চলো ভিজি বৃষ্টিতে পর্ব-৩৭

0
2883

#চলো_ভিজি_বৃষ্টিতে
#Tanjima_Islam
৩৭
.
.
.
.
.
এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে হন্তদন্ত হয়ে আরশিকে খুজে বেড়াচ্ছে ফাইয়ায!
দুপুর একটা পঞ্চাশ এ আরশির সুইডেন যাওয়ার ফ্লাইট!!
ঘড়িতে একটা সাতচল্লিশ বাজে!!! এতক্ষণে নিশ্চয়ই প্লেনে উঠে গেছে আরশি!!!!

গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম ছেড়ে ছুটে এসেছে ফাইয়ায! রাগে ক্ষোভে মাথার চুল ছিড়তে মন চাচ্ছে তার, কেন যে আরহামকে থ্রেট দিয়েছিল!!

একেবারে লাস্ট টাইমে এসে আরহাম জানালো আরশি তার মায়ের সাথে আজ দুপুরের ফ্লাইটে সুইডেন চলে যাচ্ছে!!!

দিশেহারা অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে হটাৎ কারোর গলা খাঁকারি শুনে পেছনে ফিরল ফাইয়ায।
ব্ল্যাক কালারের অফশোল্ডার টপস আর জিন্স পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরশি!
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা ফাইয়ায!! খুশিতে আত্নহারা হয়ে জড়িয়ে ধরল আরশিকে!!!

আরশির মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটল না, ফাইয়ায শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আরশিকে।
যেন আরশিকে পেয়ে দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে তার!

মিসেস আয়েশার ডাক পেয়ে আরশিকে ছেড়ে দাড়ালো ফাইয়ায।
মিসেস আয়েশা স্মিত হেসে বলল, ” প্লেনে ওঠার কিছুক্ষণ আগেই কল দিয়েছে আরহাম!

ফাইয়ায মাথা চুলকে আরশিকে বলল, ” তাহলে চলো, এবার বাসায় যাই!

আরশি মুখ ভেংচি কেটে বলল,” কথা বলবানা আমার সাথে!

বলেই গটগট করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেল আরশি আর মিসেস আয়েশা! ফাইয়ায হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আরশির যাওয়ার পথে!!
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
গা ভর্তি ফুলের গয়না আর কাচা হলুদ শাড়ি পরে নিজের রুমের বেডে বসে আছে রিয়া।
ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা বাজে, আজ সন্ধ্যায় তার হলুদের প্রোগ্রাম ছিলো।
এখনও হলুদের সাজ রেখে ফ্রেশই হতে পারেনি সে।

সারাদিনের ধকল শেষে এখন বাবা-মায়ের প্রশ্নের মুখে বসে আছে রিয়া।
সেদিন মাকে সবটা বলে হালকা হলেও এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে, ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলো ততটা মোটেই নয়।

তারচেয়ে বড় প্রবলেম হল সেদিনের পর থেকে ফাইয়ায বা আরহাম কেউই তার কল রিসিভ করছেনা! ভেবেছিলো আরহাম বা ফাইয়াযের বাসায় যাবে, কিন্ত সে তো বাসার বাইরে বের হওয়ারই সুযোগ পাচ্ছেনা!!
.
.
.
.
.
সিরাজ সাহেব গমগমে গলায় মেয়েকে বলল, ” এমন না যে বিয়ের আগে তোদের সময় দেওয়া হয়নি। তোরা ছোট থেকেই দুজন দু’জনকে ভালভাবে চিনিস জানিস। তারপরও এনগেজমেন্ট এর পর দুই বছর সময় পেলি। আজ বিয়ের আগেরদিন এসে আমাদের এসব শুনতে হচ্ছে!!!

রিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, ভাবতেও পারছেনা। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে তার!

মিসেস ইরা মেয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “হাজারবার তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছি, কিন্ত তোর তো আমাদের কথা শোনারই সময় ছিলনা!!!

