চিঠি দিও ১২

চিঠি দিও
১২
_____________

“সম্মানিত এলাকাবাসী ভাই ও বইনেরা আসসালামু আলাইকুম। খেলার খবর ফুটবল ফুটবল ফুটবল। ফুটবল প্রেমি ভাইদের জন্য এক দারুণ সুখবর। ঐতিহাসিক রাধাকৃষ্ণপুর স্কুল মাঠ প্রাঙ্গনে আজ বিকাল চাইরটার সমায়। আমি আবার বলতেছি আইজ বিকাল চাইরটার সমায়
বিয়াওদারি বনাম অবিয়াওদারিদের ঐতিহাসিক এক ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। বাঘে আর সিংহের লড়াই। কে জিতবে, কে হারবে তা দেখার জন্য আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ। আইজ বিকাল চাইরটার সমায় রাধাকৃষ্ণপুর স্কুল মাঠে। রাধাকৃষ্ণপুর..”

সাতসকালে পুরো এলাকা হাঁকিয়ে মাইকিং চলছে। পাশের এলাকায় আজ খেলা। বলা বাহুল্য উপমার ঘুমটা ভেঙেছে এই মাইকিংয়ের শব্দেই। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখছে ও ঘুম ঘুম চোখে। ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি পুরোটা। রাজ্যের অলসতা আজ পেয়ে বসেছে। উপমা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলেজে যাবে না। ফিজিক্স পরীক্ষা খারাপ হয়েছে ওর। প্রিপারেশন নিয়েছিল মোটামুটি;কিন্তু প্রশ্ন পাওয়ার পর সব গুলিয়ে গেছে। ওদিকে মিস.খাওলা বলেছেন পনেরোর নীচে কেউ পেলে পাঁচটা বেতের বাড়ি উপহার আছে। উপমা হিসেব কষে দেখেছে সে বারোও পায় কি না সন্দেহ! ইতোমধ্যে ভরা ক্লাসে অপমানিত হয়েছে একবার৷ দ্বিতীয়বার মার খেয়ে অপমানিত হতে চায় না ও। এরচেয়ে কলেজে না যাক তাই ভালো।

