চন্দ্রমহল পর্ব-০৩

0
825

চন্দ্রমহল -০৩
৭.
বনলতার পরিচয় এই বাড়ির কেউ জানে না প্রমিলা ছাড়া। বনলতার বয়স যখন ৫ বছর তখন থেকে বনলতা চন্দ্রমহলে আছে।
দাসীদের সাথে একটা ঘরে থাকে বনলতা। তবে সে এই বাড়িতে দাসী নয়।সে থাকে তার মতো। অন্দরমহলের বাহিরে কেউ কখনো তাকে দেখেনি। এমনকি জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং এবং তার বড় দুই ছেলে প্রকাশ এবং প্রতাপ ও বনলতাকে দেখে নি।
প্রমিলার ঘরেই প্রভাত আর প্রলয় প্রথম বার দেখে বনলতাকে।
এক পলক দেখেই প্রলয় এলোকেশী এই মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় আর প্রভাত পড়ে যায় কামনায়।
সেই থেকে প্রভাতকে প্রায় সময় দেখা যায় হেঁশেলের আশেপাশে,অন্দরমহলে।

বনলতা সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথা ব্যথায় অবস্থা নাজেহাল। বিছানা থেকে উঠে বসলো বনলতা। তারপর নিজের দুহাত দিয়ে টেনে ধরলো মাথার চুল।
চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে বনলতার। কিন্তু তবুও করছে না।নিজেকে নিজে সামলানোর জন্য বারবার বলছে,”না বনলতা,এভাবে সামান্য মাথার যন্ত্রণার কাছে তুমি কাবু হতে পারো না।তুমি এর চাইতে কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করেছো সেই ছোট্ট বয়সে।৫ বছর বয়সে নিজের চোখের সামনে দেখেছো কি ঘটেছে সেদিন।এখন তোমার ২১ বছর বয়স।তুমি একজন বীরের মেয়ে,তোমাকে এভাবে হেরে যাওয়ায় মানায় না।এখনো অনেক পথ বাকী।”

তপ্ত দুপুরে করিডর উত্তপ্ত হয়ে আছে।গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। খাঁখাঁ করছে পুরো চন্দ্রমহল।
বনলতা ধীর পায়ে নিজের কক্ষ থেকে বের হলো।আশেপাশে কেউ নেই।হেঁশেলে বসে বামুন ঠাকুরেরা রান্না করছে।
বনলতার আবারও মনে পড়লো নিজের মায়ের কথা।কোথায় আছে মা?
এই চন্দ্রমহলের প্রতিটি কোণা বনলতা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কিন্তু পায় নি খুঁজে।১৬ বছর ধরে একটা মানুষকে লুকিয়ে রাখা নিশ্চয় চাট্টিখানি কথা না।অথচ জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং ছাড়া আর কেউ জানে না কোথায় আছে বনলতার মা স্বর্ণলতা।

৮.
প্রভাত নিজের কক্ষে বসে পান চিবুচ্ছে। পেশায় ডাক্তার হলেও তাকে হাসপাতালে দেখা যায় কম।আর গেলেও দেখা যায় নার্সদের সাথে রংতামাশা করছে বেশীর ভাগ সময়। প্রকাশ,প্রতাপ,প্রভাত তিন ভাই বাবার চারিত্রিক সব গুণাবলি পেয়েছে। নারীদেহের উপর লোভ তাদের রক্তের সাথে মিশে আছে।ব্যতিক্রম শুধু প্রলয়। সে সর্বদা গম্ভীর হয়ে থাকে।নিজের লেখাপড়া ছাড়া অন্যকিছুতে তার মন নেই।
অনেকক্ষণ ধরে প্রভাত ভাবছে কিভাবে বনলতাকে বাগে আনা যায়।
কিন্তু কিছুতেই পারছে না।

অবশেষে প্রভাতের মাথায় একটা নোংরা বুদ্ধি এলো।এই পৃথিবীতে একজন মানুষ আছে যাকে প্রমিলা দেবী কোনো ধমক দিয়ে রুখতে পারবে না।সে হলো জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং। বনলতা যদি একবার বাবার নজরে পড়ে যায় তবে আর চিন্তা নেই।এরপর বনলতার এই অহংকার থাকবে না আর।
যেই ভাবা সেই কাজ।প্রভাত এগুলো বাবার কক্ষের দিকে।
যেতে যেতে প্রভাত এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলো।

