চলো রোদ্দুরে পর্ব-৩৮

0
1824

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_38

গ্রামের পথে এসে ভোর যেন পৃথিবী কে হাতে পেয়ে গেছে। মেয়েটার আনন্দে ভরা মুখ দেখে বেশ স্বস্তি মিললো রাদের। বেশ অনুভূতি জেগেছে অন্তকর্নে। ইচ্ছে করছে মেয়েটার উচ্ছ্বাস ফ্রেম বন্দী করে নিতে। বক বক করছে মেয়েটি। কখনো কানে যাচ্ছে আবার যাচ্ছে না। হাই তুলতে তুলতে ভোর বলল
_গাড়ি থামান।

_কেন?

_আরে থামান ই না।

গাড়ি থামাতেই নেমে গেল ভোর। পিছু পিছু রাদ ও নেমে গেল। পূর্ন শীত কাল। গ্রামের রাস্তায় খেজুর গাছের সমারোহ। রস কাঁটা হয়েছে। লোভনীয় রস চুরি করে খাওয়ার মজাই আলাদা। ভোর বলল
_গাছে উঠুন।

_এহহ?

_আরে হ্যাঁ। গাছে উঠুন। এই সময়ে কেউ নেই আশে পাশে। চুরি করে রস খাওয়ার মজাই আলাদা।

_এতে ওনাদের ক্ষতি হবে ভোর।

_প্রথমত সরকারি গাছ এগুলো। আর দ্বিতীয়ত আমরা টাকা রেখে যাবো।

_ উমম গুড আইডিয়া। বাট গাছে উঠা টা।

_আরে উঠুন না। এক টা মাত্র বউ এর জন্য এই টুকুনি করতে পারবেন না আপনি? কেমন ডাক্তার হলেন যে বউ এর সেবা করতে পারেন না।

_ডাক্তার আমি,কোনো গাছি নই।

ছেলেটার কথায় খিল খিল করে হেসে উঠলো ভোর। কখনো গাছে উঠা হয় নি ওর। প্রায় কয়েক বার চেষ্টা করলো রাদ। তবে প্রতি বার ই ব্যর্থ হলো। মুখ টিপে হাসছে ভোর। অসহায় চোখে তাকালো রাদ।তাই ভোর বলল
_আচ্ছা আমি উঠছি।

_এই না পরে যাবা।

_পরবো না। আপনি একটু সরুন।

_ আমি তোমাকে উঠতে দিবো না।

_আমি উঠবোই।

নাছোড়বান্দা হয়ে তর্ক চালাচ্ছে ভোর। গাছের কাছাকাছি যেতেই মেয়ে টি কে জাপটে ধরলো রাদ। ভোর নিজেকে ছাড়াতে চাইছে তবে পারছে না। রাদ ও যেন উপভোগ করলো বিষয় টি। কাক ভোরে খিল খিল করে হাসছে দুই দম্পতি। এর থেকে সুখের আর কিই বা হতে পারে?

কিছু পায়ের শব্দ শুনে ভোর কে নামিয়ে দিলো রাদ। কয়েক টা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরে পা দেওয়া ছেলে গুলোর চোখে মুখে উৎকন্ঠা। এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয় নি কখনো। ভোর লজ্জা পেলো। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে দের কাছে এমন ভাবে উপস্থাপন হলো ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
_এই তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন?

_লজ্জা পাবো না?

_বাচ্চা এরা চিল।

_আশ্চর্য তো!

_আপু।

কথার মাঝেই এমন শব্দ শুনে থমকে গেল দুটি হৃদয়। বুক টা কেমন ধরফর করছে। রাদ আর ভোর এর চোখ একে অপরের দিকে নিবদ্ধ।আবারো শব্দ টা কানে এলো। ছুটে গেল ভোর। তাফিন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। তাফিন এর চোখে পানি। এতো গুলো বছর পার হলেও বোন কে ভুলে নি ছেলেটা। ক্রন্দনরত অবস্থায় তাফিন বলল
_আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি আপু। অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাই নি।সবাই খুব খারাপ, শুধু তুমি ভালো।

_তাফিন,ভাই আমার।

তাফিন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো ভোর। রাদ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাই বোনের এমন ভালোবাসা যেন ওর হৃদয়ে বসন্ত নামিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের আবেগ ঝরালো দুজনেই। রাদ এসে তাফিন কে জড়িয়ে ধরলো। বলল
_কি শ্যালক সাহেব খুব তো বড় হয়ে গেছেন।

_আপনিই আমার দুলাভাই?

