলো পুরুষ শাসিত সমাজে আমার পেটে একজন পুরুষ তৈরি হচ্ছে। আমার সন্তানকে অন্তত আমার মতো মানসিক চাপে বাঁচতে হবে না। আমার স্বামী রাশেদ তার ব্যাবসা আর বাসা এই মিলিয়ে আমাকে যথেষ্ট টেককেয়ার করে। আমাদের দু’জনার সম্পর্কও মোটামুটি বেশ ভালো। বেশ ভালো মানে অনেক বেশি ভালোবাসে রাশেদ আমাকে। ভালোবাসে আর কৌশলে আমাকে কিছু কিছু করে রেস্ট্রিকশনে বেঁধে নেয়। ইলোরা এই করো না, ওই ভেবো না, ওই চিন্তা করো না, সেই চেয়ো না, ওটা ভালো না ইত্যাদি। মাঝখানে একবার একদিনের জন্য আমার আব্বা মা আর ছোটবোন ঢাকায় এসে আমাকে দেখে গেলেন। মা আমাকে মায়ের সাথে নিতে যেতে চেয়েছিলেন। আমি ডাক্তারের উছিলা দেখিয়ে বাবার বাড়ি যাইনি।রাশেদও আমাকে যেতে দিতে চায়নি। আমারও ঠিক ইচ্ছে করেনি যেতে।
আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িও একবার এসে দশ বারো দিন আমাদের কাছে থেকে গেছেন। রাশেদের যথেষ্ট ভালোবাসা ও যথেষ্ট টেককেয়ার আমাকে এতোটাই মোহিত করে রাখত যে ওর দেয়া রেস্ট্রিকশনগুলো আমার সেভাবে খারাপ লাগত না।আর রাশেদ আমাকে সবসময় আল্লাহ, রাসুল ও ধর্মীয় বিশ্বাস, বোধ ও অনুশাসন নিয়েই বলত ও বুঝাত। আমি একজন মুসলিম হিসেবে এর বিরোধিতায় পারতো পক্ষে যেতাম না। মোটামুটি জি জি জি বলে মেনে নিতাম বেশির ভাগ সময়। কারণ আমার জীবনে রাশেদ ও আমার সন্তান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিয়মিত নামাজ ও তিলাওয়াত করি। তবে আমি ধর্মান্ধ নই। আমার কথা, চিন্তা ও চলার মধ্যে ধর্মীয় গোরামি নেই। আমি চেষ্টা করি জীবন ও ধর্মকে সহজ করে ধারণ করতে। আমার কাছে মনে হয় জীবনের জন্য ধর্ম। ধর্মের জন্য জীবন নয়। এটা আমার চিন্তা ভাবনা। লেখাপড়ায় আমি রাশেদের চেয়ে কম অবস্থানে আছি। আমি এইসএসসি পাস। রাশেদ ডিগ্রি পাস। তার কথা ও যুক্তি একটু বেশি মেনে নিতেই পারি।
তবুও রাশেদের কথায়, কাজে ও আচরণে আমি ধর্মীয় জ্ঞান, চিন্তা এসবের কেমন একটা অতিরঞ্জন দেখি অধিকাংশ সময়। কখনও কখনও ওর সাথে কিছু আলোচনায় আমি আমার মতামত দিতে গেলে বা ওর মতামতের বিষয়টির অতিরঞ্জন নিয়ে বোঝাতে গেলে। আমাকে মোটামুটি নারীবাদী বা আমি কিছুই বুঝি না টাইপ সিচুয়েশনে ফেলে দেয় রাশেদ। অযথা তর্ক করা আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া রাশেদ একজন ধার্মিক মানুষ এতে আমার জন্যই সুবিধা। রাশেদের ধর্ম বিশ্বাস খুবই পাকাপোক্ত। সে নিয়মিত নামাজ পড়ে এবং মিনিমাম এক ঘন্টা ধরে তিলাওয়াত করে। হাদিস ও ইসলামি বই নিয়মিত পড়ে। জুম্মার দিন নামাজের বেশ আগেই নিয়মিত মসজিদে যায় খুৎবা ও বয়ান শুনে। মাঝে মাঝে কোরআনের তাফসির শুনতে যায় বিভিন্ন মসজিদে। আমাকেও মাঝে মাঝে ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান দেয়।আমিও বেশ মনোযোগে শুনি। আমাকে খুব সুন্দর করে আবদার ও আপত্তি সহকারে রাশেদ একদিন জানিয়ে দিলো। আমাদের বাসায় রাশেদের অনুপস্থিতিতে আমার কোনো কাজিন ব্রাদার আসতে পারবে না। আমি যেন তার এই নির্দেশনা মেনে চলি। আমি বলেছিলাম কেউ যদি হঠাৎ করে আমাদের বাসায় চলে আসে!