জানালার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে অলস ভঙ্গিতে হাই তুলল উপমা৷ এই বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘরটা ওকে দেয়া হয়েছে। অন্য ঘরগুলির চাইতে ওর ঘরে জানালার সংখ্যা বেশি৷ দুটো জানালা। দুই জানালা দিয়ে বেলা করে রোদের আলো আর জোছনা রাতে চাঁদের আলো ঝেঁপে নামে। রোদ উপমার ভীষণ পছন্দ;পছন্দ বিস্তৃত নীল আকাশ আর পেঁজা তুলোর মতো চকচকে সাদা মেঘ।
একটুখানি আকাশ দেখার লোভে, সূর্যের চম্পক রঙটা গায়ে মাখবার লোভে উন্মুখ হয়ে জানালা ঘেঁষে বসে থাকা ওর নিত্যদিনের অভ্যেস। মাঝেমধ্যে মনে হয় প্রকৃতি ওর বন্ধু হয়ে গেছে। বন্ধু হয়ে গেছে রোদের ফোঁটা গুলো। নইলে রোজ সকালে কাঠের পাল্লাদুটো খুলে দেয়ামাত্র লোহার শিক গলিয়ে পাটভাঙা রৌদ্র খিলখিল হেসে ওর গায়ে মেখে যাবে কেন? বিছানার ধারের এই জানালাটা থেকে রাস্তার একাংশ স্পষ্ট দেখা যায়। রাজ্যের ব্যস্ততার ভার মাথায় চেপে আপন খেয়ালে ছুটোছুটি করা মানুষগুলোকে মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলো উপমা। ওখানে মাইকিং করা ছেলেপেলেগুলোও আছে। পা চালিত ভ্যানে সাউন্ড বক্স বসিয়ে আনন্দের সাথে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে খেলার ঘোষণা দিচ্ছে ওরা। নিষ্পলক ব্যস্ত রাস্তাটা অবলোকন করতে করতে উপমার মনে হলো বিকেলে খেলা দেখতে গেলে কেমন হয়! আগে তো কখনো দেখা হয়নি। নতুন একটা এক্সপেরিয়েন্সও হবে, আবার বিকেলটাও আনন্দে কাটবে। কিন্তু একা তো যেতে দেবে না। কাকে নেবে সাথে? অভ্রকে!
ঝটপট নিজেকে গুছিয়ে বিছানা থেকে নামল উপমা। দরজা খুলে চৌকাঠে দাঁড়িয়েই হাঁক ছাড়ল,
— অভ্র, অভ্র? বাড়িতে আছিস?
উপমার ডাকে অভ্র তো এলো না। তবে নীচ থেকে জান্নাতি জবাব দিলো,
— ডাকেন কা? ছোটো মিয়াভাই তো আরবি পড়তে গেছে।
উপমা একদণ্ড ভাবল অভ্রের সাথে জান্নাতিকেও নিলে ভালো হয়। বিনিময়ে সে বলল,
— অভ্র এলে ওকে নিয়ে আমার ঘরে আসবি তো জান্নাতি। দরকার আছে।
— আপনি কলেজ যাবেন না বু?
— উঁহু।
সংক্ষেপে জবাব দিয়ে উপমা ঘরে ঢুকে গেল।
আরবি পড়ে অভ্র ফিরল ঘণ্টা দেড়েক পর। ততক্ষণে উপমা আরেকটু ঘুমিয়ে নিয়েছে। অভ্র এলে ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসল ভাই বোন। বাড়িতে সদস্য সংখ্যা অনেক। বারোটা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়াই চলে ওদের। এখন যদিও অতটা বাজেনি। তবে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। টেবিলে বসে বড় মামা একবার খোঁজ করেছেন উপমার। সুযোগ পেলে উনি উপমাকে কলেজে নিয়ে যান। আজও ভেবেছিলেন নিয়ে যাবেন। কিন্তু আসমার মুখে যখন শুনলেন উপমা যাবে না, গম্ভীর হয়ে উঠেছিল ওনার মুখচোখ। অকারণ ক্লাস বাঙ্ক দেয়া মোটেই পছন্দ করেন না মামা। মামা যতক্ষণ বাড়িতে ছিল বাইরে বেরোয়নি উপমা। এতক্ষণে বেরোল।
দলের কিছু ছেলেপেলে নিয়ে অতনু খেতে বসেছে। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যেস। এক সন্ধ্যা বাইরের মানুষ ছাড়া খায় না। ছেলেগুলো অবশ্য বিশ্বস্ত। খুব মানে অতনুকে। নিত্যদিন এ বাড়িতে যাতায়াত ওদের। মেজো মামি সুযোগ পেলে ছেলেগুলোর দ্বারা টুকটাক কাজ করায়। ওদের সামনে অস্বস্তিবোধ করার কিছু নেই। তবুও খানিক মিইয়ে রইল উপমা। মাথায় কাপড় দিয়ে যথাসম্ভব নীচু গলায় অভ্রের সাথে বিকেলের পরিকল্পনা সারল। ওদের গল্পের ফাঁকে জান্নাতি খাবার দিয়ে গেল। খাবার প্লেট হাতে জান্নাতিকেও টেনে নিজেদের পরিকল্পনায় শামিল করে নিলো ওরা।
অতনু খাওয়ার ফাঁকে ভাইবোনদের দেখছে। ধিমে গলায় ওদের গোপন আলাপচারিতা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেছে ওর। এক পর্যায়ে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল,
— কিরে খাবার না খেয়ে তোরা কিসের আলাপচারিতায় লেগেছিস?
অতনুর কণ্ঠ শুনতেই উপমারা চুপ। অভ্র আর জান্নাতি তো মাথা নীচু করে নিয়েছে। উপমা শুধু ঘাড় ফিরিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
— কিছু না ভাইয়া। আমরা তো এমনিই..
— খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই জানিস না তোরা? চুপচাপ খা। কথাবার্তা সব পরে।
— জ্বী ভাইয়া।
সুবোধের মতো মাথা নেড়ে উপমাও খাওয়ায় মনোযোগী হলো।
কাঠ হয়ে ওদের বসে থাকতে দেখে আড়ালে হাসল অতনু। ছোটো দুটো ওকে এত ভয় পায় কেন? ও তো কখনো উচ্চ শব্দে কথা বলেনি ওদের সাথে। তবে?

