#চন্দ্রপুকুর
||১১তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
বেগম নূর বাহারের কথায় ভ্রু কুঁচকে যায় দাদীজানের। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে মুখ খুলেন তিনি,
“এসব বিষয়ে পরে আলাপন করা যাবে। কথা মন্দ নয়। তবে দিনে দিনে বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোমার। কোথায় কী বলতে হয় ভুলে যাচ্ছো।”
মৃদু অপমানেই মাথা নত করে ফেলেন মেহমাদ শাহের মা। শাহাজাদি মেহনূর সতেজ কণ্ঠে প্রস্তাব রাখে,
“এখন আমাদের কামরার বাহিরে যাওয়া উচিত। বেগমের চেহারার যা দশা হয়েছে, তার একটু একাকিত্ব ও আরাম করার প্রয়োজন।”
“হুম। আমরা যাচ্ছি চন্দ্রমল্লিকা। নিজের খেয়াল রেখো। দাসীরা আমি অতিদ্রুত সুস্থতা চাই। চেষ্টা নয় ফলাফল চাই আমার।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
যামিনী ব্যথিত দৃষ্টিতে দেখে তিন শক্তিশালী নারীর কক্ষ ত্যাগ করা। তাঁদের চাল-চলন আর পদচারণাতেও কী ঈর্ষনীয় আভিজাত্যের ছোঁয়া!”
“দিলরুবা, আমাকে উঠাতে সাহায্য করো। আমি বসতে চাই।”
“জী” উচ্চারণ করেই দিলরুবা ও তার সেবায় নিয়োজিত দাসীরা তাকে আধশোয়া অবস্থায় স্থির করে।
যামিনী চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে হৃদয়ের আর্তনাদে। চোখের সম্মুখে কল্পনায় এঁকে দিতে থাকে তার মস্তিষ্ক মেহমাদ শাহ ও মেহনূরের কাছাকাছি অবস্থান করার দৃশ্য।
অনাকাঙ্ক্ষিত ও অতি অপ্রিয় এই দৃশ্যের দর্শনে ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠে রমণী। তার কৃষ্ণ কায়া ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে পূর্বেই। দিলরুবা এগিয়ে এসে তাকে আঁকড়ে ধরে।
“কী হয়েছে বেগম চন্দ্রমল্লিকা? খারাপ লাগছে আপনার? পানি দিব বেগম? দাসী, পানি আনো। শান্ত হন, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। শান্ত হন।”
ঘোর ভাঙে কিশোরীর। যত্ন করে পানি পান করিয়ে দেয় দিলরুবা। শান্ত হয় সে।
“আমি একা থাকতে চাই, দিলরুবা। দাসীদের বলো চলে যেতে।”
যামিনীর খাস বাঁদী দিলরুবা তা জানা কথা সকলের। তাই তার ইশারা পেয়ে স্থান ত্যাগ করে দাসীরা।
তারা যেতেই যামিনী মুখে হাত চেপে কেঁদে দেয়। বিড়বিড়ায়,
“এতো কষ্ট সহ্য করে এতো দূর আসার পরও ক্যানো আপনিও আমার থেকে আপনাকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন বাবু মশাই? না হয় কৃষ্ণবর্ণাই আমি, তবে আপনাকে ভালোবাসতে তো লবণের কণা পরিমাণও কৃপণতা করিনি।”
দিলরুবা শুনতে পারে। নিজেও দুঃখিত হয় প্রিয় মনিব তথা বেগমের এ রূপ বেদনায়।
এমন সময় দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করেন কেউ। যামিনী দরজার দিকে চোখ তুলে তাকালে ভেসে উঠে গুলবাহার খাতুনের মুখশ্রী। তার পিছন পিছন প্রহরীরাও অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে।
“এখানে কী হচ্ছে? আমার কক্ষে এভাবে কোনো কথা ছাড়া প্রবেশ করার মতো অন্যায় করার স্পর্ধা দর্শন…! আদব কি ভুলে বসেছো না কি?”