খলবিলিয়ে হাসলো রাদ। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে সম্মতি জানালো। ছেলেটির কৈশোর মন যেন আজ বাঁধন ভাঙা খুশি তে মেতেছে। চিৎকার করে বলল
_তোরা দেখ, এই যে আমার দুলাভাই। বলেছিলাম না খুব সুন্দর আমার দুলাভাই।

ছেলেটার আচারন মুগ্ধ করলো ওকে। তাফিন কে কতো টা ছোট দেখেছিলো। ভাবতেই কেমন লাগে, সেই তাফিন আজ পূর্ন কিশোর।লম্বায় ও বয়সে রাদের থেকে অনেক টাই ছোট হলে ও আচারন যেন ভিন্ন। বেশ গল্প ছড়িয়ে দিলো ওরা। ভোর এর মন টা তৃপ্ত আজ।
তবু ও ছটফট করছে প্রান। কখন যে বাড়ির উঠানে পা রাখবে।আচ্ছা পুরনো সেই শিউলি গাছ টা এখনো আছে নাকি রাগে কেঁটে ফেলেছেন কুলছুম।

_মা, মা দেখো কে এসেছে। মা ও মা দেখো না তুমি।

বহু দিন পর ছেলের মুখে এমন ডাক শুনে আঁতকে উঠলেন কুলছুম। চোখ ভরে উঠলো জলে।রান্না ঘর থেকে ছুটে এলেন তিনি। তাফিন কে বুকে চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। ভোর চলে যাওয়ার পর তাফিন এক সমুদ্র অভিমান নিয়েছে।কুলছুম কে মা বলে সম্বোধন করে না , আর না তাফাজ্জাল কে বাবা বলে সম্বোধন করে। ছোট্ট তাফিন এতো টা অভিমান নিতে পারে তা যেন সকলের কল্পনার অতীত ছিলো।
_কান্না না করে এখন রান্না চাপাও তো।

চোখ মুছলেন কুলছুম। ছেলে কে তৃপ্তির দৃষ্টি তে দেখলেন। আশে পাশের কিছু লোকজন ও এসে পরেছে। তা দেখে কুলছুম বললেন
_কি চাই সকলের? সবাই জোঁট ধরে আইছো কেন?

সকলের মাঝ থেকে এক বৃদ্ধা বললেন
_মিষ্টি খাওয়াইবা না নাকি?

_কিসের মিষ্টি চাচি?

_ওমা,এতো দিন পর মাইয়া জামাই আইছে আমাগো খালি মুখেই বিদেয় করবা বইলা স্থির করছো?

মেয়ে জামাই শব্দ টা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো কুলছুম। তারপর ই বললেন
_কি বললেন চাঁচি? কার মেয়ে জামাই?

_ঐ তো আসতেছে।

ইশারা করলেন বৃদ্ধা। হাত ভর্তি জিনিস নিয়ে আসছে এক সুদর্শন পুরুষ। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য যেন বেশ কিছু কিশোরীর বুকে তীর বসিয়ে দিলো।পাড়ার মেয়ে গুলো কেমন দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। একটু করে তাকালো ভোর।তবে সেসব গাঁয়ে মাখলো না তেমন। ছুটে এলো তাফিন। রাদ কে জড়িয়ে ধরে বলল
_সবাই দেহো আমার আপুর বর। বলেছিলাম না আমার আপুর বর খুব সুন্দর। দেহো সবাই, কেমন রাজপুত্র।

সকলের দৃষ্টি যেন রাদ কে ঘিরে। তবে এবার নজরে এলো ভোর। মেয়েটা এমনি তেই সুন্দরী। তবে এখন মনে হচ্ছে চাঁদ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরী। মেয়ে, মেয়ে জামাই সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে কুলছুম এর। শাশুড়ির পা ধরে সালাম করলো রাদ। বলল
_কেমন আছেন আন্টি?

কুলছুম তব্ধা হয়ে আছেন । ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ভোর। চোখ দুটো স্থির হলে ও পানি গুলো বাড়ন্ত। যেন টোকা দিলেই পরে যাবে। চেঁচিয়ে উঠলেন কুলছুম। আর্তনাদ করে বললেন
_আমার মাইয়া, আমার ভোর।

_মা

অস্ফুটন স্বরে উচ্চারণ করেই জড়িয়ে ধরলো কুলছুম কে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা। বুক টা কেমন উঠা নামা করছে। যেন সমস্ত জীবনী শক্তি এখনি ফুরিয়ে যাবে।

ভোরের চোখে মুখে চুমু খেলেন কুলছুম। রাদ অনেক টাই সন্তুষ্ট হয়েছে। আসার পথে সব কিছু জানিয়েছে তাফিন। যা শুনে অবাক হয়েছিলো রাদ। হয়তো ভাগ্য একেই বলে।