ছেলেগুলোর খাওয়া শেষ হলো জলদি। অতনুর নির্দেশে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল ওরা। ডাইনিং ফাঁকা হলে বুকে সাহস সঞ্চয় করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো উপমা। আগুনে ঝাঁপ দেয়ার জন্য ওকেই প্রস্তুত করে রাখে সবাই। বাহানা একটাই “তুই একমাত্র বোন। তোর কথা ফেলবে না”
আজ তো প্রয়োজনও নিজের। লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসল উপমা অতনুর মুখোমুখি। অপাঙ্গে অতনু দেখেছে ওকে। নিশ্চয়ই কোনো আবদার। বুঝতে সমস্যা হলো না অতনুর। তথাপি অবুঝের মতো চুপচাপ বসে রইল। উপমা নিজেই উশখুশ করতে লাগল। কীভাবে কথা তুলবে গুছিয়ে নিতে লাগল। অতনুর চোখ এড়াল না কিছুই। খাওয়ার মধ্যেই সে প্রশ্ন করল,
— কিরে কিছু বলতে চাস?
— নাহ্ না.. মানে হ্যাঁ।
জোর মাথা দুলিয়ে আমতাআমতা করে বলল উপমা।
ভ্রু কুঁচকে তাকাল অতনু।
— না; নাকি হ্যাঁ?
— হ্যাঁ। বলতে চাই একটা কথা।
— তো বলে ফেল।
— ইয়ে মানে। বকবে না তো?
— বল আগে শুনি। বকার মতো হলে অবশ্যই বকা খাবি।
গমগমে স্বরে বলল অতনু। ততক্ষণে আসমাও উপস্থিত হয়েছে ওদের মাঝে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুই ভাই-বোনের দিকে।
উপমা দ্বিধায় পড়ে গেল। বলবে নাকি বলবে না! কিন্তু যেতেও তো ইচ্ছে করছে তার। হোক না দেখা যাক না কি হয়!
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ও দ্বিধাজড়িত গলায় বলল,
— আজ বিকেলে রাধাকৃষ্ণপুর স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা সেজো ভাই।
— হু তো?
— ভাবছিলাম কি। আমরা যদি খেলা দেখতে যাই? কখনো তো দেখিনি?
এ পর্যায়ে চোখ সরু করে তাকাল অতনু। ওর দৃষ্টি দেখে তো গলা শুকিয়ে আসতে চাইল উপমার। শুকনো ঢোক গিলে আসমার পানে চাইল একবার। আসমাও চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছে। সংসারে এই ক’মাসে যতটা ও বুঝেছে স্বামী নামক মানুষটা ওর বাবারই দ্বিতীয় রূপ। সবখানেতে বিধি-নিষেধের বাড়াবাড়ি। শুকিয়ে যাওয়া উপমার মুখখানা দেখে বেশ মায়াই হলো আসমার। ওদিকে পেছনে বসা অভ্র আর জান্নাতিও ভীষণ সজাগ। দূরে বসলেও তাদের সমস্ত মনোযোগ এখানে।
— কে কে যেতে চাস?
ঠান্ডা স্বর ভেসে এলো অতনুর থেকে। ভয়ে ভয়ে উপমা জবাব দিলো,
— আমি, অভ্র আর জান্নাতি।
— ওখানে কত বাইরের মানুষ থাকবে জানিস?
আচমকা ধমকে উঠল অতনু। থতমত খেয়ে হাতের চামচ পড়ে গেল উপমার। সহসা উঠে দাঁড়াল ও। কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
— প্লিজ সেজো ভাই। আগে কখনও খেলা দেখিনি আমরা। খুব আগ্রহ আমাদের। বাড়ি থেকে বেশি দূরে না, তারপর আমরা থাকবও তিনজন। কে কি করবে?
— তোদের স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। কত আজেবাজে ছেলে থাকবে ওখানে। কত রকমের বিপদ হতে পারে ঠিক আছে!
— আমরা তো..
কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না উপমা।
— উঁহু। বলেছি না যেতে পারবি না; মানে যেতে পারবি না। এসব মোটেও অ্যালাও করব না আমি।
— প্লিজ সেজো ভাই।
— আর একটা কথাও না।
দ্বিতীয়বার কড়া ধমক থামতে বাধ্য করল উপমাকে।
অতিরিক্ত একটা শব্দ ব্যয় না করে উঠে চলে গেল অতনু। যেতে যেতে বলে গেল,
— আশা করছি কথার অবাধ্য হওয়ার দুঃসাহস দেখাবি না।
অতনু চলে গেলে ঠোঁট কামড়ে মাথা নীচু করে বসে রইল উপমা। চোখ ছলছল করছে; কিন্তু কাঁদবে না। কথায় কথায় কাঁদতে ওর লজ্জা করে।

