চলো ভিজি বৃষ্টিতে পর্ব-৩৫

0
1028

#চলো_ভিজি_বৃষ্টিতে
#Tanjima_Islam
৩৫
.
.
.
.
.
সূর্যের আলো জ্বলজ্বল করছে আকাশে, মৃদু বাতাসে দুলে উঠছে বড়বড় গাছের পাতাগুলো।
বাড়ির পেছনের নিম গাছতলায় বসে আছে সুমু, এতো সুন্দর প্রকৃতির মাঝেও তার মন ছেয়ে আছে বিষন্নতায়।

বাড়িতে ফিরেই মাকে বলে দিয়েছে তার জন্য অন্য ছেলে দেখতে।
এবার তার বাবা-মা যাকে পছন্দ করবে, সুমু খুশি মনে তাকেই বিয়ে করে নেবে।
সুমুর বলতে দেরি, গতরাতে তার মা জানিয়েছে আজ বিকেলে নাকি তাকে দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ!

সুমু অবশ্য খুব একটা অবাক হয়নি, তার মনে শুধু একটাই জিনিস ঘুরছে।
আর তা হল, সায়নকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করা।
এতে করে সায়নকেও দেখিয়ে দেবে সে মোটেই দূর্বল নয়, সায়ন তখন বুঝবে সে আসলে কি হারিয়েছে!

তবে একটা কথা ভেবে বেশ অবাক হচ্ছে সুমু, সে তো সায়নের ব্যাপারে মাকে সব বলেছিলো।
তাহলে মা তাকে একবারও কিছু জিজ্ঞেস করল না কেন!!?
.
.
.
মিসেস সালেহার ডাক পেয়ে ভাবনায় ছেদ পড়ল সুমুর, মেয়েকে ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে সে।
সুমু উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,” আম্মু! ডাকছিলে!!

মিসেস সালেহা বলল,” সেই কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুই এখানে! বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, এখনও গোসল করিসনি। চল গোসল করে নিবি।

সুমু বাড়ির ভেতর যেতে যেতে বলল,” উফফ আম্মু! এতো তাড়াতাড়ি গোসল করে কি করবো!? ওরা আসবে তো বিকালে!!

মিসেস সালেহা মেয়েকে রুমে নিয়ে বলল,” বিকালে আসবে তাই কি! আজকে অন্তত তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হয়ে থাক!!

সুমু আর কি বলবে, অগত্যা গোসলে গেল সে। গোসল করে বেরিয়ে দেখল বেডের উপর মিষ্টি কালারের একটা শাড়ি রাখা!
নিশ্চয়ই তার মা রেখে গেছে!! বিরক্ত হলেও শাড়িটা নিয়ে পরতে লাগল সুমু, এই একটা জিনিসের প্রতি সে ভীষণ দূর্বল!!!
শাড়ি দেখলেই তার সব রাগ বিরক্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!!!
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
শহর থেকে দূরে একটা নিরিবিলি প্রাকৃতিক লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া।
এই জায়গাটা সেদিন আরহামের সাথে রিসোর্ট থেকে ফেরার পথে দেখেছিলো।

চারপাশে ছোটবড় মেহগনি গাছে ঘেরা, তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে নাম না জানা অসংখ্য ফুলের গাছ! হালকা বাতাসে সেগুলোর সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে!!
.
.
.
হটাৎ ফোনের রিংটোন পেয়ে সম্বিৎ ফিরল রিয়ার, ফাইয়ায কল দিচ্ছে।
রিসিভ করে তাকে এক্স্যাক্ট লোকেশনটা জানিয়ে দিল রিয়া।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাইয়ায এসে দাড়ালো তার পাশে, রিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ” কেমন আছো!?

রিয়াকে কিভাবে কি বলবে সেসব মনেমনে বুলি আউড়াচ্ছিলো ফাইয়ায।
রিয়ার কথা শুনে বলল,” হ্যাঁ হ্যাঁ আছি ভালো। তুমি কেমন আছো!?

