চন্দ্ররঙা প্রেম_২ পর্বঃ১৬

0
722

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৬
#আর্শিয়া_সেহের

সেদিনের পর ছয়দিন কেটে গেছে। আজ পুনমের গায়ে হলুদ। রুশান সকাল থেকেই দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এই ছয়দিনে সে অনেক চেষ্টা করেছে পুনমের বিয়ে ভাঙার কিন্তু বিবেকে সায় দেয় নি। পুনমের উডবির ব্যাপারেও কোনো তথ্য পায় নি রুশান। ভেবেছিলো ছেলেটার সাথে কথা বলে বিয়েটা আটকাবে কিন্তু ছেলের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। শুধু ছেলের ছবিটাই দেখেছে । এতো দিনে কেসটাও ক্লোজ হয়ে যেতো কিন্তু রুশানের কোনো কিছুতেই মন বসছে না। সে পুনম ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না।

পুনম সেদিন রাতে রুশানকে কল করেছিলো কিন্তু রুশান‌ রিসিভ করে নি। পরে তনিমের থেকে শুনেছে যে রুশান সবটা নিজ কানে শুনে গেছে । অঝোরে কেঁদেছিলো পুনম তখন। সেই রাতেই পুনম তনিমের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো। তারপর থেকে পুরোপুরি ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে পুনম। সারাক্ষণ ফোনে তার আর রুশানের কাপল পিক দেখেই তার দিন কাটে।

তনিম ভোরেই চলে এসেছে শানদের বাড়িতে। এই কয়দিনে সেও‌ রুশানের সাথে চেষ্টা করেছে পুনমের হবু বরের সাথে কথা বলার কিন্তু ফলাফল শূন্য। ছেলের পরিবারের সবার সাথে শুধু ফোনেই কথা হয়েছে। তারা একবারে বিয়ের দিনে আসবে এমনটাই কথা হয়েছে। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় যেন আন্ডারওয়ার্ল্ড ফ্যামিলি।
তনিম অয়েকবার রুশানকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে এসে সোফায় বসেছে। পুনমের গায়ে হলুদ বা বিয়ে কোনোটাতেই থাকার ইচ্ছে নেই তার। যদিও রুশান তাকে বলেছে থাকতে।

সোফায় তনিমের অপজিটে রুমঝুম আর বিথী বসে আছে। শান্ত তনিমের পাশে বসে আছে। রুশানের এই দৈন্য দশা দেখে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে শান্ত। সকাল দুপুর রাতে, যখনই রুশানকে দেখে তখনই কাঁদে শান্ত। শান্তর কান্না দেখে রুশান যখন হেঁসে ফেলে তখন শান্ত চেঁচিয়ে কান্না করে‌। রুশানকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে শান্ত। রুশানের কষ্টটা যেন ওকেই বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

শান খানিকটা পরে নিচে এলো । তনিমকে দেখে বললো,
-“তোমার শালির বিয়ে আর তুমি এখানে কি করছো? যাও যাও বিয়ের কাজ করো।”
তনিম মুখ অন্ধকার করে বললো,
-“এভাবে বলবেন না ভাইয়া। আমার কাছে পুরো দুনিয়া এক দিকে আর আমার স্যার একদিকে। আমি স্যারকে এভাবে রেখে শালির বিয়েতে কখনই যাবো না।”

শাফিয়া আক্তার শানের খাবার টেবিলে রেখে এগিয়ে এসে বললেন,
-“রুশানের মতো সোনার টুকরো ছেলে রেখে কার সাথে বিয়ে দিচ্ছে ওই মেয়ের ?”
তনিম কিছু বললো না। বলবেই বা কি? ছেলের ব্যাপারে কিছু জানেই তো না।
রুমঝুম তনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আচ্ছা তনিম, পুনমের উডবির ছবি আছে তোমার কাছে?”

