চিঠি দিও ১৪

চিঠি দিও
১৪
___________________

মাথায় বেশ ভালো রকমের চোট পেয়েছে উপমা। চারটে স্টিচ লেগেছে। দুই চোখ এবং ভ্রুর কাছটা ফুলে লাল হয়ে আছে। কেবিনের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। ভেতরে উপমার বাড়ির লোক সব। কিছুক্ষণের মধ্যে অতনুও চলে আসবে নিশ্চিত। এই মুহুর্তে অতনুর সামনে পড়তে চাইছে না রওনক। মাথা গরম আছে ওর। বাঁকা কথা শুনলেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রস্থান করতে হবে। ও মূলত অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্য। ডাক্তারের মুখে উপমার খবর না নেয়া অবধি শান্তি লাগছে না। ভাবনার অবকাশে বুক পকেটে মৃদু ক’ম্পন অনুভব করল রওনক। চট করে পকেটে হাত দিতেই মনে পড়ল ওর তো একটা সেলফোন হয়েছে। ব্যবসার প্রয়োজনে আনিস শেখ ওকে আর মিজানকে একটা একটা করে সেলফোন দিয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়ে রওনক দেখল ছোট্ট আয়তাকার স্ক্রিনে আনিস শেখের নাম ভেসে উঠছে। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনাটা নিশ্চয়ই কানে চলে গেছে লোকটার! ফোঁস করে শ্বাস ফেলে হাঁটতে হাঁটতে প্যাসেজের শেষ মাথায় চলে এলো রওনক। ততক্ষণে কল বাজতে বাজতে কেটে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো কোনো মানুষের অস্তিত্ব আছে কি না! রি-ডায়াল করবে, তন্মধ্যেই হাতের ভেতর ফোনটা পুনরায় কাঁপতে লাগল। সময়ক্ষেপণ না করে সাথেসাথে রিসিভ করে ফোনটা কানে ঠেকালো রওনক। নীচু গলায় বলল,
— জ্বী আনিস ভাই৷
— রওনক কি শুনতেছি আমি এইগলা। কিসব পাগলামি করছিস তুই। তুই নাকি পুলিশের সামনে গুলি ছুঁড়ছিস?
— জ্বী।
বিব্রত কণ্ঠে বলল রওনক। ফোনের ওপাশে ভীষণ বিরক্ত হলো আনিস শেখ। চ’ জাতীয় একটা শব্দ করে বলল,
— কি কারণে করলি এরকম৷ তোর বোধবুদ্ধি কি লোপ পাইছে? জানি বুঝি কেউ পুলিশের নজরে আসে!
— ভাই আমার মাথা ঠিক ছিল না। ভুল হয়া গেছে ভাই। আপনি বিষয়টা একটু দেখেন না।

কণ্ঠে মেকি কাতরতা ফুটিয়ে তুলল রওনক। বিনিময়ে খানিক নীরব থেকে আনিস বলল,
— ঠিকাছে আমি দেখতিছি বিষয়ডা। আর কক্ষনও এইরকম করবি না। এইটায় একটা বড় সমস্যা তোর, অল্পতেই মাথা গরম করে ফেলিস। তুই জানিস না এই লাইনে মাথা ঠান্ডা করি চলা লাগবে। নিজাম সাবের কানে গেলে কি হবে ধারণা করতে পারিস!
— ভাই আপনি একটু দেখেন না প্লিজ।
— হ হ দেখাম আমি। কিন্তু তুই কামডা করলি ক্যান ক তো?
— আপনার সাথে দেখা হইলে বলব। বিষয়ডা একটু জটিল।
— ঠিকাছে ঠিকাছে। দেখা হইলেই কস। এখন ক তো সব পুস্তুতি নিছিস? কালকা রাতের গাড়ি কিন্তু।
— হ্যাঁ সব প্রস্তুতি শেষ।
— গাড়ি কই যাইতে বলব?
— ক্লাবের সামনে আসতে বইলেন। তাতেই হবে।
— আচ্ছা। এই বিষয়ডা নিয়া টেনশন করিস না আমি দেখতেছি। মন দিয়া কাজ করবি।
— জ্বী আচ্ছা ভাই। আসসালামু আলাইকুম।
— অলাইকুম।
বলে ফোন কেটে দিলো আনিস শেখ। ফোন রাখার পর চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো রওনক। চোখের পর্দায় এখনও ধূসর হয়ে উপমার র'”ক্তা”‘ক্ত মুখটা ভেসে উঠছে। জ্ঞান হারাবার আগে উপমা কা’ত’র চোখে চেয়েছিল ওর দিকে। ওই দৃষ্টিটা কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না রওনক। মনে হচ্ছে দৃষ্টিটা তাচ্ছিল্য করে ওকে বলছে, “কতখানি ভালোবাস? একটা দুর্ঘটনা আটকাতে পারলে না। এই তোমার ভালোবাসা!”