রাজেন্দ্র নারায়ণ তার খাসকামরায় বসে আছেন।সাধারণত এই কামরায় প্রবেশের অনুমতি কারো নেই একমাত্র রঙ্গনা ছাড়া। সপ্তাহে একদিন রঙ্গনা এই মহলে আসে।এসে সোজা জমিদারের খাসকামরায় ঢুকে যায়।
সেদিন সারাদিনে প্রমিলা নিজের কক্ষের দরজা খোলে না,খাবার খায় না,কারো সাথে কথা বলে না।

প্রভাত ডাকতেই রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং কক্ষ থেকে বের হলেন।কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আক্রমণের পর থেকে রাজেন্দ্র নারায়ণ যেনো অনেক অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন।

বাবা বের হতেই প্রভাত বললো,”আপনার সাথে কিছু কথা বলতাম বাবা।”

নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং বললেন,”পাশের বৈঠকখানায় গিয়ে বসো,আমি আসছি।”

প্রভাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাজেন্দ্র নারায়ণ এলেন সেখানে,চেহারায় ধরে রাখলেন কৃত্রিম গাম্ভীর্য। গমগমে স্বরে বললেন,”কি বলবে বলো।”

প্রভাত গলাখাকারি দিয়ে বললো,”বাবা আসলে বলতে চাচ্ছিলাম,আগামী এক সপ্তাহ পর আমাদের মহলে ইংরেজ সরকারের চারজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক মি. মার্টিন,মি.মার্গারেট,মি.উইলিয়াম নিকোলাস এবং মি.জোনাস বেড়াতে আসবেন।এরা সবাই পুরো দেশের রাজস্ব আদায় বোর্ডের সাথে জড়িত।
তাদের যদি আমরা খুশি করতে পারি বাবা,তাহলে সরকারকে আমাদের আর প্রতি মাসে এতো মোটা অংকের রাজস্ব দিতে হবে না।আপনি বুঝতে পারছেন বাবা এতে আমাদের কি পরিমাণ লাভ হবে?”

লোভে রাজেন্দ্র নারায়ণের চোখ চকচক করে উঠলো। ছেলের পাশে এসে বসে বললেন,”ওনাদের সম্মানে কিছু অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা তো করা উচিত। ”

প্রভাত বললো,”বাবা আমি আসলে বলতে এসেছিলাম,ওনাদের মনোরঞ্জন করার জন্য আরো কয়েকজন সুন্দরী যুবতী যদি আমরা বাগানবাড়িতে আনতে পারি তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে?”

রাজেন্দ্র নারায়ণ একমুহূর্ত ভেবে বললো,”হ্যাঁ,তা তো অবশ্যই করতে হবে।সেরা সুন্দরী দরকার হবে এই কাজের জন্য।”

প্রভাত বুঝতে পারলো রাজেন্দ্র নারায়ণ এবার আর তার কথা ফেলবেন না।

একটু থেমে বললো,”আমাদের মহলে একটা মেয়ে আছে বাবা,আপনি দেখতে পারেন একবার। তাকে রাখা যায় কি-না। ”
রাজেন্দ্র নারায়ণ চমকে তাকালেন ছেলের দিকে।তারপর বললেন,”বয়স কতো?”

প্রভাত বললো,”২০-২২”

এবার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেললেন।তারপর বললেন,”মহলে একটা নতুন মেয়ে আছে অথচ আমি জানি না কেনো এখনো?আমার কক্ষে তাকে ইতোপূর্বে দেখি নি কেনো?”

প্রভাত মাথানিচু করে বললো,”আসলে বাবা,মা ওই বনলতা মেয়েটাকে আপনার নজর থেকে দূরে রাখে।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন।তার নিজের স্ত্রী যেখানে জানে নতুন নতুন নারীদেহের উপর তার কতোখানি আগ্রহ,সেখানে সে এই মেয়েকে আড়ালে রাখলো!
ছেলের সাথে আর কথা না বলে প্রমিলার কক্ষের দিকে গেলেন তিনি।

৯.
প্রমিলা দেবী চুল বাঁধছেন বসে বসে।এই বয়সেও তার চুল যথেষ্ট লম্বা।রাজেন্দ্র নারায়ণ কক্ষে ঢুকে কক্ষের দরজা বন্ধ করে বললেন,”বনলতা কে?”

