চিঠি দিও ১৩(২)

চিঠি দিও
১৩(২)
__________________
বাড়ি ফিরে একটা চমক অপেক্ষা করছিল উপমার জন্য। দিনাজপুর থেকে তার ছোটোচাচা-চাচি এসেছে। ওনাদের আসার কথা ছিল পরের মাসে৷ উপমার জন্মদিনের ঠিক আগের দিন৷ এ মাসেই যে এসে পড়বেন কল্পনা করেনি উপমা। টেলিফোনে কথা হয়েছিল চাচির সঙ্গে দুদিন আগেও। কই, চাচি তো বললেন না! নিশ্চয়ই সারপ্রাইজ দেবেন বলে। ভেবে খুব আনন্দ হলো উপমার। তবে এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ছোটো চাচা, চাচিসহ পরের মাসে বিদেশে চলে যাচ্ছেন;সারাজীবনের জন্য। খবরটা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল উপমা। বাবার পরিবারের এই একটা মানুষের সাথেই তার যোগাযোগ ছিল। এই একটা মানুষকে এক ঝলক দেখলে, একবার কথা বললে বাবা না থাকার ব্যথা ভুলে থাকতে পারতো উপমা। এখন সেও তাকে ছেড়ে চলে যাবে? ভেবে ভেবে বোবা কষ্টের তরঙ্গমালা ফেনিল ঢেউ আকারে আছড়ে পড়তে শুরু করল উপমার হৃদয় গহীনে উত্তাল সাগর তীরে। উদ্বেলিত হৃদয় নিয়ে চুপচাপ বসে রইল উপমা দোর এঁটে। সমস্ত বাঁধন ঠেলে তীব্র লোনাপানির স্রোত চোখের কার্নিশ ছাপিয়ে কপোল মাড়িয়ে গড়াতে গড়াতে চিবুক ছুঁয়ে নেমে যেতে লাগল কণ্ঠদেশে। বহুদিন বাদে বালিশ কামড়ে চি”ৎকার করে কাঁদল উপমা। তার সকল ব্যথা আছড়ে পড়তে লাগল ইতিউতি বদ্ধ ঘরে চার দেয়ালের মাঝে;সকলের অগোচরে। সময় নিয়ে ঘণ্টাখানেক দুঃখবিলাশ শেষে হাতমুখে পানি দিয়ে যখন সে দোর খুলল তখন কেউ বুঝতে পারল না কি ভয়ানক অভিমান, ভয়ানক যন্ত্রণা চেপে সকলের মুখোমুখি হয়েছে মেয়েটা। এভাবেই “একা বেঁচে থাকা শিখতে হবে” অমোঘ সত্যখানা আরও একবার আত্মস্থ করে যন্ত্রণাটুকু লুকিয়ে ফেলার পরীক্ষায় সে ঠিকঠাক উতরে গেল। এরপর থেকে কারোর বিয়োগে বোধহয় কষ্ট কম হবে। কেউ হাত ছেড়ে দিতে চাইলে অসহায় লাগবে না।
সকলের আলাদা জীবন। অন্যের চিন্তায় কত বেলা কাটানো যায়?

ছোটোচাচা একসময় তাকে খুব স্নেহ করেছেন, এখনও করেন। তাই বোধহয় আড়ালের অভিমানটুকু ধরতে পারলেন। পাশে বসিয়ে সস্নেহে মাথায় হাত রেখে বললেন,
— চিন্তা কোরো না মামনী। ওখান থেকে রোজ কল করব তোমায়। সবে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার৷ পড়াশোনা গুছিয়ে নাও। বোর্ড এক্সাম দিতে দিতেই তোমার কাগজপত্র সব সেট করে ফেলব আমি।
বোকার মতো উপমা প্রশ্ন করল,
— কেন?
ছোটো চাচা হাসতে হাসতে বললেন,
— কেন কি! তোমাকেও নেব আমাদের সাথে, বিদেশে।ওখানে তো ভালো ভালো ইউনিভার্সিটি আছে। একবার গেলে জীবনটাই বদলে যাবে তোমার।
— সত্যি আমাকে নেবেন ছোটো চাচা?
খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল উপমা।
— অবশ্যই মামণি। তোমাকে তো এখনই নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তোমার মামাদের সাথে কথাও বলেছিলাম। তারা কেউ রাজি হলেন না। বললেন তোমার বোর্ড এক্সাম। এক্সামটা ভালোভাবে দিয়ে নাও। আমিও ভাবলাম বাইরে যেতে হলে অনেক কাগজি ঝামেলা আছে। তোমার চাচির আর আমারটা করাতে কত ঝক্কি পোহাতে হলো! নতুন জায়গায় যাচ্ছি গুছিয়ে নেয়ারও একটা ব্যাপার আছে। তাই না?
— হু।
ঈষৎ মাথা নাড়ল উপমা। চাচা আবারও বললেন,
— তাই ভাবলাম আমরা গিয়ে আগে সেট হয়ে নিই। এরপর তোমাকে ডেকে নেব। এই ক’টাদিন একটু ধৈর্য ধরতে পারবে না মামনী?
— পারব।
সন্তুষ্টচিত্তে মৃদু হাসলেন ছোটো চাচা।
— ভেরি গুড।
চাচার অগোচরে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল উপমা৷ মনে মনে আওড়াল,
“আমি আপনাদের ওখানে কখনোই যাব না ছোটো চাচা। আপনার সাথে আমার দেখা এবং কথা আজই শেষ। আমি জানি, আজকের পর থেকে আমার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ থাকবে না আপনাদের। টাইম চেইঞ্জেস পিপল। সময়ের সাথে আপনারা পরিবর্তন হয়ে গেছেন।আরও হবেন। আমি আপনাদের সকলের কাছে একটি অবশিষ্টাংশের মতো। প্রকৃতি অবশিষ্ট জিনিস পছন্দ করে না। তাই ওর ঝুলিতে শুধু ওকে ছাড়া আর কাউকে রাখে না। আমার কাছেও আমি ছাড়া কেউ নেই। এত এত মানুষের মাঝেও আমি একা। একাকিত্ব বোধহয় আমার চিরজীবনের সঙ্গী। মানুষ আমার হাত ধরে কেবল ছেড়ে দেয়ার জন্য। অ্যান্ড আই ডোন্ট লাইক ইট। আই হেইট মাই লাইফ। আই হেইট দ্য হোল ইউনিভার্স”
বাকি সময়টুকু মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে সকলের সামনে স্বাভাবিক রইল উপমা। চাচির সাথে গল্প করল, চাচা-চাচির উপহার পেয়ে আনন্দিত হলো, পুরোটা সময় মাতিয়ে রাখল সবাইকে।

বিকেলের দিকে চাচির হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে ছোটো চাচা নির্দেশ দিলেন বাড়ির সব মেয়েদেরকে নিয়ে মার্কেট করে আসতে। এরপর রাতে সবাইকে চাইনিজ খেতে নিয়ে যাবেন। বিদেশ যাওয়ার খুশিতে তাঁদের পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা ট্রিটের মতো। বড় মামা অবশ্য বারণ করেছিলেন, এসব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু চাচা কিংবা চাচি কেউই মানতে চাইলেন না। অগত্যা তৈরি হয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্যে বেরুলো উপমারা। আজ মামিও ওদের সাথে বেরিয়েছে বহুদিন পর। মামি এখনও সেজো ভাবির সাথে কথা বলে না। উপমার খুব বি”রক্ত লাগে। মেয়েটা নিজ পরিবার ছেড়ে এসেছে। নতুন পরিবেশ, নতুন একটা সংসার। মানিয়ে চলতে কত ক”ষ্ট। কত রকমের স”মস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই সময়গুলোতে অভিভাবকের খুব প্রয়োজন। এতগুলি মানুষ বাড়িতে। অথচ কেউ নেই ওঁর পাশে। ইদানিং সেজো ভাইয়ের ওপরও রা”গ হয় উপমার। হুট করে বিয়ে করে নিয়ে এলো। এরপর কোনো দায়দায়িত্ব নেই? সেই আগের মতো পার্টি, মিছিল-মিটিং নিয়ে পড়ে আছে। কালফজরে বাড়ি থেকে বেরোয় আর ফেরে যে কখন কেউ জানে না। কখনো তো ফেরেও না। আবার যে দিনগুলোতে বাড়িতে থাকে সেদিনও বাইরের মানুষদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ঘর-সংসারের দিকে যেন মনই নেই তার। এমনই যদি বোহেমিয়ান জীবন যাপন করবে, তাহলে বিয়েটা করার দরকার কি ছিল? মাঝেমধ্যে উপমার ইচ্ছে করে চোখ পাকিয়ে সেজো ভাইকে বলে,
“বাড়িতে যে একটা বউ নিয়ে এসেছ এ কথা কি মাথায় আছে? পাঁচটা মিনিট ভালো মতো কথা বলো তার সাথে? এমন অবহেলাই যদি করবে তাহলে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এলে কেন? অযথা সকলের কাছে খা”রা”প বানালে। বাবা-মায়ের কথা মনে করে কত কষ্ট পায় মেয়েটা। এত ইগো কিসের তোমার? বউটা তো তোমারই তাই না? ওকে ভালো রাখতে নাহয় একটু ছোটো হলে। ওর বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ঠিক করে নিলে কি হয়!”

ইচ্ছে করলেও অনেক সময় অনেক কথা বলা যায় না। হয় পরিস্থিতি সাথে থাকে না, নয়তো আত্মবিশ্বাস। তবে চোখের সামনে এসব অন্যায় হতে দেখলে খারাপ লাগে বৈকি!

— কিরে চাচা-চাচি চলে যাচ্ছে জন্য মন খারাপ?
পাশ থেকে চাপা গলায় মামির কথাটা শুনলে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফেরে উপমা। ফিরে তাকিয়ে মাথা নাড়ে।
— উঁহু।
কি বোঝে মামি। হঠাৎ হাত টেনে ধরে উপমার। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলে,
— মন খারাপ করিস না৷ চিরকাল পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা সবাই করে। কিন্তু জানে না এটা একটা ভুয়া প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিজ্ঞা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।
বলে একটু থামে। উপমা জানে তার দাদাবাড়ীর পরিবারকে এ বাড়ির কেউ ছিটেফোঁটা পছন্দ করে না। ছোটো চাচা নিজে থেকে এসে অধিকার জমানোর চেষ্টা করতো বলে কেউ কিছু বলেনি।

ধীর গলায় মামি আবারও বলে ওঠে,
— আমারদের জীবনটা হলো যোগ-বিয়োগের।কেউ আসবে, কেউ যাবে এটাই নিয়ম। একসময় আমরা ছাড়াও তোর পাশে তোর নানী, বড় মামী ছিলেন। আজ তাঁরা নেই। তেমন আমরাও একদিন থাকব না। সময় ফুরবে, আমরাও চলে যাব। তখন তোর কাছে থাকবে আমাদের রেখে যাওয়া কিছু স্মৃতি আর বুকভরা ভালোবাসা। এই দুটো জিনিস যদি আগলে রাখতে পারিস তাহলেই তুই ভালো থাকবি। নিজেকে কখনও একা ভাববি না আনন্দি। ভালোবাসা যেখানে থাকে তিক্ততাকেও সেখানে জায়গা দিতে হয়। তিক্ততা থাকলেই যে ভালোবাসা মিথ্যে তেমন কিন্তু নয়। যে সময়টা তোর ভালোবাসার ছিল সে সময়টা উজাড় করা ভালোবাসাই পেয়েছিস তুই। তিক্ত সময় এলে ঐ ভালোবাসাটুকু ভুলে যাবি না।
— মামি।
ছলছল চোখে মামির পানে তাকাল উপমা। মৃদু হাস্যে উপমার মাথায় হাত বুলিয়ে শিল্পী বলল,
— চাচার ওপর মান করিস না। ওদের আলাদা জীবন,আলাদা সংসার আছে মা। চাইলেও নিজ সংসারের বাইরে চিন্তা করা সম্ভব হবে না। তোর ছোটো চাচা ছেলেটা অতটাও খারাপ নয়। ও তোর জন্য ভাবে। তোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। তোর চাচির কাছে শুনলাম তোকে ছেড়ে যেতে হবে বলে খুব মন খারাপ। পাশাপাশি এই ভেবেও নিশ্চিন্ত হয়েছে তুই তো আমাদের কাছে আছিস, নিরাপদে আছিস। ভালো রেখেছি আমরা তোকে।
আপাতত তুই আমাদের কাছেই থাক। ওরা যাক, গুছিয়ে উঠুক। তোকে নেয়ার পরিকল্পনাও তো করছে।
— আমি যাব না মামি। আপনাদের ছেড়ে কিছুতেই যাব না।
মামির হাত চেপে ধরে ভেজা গলায় বলল উপমা।
— পাগলি। কাঁদিস কেন? যাবি না, যাবি না। আমাদেরও অত ইচ্ছে নেই তোকে পাঠানোর। একটাই মেয়ে আমাদের। নিজের কাছে রাখব। তা না ওই দূরদেশে পাঠাব কেন?
উপমা কিছু বলল না। মামির হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
— এসব নিয়ে চিন্তা আপাতত বাদ। যেজন্য এসেছি ঠিকঠাকভাবে সেটা করি। ঘুরেফিরে মনটা ভালো কর তো। তোকে ব্যাজার মুখে দেখতে একটুও ভালো লাগে না।
মামির কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেল উপমা। সাথে অবাকও হলো ভীষণ। মামি পাল্টে যাচ্ছে। যার তীর্যক কথায় বাড়িতে টেকা যেত না। আজ সে এত ভালোভাবে তাকে বোঝালো সত্যিই খুব অবাক লাগছে।
শিল্পী তাড়া দিলেন,
— পা চালা জলদি। দেখ ওরা কত সামনে। আর
চোখমুখ স্বাভাবিক কর তো। কেউ দেখতে পেলে আবার প্রশ্ন করবে।
— হু।
মাথা নেড়ে মামির সাথে পা বাড়াল উপমা।
________________________________
— কিরে শালা, তুই প্রেমে পড়ছিস আমাক কইস নাই। এই তোর ইয়ারি-দোস্তি।
ঝাঁঝাল গলায় কথাটি বললে বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে মিজানের দিকে তাকাল রওনক। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
— কিসের প্রেম-পিরিতি। ঐসবের সময় আছে নাকি।
— শোনো বন্ধু নাটক মারাবা না। তোমার নাড়িনক্ষত্র ভালোমতো চেনা আছে আমার। সকাল-সন্ধ্যা ছায়ার মতো চলি আমি তোমার সাথে। তাই এইসব নাটক আর কারো কাছে গিয়া মারাও।
রাগে চোখমুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে মিজানের। ওর রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল রওনকের। হো হো করে হাসতে হাসতে সে ছাদের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল,
— আজকে কেউ গেছলো ওরে নিয়া আসতে ?
— কাউকো যাওয়া লাগে? পাখি একলা একলা এসে পরিচিত গলি মাড়ায় গেছে।
— মানেহ্!
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল রওনক। ওর পাশে বসে মিজান সব ঘটনা প্রথম থেকে বর্ণনা করল। ভেবেছিল রওনক খুশি হবে। কিন্তু ওর দিক থেকে আকশানুরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। নিঃশব্দে হেসে আকাশের দিকে তাকাল রওনক। তা দেখে মিজান যার পরনায় বি”রক্ত। তবে তার বিরক্তিভাব বেশিক্ষণ রইল না। আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে রওনক হঠাৎ বলল,
— এত খুশি লাগতেছে ক্যান রে ব্যাটা?
রওনকের কথা শুনে মিজানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। পেটে জোর গুঁতো দিয়ে বলল,
— মুখ তো কইরা রাখছিস পাত্থরে মতন।
— আরেহ ব্যাটা মুখ খুললে তো চিক্কুর দিবরে।
— তো দে। না করছে কেডায়?
— বড় ভাই বাড়িতে আছে। চিক্কুর দিলে সমস্যা। কিন্তু না দিয়াও তো পারতেছি না।
বলতে বলতে এক লাফে উঠে দাঁড়াল রওনক। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে মিজানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— চ’
— কই যাব?
— চিক্কুর পাড়তে।
— এখন।
— হ। মুখ বন্ধ করি চ।
মিজানকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ত্রস্তে এগিয়ে গেল রওনক সিঁড়ির দিকে। ওর পথ অনুসরণ করে আপনমনেই হেসে উঠল মিজান। পাগল আছে তার বন্ধুটা। পুরো পাগল।
_______________
ভাবীকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে মিজানকে নিয়ে বেরুলো রওনক। হাইস্পিডে চলমান হোন্ডাটা তেঁতুলতলা পেরিয়ে, জররেজ সরণী হয়ে রামমোহন ক্লাব অভীমুখে। কোথায় যাচ্ছে কেউই জানে না। তবে গতিপথ বাতলে দিচ্ছে ডাকু সর্দারনীর বাড়ি এই পথ অনুসরণেই যায়। ব্যস্ত রাস্তা, রাস্তাভরা মানুষ কোনোকিছুর দিকে নজর নেই রওনকের। সে সত্যি সত্যি কাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে যাওয়ার খুশিতে চিৎকার করছে। এত বছরে এতখানি খুশি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হলো সে। প্রথমবার হয়েছিল আশিকের জন্মের সময়।
পেছনে বসে মিজানও ওর তালে তাল মিলিয়ে উল্লাস করে যাচ্ছে। রওনকের চাইতে ও দ্বিগুণ-তিনগুণ খুশি। রওনকের হাসিমাখা মুখটা ওকে আজ বড়ই আনন্দিত করছে। হাসিমুখের কারণ যে মানুষটা, তাকে সামনাসামনি ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে।
বলা বাহুল্য দিন-দাহাড়ে দুজন ছেলে মানুষের অকারণ উল্লাসের কারণ কেউই বুঝতে পারছে না। কেউ বোকার মতো তাকিয়ে দেখছে, কেউবা ভীষণ বি”রক্তির নজরে। সেসবে অবশ্য দুই বন্ধুর কিছু যায় আসে না। চারিদিকে নজর দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাদের নেই। আপন খেয়ালের জগতে তারা বেশ ভালো আছে।

প্রেসক্লাব পর্যন্ত নির্বিঘ্নে এগোতে পারলেও প্রেসক্লাবটা পার হলে গতিতে বিঘ্ন ঘটতে দেখা গেল। কোনো এক বিশেষ কারণে রাস্তা ব্লক। সারি-সারি গাড়ি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। একচুল নড়ার উপায় নেই। থমকে থাকা রাস্তাটা দেখে রওনকদের উল্লাস খানিক স্তিমিত হলো। হোন্ডা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে একে অপরের দিকে তাকাল ওরা। কেউই কিছু বুঝতে পারল না। তখুনি মিজানের কি মনে হলো পাশে দাঁড়ানো এক রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করল, ঘটনার কিছু জানা আছে কি না!