— এইটা কোনো দুর্ঘটনা আছিলো না রুনু। মেয়েটাক মার্ডারের উদ্দেশ্যে এইটা করা হইছে।

কানে পরিচিত কণ্ঠস্বরের ধাক্কায় চোখ মেলে তাকাল রওনক। সামনে মিজান দাঁড়ানো। চমকপ্রদ ওর কথাটা শুনে হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। গম্ভীর ভাবে শুধল,
— কারণ?
— কারণ, যে ব্যক্তি ঘটনাটা ঘটাইছে তার লগে উপমার বাজছিল কয়দিন আগে। তোর মনে আছে হপ্তাখানেক আগে একটা ফুটবল ম্যাচ হইল?
— হু।
— ঐ ফুটবল ম্যাচে ঘটে ঘটনাডা।
একে একে ফুটবল ম্যাচে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা রওনকের সামনে বর্ণনা করল মিজান যা সে এক নির্ভরযোগ্য জায়গা থেকে মাত্র শুনে এসেছে। সব শুনে রওনকের রাগের পারদ আকাশচুম্বী। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কঠোর গলায় সে জিজ্ঞেস করল,
— সব কয়ডার নাম ঠিকানা জোগাড় করছিস?
— সব কয়ডার পারিনাই। কেউই আসলে জানে না ওদের পরিচয়। তবে এইটা শুনলাম ওরা আমাদের জাতের না।
— জাতের না মানে?
— মানে বিহারি। কই থেকা কে ওদেক নিয়া আসছে কেউ বলতে পারতেছে না। তবে উপমা যারে থাপড়াইছে ঐ পোলাটার খোঁজ নিবার পারছি। অর নাম স্বাধীন। এলাকার পাতি মাস্তান আছিলো। কয়দিন হইলো অপজিশনে নাম লেখাইছে। লেখায়েই বস ভাবা শুরু করছে নিজেক।
— উয়ার বসগিরি ছুটাব আমি। পাখা গজাইছে! নাম লেখায়েই নিজেরে লিডার ভেবে বসে আছে। ওর সাহস কি করে হয় আমার উপমার দিকে হাত বাড়ায়!
এ কথার জবাবে চিন্তাগ্রস্ত গলায় মিজান বলল,
— কিন্তু রুনু ওদের পরিচয় নিবার যায়ে মনের ভেতর খচখচ শুরু হইছে আমার। রফিক্কারে যারা মারছিল ওরাও এদের মতো ছিল। নাম পরিচয়হীন। হুট করে অপজিশনে নাম লেখায়ে বসগিরী শুরু করছিল। আবার এই ছেলেগুলা। তোর কি মনে প্রশ্ন জাগতেছে না, হুট করি শহরে নতুন মুখ বাড়তে শুরু করছে কেন? আর এরা এত আক্রমণাত্মক!
মিজানের দুশ্চিন্তা এবার রওনককেও ছুঁয়ে ফেলল কিছুটা। মুষ্টি শিথিল করে ভাবুক হয়ে সে বলল,
— এই ভাবনাটা আমার মাথায়ও আসছিল বেশ কয়েকবার। খোঁজ লাগাইতে বলছি আমি মজনুদের। সমস্যা নাই। আমরা ফিরা আসি। সব রহস্যের ঘাট উন্মোচন ফেলব।

রওনকের কথায় আশ্বস্ত হলো মিজান। দুশ্চিন্তা সরে গিয়ে হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখা গেল তার ঠোঁটের কোণে। কোমর থেকে সদ্য কিনে আনা ফোল্ডের ছু”রি বের করে রওনকের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
— আর স্বাধীন?
মিজানের দিকে এক পলক তাকাল রওনক। ছুরিটা হাতে নিয়ে বাঁকা হেসে স্বগতোক্তি করল,
— চলো, স্বাধীনরে এই নচ্ছার পৃথিবী থেকে পারমানেন্ট স্বাধীনতাটা দিয়ে আসি।
রওনকের কথায় হো হো করে হেসে উঠল মিজান। আজ বহুদিন পর শিকারীর ভূমিকায় দেখা যাবে তার প্রিয় বন্ধুটিকে। নৃশংস রওনক আর শিকারের চোখে ভয়;দৃশ্যদুটো বড্ড আনন্দ দেয় মিজানকে। কেন আনন্দ দেয় জানা নেই।
আসলে মানুষকে অবদমিত করে রাখার মধ্যেই একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে।

ডাক্তারের থেকে উপমার খোঁজ খবর নিয়ে এরপর বেরুলো রওনক। স্যালাইনটা শেষ হলেই রিলিজ করে দেয়া হবে শুনে যেমন স্বস্তিবোধ করল, তেমনই আঘাতে ফোলা ওর মুখটা দেখে ভীষণ কষ্ট হলো। কষ্টে রাগ বাড়ে, ঘৃণা বাড়ে। স্বাধীন ছেলেটাকে সহজ মৃত্যু যে দেবে না প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

স্বাধীন নামক ছেলেটা প্রতিশোধে অন্ধ হয়ে চিন্তা করেনি একটা দুর্ঘটনা ঘটালে তার নিজের ওপর এর প্রভাব কতখানি পড়তে পারে। ওর বন্ধুরা বার-বার সাবধান করেছিল মেয়েটার খোঁজ খবর না নেয়া অবধি কিচ্ছু যেন না করা হয়। স্বাধীন তখন ভুল বুঝেছিল বন্ধুদের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওদের কথা চুপচাপ মেনে নিলে আজ দিগ্বিদিক হারা হয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে এভাবে পালাতে হতো না। একটু আগেই পরিচয় পেয়েছে ও মেয়েটার। অতনু হাওলাদারের বোন হয় মেয়েটা। অতনু কতটা হিংস্র কারোরই অজানা নয়। একবার ধরতে পারলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ছাড়বে, লাশেরও খোঁজ পাবে না কেউ। নাহ্ অতনু ধরার আগেই ওকে পালাতে হবে।
গাইবান্ধার কাছাকাছি সাদুল্লাহ্পুরে ওর এক দুঃসম্পর্কের মামার বাড়ি। আপাতত সেখানেই গা ঢাকা দেবে স্বাধীন। এরপর পরিস্থিতি বুঝে ঢাকামুখী হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দ্রুতহাতে গুছিয়ে নেয়া ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে ঘর তালাবদ্ধ করে রওয়ানা হলো স্বাধীন বাসস্টপের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে জানে না ইতোমধ্যে আ”জ”রা”ইল উপস্থিত হয়েছে তার প্রাণ বায়ু টেনে নেয়ার জন্য। যে ভ্যানে করে সে রওয়ানা হয়েছে ঐ ভ্যানটাই তাকে মৃত্যুকূপে নিয়ে রেখে আসবে। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সে হবেই। তবে যার হাতে ভেবেছিল তার হাতে নয়। অন্য কারোর হাতে। যাকে এখনও ঠিকঠাক চেনা হয়ে ওঠেনি, অথচ যার বিস্তৃতি ছড়িয়ে গেছে বহুদূর।
শেষ মুহুর্তে হয়তোবা তার দৃষ্টিজুড়ে মেলা বসাবে নানামুখী প্রশ্নের ভীড়। তবে কি ক্ষমতার রদবদল হয়ে গেল?
তার প্রশ্নের একটাই উত্তর, হয়নি কিন্তু হতে কতক্ষণ! এই শহরে কোনোকিছুর রদবদলে সময় লাগে না। অগোচরে তো কত কিছুই ঘটে যায়। খোঁজ রাখে কে কতখানি?