রাদ আর ভোর কে ভেতরে যেতে বলে সকলের উদ্দেশ্যে কুলছুম বললেন
_সবাই বইসা যাও। সকলরে মিষ্টি মুখ করামু আমি।

সকলেই দাঁড়িয়ে রইলো। মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে তে নয়। বরং রাজপুত্র, রাজকন্যা কে আরেক বার চোখের দেখা দেখতে।

গ্রাম টা যেন পিছিয়েই রয়েছে। বিদ্যুৎ এলে ও সঠিক ভাবে সার্ভিস দেয় না। নেহাত ই শীতকাল, না হলে যে কি হতো। তাফিন শরবত এগিয়ে দিলো। ছিম ছাম ঘর টা একি রকম রয়েছে। কোনো পরিবর্তন ই হয় নি। যেন ছয় বছর পূর্বের সেই সময়ের ই গ্রাম।
মেয়েটার চোখের জল মুছিয়ে দিলো রাদ। সন্তর্পণে মাথা টা বুকে চেপে বলল
_একদম কান্না করবে না। আমি জানি আমার ভোর অসাধারন ব্যক্তিধারী।যাঁর মাঝে কোনো আঁধারের স্থান নেই। আছে শুধুই রোদ্দুর আর রোদ্দুর।

স্বপ্নের মতো লাগছে সব। এভাবে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে তা যেন ছিলো স্বপ্ন।
তাফিন অনেক কিছুই জানিয়েছে। ছোট্ট ছেলেটার বোনের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সকলের বুকে দাগ কাঁটার মতোই।

ভোর চলে যাওয়ার এক বছরের মাথায় একটি সত্য সকলের সম্মুখ আসে। রাহিলার মেয়ের সাথে খারাপ সম্পর্ক হয়েছিলো পাত্রের। সেই নিয়ে কতো কিছু হলো। তাছাড়া ভোরের নামে করা বদনাম ও সকলের সামনে আসে। আর তখনি নিজে দের ভুল বুঝতে পারেন তাফাজ্জাল, কুলছুম। প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলেন এই ভেবে যে মেয়ে টা কতো আঘাত করেছেন। ভাগ্য ছিলো বড় বেমানান। তাই তো হজুর মারা যান আগুনে দগ্ধ হয়ে। আর ছাই হয়ে যায় সকল ডকুমেন্ট। হাজার খুঁজে ও ভোর কে পায় নি ওনারা। ক্ষমতাই বা কতো দূর?
সেই থেকে অনুশোচনায় ভুগছেন ওনারা। এদিকে তাফিন ওহ অভিমান করেছে। যেন বেঁচে থাকা টাই পাপ হয়ে গেছে। এই ভরা আঁধারে এক ফালি রোদ্দুর হয়ে ফিরে এলো ভোর আর রাদ।

পুরো গ্রামে খবর টা ছড়িয়ে পরলো। একে একে সবাই দেখতে এলো। প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে।ভোরের ভেতর থেকে তৃপ্তি এলো। সকলের অগোচরে রাদের বুকে মাথা রেখে বলল
_এমন রোদ্দুরে নিয়ে আসার জন্য কৃতঙ্গ ডাক্তার সাহেব। এমন ভালোবাসা দেওয়ার জন্য কৃতঙ্গ ডাক্তার সাহেব। এতো ঘন আঁধারের ভিরে আমাকে খুঁজে নিয়ে রোদ্দুরে পৌছে দেওয়ার জন্য কৃতঙ্গ ডাক্তার সাহেব। আমি কৃতঙ্গ আপনাকে পেয়ে।
এই রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিশ্রুতি করছি কখনো আঁধারে ডুবতে দিবো না।দু হাতে আঁকড়ে নিবো। আঁধার কে তুচ্ছ করে আমি ওহ চেঁচিয়ে বলবো ডাক্তার সাহেব চলুন রোদ্দুরে।

মেয়েটার কথায় হেসে উঠলো রাদ। আলগোছে গালে চুমু খেয়ে বলল
_চলুন নয় বলো চলো রোদ্দুরে।

লজ্জা পেলো ভোর। সে লজ্জা নিবারণে রাদ কেই বেছে নিলো। ছেলেটার উষ্ণ বুকে মুখ লুকিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। কজন পারে এভাবে নর্দমার কালো আঁধার থেকে তুলে রোদ্দুরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে?

**গল্প টা আর তিন থেকে পাঁচ পার্ট হতে পরে।**
পরবর্তী গল্প #অভিমানী_সে। সকলের ভালোবাসা আশা করছি।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here