চলো ভিজি বৃষ্টিতে পর্ব-২২

0
913

#চলো_ভিজি_বৃষ্টিতে
#Tanjima_Islam
২২
.
.
.
.
.
এ.আর. কোম্পানির অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া।
আজকের পর আর কখনও এখানে আসবেনা সে।

লিফটে উঠতে গিয়ে, সেদিনের ঘটনা মনে পড়ল রিয়ার। এই লিফটে ওঠা নিয়ে কি বিপাকেই না পড়েছিলো সে! ভাবতেই হেসে ফেলল রিয়া।

লিফট থেকে বেরিয়ে আরহামের কেবিনের দিকে যাচ্ছে সে।
চিত্রা ফোনে ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলে রিয়াকে দেখে বলল, ” আরে রিয়া! তুমি আজ অফিসে!!? তোমারতো কদিন বাসায় রেস্ট নেওয়া উচিৎ ছিলো!!!

রিয়া স্মিত হেসে কিছু বলতে গিয়ে মনে পড়ল, তার তো মেমোরি লস হয়ে গেছে!
অতএব আরহামের সাথে রিলেটেড সব কিছুই সে ভুলে গেছে!!

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিয়া জিজ্ঞেস করল, ” স্যরি! ঠিক চিনলাম না!!

চিত্রা প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও মনে পড়ল রাফাত স্যার বলেছিলো রিয়ার মেমোরি লসের কথা!

চিত্রা হেসে বলল, ” তুমি তো এই অফিসে জব করো, আমার এসিস্ট্যান্ট তুমি! আমার নাম চিত্রা!!

রিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল, ” ও আচ্ছা! তো চিত্রা!! আমি একটু আরহাম স্যারের সাথে দেখা করতে চাই, ওনার কেবিনটা কোন দিকে!?

চিত্রা ডিরেকশন বলে দিতেই রিয়া দ্রুত পায়ে চলে গেল।
চিত্রা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” আহারে বেচারি! এতো অল্প বয়সে মেমোরি লস হয়ে গেল!! অবশ্য এতে আমারই ভালো হয়েছে!!!
.
.
.
.
.
আরহামের কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া।
মনেমনে বলছে,” কাম অন রিয়া! বি ব্রেভ!! তোকে পারতেই হবে!!!

লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে দরজায় নক করল রিয়া, ভেতর থেকে আরহাম বলল, ” কাম ইন।

রিয়া দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, আরহাম ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল।

ডিপ বেগুনি রঙের শর্ট গাউন পরেছে রিয়া, চুল গুলো ছেড়ে রেখেছে, আরহাম সেই প্রথম দিনের মতো রিয়াকে দেখে আবারও ক্রাশ খেলো!

রিয়া যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ব্যাগ থেকে রেজিগনেশন লেটারটা বের করে এগিয়ে ধরল আরহামের দিকে।

আরহাম সম্বিৎ ফিরে জিজ্ঞেস করল, ” কি এটা!?

রিয়া লেটারটা আরহামের সামনে রেখে বলল, ” আমার রেজিগনেশন লেটার!

আরহাম ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, ” কিন্ত কেন!?

রিয়া বলতে গিয়ে থেমে গেল, কি বলবে সে! মনেমনে বলছে,” ওহ শিট! কি বলবো এখন, কেন রিজাইন দিচ্ছি!! আমার তো মেমোরি লস হয়ে গেছে, তাহলে সেদিনের ঘটনার জন্য জব ছাড়ছি সেটাও তো বলা যাবে না!!! উফফ রিয়া উফফ, তুই আসলেই একটা গাধী!!!!

আরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে, রিয়া আমতাআমতা করে বলল, ” আমার ফিয়ান্সে চায় না আমি জব করি!

রিয়া মনেমনে খুশি হয়ে বলল, ” বাহ রিয়া! ইউ আর সো ইন্টেলিজেন্ট!