তরতাজা একটা মানুষকে একদম গায়েব করে দেয়া কঠিন বৈকি! কতদিকে খেয়াল রেখে কাজ করতে হয়;সন্দেহের অবকাশ যেন না থাকে৷ এছাড়াও এবারের কাজটা সবচেয়ে সিক্রেটিভ কাজগুলোর একটা হওয়ায় বডি গুম, আলামত মুছে দেয়া একা হাতে করতে হলো রওনক এবং মিজানকে। সব কাজ শেষ করে যখন ক্লাবে ফিরল তখন রাতের তিনটে পনেরো। টপাটপ দুই পেগ চড়িয়ে ক্লান্ত শরীরে মিজান তো ঘুমে কাদা। ঘুম এলো না কেবল রওনকের। ক্লাবের বাইরে খোলা উঠোনে চেয়ারে পেতে বসে রইল সে পুরো রাত। নির্ঘুম রাতের ছাপে চোখের কোল ভরে উঠল। উঠোনটাও ভরে গেল সিগারেটের ফিল্টারে। কত প্যাকেট সিগারেট খেয়ে ফেলেছে বুঝতেই পারল না রওনক। এই চিত্রটা খুব পরিচিত একটা চিত্র। রক্তে হাত রাঙানোর রাতগুলিতে ঘুম তার চোখে জড়াতে চায় না। নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় নিরালা বসে রাত পার করে দেয় সে। একা একা বড্ড অশান্তি হয় তার। অজানা কষ্টে বুক ভার হয়ে আসে। সে কি তখন পাপ-পুন্যের দ্বিধায় দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে? নইলে এত অশান্তি হবে কেন। ঠিক কোন বিষয়টা নিয়ে সে পাপবোধ করে? তার জীবনে পাপের কাজ কতটুকু আর পুন্যের কাজই বা কতটুকু? হিসেব কি নিজেরই জানা!
আকণ্ঠ হ”তা”শায় ডুবে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয় রওনক। দৃষ্টিজোড়া অদূরে নিকষ কালো আঁধারে ঢাকা সুবিশাল আকাশটার দিকে। রিক্তশূন্য তিমিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আপনমনে বিড়বিড় করে, “মুক্তি কোথায়?”
_______