নিজ কষ্ট, হতাশা, যন্ত্রণা ও এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতি মিলিয়ে অনেকটা রাগান্বিতই হয়ে উঠে যামিনী
ভীতিগ্রস্ত হয় প্রহরীরা।
“দুঃখিত, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আমরা চেষ্টা করেছিলাম বাধাদানের, উনি আমাদের কথা না শুনেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েন।”
আঙুলের ইশারায় তাদের যেতে আদেশ করে কিশোরী। তারা গমন করলে কঠোর চাহনি নিক্ষেপ করে গুলবাহার খাতুনের উপর।
“আপনার সমস্যাটা কোথায় খাতুন? বারবার ক্যানো আমাকে উত্যক্ত করতে চলে আসেন? আমারও ধৈর্য্যের সীমা আছে। নিজেকে সামলে রাখুন, নয়তো আমি বাধ্য হবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে।”
আজও তার কঠোর চাহনি ও রাগান্বিত কণ্ঠ পারে না এই মধ্যবয়সী নারীটিকে দমাতে। তাঁর গা দুলানো হাসিতে প্রমাণিত হতে হয় যামিনী হুমকিও কৌতুক রূপ গুলবাহার খাতুনের নিকটে।
“ওহে রমণী আগের নিজের স্থান সামলাও, নিজের স্বামীকে নিজের করার ব্যবস্থা করো। পরে চেষ্টা কোরো আমার কোনো ব্যবস্থা করার। নিজের স্বামীকে সন্তুষ্ট করার সক্ষমতা টুকুও তো তোমার কাছে নেই। নারীত্বের অভাব বড়ো।”
ক্রোধনলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় যেন রমণীর চিন্তাশক্তি। একজন পুরুষকে গভীর ভাবে আঘাত করার সবচেয়ে শ্রেয় স্থান যেমন তার পুরুষত্ব, তেমন নারীকে গভীর ভাবে আঘাত করতে চাইলে তার নারীত্বে প্রশ্ন তুলাই যথেষ্ট।
“সামান্য খাতুন তুমি, তোমার সাহস কী করে হয় নারী আমার দিকে আঙুল তুলার? কী করে!”
ক্রোধে শয্যার ডান পাশের চৌপায়ায় বিদ্যমান ঔষধে পরিপূর্ণ পেয়ালাটি ছুড়ে মারে গুলবাহার খাতুনের দিকে। তিনি হয়তো প্রস্তুতই ছিলেন এই পরিস্থিতির উদ্দেশ্য। তাই তো অতি সহজে রক্ষা পান আঘাত পাওয়া হতে।
রাগে, উত্তেজনায় শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গিয়েছে যামিনীর। আঁখি হতে টপটপ করে পতন হচ্ছে অশ্রুর।
গুলবাহার খাতুন এগিয়ে আসেন তার দিকে। তবে হেলে-দুলে নয়, বেশ ধীর-স্থির ভাবে। চেহারায় কোনো খাপছাড়া ভাব নয়, গাম্ভীর্যপুর্ণ চাহনি তার।
যামিনীর কপোল মুছে ধীর কণ্ঠে শুধায়,
“রাগে যেই তেজটা আমাকে দেখিয়েছো, তা এই নবাবপরিবারকে দেখাও। মনে রেখো, তুমি এই পরিবারের কারো থেকে কোনো অংশে কম নয়। নবাবের স্ত্রী তুমি, জমিদারনি। অশ্রু, কষ্ট, হতাশাকে অনলে রূপান্তর করো। অগ্নিতে পরিপূর্ণ তেজস্বিনী হও সূর্যের ন্যায়। শাসন করতে না জানলে কিন্তু শাসক হওয়া যায় না।”
শেষ বাক্যটি মৃদু হেসেই বলেন বয়োজ্যেষ্ঠ মানবীটি। দেহ ঘুরিয়ে নৈশব্দে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যান। যামিনী অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নারীটিকে। সে আজও স্থির হতে পারলো না একটি বিষয়ে। তা হলো – এই নারীটি তার পক্ষে না বিপক্ষে?
___
তিন দিন পেড়িয়েছে, যামিনীর ক্ষত এখন প্রায় পুরোপুরিই শুকিয়ে গিয়েছে। বেশ ভালোও বোধ করছে সে, তবে আজকে একটু বেশিই আনন্দ, উৎফুল্লতা তার মাঝে। মেহমাদ শাহ না কি আজ সন্ধ্যার শেষপ্রান্তেই বাড়ি ফিরবে বলে খবর রটিয়ে গিয়েছে গোটা মহলে গতকাল বিকেল হতেই। কানে এসেছে কিশোরীরও, এজন্যই মুখশ্রীতে এমন লাল আভা, এমন সতেজতা।
স্নান করে ফজরের সালাত আদায় করে দিলরুবা ও নিজের অন্যান্য দাসীদের নিয়ে বাগানে ভ্রমণ করতে বেড়িয়েছে সে। বাগানে প্রবেশ করতেই মহাপরিচারিকার সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ। শিকার দালান থেকে নবাববাড়িতে আগমনের পর একবারও দর্শন পায়নি নারীটির।
“আসসালামু আলাইকুম বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক, সুখী রাখুক।”
“ধন্যবাদ এবং জাজাকাল্লাহ খাইরান মহাপরিচারিকা। আপনার তো সাক্ষাৎই পেলাম না এখানে আসার পর থেকে। কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?”
“হ্যাঁ, আমার একমাত্র জীবিত আত্মীয় চাচাজানের কিছুদিন পূর্বে মৃত্যু হয়েছে। তাই একটু পিরোজপুর গিয়েছিলাম। তবে বেগম আপনি এতো সকাল সকাল এখানে কী করছেন? কোনো কিছু প্রয়োজন হলে দাসী বা খাদিমকে বলতেন।”
“আসলে ঘরে বসে থাকতো দমবন্ধ হয়ে আসছিল, বিষণ্ণ লাগছিল। তাই একটু খোলা বাতাসে ভ্রমণ করতে এসেছিলাম। ভালোই হলো আপনি এসেছেন, আমার একজন সঙ্গী বাড়লো।”
“আসুন বেগম। আপনাকে আজ বাগানে নবাবের প্রিয় অংশ টুকু দেখাই।”
“অবশ্যই মহাপরিচারিকা।”
দিলরুবা, যামিনী ও মহাপরিচারিকা বিভিন্ন গল্পগুজবের মাঝে এগিয়ে গেল। কথা বলতে বলতেই বাগানের এক পার্শ্বে অবস্থিত একটি বিশেষ ধরনের ঘরের সম্মুখে দাঁড়ালেন মহাপরিচারিকা। ঘরটির কোনো দেওয়াল নেই, বরং চারটি পিলারের উপরে রঙিন টিনের ছাদ ও নিচে পাকা মেঝে।
“এই জায়গাটি আমাদের শাহের সবচেয়ে পছন্দনীয় স্থান। এখানে প্রায়শয়ই বসে কোরআন তিলাওয়াত এবং গজল, গান গাইতেন। এখন অবশ্য তেমন গান না। এই যে এর চার পাশে ফুলে সজ্জিত গাছগুলো দেখছেন, তাও শাহের পাক হস্তে লাগানো।”
“মাশাআল্লাহ, কিন্তু শুধু দু’পদের ফুল গাছেই কেন সজ্জিত মহাপরিচারিকা? তাও আবার চন্দ্রমল্লিকা বেশি।”
“আসলে নবাবের অতি প্রিয় ফুল হলো চন্দ্রমল্লিকা। চন্দ্রপ্রভাও অনেক পছন্দ।”
হৃদয়ে যেন হাজারটা মৌমাছি একসাথে আক্রমণ করেছে এমন অনুভূতি হয় যামিনীর। মনে মনে ভাবে,
– এজন্যই বুঝি মেহনূরকে চন্দ্রপ্রভা বলে ডাকেন বাবু মশাই? মেহনূরকে পছন্দ তাঁর?
বিতৃষ্ণা নিয়ে সে বলে উঠে,
“দুঃখিত, মহাপরিচারিকা। আমাকে যেতে হবে, খুব জরুরি কাজ মনে পড়ে গিয়েছে।”
বিদায় জানায় মহাপরিচারিকা। রমণী একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে এগিয়ে যায় নিজের কক্ষের দিকে।
___
মেহমাদ শাহ নবাববাড়িতে এসেছেন খবর জানিয়ে দেওয়া হয় প্রতিটি সদস্যকে। বাদ যায় না যামিনীও।
নিয়মমাফিক সকলেই তাকে স্বাগতম করতে অন্দরমহলের প্রবেশদ্বারের নিকটবর্তী বৈঠকঘরে উপস্থিত হন। সবার হৃদয়েই যেন উৎসব লেগে গিয়েছে।
মেহমাদ শাহ প্রথমেই বেগম লুৎফুন্নেসার কাছে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“মাশাআল্লাহ আমার সিংহ। শহর থেকে আরও সুদর্শন হয়ে এসেছো।”
“ধন্যবাদ দাদীজান। তবে আম্মাজান কোথায়?”
তখনই উপস্থিত হন মোর্শেদা খাতুন।
“এই যে আমি প্রিয় শাহ। কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আম্মাজান। তোমাকে দেখেছি না আম্মাজান, আরও সতেজ হয়ে গিয়েছি।”
যামিনী খেয়াল করলো বেগম নূর বাহারের চেহারাটা যেন ঈর্ষায় দগ্ধিত হলো। এরপর একে একে জমিদার সকলের সাথে সাক্ষাৎ করে যামিনীর ছোট্ট শীর্ণ ও হস্ত খানা নিজ হস্তে নিয়ে নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।
শাহাজাদি মেহনূর হাসি মুখে দেখলো তাদের কামরায় গমন। তারা দৃষ্টির বাহিরে চলে যেতেই চোখ-মুখ কুঁচকে গেল তার আক্রোশে।
কক্ষে প্রবেশ করেই মেহমাদ শাহ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তার চন্দ্রমল্লিকাকে। কালো কেশের মাঝে মুখমণ্ডল গুঁজে লম্বা এক প্রশ্বাস নিল, যেন শুষে নিচ্ছে রমণীর দেহের সকল সুবাস।
“আপনি কেন চলে যান বারবার আমাকে ছেড়ে বাবু মশাই? আপনি হীনা আমি একদণ্ড স্বস্তিতে থাকতে পারি না, আপনি তো জ্ঞাত এ সম্পর্কে।”
“কী করবো চন্দ্রমল্লিকা? তোমার প্রিয়তম যে একজন জমিদার, তাকে যে তোমার ভালোবাসায় দগ্ধিত হওয়া ছাড়া আরও হাজারও কার্য সম্পাদন করতে হয়। আমিও তো বড্ড প্রাণশক্তি হারা হয়ে পড়ি তোমার খুশবু নিজের মাঝে না পেয়ে, হয়ে পড়ি নিস্তেজ। তবে এটাই জীবন, এভাবেই থাকতে হবে।”
“হুম, জানি তো। তবুও বড্ড লাগে আপনার বাচ্চা হরিণীর বুকের মাঝখানটায়। যাকগে স্নান করবেন না? আজ আপনাকে আমি নিজ হাতে স্নান করিয়ে দিব।”
কোনোরকম “হুম” উচ্চারণ করেই যামিনীর ললাটে সিক্ত স্পর্শ অঙ্কন করে দেয় মেহমাদ শাহ। তাদের গভীর ভালোবাসার সাক্ষী হয় কামরার প্রতিটি নির্জীব উপাদান।
রমণীর খুব করে ইচ্ছে করছে শাহাজাদি মেহনূরের কথা উঠাতে, বিবাহ বন্ধের আবেদন করতে। এই সুন্দর ও শান্তিময় মুহূর্তটি ম্লান করার ভীতিতে নিঃশ্চুপ থাকে সে। এভাবেই হয়তো বহু ক্ষেত্রে একজন নারী নীরব রয়ে যায় মস্তিষ্কের বিরোধিতা করে।
স্নান করে কক্ষে ফিরার পর ক্রন্দনরত যামিনী মেহমাদ শাহের বক্ষে লুটিয়ে পড়লো। যুবক হুটহাট কান্নার কারণ অনুধাবন করতে না পেরে প্রশ্ন করতে শুরু করে।
কিশোরী করুণ কণ্ঠে বলল,
“আপনি আমার সবচেয়ে প্রিয়, তার চেয়েও অধিক প্রিয় আপনার ভালোবাসা। এই ভালোবাসার ভাগ আমার পক্ষে কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। ক্যানো এই দ্বিতীয় বিয়ের মতো আঘাত দিচ্ছেন আমাকে? এই বিবাহের সংবাদ যে আস্ত এক অজগর সর্প হয়ে নিংড়ে ফেলছে আমাকে।”
মেহমাদ শাহ চুপ থাকে। যামিনীর শঙ্কিত হৃদয়। প্রতিবারের ন্যায় এবারও কিতার বাবু মশাই রেগে যাবে তার উপর?
চলবে…
আনইডিটেড পার্ট, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন।