চিঠি দিও
৫
__________________
রওনক এসেছে রংপুর সরকারি হাসপাতালে। তার মাকে দেখতে। নাহ্, কেউ জোর করে নিয়ে আসেনি তাকে। একা একাই এসেছে। ক্লাস শেষ করে আরেকবার ক্লাবের দিকে গিয়েছিল। মিজান তখনও রেখে আসেনি হোন্ডাটা। বেরুবে বেরুবে ভাব। রওনকের মনে হলো মিজানকে আর কষ্ট দেয়ার দরকার নেই। সে নিজেই নিয়ে যাক। পরে একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে বাজারের দোকান থেকে এক লিটার পেট্রোল আনিয়ে গাড়িতে দিয়ে বেরুলো রওনক। মিজানও উঠল সাথে পথে কোথাও কাজ আছে বলে। মিজানকে নামিয়ে দিতে বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে অনেকটা যেতে হলো রওনককে। হাসপাতাল কাছেই ছিল। এক মুহুর্ত ব্রেক কষে রওনক ভাবলো যাবে কি যাবে না! ভাবনা শেষই হলো না হোন্ডা স্টার্ট দিয়ে হাসপাতালের পথ ধরল।
হাসপাতালে গিয়ে বুঝতে পারল জল বসন্ত রোগটা হঠাৎই প্রকট আকারে ছড়িয়েছে। যত রোগী সব এই রোগ নিয়েই এসেছে। দোতলা, তিনতলা আঁতিপাঁতি করে খুঁজল রওনক কিন্তু তার মাকে পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে ফিরে আসবে সেই মুহুর্তে দোতলার সিঁড়ির কাছে কমবয়সী একটা মেয়ে “রুনু ভাই” সম্বোধনে ডেকে উঠল ওকে। ঘাড় ফিরিয়ে ও একনজর দেখলো মেয়েটাকে। সরু লিকলিকে, ফ্যাকাশে মতো একটা কাপড় পরে শুকনো মুখে চার-পাঁচ বছর বয়সী একটা ছেলে বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা যে ওর মায়ের দ্বিতীয় ঘরের সন্তান বুঝতে বেগ পেতে হলো না রওনককে। চেহারার গড়নই আপনা থেকে পরিচয় বাতলে দিচ্ছে। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল রওনক। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করল,
— উনি কোথায়?
— আসুন আমার সাথে।
ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বইতে লাগল মেয়েটা। ওকে অনুসরণ করে রওনকও পা বাড়াল সামনের দিকে।
রোগীর আধিক্যে জায়গার সংকুলান। ওয়ার্ডগুলিতে বেডে তো জায়গা নেই ই, মেঝেতেও লোক ধরছে না। এদিকে বসন্ত তো ছোঁয়াচে রোগ। রওনকের মায়ের জায়গা হয়েছে এক কোণে ফ্লোরে। হলদেটে একটা পাটি বিছিয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে আছে ভদ্রমহিলা। গায়ে ভয়ানক জ্বর। জ্বর আর গা ব্যথায় ঘুমুতে তো পারছেই না কোনোরকমে শুয়ে শুধু গোঙ্গাচ্ছে। জানে না কেন এই দৃশ্যটা দেখার পর বুকে একটা ধাক্কা মতো টের পেলো রওনক। অজান্তেই ভিজে উঠল চোখের কোল। অথচ ও বলে মায়ের প্রতি নাকি ওর টান নেই!