তনিম কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-“হ্যাঁ হোয়াটসঅ্যাপে আছে মনে হয়। পিহুর মামা পাঠিয়েছিলো দেখার জন্য।”
-“আমাকেও দেখাও তো।”
তনিম ছবিটা বের করে রুমঝুমের হাতে দিলো। ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম। এমন ছেলেকে যে কোনো পরিবার তাদের মেয়ের জন্য পছন্দ করবে।
রুমঝুম হালকা হেঁসে বললো,
-“ভালোই তো।”
রুমঝুমের পাশ থেকে বিথী উঁকি মারলো স্ক্রিনে। সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠলো তার। খানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
-“রায়হান। এটা তো রায়হান। রাশেদ এর ভাই। এই ছেলেটার সাথে বিয়ে হবে পুনম মেয়েটার? ওর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। এই ছেলে অনেক খারাপ। বাজে চরিত্র। এই বিয়ে আটকাও। দরকার হলে মেয়েটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলো তবুও নরকে পাঠিও না।”

বিথীর চিৎকার শুনে শান উঠে এলো। শাফিয়া আক্তার,রুমঝুম আর তনিম তিনজনই হতভম্ব হয়ে গেছে। তনিম মিনমিন করে বললো,
-“তাহলে আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। আন্ডারওয়ার্ল্ড পরিবার বলেই হয়তো সামনে আসে না।”
শান রুমঝুমের হাত থেকে ফোন নিয়ে ছেলেটাকে দেখলো। বেশ কিছুক্ষণ পরখ করে বললো,
-“ছেলেটা যেন তেন ছেলে না। বুদ্ধিমান ছেলে মনে হচ্ছে। তনিম তুমি সবটা রুশানকে বুঝিয়ে বলো। আজকের দিনটা এভাবে যাক। কাল বিয়ের আসরেই ড্রামা স্টার্ট করা যাবে।
আর রুশানকে একা ছেড়ো না। এমনিতেই ওর মাথা খারাপ হয়ে আছে। কখন কি করে ফেলবে টের পাবো না। সবকিছু ঠিকঠাক সামলে রেখো।”

শানও এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। আর যাই হোক পুনমের বিয়েটা নিশ্চিত ভাঙবে আর রুশানটাও আগের মতো স্বাভাবিক হবে এটা ভেবে।
বিথী অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। প্রায় এক সপ্তাহ পর আবার একটা পশুর ছবি দেখে ওর অতীতটা একে একে ঘুরছে মাথায়। শাফিয়া আক্তার বিথীকে সোফায় বসিয়ে পানি খাইয়ে দিলো। শান্ত তনিমের আগেই লাফাতে লাফাতে রুশানের ঘরের সামনে চলে গেছে সবকিছু বলতে। তার রুশান ভাইয়ের ক্লান্তিমাখা মুখটাতে হাঁসি দেখেনি যেন কতকাল হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই খবরটা পেয়ে হাসবে সে।

শান অফিসের জন্য বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“সবাই তৈরি হয়ে পুনমের হলুদে যাও। বেচারি এমনিতেই অনেক কষ্টে আছে।
আর আগামী পরশু তিহান আসছে দেশে। আগেই জানিয়ে রাখলাম।”

তিহানের নামটা শুনে বিথীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। এই একটা মানুষ বিথীর আগাগোড়া অস্তিত্ব দখল করে আজও আছে। রাশেদের দেওয়া কষ্টগুলো তিহানের কথা আরো বেশি মনে করিয়ে দিতো বিথীকে। বারবার মনে হতো তিহানের উপর রাগ করে সে নিজেই নিজের এতো বড় সর্বনাশ করেছে।
সেদিনের পর কতগুলো বছর কেটে গেছে। সে তিহানকে দেখেনি,তার কথা শোনে নি, তার নামটাও উচ্চারন করেনি কেউ তবুও মানুষটা তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ‘ভালোবাসা, ভালোবাসা’ – বিথী দুই তিন বার মনে মনে আওড়ালো শব্দটা। আবার নিজ মনেই ব্যর্থতার হাঁসি হেঁসে বললো, ‘ভালোবাসা না একতরফা ভালোবাসা।’

শান্তর চেঁচামেচি শুনে তনিম পেছন দিকে তাকালো। রুশান হাতে একটা টিশার্ট নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছন পেছন শান্ত চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে,
-“দাঁড়াও রুশান ভাইয়া, দাঁড়াও। এতো তড়িঘড়ি করে কিছু করো না। হিতে বিপরীত হবে নইলে।”
তনিম এক লাফে সোফা থেকে উঠে এসে রুশানকে ধরলো। রুমঝুমও রুশানের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করলো। শাফিয়া আক্তার শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই ছেলেটা বেশি পাকা। তোকে কে বলেছে এখনই ওকে সবটা জানাতে? ছোট মানুষ, ছোট মানুষের মতো থাকতে পারিস না?”

শান্ত মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে তো শুধু রুশান ভাইয়ের হাঁসি মুখটাই দেখতে চেয়েছিলো।
রুশান শান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। তনিমের হাত ছাড়িয়ে শান্তর কাছে এসে দাঁড়ালো। সবার দিকে একপলক তাকিয়ে শান্তকে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো।
সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুশানের দিকে। চুলের উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে তার। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। কত রাত ঘুম বিসর্জন দিয়েছে কে জানে? মুখটাও ফুলে আছে।

রুমঝুম রুশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তনিম এসে দাঁড়ালো রুশানের পেছনে। রুশান ধীরে ধীরে মাথা তুলে রুমঝুমের দিকে তাকালো। বোনের দু’চোখ যেন উত্তাল যমুনা। যেকোনো সময় বাঁধ ভাঙবে।
রুশান হেঁসে ফেললো রুমঝুমকে দেখে। মেয়েটা এত্তো কেন কাঁদে তা বুঝতে পারে না রুশান।
রুশানের হাঁসি দেখে রুমঝুম মুখ ফিরিয়ে নিলো। সাথে সাথেই দু’চোখ বেয়ে টুপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রুমঝুম অভিমানী কন্ঠে বললো,
-“আমাদের কথা তো ভুলেই গেছিস তুই। তোর এমন অবস্থা দেখে বাকিদের কেমন লাগছে সেটা তো দেখতে বা জানতে ইচ্ছে করে না তোর। আজকে পুনমের উডবির ব্যাপারে না জানলে তো‌ আজও দেখতে পেতাম না তোকে। স্বার্থপর কোথাকার। কারো কথা ভাবিস না।”

রুশান আলগোছে রুমঝুমের হাত ধরলো। সোফা থেকে উঠে নিজের জায়গায় বসালো রুমঝুমকে। রুমঝুমের দুই হাত নিজের গালে রেখে বললো,
-“আমার দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটি তুমি,আপু। আমি এখন স্বার্থপরের মতো আচরণ করেছি আমি জানি। কিন্তু একটা কথা কি তুমি জানো? ”
রুমঝুম রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে। রুশান হেঁসে বললো,
-“আমি সবচেয়ে বড় স্বার্থপর হই আমার আপুর বেলায়।”

রুমঝুম মুচকি হাসলো। রুশানের গাল থেকে বাম হাতটা সরিয়ে চোখ মুছলো। সোফা থেকে উঠে বললো,
-“এখন এতো মিষ্টি কথা বলতে হবে না। তনিমের সাথে কালকের সব প্ল্যান গুছিয়ে নে। আমি তোদের খাবার রেডি করি।”
রুমঝুম যেতেই বিথীও উঠে পড়লো। সাথে সাথে রুশান বললো,
-“আপু আপনি যাবেন না প্লিজ। আপনাকেও প্রয়োজন এই প্ল্যানে। আমাদের কাছে আপনার স্বামী রাশেদের ব্যাপারে প্রমান থাকলেও আপনার দেবরের ব্যাপারে কোনো প্রমান নেই যার প্রেক্ষিতে তাকে আমরা কিডন্যাপ করবো। তাই আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।”

বিথী হালকা হেঁসে বসে পড়লো। ব্যথিত কন্ঠে বললো,
-“আমি তোমাদের সব রকমের সাহায্য করবো। বলো কি করতে হবে?”

রুশান,তনিম বিথীকে সাথে করে নিয়ে পুরো প্ল্যান করে ফেললো। শান্তর জোরাজুরিতে তাকেও প্ল্যানে শামিল করতে হলো। সে কোনো কথাই শুনলো না।
তনিম রুশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“স্যার, আমাদের প্ল্যান যদি সফল না হয় তাহলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। পুনমের জীবনটাও শেষ হয়ে যাবে। ”

বিথীও তনিমের কথায় সায় জানালো। চিন্তিত গলায় বললো,
-“সত্যিই অনেক বড় সমস্যা হবে যদি রায়হান আমাদের ফাঁদে পা না দেয়। ও কিন্তু গভীর জলের মাছ। খুবই সতর্ক।”

রুশান আনমনে বললো,
-“আমি জানি না কি হবে। সবটাই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম। চেষ্টা তো করতে হবে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”

তাদের কথার মধ্যেই রুমঝুম খাবার খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। রুশান আর তনিম উঠে গেলো খেতে। বিথী উঠে মেয়ের কাছে গেলো।
রুশান আর তনিমকে খেতে দিয়ে রুমঝুম বললো,
-“আমি পুনমের গায়ে হলুদে যাবো। দাওয়াত যেহেতু আছেও তো মিস করবো কেন?”

রুশান পরোটা চিবুতে চিবুতে আড়চোখে তাকালো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম ঠোঁট চেপে হাসছে। তনিম খেতে খেতে বললো,
-“আমি যাবো আপু। আপনি রেডি হয়ে নিন। একমাত্র শালিকার গায়ে হলুদ মিস করা যায় নাকি?”

রুশান চুপচাপ খাচ্ছে। সে ভালোই বুঝতে পারছে এরা দুজন ওকে রাগাচ্ছে। রুশান একমনে খেয়েই চলেছে। অনেকদিন হলো ঠিক মতো খেতে পারে না সে। আজ মনটা বেশ শান্তি পাচ্ছে। তবে কোথাও ভয় রয়েই যাচ্ছে। যদি প্ল্যান সফল না হয় তাহলে পুনমকে হারিয়ে ফেলবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে। যতবার এমনটা ভাবছে ততবারই মেরুদন্ড বেয়ে নেমে যাচ্ছে এক শীতল স্রোত।

শান্ত চুপচাপ বসে আছে। মনে মনে ভেবে ফেলেছে কাল একটা ছুড়ি নিয়ে যাবে লুকিয়ে। তাদের প্ল্যানিং সফল না হলে সবার সামনেই ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলবে ওই লোকটাকে। পুলিশে ধরলে ধরুক। তারপর খবরের চ্যানেল, পেপারের হেডলাইনে উঠে আসবে তার ছবি আর নাম। তার জন্য সবাই ফেমাস হয়ে যাবে।
উর্বিন্তাও নিশ্চয়ই দেখবে তাকে। কাল একটু বেশিই স্টাইলিশ হয়ে যেতে হবে। ছবি খারাপ আসলে চলবে না। উর্বিন্তার চোখে তাকেই সবচেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম হতে হবে। উর্বিন্তা তাকে টিভিতে দেখে অবশ্যই আবেগাপ্লুত হয়ে ছুটে আসবে পুলিশ স্টেশনে তার সাথে দেখা করতে।

‘পুলিশ স্টেশন’ কথাটা মাথায় আসতেই শান্তর সমস্ত ভাবনা উধাও হয়ে গেলো। মানে সে ফেমাস হওয়ার সাথে সাথে একজন আসামিও হয়ে যাবে সেই ব্যাপারটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। একজন আসামিকে উর্বিন্তা ভালোবাসবে না আর উর্বিন্তার বাবাও মেনে নিবে না জামাই হিসেবে, তা শান্ত জানে। তাই খুন করার প্ল্যান বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার চিন্তায় ডুব দিলো‌ শান্ত।

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি এখনো শিওর না পুনমের বিয়ে ভাঙবো‌ নাকি ভাঙবো না 🐸)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here