রিয়া কাপা কাপা গলায় বলল, ” মা আমি!

সিরাজ সাহেব মেয়েকে ধমক দিয়ে বলল, ” আর কিছু শুনতে চাইনা। কাল ফাইয়াযের সাথেই তোমার বিয়ে হবে!

রিয়া আর সহ্য করতে না পেরে চেচিয়ে উঠলো, ” ফাইয়ায এই বিয়ে করবেনা! ফাইয়ায আরশিকে ভালবাসে!!

মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠল সিরাজ সাহেব, মিসেস ইরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” কিসব বলছিস তুই!?

রিয়া আর কিছু বলতে পারলনা, কাদতে কাদতে বেডে লুটিয়ে পড়ল সে।
মিসেস ইরা দ্রুত মেয়েকে ধরে বেডে শুইয়ে দিল, রিয়া সেন্সলেস হয়ে গেছে!

সিরাজ সাহেব স্ত্রীকে বলল,” তুমি জলদি ওর ড্রেস চেঞ্জ করে দাও, আমি ডক্টর ডাকছি!

মিসেস ইরা বাধা দিয়ে বলল, ” পাগল হয়েছো! বিয়ে বাড়িতে এতো রাতে ডক্টর আসবে!! তাও আবার বউকে চেকাপ করতে!!!

সিরাজ সাহেব ধৈর্য্য হারিয়ে বলল,” তাহলে কি করবো আমি!? বলো!!

মিসেস ইরা স্বামীকে শান্ত করে বলল, ” তুমি টেনশন নিওনা, এই মুহুর্তে আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ” ও সেন্সলেস হয়ে গেছে! আমি আগে ওকে চেঞ্জ করে ফ্রেশ করে দিই, তারপর দেখছি।

অগত্যা সিরাজ সাহেব মেয়ের রুম থেকে বেরিয়ে এলো, সারাবাড়ি ভর্তি মানুষ!
রিয়ার কাজিনরা সব এখনও ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে, রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও ছাদে করা হয়েছে।
স্ত্রীর মুখে সব শুনে মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছিলো সিরাজ সাহেব। কাল মেয়ের বিয়ে! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা সে!!
.
.
.
.
.
মিসেস ইরা মেয়ের শাড়ি চেঞ্জ করে শর্ট প্লাজো আর লং ঢিলাঢালা টিশার্ট পরিয়ে দিল।
রিয়ার মাথা নিচে রেখে পা দুটো উঁচু করে বালিশে রাখল মিসেস ইরা।
ওয়াশরুম থেকে এক মগ পানি এনে তোয়ালে ভিজিয়ে রিয়ার মুখ মুছে ঘাড়ে দিয়ে রাখল।

মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই জ্ঞান ফিরল রিয়ার, মিসেস ইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিয়ার গায়ে ব্লানকেটটা টেনে দিল।

রুমের দরজা ভেজিয়ে বের হতেই সিরাজ সাহেব উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” কি অবস্থা এখন!?

মিসেস ইরা আশ্বস্ত করে বলল, ” জ্ঞান ফিরেছে! রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আজ রাতে ওর পাশে আমি থাকবো। আফসানা আর সুমাইয়াকে বলো মেয়ে গুলোকে নিয়ে এসে শুয়ে পড়তে। আমি রুমের ফ্লোরে শোবার ব্যবস্থা করছি।

সিরাজ সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল, একটু থেমে বলল,” সে যাইহোক কাল কি হবে!?

মিসেস ইরা ইরা মাথা নাড়িয়ে না করে বলল, ” আমিও কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। কাল ভোরে উঠে তুমি আর আমি ফাতেমা আপার বাসায় যাবো। আগে ফাইয়াযের সাথে কথা বলা দরকার।

সিরাজ সাহেব মাথা দুলিয়ে বলল, ” হুম সেটাই। আমি আর ভাবতে পারছিনা!