রাশেদ বলেছিল আমি যেন তাহলে দরজা না খুলি ইত্যাদি। তারপরও আমি বলেছিলাম কেন রাশেদ! তারা তো আমার রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়। ও তখন বলেছিল এটা গুনাহের কাজ ও নাজায়েজ কাজ হবে। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। আমার কাজিন ব্রাদাররা আমার জন্য মাহরাম পুরুষ না। আর মাহরাম পুরুষ ছাড়া কোনো আত্মীয় পুরুষ বা ছেলে আমার বাসায় আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে আসতে পারবে না।আমি তখন বললাম আমার সাথে যদি বাসার কাজের মেয়ে থাকে তাহলে! আর তাছাড়া একজন কাজিন ব্রাদার না এসে যদি তিন-চারজন একসাথে আসে তখন! তখন রাশেদ খুব আদর কণ্ঠে আমাকে বলেছিল।
—না তাও আসতে পারবে না। আমি চাই না আমি বাসায় না থাকলে তোমার কাছে কেউ আসুক। বিষয়টি আল্লাহ নিষেধ করেছেন ইলোরা।আর আল্লাহর নিষেধ আমারও নিষেধ। আল্লাহর নিষেধ পালন করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য।
আমিও চেষ্টা করেছি রাশেদের আবদার ও নির্দেশনা পালন করতে। আল্লাহর বিধান মানতে। এগুলো তো আমার দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় দুনিয়ার জন্য ভালো।আর তাছাড়া রাশেদ নিজে যত আল্লাহর বিধান মেনে চলবে ততই আমার জন্যও ভালো। কারণ আমি ছাড়া সে অন্য কোনো নারীর দিকে চোখ বা মন দেবে না কখনোই। রাশেদ কখনোই বিপথগামী হবে না তাহলে। আমি রাশেদের সাথে বাইরে কোথাও গেলেও খেয়াল করলাম। মহিলাদের একটু খোলামেলা পোশাক পরা দেখলেই রাশেদ সে সবের সমালোচনা করে ও বিরক্তি দেখায়। তার মানে হলো আমার স্বামী খুব ভালো মন ও চরিত্রের মানুষ।
সব এভাবেই চলছিল। আমার তেমন একটা বাইরে যাওয়া হয় না। ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার আর বাসা। অথচ সেই ধর্মভীরু রাশেদ প্রতিবেশি মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। কীভাবে হলো! এখন কী সে আল্লাহর নির্দেশ ভুলে গেল! এখন কী তার পরকালের ভয় চলে গেল! এই মেয়ের জন্য কী রাশেদ মাহরাম পুরুষ! তাহলে রাশেদ কেন এমন অপকর্মে জড়িয়ে গেল! কি অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে আমি পড়ে গেলাম!