আগের রাতে ঠিকমতো ঘুম না হলেও দিনের বেলাটা একটু ঘুমিয়ে নেয় রওনক। ঘুম থেকে ওঠে একদম দুপুরের দিকে। এরপর বেরিয়ে যায় হোন্ডা নিয়ে। এলেবেলে কিছু কাজ গুছিয়ে বাড়ি ফেরে। সন্ধেটা কাটায় ভাস্তে আশিকের সাথে। এরপর ব্যাগ গুছিয়ে ভাই-ভাবির থেকে বিদায় নিয়ে রাত সাড়ে ন’টার দিকে রওয়ানা হয় বাড়ি থেকে। ক্লাবের সামনে থেকে রিসিভ করবে কথা থাকলেও পরবর্তীতে জায়গা পাল্টে মিজানের বাড়িতে আসতে বলে দেয় আনিসকে। রওয়ানা হবে ওরা বারোটার দিকে। ততক্ষণ মিজানের বাড়িতেই সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয় রওনক। মনটা ওর খচখচ করছে। শেষ মুহুর্তে উপমাকে দেখে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এখন রাত। এই রাতে ওর দেখা পাবে কি করে?
প্রিয় বন্ধুটির অস্থিরতা কি করে যেন বুঝে ফেলে মিজান। হুট করেই প্রশ্ন করে,
— কি, পাখিরে মনে পড়তেছে?
বন্ধুর ঠাট্টায় যোগ দেয় না রওনক। বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলে,
— ধের!
মিজান হাসে। কোত্থেকে ছোট্ট একটা কাগজ এনে হাতে পুরে দিয়ে বলে,
— এই নে ব্যাটা তোর পাখির নম্বর।
কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে যায় রওনক। সত্যি সত্যি একটা টেলিফোন নম্বর লেখা। বিস্ময়াভিভূত হয়েই শুধয়,
— তুই কোথায় পেলি?
— পাইছি একভাবে। সব তোরে কওয়া লাগবে?
— তুই শিওর এইটা ওদের বাড়ির নম্বর?
— আমার ওপর সন্দেহ করিস ব্যাটা!
কপট রাগে মিজান।
জবাবে মাথা চুলকে মৃদু হাসে রওনক। কাগজটা হাতে নিয়ে একদণ্ড ভাবে। এরপর হুট করে মিজানকে বলে,
— চল।
— কই?
— ওর বাড়ির সামনে।
— মানে! পাগল হইছিস? স্বেচ্ছায় সিং”হে”র গুহায় পা দেব ক্যান?
— ঐ সিংহের গুহায় আমার হরিণী থাকে। হরিণীকে একপলক দেখতে যাব।
— যাওয়া-যাওয়ির কথা আসে ক্যান? কথা বললেই তো হই যাইতেছে।
— নাহ্ হবে না। কথা বললে দেখতে ইচ্ছা করবে।
— তুই শা”লা নিজেও ডুববি, আমাকও ডুবাবি। সেই পায়তারা করতেছিস৷
— আরেহ্ চল কিচ্ছু হবে না।
— ধের আমি যাবার পাবো না। হাওলাদারের হাতে প্রা”ণ দেয়ার শখ নাই আমার।
— আরে ব্যাটা আমি আছি তো।
— উঁহু ।
নিমরাজিভাবে মাথা নাড়ে মিজান। ওকে টেনে দাঁড় করাতে করাতে রওনক বলে,
— বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়াবি না?
— শালা বন্ধু বন্ধু করে আমাক বাঁশ ডলা দিবি তুই।
হাত ঝাড়া দিয়ে মোটরসাইকেলের চাবি আনতে যায় মিজান। মোটরসাইকেল ওরও একটা আছে। শখ করে কিনেছিল। কিন্তু তেমন কাজে লাগে না। প্রতিদিন দেখে, ঝেড়ে মুছে চকচকে করে আর ঘরের ভেতর রেখে দেয়। প্রয়োজন সব রওনকের হোন্ডা দিয়েই তো হয়ে যায়। তাই তার মোটরসাইকেল ছুটিতে থাকে।
আজ বহুদিন পর শখের মোটরসাইকেলটির ছুটি ফুরলো। কে জানে বন্ধ থাকতে থাকতে স্টার্ট নেয়া ভুলে গেল নাকি মোটরসাইকেলটা!

অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে সকলের বিশেষ যত্নআত্তি পাচ্ছে উপমা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বিছানা থেকে এক পা নামতেও হচ্ছে না। একটু নড়েচড়ে বসলেও অভ্র ছুটে এসে জিজ্ঞেস করছে, “বু তোমার কিছু লাগবে?”
একদিনেই অস্থির উপমা। যত্নআত্তি কম
রেস্ট্রিকশন লাগছে বেশি। মনে হচ্ছে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে তাকে। একটু হাঁটাচলা করতেও পারমিশনের প্রয়োজন পড়ছে।

বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে অভ্র নেই। কোথায় গেছে কে জানে! ভালোই হয়েছে। এবার একটু হাঁটাচলা করা যাবে। মুচকি হেসে নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল উপমা। কলেজ যেতে পারেনি। মিতালি আর সাজুর বিষয়টা কতদূর গড়ালো তা নিয়ে খুব আগ্রহ ওর। আচ্ছা মিতালিকে ফোন করলে কেমন হয়? ঘড়ির দিকে একবার তাকাল উপমা। বেশি রাত হয়নি। ফোন করাই যায়।
ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে নীচ তলায় গেল। এরপর টেলিফোন হাতে এক ছুটে ঘরে। কেউ দেখেছে কি না জানে না। আচ্ছা, দেখলে দেখবে। নিঃশব্দে হেসে দরজা আটকে দিলো। এরপর টেলিফোন কোলে করে বিছানার ওপর জামু ফেলে বসল। রিসিভারটা হাতে নিয়ে একটা নম্বরে হাত লাগাবে ঠিক সেই সময়ে হুট করে টেলিফোন বেজে উঠল। সাথেসাথে ভ্রু কুঁচকে গেল উপমার। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে সে শোনার চেষ্টা করল অপরপাশে কে। বাড়ির অন্য কাউকে চাইলে ফোন দিয়ে আসবে এই তার পরিকল্পনা। কিন্তু দশ-পনেরো সেকেন্ডেও ওপাশ থেকে কথা ভেসে না এলে ভ্রু কুঁচকে সে নিজেই কথা বলল,
— হ্যালো। কে?
এবারেও নিস্তব্ধতা। এই করে করে বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করল উপমা। নীরবতা ভেঙে একটা শব্দও শোনা গেল না। একসময় উপমা বিরক্ত হলো। ফোন রেখে দিলো। কিন্তু ফোন রেখে দিলে আবারও কল করল ওপাশের ব্যক্তিটি। এভাবে প্রায় তিন-চারবার একই ঘটনা যখন ঘটতে দেখা গেল তখন একটু সন্দেহ জাগল উপমার মনে। হুট করে তার মাথায় একটা নাম এলো। কল করে চুপ থাকা ব্যক্তিটা রওনক কি হতে কোনো ভাবে? নাহ্ সে কি করে হয়? কেনই বা?
নিজের ভাবনায় ডুবে রয়েছে যখন উপমা সেই বিরতিতে পঞ্চম কলটা এলো। পূর্বের ন্যায় ভদ্রতাসূচক দুবার হ্যালো হ্যালো করে উপমাও থেমে গেল। কি ভেবে সময় নিয়ে সে ধীর গলায় বলল,
— আপনি আমাদের বাড়ির নম্বর পেলেন কোথায়?
এতক্ষণে ফোনের ওপাশে নীরবতা ভাঙতে শোনা গেল। উপমার ধারণাকে সত্যি করে অপর পাশ থেকে রওনক হেসে উঠল। উপমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
— তুমি এখন কেমন আছো উপমা?
ধারণাকে মিলে যেতে দেখে অবাক হলো উপমা। তথাপি নিজের বিস্ময় লুকিয়ে কড়া গলায় বলল,
— আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
এবারেও রওনক তার কথার পাশ ঘেঁষে গেল না। একঘেয়েভাবে বলল,
— কেমন আছো বললে না।
ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল উপমা।
— বুঝেছি। উত্তর দেবেন না। আছি, ভালো আছি আমি।
— ব্য”থা কমেছে?
— কিছুটা। রাত হলে ব্য”থা চা/ড়া দিয়ে ওঠে। সাথে জ্ব’র।
— ঔষধ খাচ্ছ নিয়মিত?
— খাচ্ছি।
— আচ্ছা যত্ন নিও।
— এই, এই। রাখছেন নাকি?
হুট করেই বলে উঠল উপমা। জবাবে মিনিটখানেক নীরব রইল রওনক। ক্ষীণস্বরে বলল,
— হু।
— এত জলদি?
— আরও কথা বলতে চাও?
সহাস্যে প্রশ্ন করল রওনক। নির্বুদ্ধিতায় জিহ্বায় কামড় পড়ল উপমার। কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ওর। কেন বলল কথাটা? ছিঃহ্!
— উত্তর দিলে না।
পুনরায় রওনকের কথা ভেসে এলে ফোনটা কানে ধরল উপমা।
— আচ্ছা তবে রাখি।
— উপমা শোনো
— হু?
এবারে ইতস্ততভাবে রওনক বলল,
— একটু বাইরে আসবে?
— মানেহ্!
সহসা বিছানা থেকে নেমে পড়ল উপমা। আমতাআমতা করে রওনক বলল,
— আমি তোমায় দেখতে এসেছি। একটু বারান্দায় এসে দাঁড়াও দেখেই চলে যাব।
— কিহ্!
আঁতকে উঠে ফোন হাতে জানালার ধারে চলে গেল উপমা। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল ঠিক ওদের বাড়ির ঠিক সামনে শাটার নামানো দোকানের কাছে মোটসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। পাশে তার বন্ধুও আছে বোধহয়। দোকানের সামনে হলুদ আলো জ্বেলে রাখায় দুজনের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রওনকের এতখানি দুঃসা’হস দেখে কেঁ”পে উঠল উপমা। অজানা আশংকায় তার গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। তবুও রওনকের সাথে সামনে থেকে একবার দেখা হওয়া কিংবা কথা বলার লোভটা এড়িয়ে যেতে পারল না। বুকের কাঁপন সামলে রেখে তাই নিজেও দুঃসাহসিকতার একটা কাজ করে ফেলল। হুট করে বলে ফেলল,
— শুনুন পেছনের গেটে আসুন। আমি নীচে নামছি।
রওনকের কাছে এমন উত্তর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। যেমন অবাক সে হলো, তেমনই আনন্দ জেঁকে ধরল তাকে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল অবর্ণনীয় হাসির আভাস। সহাস্যে সে শুধল,
— কোনদিকে ওটা?
— আপনার সামনে যে গলিটা আছে ওটা দিয়ে সোজা এসে বাঁয়ে ঘুরলেই আমাদের পেছন গেট।
— ঠিকাছে আসছি।
ফোন কেটে পকেটে পুরে তৎক্ষণাৎ রাস্তা পার হয়ে গেল রওনক। উত্তেজনায় বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে তার।

জানালা দিয়ে অস্থিরচিত্তে রওনককে এগিয়ে আসতে দেখে লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠল উপমার। পর্দা টেনে আপনমনেই সে বলে ফেলল, ‘পাগল একটা’

নিজেও কি কম পাগল? রওনকের মুখোমুখি হবে ভেবে চটপট ফোন রেখে সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বেনি করা চুলগুলোতে আরেকবার চিরুনি চালিয়ে, মুখে একটু পাউডারের ছোঁয়া দিয়ে ওড়না পেঁচিয়ে সেও রওয়ানা হলো পেছন গেটের উদ্দেশ্যে। ভাগ্যটা তার বড্ড ভালো ড্রয়িং রুমে তখন বাড়ির কেউই উপস্থিত ছিল না। হয়তোবা তারা রান্নাঘরে।
সুযোগ বুঝে উপমাও বড় বড় পা ফেলে বাড়ির বাইরে চলে এলো।
পেছনের গেটে ততক্ষণে এসে পড়েছে রওনক। ক্ষীণ আলোয় হেঁটে দরজা খুলতেই নিজের ঠিক সামনে রওনককে দাঁড়াতে দেখল উপমা। খুশির ছটা তার চোখেমুখে বি’চ্ছুরিত হতে লাগল। নিঃশব্দে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে। এরপর বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই রওনক এগিয়ে এসে উপমার একটা হাত চেপে ধরল নিজের দু’হাতের মুঠোয়। কম্পিত গলায় বলল,
— খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে যাচ্ছি উপমা। দেখা হবে না কয়েকদিন। তাই তোমায় দেখতে এসেছিলাম।
অকস্মাৎ রওনকের হাতের স্পর্শে চমকে গিয়েছিল উপমা। দ্রুতই সে চমক সামলে নিলো। স্বাভাবিক গলায় শুধল,
— কোথায় যাচ্ছেন?
— শহরের বাইরে।
— ফিরবেন কবে?
— জানা নেই।
উত্তর শুনে মলিন হয়ে উঠল উপমার মুখখানা। কতদিন দেখা হবে না মানুষটার সাথে। খারাপ লাগবে তার। ভীষণ খারাপ।
উপমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রওনকই আবার বলল,
— আমি আগে ভাবতাম আমার কোনো পিছুটান নেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে..
কথা সম্পূর্ণ করল না রওনক। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উপমা শুধল,
— এখন কি মনে হচ্ছে? আছে?
জবাবে সরাসরি উপমার চোখে চোখ রাখল রওনক। মৃদু শব্দে বলল,
— আছে।
সাহস করে এবার দু’পা এগিয়ে এলো উপমা। বুকের কাছটায় রওনকের শার্ট খামচে ধরে অস্ফুটে বলল,
— জলদি ফিরবেন।
বলতে বলতেই তার মেদুর কপলদ্বয়ে নোনাজলের ধারা বইতে দেখা গেল। এই নোনাজলের কি অর্থ, উপমা কিংবা রওনক কেউই জানে না। জানার চেষ্টাও করল না। বিনিময়ে বুকের ওপর উপমার হাতটায় আলতো করে হাত রাখল রওনক। বলল,
— ফিরব। অপেক্ষা কোরো।
— আমার সমস্ত অপেক্ষা আপনাকে ঘিরেই।
এক মুহুর্ত ব্যয় না করে ফিসফিসিয়ে বলল উপমা।
ওর কথায় থমকে গেল রওনক। আরেকটা বাঁধন কেটে যেতেই মনের ভেতর অদ্ভুত ইচ্ছেরা হানা দিতে শুরু করল। খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে একবার জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এতখানি অধিকার যে ও পায়নি। সুপ্ত ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে তাই বলল,
— উপমা যাই।
— যাই বলতে হয় না। বলুন আসি।
বুকের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো উপমা। কুঁচকে যাওয়া শার্টের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রওনক। ধীর গলায় বলল,
— আচ্ছা আসি।

পিছু মুড়ে যেতে উদ্বুদ্ধই হয়েছিল, কয়েক পা এগোতেই পুনরায় ডাক পড়ল,
— শুনুন।
সাথে সাথে ফিরে তাকাল রওনক। উপমা কিছু বলল না। এই মুহুর্তে ওর ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রওনকের বুকে লুকোতে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। বুকে লুকোতে গেলে একটা অধিকার থাকতে হয়, সম্পর্কের নাম থাকতে হয়। তার তো দুটোর একটাও নেই। বিনা সম্পর্কে এতখানি কি করে এগোয়?
ছোট্ট শ্বাস ফেলে উপমা বলল,
— কিছু না৷
রওনক দাঁড়াল দু মিনিট। কি মনে করে না গিয়ে ফিরে এলো। সস্নেহে উপমার মাথায় হাত রাখল। আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
— ভালো থেকো ছায়াকন্যা।
এরপর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিজেই ছায়ায় মিলিয়ে গেল। ওর অবয়ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার পর ফিরে এলো উপমা। ঘরে এসে ব্যাগের ভেতর থেকে খাতা বের করে কম্পিত হাতে লিখল,
“আপনি এত পাগল কেন?”

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here