বোবা কান্নায় শ্বাস ঘন হয়ে এলো রওনকের। বড় করে দম নিয়ে আশেপাশে চোখ বুলালো একবার। উঁহু এখানে এভাবে সম্ভব নয়। এই পরিবেশে থাকলে সুস্থ হওয়া দূরের কথা লাশ নিয়ে ফিরতে হবে বাড়িতে।
— তোমরা দাঁড়াও আমি আসছি।
মৃদু গলায় ছেলেমেয়ে দুটোকে দাঁড়াতে বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল রওনক। এক টানে সোজা মিজানের কাছে। মিজানের মামা বেসরকারি এক হাসপাতালের কর্মরত। হার্ট সার্জন। এ ব্যাপারে কতটুকু সাহায্য করতে পারবেন জানা নেই তবুও সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত ওনার শরণাপন্ন হলো দুই বন্ধু। মায়ের অবস্থা জানাতেই মিজানের মামা অ্যাম্বুলেন্স বলে দিলেন। পরে সেই অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী নিয়ে এসে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো বেসরকারিতে। ছুটোছুটি করে সবটা একা হাতে সামলালো রওনক। পুরোটা সময় ওকে অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখলো মিজান। রওনকের চিন্তাগ্রস্ত মুখখানা দেখে চোখ ভরে উঠল ওর খুশিতে। অভিমান ছাপিয়ে মমতার স্থানটা বড় হয়ে উঠেছে তবে। আর কেউ না জানলেও ও জানে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ নিয়ে কতখানি ভেঙে পড়েছিল রওনক। বাইরে শক্ত খোলস পরে থাকলেও ভেতরে অবর্ণনীয় জ্বালায় দগ্ধ হয়েছে প্রতিনিয়ত, দগ্ধ হয়। চোখের সামনে বাবা-মা, সন্তানের পরিপূর্ণ সুখী পরিবার দেখলে যন্ত্রণা হয়েছে ওর। সে যন্ত্রণা সহনশীলতার বাইরে চলে গেলে রেগে কষ্ট দিয়েছে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। একসময় মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের খবর শুনলে কষ্ট তার ঘৃণার রূপ ধারণ করে ফেলেছে। যদিও মিজানের একে ঘৃণা নাম দিতে ঘোর আপত্তি। ওর কাছে এটা হলো অভিমান।
যাহোক এরপর “মা” শব্দটা শুনলেই ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলতো রওনক। নিজের মায়ের প্রতি ওর মাত্রা ছাড়ানো ঘৃণা দেখলে ভয়ই লাগতো মিজানের। খুব করে প্রার্থনা করতো কিছু একটা হোক আর সব ভুলে মা-ছেলে মিটিয়ে ফেলুক নিজেদের ভেতরের সব দূরত্ব। খালাম্মার এই অসুস্থতা কি তবে দূরত্ব মেটানোর প্রথম সুযোগ?
কেবিনের বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। এতটুকু সময়ে অনেক ছুটোছুটি করেছে। ক্লান্তিতে বুঁজে আসছে শরীর। তথাপি ক্লান্তিকে ভারী পড়তে দিচ্ছে না শরীরের ওপর। এখনও অনেক কাজ বাকি। একটু পরেই আবার সার্কিট হাউজে যেতে হবে। নির্বাচনের সময়। এখন প্রত্যেকটা সেকেন্ড ওর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের দিকে তাকানোর সময় নেই।
— একি আপনার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে।
কিছুক্ষণ আগের পরিচিত গলাটা ভেসে আসতে শোনা গেল আবারও। মেয়েটা ওর কনুইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের কনুইয়ে তাকাতেই বিরক্তি সরে অল্প একটু হাসির ছটা খেলে গেল রওনকের মুখে। ছোটোখাটো সরলাকৃতির ক্ষতটা আজই হয়েছে, একটু আগে কলেজে। উপমা নামক মেয়েটা দিয়েছে তাকে এই ক্ষত। তখন রিকশা টেনে ফেলে দিয়েছিল বলে রাগে গমগম করতে করতে এসে খেঁকিয়ে উঠেছিল মেয়েটা। অমন ঝগড়ুটে মেয়ে মানুষ আগে দেখেনি রওনক। সেও খুব সুন্দরভাবে উপমার দোষ ধরিয়ে দিয়েছিল উপমাকে। কিন্তু মেয়ে মানতে নারাজ। ক্রমে চড়াও হচ্ছিল রওনকের ওপর। একসময় সহ্য করতে পারেনি রওনকও। মুখের ওপর বলেছিল “বেয়াদব মেয়ে” তারপরেই এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণ। ব্যাগের সাইড পকেট থেকে কাটা কম্পাস বের করে সবেগে আঁচড়ে দিয়েছে মেয়েটা। যেন ওর হাতটা খোলা ক্যানভাস। চাইলেই আঁচড় কাটা যায়। অতটুকু মেয়ের এতবড় স্পর্ধা দেখে রওনক অবাক হয়েছিল বৈকি! রাগে একদম তুলে আছাড় দিতে মন চাইছিল। রিকশা থেকে নেমেও পড়েছিল সে উদ্দেশ্যে। পরে কোত্থেকে ওর বান্ধবীটা ছুটে এলো। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে টেনে নিয়ে গেল ডাকু মেয়েটাকে। যেতে যেতেও ফিরে তাকিয়ে ছোট ছোট চোখ দুখানা দিয়ে অগ্নিবান ছুঁড়ে শাসিয়ে গিয়েছে মেয়েটা, ওর সাথে পাঙ্গা নিতে গেলে ফল ভালো হবে না।
জানে না কেন ওর শেষ চাহনিটায় খুব মজা পেয়েছে রওনক। চোখের সামনে সাহসী মেয়ে কমই দেখেছে ও। বাড়িতে থাকতো তিনটে ছেলে। মেয়েরা কেমন হয়, তাদের আচার-আচরণ, মনোভাব কি বলতে গেলে জানেই না রওনক। এরপর ভাবী এলো। সে তো লজ্জাবতী লাজুক লতা। মমতাময়ী, কখনো বিষাদীনি। ঠিক বোঝা যায় না।
সংগঠন নিয়ে পড়ে থাকা তার জীবনেও তেমন কেউ আসেনি। আর রাজনীতির এ ক্ষেত্রটাতে আসার পর তো ওকে সবাই ভয় নয়তো সমীহের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে সবসময়। এতদিন পর নতুন এ দৃষ্টির আগমন বলা যায় ওকে অস্থিরই করে তুলছে বেশ। ভাবনার অবকাশে সগতোক্তিতে বিড়বিড় করল রওনক “ডাকাতের বোন ষোলোআনা ডাকাত। একদম ডাকাত সর্দারনী।”
— ডাক্তার সাহেব মাত্র গেলেন। আপনি বলেন তো ডেকে আনি?
— উঁহু প্রয়োজন নেই। এ ক্ষত পুরনো।
মৃদু হেসে শার্টের হাতা নামিয়ে ফেলল রওনক। মেয়েটা চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলল,
— কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে..
— তিনদিন থাকতে হতে পারে এখানে। ডাক্তার তো তাই বলল। তো তোমরা প্রয়োজনীয় সবকিছু সাথে এনেছ?
মেয়েটার কথার মাঝেই বলে উঠল রওনক। জবাবে ওপর নীচে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালো মেয়েটা।
— ঠিকাছে। এই মুহুর্তে বেশি টাকা নেই আমার সাথে। যা আছে দিয়ে যাচ্ছি। তোমাদের প্রয়োজনমতো খরচ করবে। আর অন্য কোনো প্রয়োজনে আমার বন্ধু মিজানকে রেখে যাচ্ছি। টাইম টু টাইম খোঁজ নেবে ও। টাকার দরকার হলে নিঃসংকোচ বলবে।
হাজার টাকার কয়েকটা নোট এগিয়ে দিলো রওনক মেয়েটার দিকে। টাকাগুলো হাতে নিয়ে সে পুনরায় বলল,
— আর কিছুক্ষণ থেকে যেতেন। মায়ের সাথে দেখা করে যেতেন।
— কাজ আছে আমার।
দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল রওনক। এরপর আর বলার কিছু থাকে না। ঈষৎ মাথা নেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা।
যেতে যেতে কি মনে করে অর্ধেক পথে দাঁড়াল রওনক। ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকল,
— আচ্ছা শোনো, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তোমাদের?
— আমার নাম বকুল। বকুল বলে ডাকবেন। আর খাওয়া হয়নি আমাদের। সুযোগ পাইনি৷
জবাব দিলো মেয়েটা ।
— তোমার ভাইও না খাওয়া?
— হু।
— আচ্ছা মিজানকে দিয়ে আমি খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। খেয়ে নিও। কেমন?
পুনরায় মাথা কাত করে সম্মতি দিলো বকুল। পাল্টা শুধল,
— আপনি খেয়েছেন ভাইয়া?
ওর প্রশ্নে একটু যেন থমকাল রওনক। বুকের ভেতর কিসের একটা ঢেউ। বকুল বলে মেয়েটার গলাও ওদের মায়ের মতো। কথাটায় মা মা একটা মমতা লুকিয়ে আছে। সেজন্যই বোধহয় এমন লাগল রওনকের।
ক্ষীণ কণ্ঠে হু বলে পুনরায় হাঁটা দিলো সে। অতীত ভোলার উত্তম উপায় জাগয়া পাল্টানো। আর রওনকের জন্য বুঝি দূর্বলতা লুকানোর উত্তম উপায় এটা?