মেয়েটিকে আমরা চিনি প্রায় এক বছরের উপরে সময় ধরে। আমার সাত মাসের প্রেগনন্সির সময় আমাদের বাসার মেইন গেইটের ঠিক অপজিটের বাসার পুরনো ভাড়াটিয়া চলে গিয়ে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছিল। তারা মা আর দুই মেয়ে থাকে বাসায়। মায়ের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পরিচিত হয়ে ভদ্রমহিলাকে আমি খালাম্মা বলে ডাকলাম। জানতে পারলাম খালাম্মার তিনটি সন্তান। বড়ো ছেলে আমেরিকায় থাকে স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে। বড়ো মেয়ে ইংলিশে অনার্স পড়ছে ইডেনে শেষ বর্ষে। ছোট মেয়েও অনার্স পড়ছে। খালাম্মার স্বামী মারা গেছেন পনেরো বছরেরও বেশি সময় হয়েছে।
তাদের সাথে আমার মোটামুটি একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। খালাম্মা এবং তার মেয়ে মিমি ও রিমি খুবই মিশুক প্রকৃতির। এর মধ্যে আমার ছেলে ইফতি হলো। ইফতি একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। খালাম্মার বড়ো মেয়ে মিমির আমার ছেলের জন্য ভালোবাসায় অতিরঞ্জন আমারও খুব ভালো লাগছিল। আমার ছেলেটা সঙ্গ পাচ্ছে।
তবে মিমি ও রিমি দু’বোনের পোশাক বেশ খোলামেলা। কখনোই ওদের গায়ে ওড়না থাকে না। লম্বা একটা টিশার্টের সাথে একটা পেন্টি পরে আমার ঘরে চলে আসে। দরজার বাইরের পেসেজে ওরা খোলামেলা পোশাকে হাঁটাহাঁটি করে।শাড়ি পড়লে তো কথাই নেই শরীরের সিংহভাগই যেন খোলা থাকে ওদের দু’বোনের। প্রথম প্রথম মাঝে মধ্যে আমার স্বামী রাশেদের সামনে ওরা পড়ে গেলে। রাশেদ চোখ নামিয়ে বাসায় ঢুকে ওদেরকে শাপ শাপান্ত করত আমার কাছে।
——এগুলো মেয়ে মানুষের চলাফেরা হলো! দেখেছ কি ধরনের খোলামেলা পোশাক পরে!
এইসব মেয়েদের কোনো লেহাজ নেই বুঝলে!
—–আচ্ছা থাক না। ওদের নিজেদের বিষয়। শুধু শুধু এখানে গজগজ করে নিজের মন মিজাজ খারাপ করার কি দরকার! বাদ দাও।
——-কেন বাদ দেব ইলোরা। দরজার কাছে যাওয়া যায় না। ছিঃ এই ধরনের মেয়েরা সমাজের কলঙ্ক। এদের তো মনে হয় জাহান্নামেও জায়গা হবে না। কি বেহায়া বেশরম মেয়ে মানুষ রে বাবা।লানত!
—— আহা! বাদ দাও তো!
—–তার মানে কী ইলোরা! তুমি এগুলো পছন্দ করো! তোমারও কী এগুলো পরতে ইচ্ছে করে! এরকম চলতে ইচ্ছে করে! এজন্যই তুমি এতো খাতির করো ওদের সাথে! কবে যে তোমাকেও এরা নষ্ট করে ফেলবে!
—-রাশেদ তুমিও না!
——আমি কি ইলোরা! নাউজুবিল্লাহ! কি বাজে টাইপ মেয়ে এরা! আল্লাহ হেদায়েত করুন এদেরকে।
আমি অবশ্য মনে মনে একটু শান্তি পেলাম যে। আমার রাশেদ ওরকম খোলামেলা মেয়েদেরকে নয়। আমার মতো মেয়েকেই পছন্দ করে। আমি রাশেদের প্রতি প্লিজড হয়ে ওকে আরও বেশি ভালোবাসতে লাগলাম।
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার পরহেজগার স্বামী তার ভাষ্যমতে সেই বাজে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল!