রিয়া স্মিত হেসে বলল, ” এই তো ভালো। ফাইয়ায তোমাকে অনেকদিন ধরেই একটা কথা বলতে চাচ্ছি। কিন্ত বুঝতে পারছিনা কিভাবে বলবো!

ফাইয়ায হেসে বলল, ” বলো, কি বলতে চাও।

সাথেসাথেই রিয়ার ফোনে কল এলো, রিয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরহাম কল দিচ্ছে।
রিয়া কল কেটে ফাইয়াযকে বলল,” হ্যাঁ তো যা বলছিলাম, আমার পক্ষে

রিয়া আর কিছু বলার আগেই ফাইয়াযের ফোন বেজে উঠল, ফাইয়ায ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরশি কল দিচ্ছে!

ফাইয়ায কল কেটে লম্বা শ্বাস নিয়ে রিয়াকে বলল,” রিয়া আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে। আমি চাই না তোমাকে কষ্ট দিতে। আমি ছোট থেকেই তোমার ভালো চেয়েছি, আজও তাই চাই।

রিয়া বুঝতে পারছেনা ফাইয়ায কি বলতে চাচ্ছে, ফাইয়ায একটু থেমে আবার বলল, ” রিয়া আমি এতোদিন বুঝিনি ভালবাসা আর ভাললাগার মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক কি। ভাবতাম আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্ত আজ বুঝেছি, হ্যাঁ ভালবাসি তোমাকে! কিন্ত অ্যাজ এ ফ্রেন্ড!!

কথাটা শোনা মাত্রই খুশিতে চকচক করে উঠল রিয়ার চোখ জোড়া!
ফাইয়ায থরথর করে কাপছে, না জানি রিয়া তাকে কি না কি ভাবছে!!
সব শুনে চড় থাপ্পড় মেরে না বসে!! কিন্ত না, আজ যাই হয়ে যাক না কেন সত্যিটা সে বলবেই।
রিয়াকে বিয়ে করে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে সারাজীবন বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকাটাই তার কাছে অনেক!!!

রিয়া খুশি চেপে রেখে বলল, ” তুমি কি সত্যি বলছো ফাইয়ায! তুমি বুঝতে পেরেছো!!?

রিয়ার কথায় ফাইয়ায কিছুটা স্বস্তি পেলো, মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে বলল, ” হুম!

রিয়া খুশিতে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বলল, ” কিন্ত কিভাবে!!?

ফাইয়ায বুঝতে পারছেনা রিয়া কষ্ট না পেয়ে খুশি হচ্ছে কেন!
আমতাআমতা করে বলল, ” আ’আরশিকে ভালবেসে ফেলেছি আমি!

বলেই চোখ নামিয়ে নিল ফাইয়ায, এদিকে রিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে!!
কি বলল ফাইয়ায!! আরশি আপু!! আর সে!!! কিন্ত কিভাবে!!!! আর কখনই বা হল এসব!!!!????

রিয়ার মুখ থেকে হাসি সরে গিয়ে একরাশ বিস্ময় দেখা দিচ্ছে!
ধীর পায়ে ফাইয়াযের কাছে গিয়ে বলল,” আরশি আপু!? মানে আরহামের বোন!!?

ফাইয়ায অপরাধীর মতো মাথা নিচু করেই হ্যাঁ জানালো।
মনেমনে প্রস্তুতি নিচ্ছে রিয়ার হাতে চড় খাওয়ার জন্য।রিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, একসাথে এতগুলো খুশির খবর!
রিয়া খুশিতে ফাইয়াযকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” কংগ্রাচুলেশন ফাইয়ায!

রিয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে ফাইয়ায, অবাক হয়ে বলল, ” মানে!!!?

রিয়া ফাইয়াযকে ছেড়ে মুখ টিপে হাসতে লাগল, ফাইয়ায ভ্রু কুচকে বলল, ” কি ব্যাপার বলো তো! রিয়া!! তুমিও কি!!!

রিয়া মুখ ভেংচি কেটে বলল,” আমি আবার কি হ্যাঁ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ফাইয়ায! এই ছিলো তোমার মনে!! আমাকে এভাবে ধোকা দিলে তুমি!!! আমি সবাইকে বলে দেবো ফাইয়ায আমাকে ঠকিয়েছে!!!!