অতনুর ধমক শুনে আসমাও সতর্ক হয়েছিল বটে। তবে এখন মনে হচ্ছে মানুষটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এতটুকু ছাড় না দিলে চলে? ছোট মানুষ নাহয় খেলা দেখার আবদারই করেছে। রাজি হলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? এক ঘণ্টার পারমিশন না-হয় দিতো। নাহ্ রসকষহীন মানুষটাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে উপমার পাশে গিয়ে দাঁড়াল আসমা। স্নেহের পরশ মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
— মন খারাপ করে না। আমি ম্যানেজ করছি তোমার ভাইকে।
— উঁহু দরকার নেই ভাবী। খেলা দেখার ইচ্ছে মরে গেছে আমার।
নাক টেনে মৃদু স্বরে বলল উপমা। ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভ্র আর জান্নাতিও বলল,
— থাক দরকার নেই।
সে কথায় পাত্তা দিলো না আসমা।
— বেশি বুঝবে না তো মেয়ে। ইচ্ছে মরে গেছে মানে কি? ইচ্ছের মৃত্যু কি এতই সহজ! চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেয়া ভারী অন্যায়ের কাজ।
— চেষ্টা আমি করিনি ভাবি?
বিস্ময়ের সাথে বলল উপমা।
— কোনো জিনিস একবার চেষ্টা করে পেলে না বলে কি চেষ্টা থামিয়ে দিতে হবে? মোটেই না। দ্বিতীয় বার, তৃতীয় বার, সর্বোচ্চ যতবার তোমার সামর্থ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এরপর সফল না হলে বুঝতে হবে ওই কাজটায় তোমার রিজক নেই।
— ভাবী!
— আজ তোমার হয়ে বাকি চেষ্টাটা আমি করছি। প্রিপারেশন নাও । খেলা তো অবশ্যই দেখতে যাবে তুমি।
— থ্যাঙ্কিউ ভাবী।
স্মিতহাস্যে আসমার হাত চেপে ধরল উপমা। বিনিময়ে আসমাও অল্প হেসে বলল,
— আর কখনও বলবে না ইচ্ছে মরে গেছে। ইচ্ছের মৃত্যু খুব ভয়ানক জিনিস উপমা। এর ব্যথা অসহনীয়। আমার জীবনের সমস্ত ইচ্ছে শুধুমাত্র মেয়ে বলে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছি আমি। বুকে আমার পাহাড়সম ব্যথা। উপশম করার সময়টা নেই।
চোখের কোল জলে ভরে উঠলে আড়াল করার নিমিত্তে দ্রুত প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিলো আসমা। ওর গমনপথে তাকিয়ে উপমা প্রার্থনা করল,
“বাকি জীবনটা ভাবির সমস্ত ব্যথার উপশম যেন সেজো ভাই হয়ে ওঠে। পুরনো সবকিছুকে ভুলিয়ে মানুষটাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। পরিপূরক হয়ে ওঠে দু’জন দু’জনার”
________________