কিন্তু রিকশাচালক মাথা নেড়ে বলল, সে কিছু জানে না। মাত্র এসেছে।
তন্মধ্যে হঠাৎ সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটি অ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশের গাড়ি সামনে দিয়ে যেতে দেখা গেল। দুই বন্ধুই এবার বেশ কৌতুহলী হয়ে পড়ল।
পেছন থেকে মিজান বলল,
— ঘটনা জটিল মনে হইতেছে রওনক। পত্রিকা অফিসের রাস্তা ধর।
রওনককও তেমনটাই চিন্তা করছিল। এক মুহুর্ত নষ্ট না করে ফাঁক ফোকর গলিয়ে সে পত্রিকা অফিসের গলি দিয়ে রওয়ানা হলো রামমোহন ক্লাবের দিকে।
অতদূর অবশ্য যেতে হলো না। পত্রিকা অফিস থেকে বেরোতেই সুপার মার্কেট সংলগ্ন এরিয়াতে পুলিশের গাড়ি এবং অ্যাম্বুলেন্স উভয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। হোন্ডা সাইড করে নেমে পড়ল রওনক এবং মিজান। কোনোকিছু না ভেবে সরাসরি অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগিয়ে গেল তারা। সেখানে গেলেই দেখা গেল অ্যাসিডে সম্পূর্ণ ঝলসে যাওয়া একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। সেই দৃশ্যই দেখছে উৎসুক জনতা। মর্মান্তিক এই দৃশ্যখানা দেখে রওনক এবং মিজান দু’জনেরই হাসিমুখ মলিন হয়ে গেল। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে রওনক এগিয়ে গেল অল্প দূরে দাঁড়ানো পুলিশের জিপটার দিকে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রতক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। কাছাকাছি যেতেই রওনক দেখলো এই কর্মকর্তা তো তার পরিচিত। হাত মিলিয়ে সে সরাসরিই জিজ্ঞেস করল পুলিশকে দুর্ঘটনার ব্যাপারে। পুলিশ খোলাসা করে বলতে পারল না কিছুই। মেয়েটা কে, তার পরিচয় কি কেউই বলতে পারছে না। মিনিট পনেরো আগে একা একা হেঁটে আসতে দেখা যায় তাকে রামমোহন রোড থেকে। সুপারমার্কেটের সামনে আসতে না আসতেই কোত্থেকে ভূ”তের মতো প্রকট হয় মোটরসাইকেলগামী দু’জন। এরপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাটি ঘটে যায়। মেয়েটার মুখ পুরোপুরি ঝ”লসে গেছে। এমনকি কিছুটা অ্যাসিড তার শরীরেও লেগেছে। দিন-দাহাড়ে এমন ভয়ানক ঘটনা এই শহরে আজ প্রথম। অ্যাসিড সন্ত্রাস আছে শহরে। কিন্তু এতটাও ফলাও করে কোনো ঘটনা পূর্বে ঘটতে দেখা যায়নি। আপাতত ক্লু লেস পুলিশ।
এসব ব্যাপারেই কথা চলল রওনকের পুলিশ কর্মকর্তার সাথে বেশ কিছুক্ষণ। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কি মনে করে সে মুখ তুলে সামনে তাকাল। তখুনি মনে হলো রাস্তার ওপাশে একটা পরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল রওনকের। কথা শেষ করে যখন সে এগোবে, ঠিক সেই মুহুর্তে বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন একটা পিকআপ ভ্যান এসে সরাসরি উঠে গেল ফুটপাতের ওপর যেখানে সে দাঁড়ানো ছিল। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল, রওনক তাকে সতর্কই করতে পারল না এবং পিক-আপের জোর ধা”ক্কায় ফুটপাত থেকে সে ছিটকে পড়ল বড় রাস্তায়। পিচঢালা রাস্তা নিমেষে হয়ে উঠল ভ”য়াল রক্তিম। নারীকণ্ঠের কেউ সবেগে চিৎকার করে উঠল, “আনন্দি”