বলেই ন্যাকা স্বরে কাদতে লাগল রিয়া। ফাইয়ায তাতে গলছেনা, রিয়ার ন্যাকামি সে ঠিকই বোঝে।
রিয়া বুঝতে পারল ফাইয়ায ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। সো লুকিয়ে লাভ নেই!

রিয়া হালকা কেশে বলল,” আমরা দুজনেই ইকুয়াল কাজ করেছি! সো

রিয়া আর কিছু বলার আগেই ফাইয়ায আঁতকে উঠে বলল,” মানে!? তুমি!!

রিয়া ভাব নিয়ে বলল, ” হ্যাঁ আমি!

ফাইয়ায শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, ” আরহাম তাই না!

রিয়া লজ্জায় আরক্তিম হয়ে বলল,” হুম!

ফাইয়ায হেসে বলল, ” তাহলে তুমি আমার ভাবি হবা!!

রিয়া ফিক করে হেসে বলল, ” হুম আর তুমি আমার জিজু হবা!!!

বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল রিয়া, ফাইয়ায মাথা চুলকে বলল, ” কিন্ত একটা প্রবলেম আছে!

রিয়া হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” আবার কি সমস্যা!?

ফাইয়ায একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আমাদের ফ্যামিলিকে কে বোঝাবে!?

ফ্যামিলির কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলল রিয়া, কাপা কাপা গলায় বলল, ” ফাইয়ায! এবার কি হবে!?

ফাইয়ায কিছু একটা ভেবে বলল, ” আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে, এখন আমাকে একটু আরশির সাথে দেখা করতে হবে।

রিয়া বাধা দিয়ে বলল, ” ঐ থামো, আমিও যাবো। আরহাম সেই কখন থেকে কল দিচ্ছে। আচ্ছা ফাইয়ায! তোমার আর আরশি আপুর ব্যাপারটা ঠিক কখন কিভাবে হল বলো তো!!

ফাইয়ায সলজ্জ হেসে বলল, ” আচ্ছা, যেতে যেতে বলছি চলো।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
শোভন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের সামনে, দরজার আড়ালে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে ইশি।

মিসেস সানজিদা ছেলেকে বলল,” আমি যেটা বলছি সেটাই ফাইনাল। শেলীকেই তোর বউ করে আনবো, আর আজই আমরা লিলির বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবো।

শোভন না চাইতেও মাথা দুলিয়ে সায় দিল। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কোনো সিদ্ধান্তেই সে দ্বিমত করেনি কোনোদিন, যদি মা কষ্ট পায়!

কিন্ত আজ না চাইতেও মেনে নিতে হচ্ছে তাকে। শুধু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, আফসার ব্যাপারে একটু খোজও নিতে চাইলোনা তার মা।

শোভনের রুম থেকে বেরিয়ে এলো মিসেস সানজিদা, সাথেসাথে ইশি প্রায় হুড়মুড় করে ছুটে নিজের রুমে গেল।

শোভনের জন্য বেশ খারাপ লাগছে তার। ইশিরা তিনবোন, কোনো ভাই ছিলনা তার।
শাওনের সাথে বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে একটা ভাই পেয়েছে সে।

শোভনকে কখনও দেবর ভাবেনি ইশি, আপন ভাইয়ের মতই আদর যত্ন করে সে।
আজ সেই ভাইয়ের এমন কষ্টের সময় সে কিছুই করতে পারছেনা!

নাহ এভাবে বসে থাকলে চলবেনা, লিলি ফুপুর বাসায় যাওয়ার আগেই শ্বাশুড়ির সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে তার।.
.
.
.
.
.
সাতপাঁচ ভেবেচিন্তে এক গ্লাস শরবত নিয়ে শ্বাশুড়ির রুমে গেল ইশি।
মিসেস সানজিদা বেডে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন।
ইশি ডেকে বলল, ” মা, এই শরবতটুকু খেয়ে নিন। খুব গরম পড়ছে আজ।

মিসেস সানজিদা গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো শরবতটুকু খেয়ে নিল।

তাকে দেখে বেশ খুশিই মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই ছোট ছেলের বিয়ের জন্য!
ইশিকে বসে থাকতে দেখে মিসেস সানজিদা বলল,” কিছু বলবে বউমা!?