আসমার জোরাজোরিতে রাজি হয়েছে অতনু। তবে জুড়ে দিয়েছে রাজ্যের শর্ত। সময় বেঁধে দিয়েছে একঘণ্টা। যখন বেরোবে তার ঠিক একঘণ্টা পর বাড়িতে উপস্থিত হওয়া চাই। জিপ রেখে যাবে অতনু। ঐ জিপে করে যেতে হবে উপমাদের। খেলা দেখার বাইরে অন্য কোত্থাও যাওয়া চলবে না। কি করছে না করছে সব তত্ত্বাবধানের জন্য লোক পাঠিয়ে দেবে অতনু৷ অন্য শর্তগুলোতে সমস্যা নেই কিন্তু সাথে লোক পাঠাবে এই শর্তে উপমা নাখোশ। অপরিচিত একজনের সাথে যাবে। হোক না ছেলেটা ভাইয়ের পরিচিত। উপমার তো নয়। অপরিচিত একটা মানুষের সাথে কোথাও গেলে ঠিকঠাকভাবে মজা করা যায় না। কিন্তু করারও তো কিছু নেই। অনুমতি দিয়েছে এই ঢের। সব শর্ত মেনে বিকেলে তিনজনে গোঁজ মুখে বেরুলো। সাথে যে ছেলেটাকে দেয়া হয়েছে ওর নাম লিখন। কম বয়সী একটা ছেলে। মিনিটে মিনিটে পান খায় আর কথা বলে প্রচুর। উপমা অবশ্য ওর কোনো কথায় তাল দিলো না। অভ্র ছোটো মানুষ। ও বেশ আড্ডা জমাতে পারল।
উপমাদের বাড়ি থেকে স্কুলটার দূরত্ব বেশি নয়। একটু ঘুরে ঘুরে তিন চারটে গলি পার হলে রাস্তার ওপরেই। ওরা যখন গেছে খেলা তখন জমজমাট। কাছে থেকে যেন খেলা দেখতে পারে সেজন্য লিখন নামক ছেলেটার কত অস্থিরতা! উপমার আবার এসব পছন্দ হচ্ছিল না। অতিরিক্ত তোষামোদ দেখে আশেপাশের মানুষ খেলা বাদ দিয়ে ওকে দেখছে। বিষয়টা অস্বস্তিকর ছাড়া আর কিছু নয়। উপমা ভাবল যে করেই হোক এই ছেলের থেকে ছাড়া পেতে হবে।
খেলা দেখতে এসেছে একটু উল্লাস না করলে হয়! এটাওটা কিনে খাবে, অন্যের সাথে গলা মিলিয়ে টিমকে সাপোর্ট করবে এই তো। এসবই তো মজা। সুযোগটা দ্রুতই এলো উপমার কাছে।
সাথের তিনজন পুরোদমে যখন খেলায় মজে গেল। একফাঁকে জান্নাতিকে বলে উঠে পড়ল উপমা। আলাদা বসে খেলা দেখবে। সকলের সাথে গলা মিলিয়ে চিল্লাফাল্লা করবে। এই তার উদ্দেশ্য।
লিখনের চোখ এড়ানো বড় ব্যাপার হলো না। শহরের অর্ধেক লোক ভেঙে এসেছে এখানে। সেই ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে টুপ করে বিপরীত দিকে চলে এলো উপমা। ভেতরে তার চাপা উচ্ছ্বাস। কয়েক মুহুর্তের জন্য ভয়ডর ছুটিতে পাঠিয়ে অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে খেলা বেশ উপভোগ করতে লাগল ও। তখনও টের পায়নি ওর ঠিক পাশেই দাঁড়ানো চার পাঁচটা বখাটে মতো ছেলে বাজে নজরে দেখে যাচ্ছে ওকে। কয়েক জোড়া চোখ দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি পরখ করছে যেন। সম্বিত ফিরল বুকে কনুইয়ের জোর খোঁচায়। চমকে পাশ ফিরতেই নোংরা দৃষ্টিজোড়া চক্ষুগোচর হলো। ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল ভেতরটা। এই মুহুর্তে কোনোরকম ঝামেলা চাইছে না উপমা। এমনিতেই অতনুর রাজি ছিল না ওদের আসার ব্যাপারে। ঝামেলা হলে নিশ্চিত বকা খেতে হবে। তাই প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু ও ঝামেলা এড়াতে চাইলেও বখাটেগুলো তো চায় না৷ নিঃশব্দে উপমাকে প্রস্থান করতে দেখে ওদের সাহস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দ্রুত পা চালিয়ে এসে উপমার ওড়নায় টান দিলো একজন। এতখানি স্পর্ধা আর সহ্য করতে পারল না উপমা। কোনোদিকে না তাকিয়ে পিছু ঘুরে সপাটে চ’ড় বসালো ও হাতের মালিক ছেলেটাকে। চ’ড় খেয়ে ছেলেটা তো হতবিহ্বল। এমনকি আশপাশটাও কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। ঝটকা মেরে ওড়না সরিয়ে বখাটেটার কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে সরোষে বলে উঠল,
— দ্বিতীয়বার কোনো মেয়ের গায়ে হাত দেয়ার আগে এই চড়টার কথা মনে রাখবি। কু’ত্তা’রবাচ্চা।