মিসেস ইরা স্বামীর কাধে হাত দিয়ে বলল, ” এখন আর ভেবে কি হবে বলো, শুয়ে একটা ঘুম দাও। ভোরে সবার ওঠার আগেই বের হতে হবে।

সিরাজ সাহেব আচ্ছা বলে ছাদের দিকে পা বাড়ালো, মিসেস ইরা মেয়ের রুমে এসে শোবার ব্যবস্থা করতে লাগল।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
ডার্ক রেড কালারের লেহেংগা পরে বউ সেজে বসে আছে রিয়া। সকাল থেকে আব্বু আম্মুকে খুজে পাচ্ছেনা সে।

এখন ঘড়িতে দুপুর একটা বাজে! নামাজের পরই বরপক্ষ চলে আসবে!! তার আগেই পালাবে রিয়া!!!

আফসা আর সুমু সব ম্যানেজ করে রেখেছে, এখান থেকে বেরিয়ে সোজা আরহামের বাসায় যাবে রিয়া। গিয়ে ইচ্ছেমতো ধোলাই করবে আরহামকে!

গার্লফ্রেন্ডের আজ বিয়ে আর তার কোনো হদিস নেই!! আর ফাইয়াযও বা কেমন মানুষ! সে না আরশিকে ভালবাসে!!
তাহলে কেন বিয়ে করতে আসছে!? এই তার ভালবাসার নমুনা!!!

আর ভাবতে পারছেনা রিয়া, বেশি টেনশন করলে শেষে কেদে ফেলবে!
কেদেকেটে সাজগোজ নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না!

কিন্ত আফসা আর সুমু গেল কই!? এই শেষ টাইমে এসে পল্টি খাবেনা তো!!?
ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে রিয়ার!!! মনেমনে আল্লাহকে ডাকছে আর পালানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সে!!!!

এরমধ্যেই সিরাজ সাহেব আর মিসেস ইরা এসে বসল রিয়ার পাশে, ফটোশুট চলছে!
আব্বু আম্মুকে বেশ হাসি খুশি লাগছে দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে রিয়ার!!
আর কিছুক্ষণ পরেই পালিয়ে যাবে সে, না জানি বাড়িতে কি অবস্থা হবে তখন!!!

কিন্ত অতো ভাবলে এখন চলবেনা, এখান থেকে পালিয়ে আরহামকে ধরে মারতে মারতে বাসায় নিয়ে আসবে সাথে আরশিকেও।
ততক্ষণ আব্বু আম্মু সুস্থ থাকলেই হয়!!
.
.
.
.
.
হটাৎ কানে এলো, ” বর এসেছে বর এসেছে!

মুহুর্তেই রিয়ার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেল! এদিক ওদিক তাকিয়ে আফসা আর সুমুকে খুজতে লাগল রিয়া।

মিসেস ইরা মেয়ের কানে ফিসফিস করে বলল, ” চুপচাপ বসে থাকো আম্মু! কোনোধরনের চালাকি করার চেষ্টা করোনা!

রিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলল, আব্বু আম্মু কিভাবে জানলো যে সে পালানোর পায়তারা করছে!?

সিরাজ সাহেব হেসে বলল, ” আফসা আর সুমুকে খুজছিস নাকি!? ওরা তো আমাদের একমাত্র জামাইকে আনতে গেছে রে!!

রিয়ার এবার প্রাণ যায়যায় অবস্থা, এরা তো দেখছি এতকিছুর পরও ফাইয়াযের সাথে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে দেখছি!!!

সব প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে বর এসে বসল রিয়ার পাশে!
মিসেস ইরা আর সিরাজ সাহেব উঠে গেল। রিয়ার এবার মন চাচ্ছে বিয়ে বাড়িতে বোম ফাটাতে!
শালা সবকয়টা শয়তান, ফাজিল, বান্দর গুলো সব!!