মেয়েটার কণ্ঠ শুনলেই আমার রাশেদ ঘরের যে কোন প্রান্ত থেকে একরকম দৌড়ে আমাদের বাসার মেইন গেইটে চলে যায়।আমাদের বাসার কলিং বেলের শব্দ শুনলেই রাশেদ দরজা খুলতে চলে যায়। আমার বাসায় একটা বারো চৌদ্দ বছরের মেয়ে সহকারী আছে আমার ছেলে ইফতির সাথে খেলা করা ও ইফতির সাথে থাকার জন্য। প্রায় সবসময় ওই মেয়েটাই দরজা খুলত। কিন্তু ইদানীং আমার হাসবেন্ড দরজা খুলতে চলে যায়। আমার হাসবেন্ডকে মেয়েটি ভাইয়া ভাইয়া করে অস্থির। ইফতিকে রাশেদের কোল থেকে নেয়ার সময় তারা পরস্পর হাতে ও শরীরে যতটুকু সম্ভব নিকটবর্তী হয়। মিলি যখন শাড়ি, ওয়েস্টার্ন বা সেলোয়ার-কামিজ পরে ভীষণ সেজেগুজে বাইরে যায়। তখন সব সময় সে আমার বাসার কলিং বেল বাজাবে। আমার ছেলেকে দেখার নাম করে দশ মিনিট তাদের দু’জনার একটা লীলা চলতে থাকে।
কখনও কখনও আমি খেয়াল করলাম। রাশেদ বাথরুমে বা পেছনের বারান্দায় থাকলেও কলিং বেলের শব্দটি হতেই প্রায় দৌড়ে চলে আসে। কারণ তার লীলাবতী ডাকছে তাকে।
আমি বিষয়গুলো যতই বুঝতে পারছি ততই আমার কষ্ট হচ্ছে।
তাদের রং তামাশা আরও বেড়ে গেল। মিমির পছন্দের খাবার রাশেদ এনে এনে আমার হাতে দিয়ে বলে।
—-খালাম্মার বাসায় দিয়ে আসো। এগুলো মিমির খুব পছন্দ। সেদিন কথায় কথায় বলেছিল মিমি।
আমার গা জ্বলে যায়। কখনও কখনও আমি হয়তো টেবিলে রাখলাম যে ঠিক আছে পরে দিয়ে দেব।
রাশেদ তখনই আমাকে বলবে।
—ইলোরা এটা এখানে রাখলে কেন! দিয়ে আসো। আমি হয়তো নিয়ে যাচ্ছি দেবার জন্য। তখন আবার রাশেদ বলে দিচ্ছে আমাকে।
—–তুমি বলো যে আমি এনেছি। মিমি খুব পছন্দ করে তো।
ওই পক্ষেরও একই অবস্থা!
—–আপা এটা নিশ্চয়ই ভাইয়া এনেছে। আমি সেদিন বলছিলাম এগুলো আমার ভীষণ পছন্দ। ভাইয়াকে থেনক্স বলবেন আপা।
আমার মন মিজাজ ভয়ানক খারাপ হয়ে যেত। আরে মেয়ে! তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়ো হয়ে আবার আমাকে আপা আপা ডাকো! ফাজিল কোথাকার। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারি না।
নিজের স্বামীর এই সকল আচরণে আমি মিমির কাছে ছোট হয়ে যেতে লাগলাম। এ তো আমারই ব্যার্থতা! আমার স্বামীর এখন আর আমার প্রতি মন নেই। আমি স্মার্ট না।আমি অতটা শিক্ষিত না। আমার স্বামী আমাকে ইগনোর করে অন্য মেয়েকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ওই মেয়েটির কাছে আমাকে অসম্মান করছে।
কি যে এক মানসিক যাতনা বেড়ে গেল আমার। আর কত! আমার অবশ্যই কিছু একটা করা উচিত। কিছু বলা উচিত। আমার স্বামী আমাকে এতো আল্লাহর নির্দেশের বয়ান ও নসিহত করে আর এখন সে কীভাবে বেগানা নারীর প্রতি আসক্ত হয়! কীভাবে সে এতো নিকটবর্তী হয় পরনারীর! কেন সে তার মুখে বলা বাজে মেয়ের সাথে এতো কথা বলে! ওই মেয়ের পছন্দের খাবার কিনে পাঠায়!