________________________
নিজের চুল নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের পাগলামি রয়েছে উপমার মধ্যে। চুলগুলোকে সে যেমন ভালোবাসে তেমন যত্নও করে। তার ধারণা এই চুলই তার সকল সৌন্দর্যের আধার।
এক দেখায় চোখে পড়ে যাওয়ার মতো সুন্দরী না হলেও স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের অধিকারী উপমা। কমনীয় অথচ মায়া মেশানো এক আকর্ষণ আছে তার মধ্যে। কেউ দু’বার তাকালে চোখে পড়তে পারে।
সকলের মতে উপমা দেখতে হয়েছে একদম তার মায়ের মতো। উপমারও তাই মনে হয়। মায়ের কিশোরী বয়সের ফটো দেখেছিল তো সে।
মাঝারি গড়নের গোলগাল মুখ উপমার, আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের যেমন হয়। তবে থুতনির কাছে তার ভাঁজ আছে একটা;উল্টো পাশে ইউ লিখলে যেমন হয় ঠিক তেমন। গালগুলো বেশ ফোলা ফোলা। চোখ সুন্দর। দৃষ্টিতে গভীরতা আছে। আবার চোখের পাপড়ি, ভ্রু যুগোল বেশ ঘন কালো। ছোট্ট কপাল। মাথায় এত বেশি চুল! ওর ভারেই যেন ন্যুব্জ হয়ে যাবে কখনো।
উঁহু এতটুকুতে বোধহয় হচ্ছে না। চুলের আরেকটু প্রশংসা করা উচিৎ।
লম্বায় উপমার চুলগুলো হাঁটু ছুঁয়েছে। সোজা নয় অবশ্য। পেঁজা তুলোর মতো ঢেউ খেলানো। ঘন এবং মসৃণ। রঙটা কালোই। কখনো নৈর্ঋত হাওয়ায় ছেড়ে রাখলে মনে হয় মেঘ নয়, উত্তাল সাগরের ঢেউ বুঝি ওগুলো।
গায়ের রঙ আগে চাপা লাগলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে রঙ খুলছে। এখন বেশ উজ্জ্বল লাগে ওকে। এই দেশে তো গায়ের রঙের নাম দুটো। এক কালো, আরেক ফর্সা। কিন্তু নানি বলেছিল ও উজ্জ্বল শ্যামলা। এ রঙকে না ফর্সার কাতারে ফেলা যায়, না কালোর কাতারে। গায়ের রঙ নিয়ে ভাবে না উপমা। নানা লোকের নানা কথা শুনতে হয় ঠিক,কিন্তু নিজের চেহারাটা খুব ভালো লাগে উপমার নিজের কাছে। যখন থেকে জেনেছে ও দেখতে ওর মায়ের মতো তখন থেকেই এই ভালো লাগার জন্ম।
শখ-আহ্লাদ কমই আছে উপমার। সারাদিন চুল নিয়ে গবেষণা করলে অন্য শখ-আহ্লাদ আসার কথাও না। যদি কখনো এসেও থাকে তা অবশ্যই চুলভাবনার অবসরে।
ফুরসতে আসা শখগুলো সব ক্ষণস্থায়ী হয়। উপমারও হয়েছে। তবে ও খুব ডেডিকেটেড মেয়ে। মন বারান্দায় কখনো অন্য কোনো শখের আনাগোনা টের পেলে তখন সে তার পেছনে নিজের সর্বস্বটা দিয়ে দেয়ার চেষ্টা ঠিকই করে। ফলস্বরূপ বলা যায় আজকের তার গানের গলা। প্রাথমিকে পড়া অবস্থায় একবার হুট করে গান শেখার শখ পেয়ে বসেছিল ওকে। ওর মুখের কথা আর বড় মামির কাজে রূপান্তর করতে এক মিনিটও ব্যয় হয়নি। ছয় মাস শিখেছিল গান। বাড়ি বয়ে এসে গানের শিক্ষক শিখিয়ে যেতেন। গুনে গুনে ছয়টা মাস যখন শেষ হয়ে গেল কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ গানের শখও কেটে গেল ওর। ক্রমান্বয়ে তারপর পেয়ে বসল বাগান করার শখ। সেবারও বড় মামির প্রচ্ছন্ন সায়। খুশিতে ডগমগ করতে করতে মামি-ভাগ্নিতে মিলে দোকানে গিয়ে গাছ কিনে আনলো। জবা, ডালিয়া, সহস্র বেলী। কিনলো ডালিম, কমলা এবং জামরুলও। তিনটে ফুলগাছ, তিনটে ফলগাছ। মোট ছয়টা দিয়ে শুরু।
অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য ওদের বাড়িটা চারিদিক উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়াল দেয়ায় সুবিধেই হয়েছিল বেশ। দুদিন লাগিয়ে চিন্তাভাবনা করে বাড়ির সামনের ফাঁকা অংশটার ঝাড় জঙ্গল পরিষ্কার করে জায়গা বুঝে বুঝে সুন্দরমতো ফুল গাছ গুলো লাগিয়ে ফেলল ওরা। ফল আবার লাগানো হলো পেছন দিকে। গাছ লাগানোর নেশা এক অন্যরকম নেশা। এ নেশা পেয়ে বসলে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ছয়টা গাছ দিয়ে শুরু করা শখ সময় বাড়ার সাথে সাথে আরো কত গাছের সন্ধ্যান এনে দিলো লিখে বর্ণনা করা যাবে না। বর্তমানে ওদের বাড়িতে যতগুলি গাছ দেখা যায় সব ওর আর বড় মামির হাত দিয়ে লাগানো।
যাকগে আমরা এবার উপমার গাছ রোপনের শখ সমাপ্তির ঘটনাটা ছোট্ট করে বর্ণনা করে শখগল্পের সমাপ্তি টেনে ফেলি।
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে উপমার ছোটো চাচা নিজের চাচা হওয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাননি। বরং সকলের বিপক্ষে গিয়ে খুব ভালোভাবেই সেই দায়িত্ব আঁকড়ে রয়েছেন এখন অবধি। ছোটো চাচা যখন চাকরিসূত্রে দিনাজপুরে তখন উপমার পুরো পরিবার সমেত যাওয়া হয়েছিল চাচার বাড়িতে। নতুন চাচি ঘরে এসেছেন। তিনি আবার এসব বিষয়ে শৌখিনতার পরিচয় রাখেন। ওখানে গিয়ে উপমা নতুন এক ফুল গাছের সন্ধান পেয়েছিল যার নাম “কুঞ্জলতা”। বাড়ির গেটের সামনে বীজ বুনে দিলে সময় যাওয়ার সাথে সাথে গেটকে আঁকড়ে ধরে লতিয়ে ওঠে গাছটা। আপনা থেকে সাজিয়ে দেয় পুরো গেটকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় রাজার মাথার রাজমুকুট। গেটে হয় বলে এই ফুলকে অনেকে গেট ফুল বলেও চেনে। দুদিন ওই ফুলগাছ লক্ষ্য করে উপমার এত ভালো লেগে গিয়েছিল যে বাড়ি ফিরে তৎক্ষনাৎ তার কুঞ্জলতা চাই। তারও বাড়ির গেটকে ওরকমভাবে সাজানো চাই। সব বিষয়ে অঘোষিত সমর্থন থাকলেও খুব অদ্ভুতভাবে কুঞ্জলতার বিষয়টাতে মামি একদমই সমর্থন করল না। নানিও ধমক লাগিয়ে বলল,
” ঐ গাছ লাগা যাবানায়। বাড়িতে সাপ আসে বুবু ”
সব কাজে প্রচ্ছন্ন সায় পাওয়া মেয়ে উপমা হুট করে নিষেধ ঠিক হজম করতে পারল না। কান্নাকাটি, জেদাজেদি করে রীতিমতো জ্বর বাঁধিয়ে ফেলল। শুধুমাত্র শখ পূরণ হয়নি জন্য আদরের ভাগ্নির এমন করুণ দশা কাম্য নয়। দেখে খুবই আশ্চর্যান্বিত এবং মর্মাহত হলেন উপমার বড় মামা রঞ্জু সাহেব। পরে সেদিনই আঁতিপাঁতি করে খুঁজে এনে দিলেন কুঞ্জলতা বীজ। শখ পূরণ হওয়ায় উপমারও জ্বর ছেড়ে গেল। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে খুশি মনে সে সব ক’খানা বীজ পুঁতে দিলো গেটের দু পাশে।