ইশি ইতস্ততভাবে বলল, ” হ্যাঁ মানে, শোভনের ব্যাপারে আর কি।

মিসেস সানজিদা গ্লাসটা ইশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” হুম বলো শুনছি।

ইশি গ্লাসটা ট্রেতে নিয়ে বেড টেবিলে রেখে বলল,” শোভনের মুখে আফসানার কথা অনেক শুনেছি। ছবিও দেখেছি, বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।

মিসেস সানজিদা হেসে বলল, ” তুমি তো শুধু ছবিতে দেখেছো, আর আমি তো মেয়েটাকে সরাসরি দেখেছি!

ইশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” তাই নাকি!? কোথায় কিভাবে!?

মিসেস সানজিদা স্মিত হেসে বলল, ” বউমা! আমি জানি তুমি কি নিয়ে কথা বলতে এসেছো।

একটু থেমে আবার বলতে লাগল,” শাওন ছোট থেকেই খুব শান্ত স্বভাবের ছিলো কিন্ত শোভন ছিলো ঠিক তার উলটো। রাগী, জেদী, অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির! কিন্ত ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে শোভন একদম শান্ত হয়ে গেছিলো। কখনও কোনো কিছু নিয়ে রাগ বা জেদ করতো না। আজ সেই ছেলে তার ভালবাসার কথা আমাকে জানিয়েছে আর আমি মুখের ওপর না করে দিয়েছি!!

বলেই হাসতে হাসতে চোখের জল মুছলেন মিসেস সানজিদা, ইশি কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। শ্বাশুড়ির কথা গুলো কেমন যেন রহস্যময় লাগছে তার কাছে।

মিসেস সানজিদা চোখ মুছে বলল,” আফসানাকে প্রথম দিন দেখেই আমার খুব ভালো লেগেছিলো। মেয়েটা যেমন মিষ্টি দেখতে তেমন তার অমায়িক ব্যবহার! বেশ কদিন ধরে খেয়াল করলাম শোভন কারো সাথে রাত জেগে ফোনে কথা বলে!! সেদিন সকালে ওকে ডাকতে গিয়ে দেখি ওর ফোনে কল এসেছে। ওপরে বড় করে লেখা আফসানা!!! তখনই বুঝতে পারি বিষয়টা। তারপর আফসানার ব্যাপারে খোজ খবর নেওয়া শুরু করি। মেয়েটাকে অপছন্দ হওয়ার কিছুই নেই , ভাবলাম শোভনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো। কিন্ত তার আগেই আজ যখন শোভন আমায় আফসানাকে বিয়ে করার ব্যাপারে বলল। তখন মনে হল ছেলের সাথে একটু দুষ্টুমি করে দেখি, তাই ইচ্ছে করেই ওর মুখের ওপর না করে দিয়েছি। আর আমার ছেলের অবস্থা দেখো, নিশ্চয়ই এখনও মন খারাপ করে বেডে উলটে পড়ে আছে!!

বলেই হাসতে লাগল মিসেস সানজিদা!!! ইশি তো রীতিমতো অবাক!!!
শেষে শ্বাশুড়ির সাথেসাথে সেও হাসতে লাগল!!!

এদিকে মাকে ডাকতে এসে সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে শোভন!!!!
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে!!!! ধুপ করে বসে পড়ল ফ্লোরে।

কিছু পড়ার শুব্দে বেরিয়ে এলো মিসেস সানজিদা আর ইশি।
ছেলেকে দরজার সামনে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে বাকি নেই শোভন সব শুনে ফেলেছে!!!
মিসেস সানজিদা আর ইশি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শোভনকে তুলে রুমে নিয়ে গেল।
.
.
.
.
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here