আমি আর তাদের রঙো লীলা সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিতে লাগলাম কি করা যায়! প্রথমে ভাবলাম মেয়েটাকেই কিছু বলব। পরবর্তীতে মনে হলো মেয়েটাকে কেন বলব। মেয়েটা আমার কে? মেয়েটা যদি আমার মুখের উপর বলে দেয়।আপনার স্বামীকে সামলাতে পারেন না! যদি এতো ভালো একটা সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় খালাম্মার সাথে! তিনি তো খুব ভালো মানুষ! কি করব!
তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যা বলার আমার স্বামীকেই বলব। কিন্তু সেখানেও ভয়! সারাজীবনের জন্য তার সাথে আমার বিশ্বাসটা নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ভয়ও পেলাম যদি রাশেদ ডেস্পারেট হয়ে যায়! যদি বলেই ফেলে আমি ওই মেয়েকেই চাই। তবে আমি এটুকু বুঝতে পারছিলাম এই মেয়ে আমার স্বামীকে ঠিক বিয়ে করবে না। একটু নাচিয়ে রাখবে।আর ভাঙিয়ে খাবে। তবুও কিছুই বলা যায় না। আমার স্বামীকে তো আমি ফেরেশতা তুল্য মানুষই মনে করছিলাম। মনে করেছিলাম একজন চরিত্রবান ও ইসলামি বিধানে বিশ্বাসী ও পালনকারী মানুষ। কিন্তু সে এসব কী শুরু করল!
আজকে যদি আমি ইলোরা আমার পাশের ফ্ল্যটের কোনো ছেলে বা পুরুষের সাথে ঠিক এভাবেই গল্প করতাম, হাসতাম বা ঢলে পড়তাম! এভাবেই কোনো ছেলের জন্য খাবার এনে তার নাম করে করে আমার স্বামীর হাত দিয়ে পাঠাতাম। সেই ছেলে যদি যখন তখন আমার ঘরের কলিং বেল বাজাত! আমি যদি দৌড়ে সেই ছেলের কাছে আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে ছুটে যেতাম! আমি যদি অন্য কোনো পুরুষ ছেলের সাথে ঠিক এভাবেই আচরণ করতাম, লীলা করতাম! তাহলে কী আমার স্বামী তা সাপোর্ট দিতো! আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি তা মেনে নিতো!
তখন কী তারা আমার বাবা-মায়ের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলত না! আমাকে অপবাদ দিতো না!
আমার নিজের আপন কাজিন ব্রাদাররাই আমার বাসায় এলাউ না। সেখানে প্রতিবেশি পুরুষ কী এভাবে এলাউ করত আমার স্বামী!
তাহলে সে নিজের বেলায় এসব কীভাবে করে!
নাহ্ আমাকে এসবের একটা বিহিত করতেই হবে। আমি তো আর আমার স্বামীর মতো পুরুষ না। আমাকে কিছু কৌশল অবলম্বন করতেই হবে।
আমি তখন কৌশল করতে লাগলাম। কলিং বেলের শব্দ পেলেই আমি দৌড়ে যাই দরজা খুলতে। রাশেদ যেতে থাকলে তাকে থামিয়ে দেই।
—- তুমি বসো আমি দেখছি।
কখনও কখনও সময় বুঝে বলি।
—–এখন মিমি আসছে দরজা খোলার দরকার নেই। দরজার কাছে গিয়ে আমি মিথ্যা করে বলে আসি।
—-ইফতি এখন ঘুমাচ্ছে।
এভাবে বাহানা করে আমি রাশেদ আর মিমির মাঝে দূরত্ব বাড়াতে লাগলাম। কিন্তু তারাও কৌশল পাল্টাতে লাগল। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রাশেদ ও মিমি অযথাই দরজার সামনের পেসেজে কথা বলে বলে সময় কাটায়। আমাকে দরজা বন্ধ করতে না দিয়ে আমার কোলে থাকা ছেলের সাথে জোরে জোরে কথা বলে আদর করে রাশেদ। যাতে করে মিমি ওদের বাসা থেকে বের হয়ে আসে।
হায়রে বেহায়া! ভাগ্যিস তখন মোবাইলের এমন এভেইলেভল ব্যবহার ছিল না। থাকলে না জানি কি হতো!