ধাক্কা মেরে ছেলেটাকে ফেলে দিয়ে দ্বিতীয়বার প্রস্থানের নিমিত্তে পা বাড়াল উপমা। উপস্থিত জনতা হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। উপমার এসবে কিছু যায় আসে না। কিন্তু একটা মেয়ের কাছে মার খাওয়ার মতো অপমান হজম করতে পারল না বখাটেগুলো। রোষপূর্ণ দৃষ্টিতে উপমাকে দেখে অন্যদিকে চলে গেল। ওরা যে বিষয়টাকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না ওদের দৃষ্টিজোড়াই স্পষ্ট বলে দিলো।

রাগটা কোনো রকমে নিয়ন্ত্রণ করে উপমা সোজা অভ্রদের কাছে চলে গেল। তাড়া দিয়ে বলল এক্ষুণি বাড়ি যেতে চায়। কোনো কারণে চটে আছে বুঝতে পেরে অভ্র আর জান্নাতি ওকে ঘাঁটাল না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রাজি হলো ওর কথায়। লিখনও অবাক হলো ওর অকস্মাৎ মন পাল্টানো দেখে। কিন্তু কিছু বলল না। অতনুর বোন হয়। বুঝেশুনে কথা বলতে হবে এই মেয়ের সাথে। অগত্যা রওয়ানা হলো ওরা তৎক্ষনাৎ।

ওদিকে উপমাদের সমস্ত গতিবিধি দূর থেকে লক্ষ করছিল বখাটেগুলো। উপযুক্ত শাস্তি না দেয়া অবধি ওদের গায়ের রক্ত ঠান্ডা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে আরও কিছু ছেলেপেলে জুটিয়ে নিয়েছে ওরা নিজের দলে। সদলবলে মোটরসাইকেল নিয়ে আক্রমণ করবে উপমাদের ওপর এই পরিকল্পনায় স্কুল গেটে প্রস্তুত হয়েছে।
হাতে ওদের ভয়ানক কিছু অস্ত্র। এবং যে ছেলেটাকে চড় মেরেছিল উপমা ওর হাতে মাঝারি সাইজের একটা কাঁচের শিশি ভরা ঈষৎ হলুদাভ অ্যাসিড। মেয়ে মানুষের এসব বাড়াবাড়ি কীভাবে কমাতে হয় খুব ভালো করেই ওর জানা।

ভেতর থেকে কেউ এসে খবর দিলো উপমাদের গাড়ি এদিকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিলো সব। মিনিটখানেক বাদে ঠিক ওদের সামনে দিয়ে পার হলো উপমাদের জিপটা। পেছন পেছন বাকিরাও রওয়ানা হবে ঠিক সেই মুহুর্তে সামনের মোটরসাইকেলে বসে থাকা কেউ একজন হুট করে চিনে ফেলল লিখনকে। লিখন যে অতনুর সাথে কাজ করে খুব ভালো করেই জানা তার। সমক্ষেপণ না করে সে তড়িৎ উগ্র সঙ্গীসাথীদের হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ধীর গলায় বলল,
— এই মাইয়ারে কিচ্ছু করা যাবে না।
— মানেহ্! কি বলতেছিস তুই? চিন্তা করে বলতেছিস।
সকলের সম্মুখে চড় খাওয়া ছেলেটা রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলে তার দিকে শান্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো সামনের জন। বলল,
— অকালে প্রাণ যদি ক্ষো’য়াতে না চাইস তাইলে চুপচাপ আমার কথা মানি নে। মেয়ের পরিচয় না জানা অবধি একটা টোকা দিবি না কেউ ওর গায়ে।
— ও আমারে সকলের সামনে চড় মা”রছে।
— আহ্ স্বাধীন! ধৈর্য ধর। সব বিষয়ে মাথা গরম করলে চলে না।
— কিন্তু..
— বললাম না ধৈর্য ধর।
— হঠাৎ কি হইল বা”ল?
— এই মুহুর্তে বলতে পারব না।
— শা’উ’য়া আমার।
হাতে ধরে রাখা অ্যা’সিডের বোতলটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে ফেলে স্বাধীন নামক ছেলেটা মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ল।
বন্ধুর উদ্দেশ্যে আর কয়েকটা গা’লি ছুঁ’ড়ে মোটরসাইকেলে লাত্থি মেরে একদিকে হাঁটা ধরল সে। গায়ের জ্বা”লা দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে গেছে তার। ঐ মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষা না দেয়া অবধি এই জ্বা”লা প্রশমিত হওয়ার নয়।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara
★আনএডিটেড 😕

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here