আরহাম কিছুক্ষণ রিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ” বসো আসছি।
.
.
.
.
.
রিয়া একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, বেশ কিছুক্ষণ পর আরহাম একটা ফাইল নিয়ে এসে রিয়ার সামনে রাখল।

রিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ” আমি মেবি আপনাকে বোঝাতে পারিনি! আমি রিজাইন দিচ্ছি মি. আরহাম, আপনি আমাকে ফাইল কেন দিচ্ছেন!?

আরহাম বাকা হেসে বলল, ” এটা কোম্পানির রুলসের ফাইল!

রিয়া বুঝতে পারছেনা আরহাম কি করতে চাচ্ছে, ফাইল খুলে যা দেখল তা পড়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল রিয়ার!

আরহাম চেয়ারে হেলান দিয়ে রিয়ার দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলছে,” এবার দেখি, তুমি আমার থেকে কিভাবে পালাও! উডবি মিসেস রহমান!!

রিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, ” এসবের মানে কি!? রিজাইন দিতে হলে আগে দশ লক্ষ টাকা দিতে হবে!!

আরহাম হেসে বলল, ” তুমি মেবি ভাল করে পড়োনি, কোম্পানিতে আসা নিউ এমপ্লয়িদের কেউই একবছর এর আগে সেচ্ছায় জব ছাড়তে পারবে না। তবে হ্যাঁ, একবছর পর যেতে পারবে।

রিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” একবছর!?

আরহাম মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বলল, ” তুমি অফিসে জয়েন করেছো মেবি সাত মাস হতে যাচ্ছে। আর বাকি মাত্র পাঁচ মাস! এই পাঁচ মাস জব করো, তাহলেই হয়ে গেল!!

রিয়া হেসে বলল, ” পাঁচ মাস! নো ওয়ে!! সামনের মাসে আমার বিয়ে, তারপরের মাসে আমি কানাডা চলে যাবো!!! তখন আমি জব করতে আসবো কিভাবে মি. আরহাম!!!?

রিয়া দুহাত দিয়ে ওড়ার মতো করে আবার বলল,” উড়ে উড়ে আসবো!!!!?
.
.
.
.
.
আরহামের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে, মনেমনে বলছে, ” এহহ! ফাইয়াযকে বিয়ে করার জন্য কেমন লাফাচ্ছে দেখো!! ওয়েট তোমার একটা ব্যবস্থা করছি আমি!!!

আরহাম রিয়ার রেজিগনেশন লেটারটা নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,” সেটা আমি কিভাবে জানবো মিস রিয়া! তোমার কাছে দুটো অপশন আছে, একটা চুজ করো!! ব্যস!!!

রিয়া হালকা চেচিয়ে উঠলো, ” মানি না আমি! এসব কোন দেশের নিয়ম হ্যাঁ !!?

আরহাম এবার বেশ মুড নিয়ে বলল, ” মানতে হবে না, ক্যাশ পে করে রিজাইন দাও! নো প্রব্লেম!!

রিয়া দাতে দাত পিষে বলল, ” আপনার এতো বড় কোম্পানি থাকতে দশ লক্ষ টাকা নিয়ে কি করবেন শুনি!

আরহাম টেবিলের দুপাশে হাত রেখে রিয়ার দিকে ঝুকে বলল,” কোম্পানির ওউনার কেন কোম্পানির দশ লক্ষ টাকা লস হতে দেবে শুনি! তুমি তো দেখছি আমার কোম্পানি ভাসিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করছো!!

রিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল,” ঠিকাছে ঠিকাছে, আপনার টাকা পেয়ে যাবেন।
বলেই গটগট করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রিয়া।
আরহাম রিয়ার যাওয়ার পথে তাকিয়ে মনেমনে বলল, ” আমার তো শুধু তোমাকে চাই, রিয়া!
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
অনেক খুজে খুজে ফাইয়াযের ফেসবুক আইডি পেয়েছে আরশি।
কভারে কানাডার একটা মিউজিয়ামে তোলা ছবি দেওয়া।
প্রোফাইলে দেওয়া ফাইয়াযের হাস্যজ্বল ছবিটা মন কেড়েছে আরশির।
.
.
.
হটাৎ ফোনের রিংটোন পেয়ে ফোনস্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল তার মা কল দিয়েছে!