তখনই কানে এলো সেই কন্ঠ,” গালি দেওয়া শেষ হলে এবার একটু নিজের বরের দিকে তাকাও শ্যামবতী!

রিয়া চমকে তাকাতেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল! মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো, ” আরহাম!!

আরহাম বাকা হেসে বলল, ” কেন ফাইয়াযকে এক্সপেক্ট করছিলে বুঝি!?

রিয়া কিছু বলতে পারছেনা, মাথায় কিছুই ঢুকছেনা কিভাবে কি হল!
কাজির ডাকে সম্বিৎ ফিরল রিয়ার, এতো তাড়াতাড়ি কাজিও এসে গেছে!!? মানে হচ্ছে টা কি এসব!!!!

আরহাম সাইন করে তিনবার কবুল বলে রিয়ার দিকে তাকালো!! রিয়া বুঝল এবার তার পালা!!!

রিয়া বিন্দুমাত্র দেরি না করে সাইন করে তিনবার কবুল বলে দিল!
কাজি চলে যেতেই আরহামের দিকে কটমট করে তাকালো রিয়া।
আরহাম না দেখার ভান করে বিভিন্ন স্টাইলে পোজ দিচ্ছে!
.
.
.
.
.
রিয়া দাতে দাত পিষে বলল, ” আমাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে তাই না! তোমাকে তো আমি দেখে নিবো, ফাইয়াযও রেহাই পাবে না!! কোথায় ফাইয়ায!!!?

রিয়ার বলতে দেরি ফাইয়ায এসেই আরহাম আর রিয়ার সাথে সেলফি তুলতে তুলতে বলল,” কিরে আমাকে খুজছিলি নাকি রিয়া!?

রিয়া তো অবাকের পর অবাক হচ্ছে! আজ কি সত্যিই তার বিয়ে নাকি অবাক হওয়ার দিন!!
আফসা আর সুমুকে দেখল শোভন আর সায়নের সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে!!! শয়তান শাকচুন্নির দল!!!!!

” তোমার বর এখানে আর তুমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ছেলে দেখছো রিয়া! ছিঃ ছিঃ

রিয়া বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, ” মানে!?

ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই আরহামকে কিল ঘুষি মারতে লাগল রিয়া!
আরহাম হাসতে হাসতে বলল, ” রিল্যাক্স বেবি গার্ল!

রিয়া আরও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেই আরহাম সলজ্জ হেসে বলল, “উপস স্যরি স্যরি, মাই ডিয়ার ওয়াইফ!!

রাগ না কমলেও আরহামের মুখে “ওয়াইফ” নামটা শুনে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেল রিয়া!

আরশিও এসেছে! সাথে মিসেস আয়েশা!! দুজনেই শাড়ি পরেছে!!!
আরহাম আর রিয়ার সাথে তারাও ছবি তুলছে, কিন্ত রিয়ার মন থেকে খুচখুচানি যাচ্ছে না। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে কিভাবে কি হল।

রিয়া আদুরে গলায় আরহামকে ডাকল,” আরহাম!

আরহাম সাথেসাথে রিয়ার দিকে তাকালো, রিয়া ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,” বলো না কিভাবে কি হল!!

আরহাম রিয়ার নাক টেনে বলল,” এখন অতকিছু জানতে হবে না বউ। ক্যামেরায় তাকাও, আমাদের বিয়ের ফটোশুট বলে কথা! একটা মোমেন্টও মিস হোক চাইনা!!

রিয়ার মনে হাজারো প্রশ্নের ঝড় বইছে! সেগুলোর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে।
কিন্ত এখন না চাইলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে হবে! আরহাম ঠিকই বলেছে, আমাদের বিয়ের ফটোশুট বলে কথা!!
বিয়ে তো আর মানুষ বারবার করে না, একবারই করে!!!
.
.
.
.
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here