রওনক কিচ্ছু শুনতে পারছিল না। পথের ধারে মুখ থু”বড়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত উপমাকে দেখে তার সম্পূর্ণ শরীর অবশ হয়ে আসতে চাইল। তবে এই বিবশতা ক্ষণিকের। মিনিটখানেকে ঘটনাটা বুঝে উঠতেই আচমকা হিংস্র হয়ে উঠল সে। এতগুলো মানুষ, পেছনে দাঁড়ানো পুলিশ কারোর দিকে খেয়াল না করে কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ল পিকআপের দিকে। লাভের লাভ তেমন হলো না। পিকআপে আসলে কেউই ছিল না। নির্দেশমতো শিকারকে ঠুকে সে জীবন হাতে নিয়ে কখন ছুট লাগিয়েছে। সামনাসামনি দুটো ঘটনা দেখে পুলিশ তো বিমূঢ়। ওয়াকিটকি ‌যোগে ফোর্স পাঠাতে বলে পুলিশ এগোলো উপমার দিকে। ততক্ষণে ছুটে রাস্তাটা পার হয়েছে রওনক। জ্ঞানহীন উপমাকে চেপে ধরেছে বুকের সাথে। অবিরত বেরুতে থাকা গাঢ় রক্তে ভিজে যাচ্ছে ওর গায়ের শার্ট। এসবে অবশ্য ওর খেয়াল নেই। প্রিয়তমাকে দু হাতে আগলে নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে সে ডেকে যাচ্ছে,
— উপমা? এ্যাই মেয়ে। এ্যাই কথা বলছো না কেন? উপমা। একবার তাকাও প্লিজ।
বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে রওনকের। বাহুতে জড়ানো জ্ঞানহীন উপমাকে দেখে হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো রওনক। নাহ্ বেসামাল হলে চলবে না। জলদি হসপিটালে নিতে হবে মেয়েটাকে। উপমার বাড়ির লোক এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল সব। ওকে কোলে করে রওনক যখন উঠে দাঁড়াল তখুনি সবার টনক নড়ল। ছুটে এসে রওনকের হাত টেনে ধরল উপমার মামি। ভীত কণ্ঠে বলল,
— এ্যাই ছেলে কে তুমি? কোথায় যাও আমাদের মেয়েকে নিয়ে।
রক্তিম চোখে রওনক ফিরে তাকাল তাঁর দিকে। স্বল্প কথায় বলল,
— এখন এত কথা বলার সময় নয়। ওকে হসপিটালে নিতে হবে। জলদি আসুন।

এরপর পুলিশের সাহায্যে পুলিশের জিপে করে উপমাকে নিয়ে রওয়ানা হলো রওনক হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পুরোটা পথ উপমাকে সে বুকে চেপে রাখল নিবিড় আলিঙ্গনে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভ”য় কাবু করে রাখল ওকে। ভাগ্যিস বাড়ির মানুষদের অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল মিজান। এই দুঃসময়ে তার মস্তিষ্ক ঠান্ডাই ছিল। ভুলবশত রওনের একটুখানি পাগলামি দেখে ফেলেছে ওরা। এটাকে নাহয় ট্যাকল দেয়া যাবে। কিন্তু জিপে বসে যেভাবে জড়িয়ে ধরে আছে। এই দৃশ্য দেখলে নিশ্চিত সব হাতের বাইরে চলে যেত।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রওনকের কাঁধে হাত রাখল মিজান। সান্ত্বনাসুলভ কিছু বাক্য বেরুনোর পূর্বে ক্রো”ধে অন্ধ রওনক দাঁতে দাঁত চেপে তাকে বলল,
— এর পেছনে যার হাত আছে তাকে আমার জীবিত চাই মিজান। কীভাবে করবি জানি না কিন্তু আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই ওকে আমার সামনে চাই।
সামনে পুলিশ বসা। এই মুহুর্তে রওনকের লাগামছাড়া কথাবার্তা দেখে থতমত খেয়ে গেল মিজান। কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে থামতে ইশারা করল রওনককে। রওনক ফিরে তাকাল ওর দিকে। চুপ তো করলই না বরং আরও দৃঢ় স্বরে বলল,
— যে সিন্দুকের ভেতরেই লুকায় থাকুক না কেন ওকে আমার চাই। আমার কলিজার দিকে হাত বাড়ায় কার এতবড় দুঃসাহস! ওর হাত উপড়ে না ফেলা অবধি আমার শান্তি নাই।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here