এই প্রশ্ন শুনে প্রমিলা দেবী যথেষ্ট অবাক হলেন।হাত থেকে ফসকে চিরনি পড়ে গেলো। সেই সাথে তার বুকের ভেতর এক কাঁপন শুরু হলো। তবে কি তিনি মেয়েটিকে আর রক্ষা করতে পারবেন না?

প্রমিলাকে চুপ থাকতে দেখে রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং আরো বেশি রেগে গেলেন। চিৎকার দিয়ে বললেন,”তোমার এতো বড় স্পর্ধা কবে হলো প্রমিলা?”

নিজেকে সামলে প্রমিলা দেবী বললেন,”মেয়েটি আমার আত্মীয়ের মেয়ে,তাই আমি চাই নি আপনি ওর সাথে… ”

প্রমিলা আর বলতে পারলো না।

রাজেন্দ্র নারায়ণ হাসলো,তারপর বললো,”ভয় পাও তুমি আমাকে প্রমিলা?
ডেকে আনো মেয়েটিকে। তারপর নিজের হাতে তাকে আমার কক্ষে দিয়ে আসবে সব বুঝিয়ে শিখিয়ে।আমি আমার কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করছি।”

তারপর নিজের দুজন পেয়াদাকে ডেকে বললেন,”তোমাদের গিন্নি মায়ের সঙ্গে যাও,মেয়েটা যেনো তোমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাতে না পারে।আমার কক্ষে যেনো আসে তোমার গিন্নি মায়ের সাথে।”

অভিজ্ঞ পেয়াদারা বুঝে গেলো জমিদারের অভিসন্ধি। ইশারায় মুচকি হেসে দুজনেই মাথা নুইয়ে সম্মতি দিলো।

পাথরের মূর্তির মতো প্রমিলা বসে আছে পালঙ্কে। সমস্ত বোধশক্তি যেনো লোপ পেয়েছে তার।জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ এসে ধমক দিতেই প্রমিলার ঘোর কাটলো।তারপর ভীত পায়ে এগুতে লাগলো।
তার ইচ্ছে হলো নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে ফেলতে বনলতাকে রাজেন্দ্র নারায়ণের হাতে তুলে দেবার আগে।

দুচোখ বন্ধ করে ঈশ্বরকে ডেকে বললেন,”মেয়েটাকে বাঁচাও ভগবান। জমিদার সুশান্ত সেনের স্ত্রী স্বর্ণলতাকে আমি কথা দিয়েছি এই মেয়েকে আগলে রাখার।
আমার কথার আমি বরখেলাপ করতে চাই না।আমার যে আর কোনো উপায় ও নেই।”

বনলতা স্নান করে এসেছে সবেমাত্র। পরনে বেগুনি রঙের তাঁতের শাড়ি।খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে নিজের কক্ষের সামনে। দুপায়ে আলতা দেওয়া। এক নজর তাকাতেই প্রমিলার মনে হলো এই যেনো সাক্ষাৎ প্রতিমা।কিভাবে তিনি তাকে তুলে দিবেন জমিদারের হাতে?
নিরবে অশ্রুপাত করলেন প্রমিলা।
তারপর বললেন,”বনলতা। ”

বনলতা চমকে তাকালো। তারপর প্রমিলাকে দেখে হেসে বললো,”কি গিন্নিমা?”

চোখ বন্ধ করে প্রমিলা বললো,”আমার সাথে আয়।”

“আসছি” এই বলে বনলতা নিজের কক্ষে গেলো এবং সাথেসাথে ফিরে এলো চুল বাঁধার জন্য একটা কাঠি হাতে নিয়ে।খোপায় কাঠি আটকাতে আটকাতে বললো,”কি হয়েছে গিন্নিমা?”

প্রমিলা তার জবাব দিলেন না আর।

চলবে…..

জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here