কল রিসিভ করতেই আরশির আম্মু মিসেস আয়েশা বলল,” কিরে কি করছিস!?

আরশি স্মিত হেসে বলল, ” এই তো বসে আছি, তুমি কেমন আছো মম!?

মিসেস আয়েশা অভিমানী সুরে বলল,” কেমন আর থাকবো, মাকে তো দেখছি ভুলেই গেছিস!?

আরশি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,” উফফ মম, সেদিনই তো কথা বললাম।

মিসেস আয়েশা হেসে বলল, ” হুম হয়েছে হয়েছে। যাইহোক আরহাম কেমন আছে!?

আরশি বলল,” ভাইয়া আছে ভালো। আংকেল রফিক কেমন আছেন!?

মিসেস আয়েশা হালকা ধমক দিয়ে বলল, ” আরশি! উনি তোর বাবা হন!! তোকে কতবার বলেছি, ওনাকে বাবা ডাকতে!!!

আরশি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ” ওহ প্লিজ মম! আমি ওনাকে বাবা ডাকতে পারবোনা!! আমার বাবা আশফাক রহমান, আর আমি তার মেয়ে!!! আর নেক্সট টাইম এসব নিয়ে আমাকে বলতে আসবেনা।

বলেই কল কেটে দিল আরশি, ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
আরহামের বাবা আর আরশির মায়ের ডিভোর্সের পর আরশির মা বিয়ে করে বিজনেসম্যান রফিককে।
কিন্ত আরশি কখনই রফিককে বাবা হিসেবে মেনে নেয়নি।
সেজন্য ছোট থেকেই মায়ের সাথেও সম্পর্কটা খুব একটা ভাল ছিলোনা তার।
আবার তার এমন মিসবেহেভের জন্য রফিকের সাথেও আয়েশার প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকতো।
রফিক চাইতো আরশিকে আশফাকের কাছে পাঠিয়ে দিতে। কিন্ত আয়েশা মেয়েকে ছাড়তে নারাজ।
সুইডেনে মায়ের সাথে থেকেও প্রচন্ডরকম একাকিত্বে ভুগতো আরশি।
সবসময় বাবা আর ভাইয়াকে মিস করতো সে।

সেসব দিন গুলো মনে পড়তেই চোখের বাধ ভেঙে পড়ল আরশির।
হাটুতে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাদতে লাগল সে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
ঘড়িতে সন্ধ্যা ছটা বাজে, কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলল আফসা।

রিয়া এসেছে! আফসা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ” এতক্ষণে এসেছিস!

রিয়া ভেতরে ঢুকে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ” কেন রে!? তোকে ভূতে তাড়া করছিলো নাকি!?

আফসা দরজা লক করে বলল, ” ভূতে না রে, মানুষে তাড়া করছে!

রিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” মানে!? কে তাড়া করছে!!? কি করেছিস সত্যিই করে বল।
.
.
.
.
.
আফসা রিয়াকে কিচেনে এনে সব খুলে বলল। রিয়া সব শুনে হেসে বলল, ” বাব্বাহ! তা কি কি রান্না করছিস দেখি।

আফসা মাথা চুলকে বলল, ” খিচুড়ি আর গরুর মাংস ভুনা রান্না করতে চাচ্ছি। বাট ভয় হচ্ছে, না জানি কেমন হবে। যদি রান্না ভাল না হয়!!

রিয়া হেসে বলল, ” আরে এতো টেনশন নিচ্ছিস কেন!!? ইউটিউব আছে কি করতে, আর আমি তো আছি। ঠিক সব ম্যানেজ করে নেবো।

রিয়ার কথায় আফসা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে, রিয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল, ” সে যাইহোক, এতকিছু হয়ে গেল!! অথচ তুই আমাকে কিচ্ছু বলিস নি!!!