সবাই বলে উপমার হাত সৌভাগ্যের হাত। আজ পর্যন্ত যাই বুনেছে তাতেই ভালো ফলন হয়েছে। পূর্বের কথা সত্যি ধরে তেমন কুঞ্জলতাও কম সময়ে ফুলে ফেঁপে জাপ্টে নিলো গেটটাকে। গুটি গুটি অসংখ্য গোলাপি ফুলে বাড়িয়ে তুলল নিজের শোভা। এবার উপমার খুশি দেখে কে! ছোট্ট উপমা নতুন গাছে এত এত ফুল দেখে আবেগে-আপ্লুত হয়ে উঠল। সকাল বিকেল সময় পেলে যত্ন নিতে লাগল সে ফুলের। তবে নতুন ফুলকে ঘিরে যত আনন্দ, আগ্রহ সব তার একারই ছিল। এত ঘন, এত ফুলেল লতানো গাছটা তার ছাড়া বাড়ির আর কারো মুখেই হাসি ফোটালো না। বরং অদ্ভুত দুশ্চিন্তায় ন্যুব্জ হয়ে রইলো সবাই। এই দুশ্চিন্তার কারণ কি, উপমার জানা নেই।
ঋতু বদলে বর্ষা এলো। বর্ষা মানে সাপ খোপের আড্ডাখানা। বর্ষা আসতেই সকলের বারণে নিজের কুঞ্জবনে যাওয়া কমে গেল উপমার। খারাপ লাগতো ওর। মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে লুকিয়ে অবশ্য যেত। তবে কিছুক্ষেত্রে বড়দের বারণ শোনা কিন্তু নিজের জন্যই মঙ্গলকর উপলব্ধি করতে পারল না উপমা। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগে ঘটে গেল এক অঘটন। বৃষ্টিমুখর কোনো এক দিনে সবার ভয়কে সত্যি করে সাপ এলো উপমার ছোট্ট কুঞ্জবনে। যে সে সাপ নয় একেবারে বিষধর সাপ। ফণা তুলে সে কাটলো কেবল উপমাকেই।
ভাগ্যিস সঠিক সময়ে দেখেছিল পরিবারের কেউ একজন। তাই তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সম্ভবপর হয়েছিল সেবার! উপমার নানাবাড়িতে নাকি কিসের অভিশাপ আছে। মেয়ে সন্তান টেকে না। কম বয়সে তার মা মরে গিয়েছিল। মায়ের পর সে একমাত্র মেয়ে। তার ওপরেও প্রেতাত্মার মতো মৃত্যুছায়া সতর্কবাণীই ছিল বোধহয়।
এরপর কেউ আর ঝুঁকি নিতে চাইল না। এক মুহুর্ত রাখা হলো না কুঞ্জলতা বাড়ির গেটে। লোক ডেকে সমূলে উপড়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলে আসা হলো। সাপের কামড় খেয়ে বোধ জাগ্রত উপমার মধ্যেও হয়েছিল। শখের দুনিয়ায় বড় তালা ঝুলিয়ে দিলো তখুনি।
সত্যি বলতে এরপর আর নতুন কোনো শখ জাগেনি উপমার মধ্যে। শখ না জাগার আরেকটা ব্যাখ্যা অবশ্য আছে উপমার কাছে। তা হলো বড় মামির অপ্রত্যাশিত বিদায়। ওর ভালো-মন্দ সব শখে যে মানুষটা অঘোষিত সায় ছিল। সে চলে যাওয়ার পর নতুন শখ উৎপন্ন হবে কি করে?
বাড়ি ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়। হেঁটে এসেছে আজ। ক্লান্ত লাগছিল বলে কাপড়চোপড় না পাল্টে শুয়ে পড়েছে উপমা। ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে আসছে এই মুহুর্তে। কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে চোখ বুজেছে উপমা। তদ্রাচ্ছন্ন তার দু-চোখের পাতায় ধূসর একটা অবয়ব ভেসে উঠছে বারবার। অবয়বটাকে ও চেনে। এ অবয়ব রওনক নামক লোকটার। আজ তার হাতে আঁচড় কেটেছে উপমা। ডালিয়া বলল ও নাকি খুব ডেঞ্জারাস। প্রতিশোধ পরায়ণ। আঘাত করেছে বলে প্রতিশোধ নেবে উপমার থেকে। কি প্রতিশোধ নেবে? উপমাকে ও চেনে? তার আগেই কুপোকাত করে ফেলবে না উপমা ওকে! আধোঘুম আধো জাগরণেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল উপমার ঠোঁটের কোণে। রওনক নামক লোকটা গভীরভাবে ও চেতনায় মিশে যেতে চাইছে হুট করে। ভালো লাগছে ওর। ভীষণ ভালো লাগছে।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara