চন্দ্রপুকুর’ পর্ব-৪৩

0
1156

#চন্দ্রপুকুর
||৪৩তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“খাতুন, বেগম লুৎফুন্নেসা আপনাকে অন্দরমহল সাজানোর ব্যবস্থা করার আদেশ দিয়েছেন। আর বেগম নূর বাহার বলেছেন রঙ্গশালায় কন্যাদের উৎসবের ব্যবস্থা করতে।”

“ঠিক আছে। এই নেও অর্থ, দয়া করে ভ্রাতা ভুল করেও কাউকে জানতে দিয়ো না আমার বাহিরে যাওয়ার বিষয়ে।”

কিছু অর্থ হাতে গুঁজে দিয়ে অনুরোধের সুরে বলেন নারীটি। প্রহরীকে যেন ছুঁতে পারে তাঁর অসহায় কণ্ঠ।

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি কাউকে জানতে দিব না।”

আশ্বাস পেয়ে মহলে প্রবেশ করেন তিনি। দ্রুতো চাপকলের নিকট যেয়ে নাক ছিঁটকিয়ে হস্ত খানা ডলে ডলে ধৌত করে সে। যেন খুব নিকৃষ্ট কিছু ছুঁয়েছিলেন তিনি।

“বিপদে পড়লে ফকিরকেও জমিদারের ন্যায় সম্মান জানাতে হয়। যত্তসব নিচু বংশের লোকজনকে ছুঁতে হয় আজকাল আমার।”

বিড়বিড় করতে করতে অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন তিনি।

___

মেহমাদ শাহের যখন তন্দ্রা কাটে তখন তপ্ত দুপুর বেলা। যুবক গতকাল রাত্রিতে সাক্ষাৎকার দিতে দিতে এবং জনাব আরহান করিমের সাথে তাদের তৈরিকৃত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই শয্যায় গা ঠেকাতেই অনতিবিলম্বেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

জাগ্রত হয়ে উঠে বসতেই তার সর্বপ্রথম মনে পড়ে যামিনীর কথা। মৃদু হাসে সে। কন্যাটির প্রতি এবারও ক্রোধ ধরে রাখতে অসক্ষম সে।

আনমনেই বিড়বিড়ায় সে,

“তুমি আমার হৃদয়ে অনুরাগে রাখা আস্ত এক অগ্নিকুণ্ডলি। যা আমায় কভু উষ্ণ রাখে, কভু পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয় ভিতরটা।”

“মিনার!”

তার ডাকে ছুটে আসে কক্ষে প্রবেশ করে খাঁস ভৃত্য। তরুণ আতঙ্কিত, অজান্তেই কোনো ভুল করল কি না কে জানে।

“আসসালামু আলাইকুম আমার শাহ! আমি দুঃখিত। আমার দ্বারা কোনো ত্রুটি সম্পন্ন হয়েছে কি?”

হেসে দেয় যুবক। না বোধক মাথা নাড়ায়।

“তেমন কিছু নয়। আমি চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছি তাকে জানাও, তৈরি হতে বলো। আজ তার সাথে আমি উত্তরের অরণ্যে ভ্রমণ করতে যাব।”

“যথা আজ্ঞা, জমিদার বাবু। আপনার স্নানের ব্যবস্থা করতে বলব খাদিমদের?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

মেহমাদ শাহের খবর পৌঁছে যায় যামিনীর নিকট। শ্রবণগত হলে সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

“কী বললে দাসী? পুনরায় উচ্চারণ করো তা।”

“জমিদার নবাব শাহ, আপনাকে তৈরি হওয়ার হুকুম জারি করেছে বেগম। আপনাকে নিয়ে সে বন ভ্রমণে যাবে।”

হাসি চলে আসে রমণীর। তার খিলখিল হাসির আলোড়নে আলোড়িত হয় প্রতিটি দেয়ালও। না কি অন্তরালে লুকিয়ে থাকা বেদনার সাক্ষী এই দেয়ালগুলো কেঁপে কেঁপে কাঁদছে কে জানে?

দিলরুবা পরিস্থিতি বোধ করতে পেরে দাসীটিকে চলে যাওয়ার আদেশ করে। তবে অবাককর হলেও সত্য এই প্রথম সে বা মোহিনী কেউই মনিবকে সান্ত্বনা দেওয়ার এক বিন্দু চেষ্টা অবধি করে না।

“আপনিও অদ্ভুৎ এক নাটকীয়তা দেখান বাবু মশাই। কখনও দূরে ফেলে রাখেন অযত্নে অপ্রয়োজনীয় কোনো বস্তুর ন্যায়, তো কখনও নিজের জীবনরত্নের নমনীয়তার সহিত আগলে রাখেন বক্ষপিঞ্জরে। এতোটা নাটকীয়তা কি মেনে যায় আদৌ?

আমি পারছি না আপনার উপর অন্ধ বিশ্বাস রেখে আপনার বলা পথে হাঁটতে। কারণ তাতে আমি আপনাকে নিজের নিকট ধরে রাখা তো দূরে থাক, নিজেকেই হারিয়ে ফেলব বলে মনে হচ্ছে। আপনাকে আমি ভাগ্যের জোরে পেয়েছিলাম তা ঠিক।

কিন্তুই বেগমের মর্যাদা, ক্ষমতা, এই খ্যাতি সব আমার অর্জিত। তা কখনোই কাউকে আমি নিতে দিব না।”

একদম নিচু কণ্ঠে একাকিই বলে যামিনী। উপস্থিত কেউই শুনতে পায় না তা।

“দিলরুবা আর মোহিনী, আমার নীল বর্ণের পোশাক ও সে রঙের পাথর যুক্ত গহনা বের করো পরিধান করার উদ্দেশ্যে।”

“জী, বেগম।”

যুবতী জমিদার গিন্নি তৈরি হয়ে নিল পছন্দ অনুযায়ী তার বাবু মশাইয়ের সাথে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে।

মেহমাদ শাহও তৈরি এর মাঝেই। সংবাদ পেয়ে নবাববাড়ির বাহিরে আসে যামিনী। সেখানে পূর্ব হতে ঘোড়া প্রস্তুত রেখেছে মিনার, তার প্রিয় পুরুষটিও হাসি মুখে দাঁড়িয়ে।

সে আসতেই দু’হাত ছড়িয়ে দেয়, যুবতী জড়িয়ে ধরে তাকে। যদিও তার অঙ্গভঙ্গিমার মাঝে আকাশ সম আড়ষ্টতা। যুবম হয়তো তা ধরতে পারে খাণিক হলেও।

“কী হয়েছে আমার সোনামুখী হরিণ? তুমি এমন উদাস ক্যানো?”

“তেমন কিছু নয়, বাবু মশাই। এই খাণিক মাথা ব্যথা।”

যামিনী স্বীকার না করলেও মেহমাদ শাহ বোধ করতে পারে তার এমন আচারণের কারণ। তবে সে বিষয়টি আর ঘাটায় না, বর্তমানে তার নিকট এই সময়টা উপভোগ করতে পারাই মুখ্য বিষয়।

“ঠিক আছে, আমার চন্দ্রমল্লিকা। তবে চলো, উঠা যাক আমাদের বাহনে।”

“হু।”

দু’জন এগিয়ে যায় ঘোড়াটির দিকে। খয়েরি রঙা ঘোড়াটি দেখতে ক্রোধ খাণিক মলিন হয় যামিনীর। এই ঘোড়াটির সাথে গত পাঁচ বছরের বহু মোহোণীয় স্মৃতি জুড়ে আছে, যেখানে সুখ এবং আনন্দ ব্যতীত কিছুই নেই।

এই ঘোড়ায় চড়ে মেহমাদ শাহ ও সে বন ভ্রমণে যেতো। তাকে কখনই একাকি পৃথক ঘোড়ায় চড়তে দেয়নি পুরুষটি। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না।

“জমিদার সাহেব! জমিদার সাহেব! থামুন!”

মেহমাদ শাহ নিজের প্রেয়সীকে ঘোড়ায় চড়তে সহায়তা করছে তখনই জনাব আরহান করিমের চেঁচানো কর্ণকুহরে পৌঁছায়। কাজ থামিয়ে স্থির হয় উভয় ব্যক্তি।

আরহান তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। এই মুহূর্ত জমিদার দম্পতির এই তরুণকে উটকো ঝামেলা বৈকী কিছুই মনে হচ্ছে না।

“আরহান করিম সাহেব, আপনি? আপনি এখানে কী করছেন?”

“এই মানে… তা বাদ দিন না। আগে বলুন আপনি কোথায় যাচ্ছেন? রমণীও দেখছি সাথে।”

এতোক্ষণে যামিনীর দিকে চোখ যায় আরহানের। তার মানুষটি বাকি সাক্ষাৎ হতে একটু কেমন যেন ভিন্ন লাগলেও মাথা ঘামালো না। বস্তুত, পূর্বেও ঢোলা বোরখা, নিকাব ও হিজাবে ঢাকা নারীকেই দেখেছিল সে, আজও তাই। সন্দেহ করার আর ক্ষেত্র নেই।

“আমি একটু বন ভ্রমণ করতে বের হচ্ছি। সন্ধ্যা নামার পূর্বে চলে আসবো। আপনার কোনো প্রয়োজন হলে যে কোনো খাদিমকে বলতে পারেন।”

“না, না, আমার আপনাকেই প্রয়োজন। আজ কষ্ট করে এই পরিকল্পনাটি ত্যাগ করুন। বেগমকে নিয়ে অন্য কোনোদিন বের হবেন। বেগম, আপনি বলেন না জমিদার বাবুকে।”

যামিনী কিছু বলবে তার পূর্বেই মেহমাদ শাহ বলে উঠে,

“না, সে আজ কথা বলতে পারবে না। তার জিভ পুড়ে গিয়েছে গরম চা পান করতে যেয়ে। আর আপনি যেহেতু এতো করে বলছেন, তবে আপনার কথাই থাক।”

তার কানের নিকটে ফিসফিস করে,

“তুমি কোনো কথা বোলো না চন্দ্রমল্লিকা। তোমার স্থান ত্যাগ করাই উত্তম।”

আহত চাহনি রমণীর। এতোটাই কী অযোগ্য সে! ক্রোধের অনলে পুড়ে সে। হনহন করে চলে যায়।

___

আঁধার রাত্রি, দু’জন ব্যক্তির মিলনায়তন হচ্ছে এক শূন্য কামরায়।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম। আপনার কথা অনুযায়ীই দশা এখন বেগম চন্দ্রমল্লিকার। খুবই সূক্ষ্মভাবে দেয়াল তৈরি করা হয়ে গিয়েছে তার আর জমিদার বাবুর মাঝে। লোহা গরম আছে এখনই হাতুড়ি মারা মুখ্যম সময়।”

“না, এখনও আরও সময় বাকি। তাকে আরও ক্রোধের নদে ডুবাতে হবে। অন্ধ করতে হবে ক্রোধে। তবেই না কোনো কিছু না চিন্তা করেই সে ধ্বংস ডেকে আনবে এই নবাব বংশের।”

“যথা আজ্ঞা, বেগম।”

“তবে তুমি সতর্ক থাকবে, তাদের ভুল বুঝাবুঝিত দেয়াল যেন কোনোক্রমে না ভাঙে। ধীরে ধীরে ক্রোধের বিষ ঢালবে তার কানে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না বেগম। আপনাকে অসন্তুষ্ট করার ভুল করব না আমি বা আমরা।”

রোহিণীর ঘুম আসছিল না বলে সে অন্দরমহলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ই এ সকল কথোপকথন শুনে ফেলে সে। আরও আঁতকে উঠে পরিচিত দু’টি কণ্ঠস্বর শুনে।

ঝুঁকি নিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রাখতেই আরও বিস্মিত। পরিচিত মুখশ্রী যে ভিন্ন রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে।

পালিয়ে দৌড়ে চলে যেতে নেয় সে। ধপাস করে পড়ে। অবশেষে বিষাক্ত মানুষ দুটিও দর্শন করে ফেলেছে তাকে।

অতঃপর একটি আঘাত, একটি চিৎকার ও একটি মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসছে।
৪৪ও৪৫|
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=323108853150541&id=100063542867943
চলবে…
দুঃখিত, তবে আমার কোনো দোষ নেই। আমার সাড়ে দশটাতেই লিখা শেষ। কিন্তু আমার আম্মাজান কথা বলা শুরু করসিল খালামনির সাথে তার মোবাইলে, আর কয়েকদিন ধরে যেহেতু ঘুম হচ্ছে না আমারও চোখ লেগে যায়। অতঃপর এই মাত্র উঠলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here