আফসা ছুরি দিয়ে মাংস কাটতে কাটতে বলল, ” তোকে বলেছিলাম, কিন্ত তোর মনে নেই।

রিয়া মুখ ভেংচি কেটে বলল, ” হুহ, বলেছিলি শোভনকে লাইক করিস। বাট তলেতলে যে এতো কিছু হচ্ছে তাতো বলিস নি!

আফসা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” তোর মনে আছে!?

রিয়া চুপ মেরে গেল, বকবক করতে করতে কি বলছে না বলছে কোনো হুস নেই তার।

জোর করে হেসে বলল, ” মনে না থাকার কি আছে আজব! আচ্ছা বাদ দে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর একসাথে রান্না করবো।

বলেই কিচেন থেকে কেটে পড়ল রিয়া, আফসা কিছুক্ষণ হাবলার মতো তাকিয়ে থেকে মাংস কাটায় মন দিল।
.
.
.
.
.
আফসার পাঠানো লোকেশনের এরিয়ায় এসে নামল শোভন।

কিন্ত এখানে কোন বাড়িটা ঠিক বুঝতে পারছেনা সে। ভুল লোকেশনে চলে এলো নাতো!

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কল দিল আফসাকে। রিং বেজেই চলেছে কেউ রিসিভ করছেনা!!

হটাৎ খেয়াল করল সামনের একতলা বাড়ির গেটে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে ঘেউঘেউ করছে।

শোভনের আবার কুকুর বিড়ালে ফোবিয়া আছে, ভুলেও এগুলোর ধারে কাছেও ঘেষেনা শোভন। নিজেকে শান্ত রাখতে পায়চারী করতে লাগল সে, এদিকে আফসাকে কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্ত কল রিসিভ করছেনা!

এদিকে কুকুরটাও যেন চেচিয়ে মরছে, শোভন মনেমনে বলল, ” এবারই লাস্ট, কল ধরলে ভালো, না ধরলে আমি চললাম।

বলেই কল দিল শোভন, কুকুরটা ঘেউঘেউ করেই চলেছে!
.
.
.
.
.
আফসা কিচেন থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখল তার ফোন বাজছে!

ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই খেয়াল করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে কল রিসিভ করল আফসা।

কল রিসিভ করতেই শোভন বলল, ” কই থাকেন!? সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি!! এবার না ধরলে তো চলেই যেতাম!!!

আফসা বিনয়ী সুরে বলল, ” আ’ম সো স্যরি। আসলে ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই। বাই দ্যা ওয়ে আপনি এখন কোথায়?

শোভন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ” সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।

আফসা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, ” মানে!?

শোভন কুকুরটাকে একবার দেখে একটু সরে দাড়ালো। ফোনে লোকেশনটা আবার দেখে বলল, ” আপনাদের এলাকায় তো এসে গেছি, বাট বাসা চিনতে পারছিনা!

এদিকে কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দে আফসা ঠিকমতো কিছু বুঝতে পারছেনা।
শোভনের তো প্রাণ যায়যায় অবস্থা, ভয়েভয়ে বলল,” আপনার বাসাটা কোন দিকে তাড়াতাড়ি বলুন না!

আফসা যেই বাসার অ্যাড্রেস দিল, তা শুনে পিলে চমকে উঠল শোভনের।
কুকুরটা যেই বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে ওটাই সেই বাসা!

আফসা ফোন রাখতে রাখতে বলল, ” আচ্ছা আপনি আসুন তাড়াতাড়ি, কিচেনে অনেক কাজ বাকি! আমি রাখছি!!

বলেই কল কেটে দিল আফসা, শোভন ধীর পায়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল, কুকুরটা গরগর করে শব্দ করছে!
.
.
.
.
.
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here