আমি ওদের শয়তানির কাছে হেরে যাচ্ছিলাম। কৌশল প্রয়োগ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম।
তবুও হাল ছাড়াছিলাম না।
আমি তখন ইচ্ছে করে নিজে নিজেই মিমির নামে বদনাম করতে লাগলাম রাশেদের কাছে।
—–মিমি এতো বাজে ভাবে চলাফেরা করে।
আর বলো না ওর যত কাজিন ব্রাদার ও ছেলে বন্ধুরা আসে সবাইকে ও জড়িয়ে ধরে হাগ করে। কি অবস্থা!
আচ্ছা রাশেদ! আমি বুঝি না মিমিরা দু’টো বোনই কেন এমন বেলাল্লাপনা করে! আমার একদম ভালো লাগে না। তুমিও আর ওদের সাথে কথা বলো না তো!তুমি ঠিকই বলেছিলে ওরা আসলেই খুব বাজে মেয়ে।
আমার কথায় রাশেদ পাত্তাই দেয় না।কথা ঘুরিয়ে নিয়ে নেয় অন্যদিকে।
তাদের একের প্রতি অপরের আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। আমি লক্ষ্য করলাম তারা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করে। আমাদের ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করে। আমি হয়তো ছুটির দিন রান্না করছি রান্না ঘরে। তখন তারা দু’জন আমার ছেলেকে নিয়ে খুব হাসি ঠাট্টা করে গল্প করে আর ছেলের সাথে খেলে। কেউ যেন কাউকে না দেখে থাকতে পারে না। কোনো ভাবেই আর আমার এসব কৌশলে আমি রাশেদকে ফেরাতে পারছিলাম না।
এবার মনে হলো আমাকে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে যেতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ।মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করলাম। কিছু বিষয় পরিকল্পনা করলাম।সেই মোতাবেক রিহার্সাল করলাম নিজে নিজে মনে মনে। কোন কোন শব্দে রাশেদের কি কি রিঅ্যাকশন হতে পারে! কি কি বলতে হবে রাশেদকে! যেহেতু আমি সংসার করব রাশেদের সাথে। তাই ঝগড়াঝাটি না করে ঠাণ্ডা মাথায় আগে চেষ্টা করতে হবে সমস্যাটার সমাধানের। কার সাথে পরামর্শ করব!আমার তো তেমন কেউ নেই যার সাথে আমি পরামর্শ করতে পারি এই বিষয়ে। তবে না থেকে ভালোই হয়েছে।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমস্যা হলে তৃতীয় পক্ষকে ডেকে না আনাই ভালো আমার মতে। নিজেরা আলোচনা করে সমাধান করে নিতে পারলে তারচেয়ে শান্তির কিছু নেই। কিন্তু আমি চাইলেই তো সব আমার মতো হবে না। তবুও আমি আমার চিন্তা ভাবনা ও পরিকল্পনা মতো একদিন শুক্রবার দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে রাশেদ আর আমি বিছানায় গড়াগড়ি করছিলাম। আমার ছেলেটা ঘুমাচ্ছিল। বিকেল সাড়ে তিনটা বা চারটার মতো বাজে। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ। রাশেদ এক রকম উড়াল দিয়ে চলে যাচ্ছিল দরজা খুলতে। আমি খপ করে রাশেদের হাতটা আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে ধরে ফেললাম আর বললাম……
(চলবে)