চিঠি দিও ৪

চিঠি দিও

______________
৭.
“বন্ধু? এই রওনক, কাল সারারাত ক্লাবঘরেই ঘুমাইছিলি নাকি?”
মিজানের হেঁড়ে গলার ডাকে চমকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে রওনক। ইতিউতি তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে থেমে যায়। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে ঘুম জড়ানো গলায় শুধয়,
— কি?
— বললাম কালকে বাড়ি ফিরোনাই এইখানেই ছিলা সারারাত?
সোজা হয়ে বসে ওপর নীচে মাথা নেড়ে হাই তোলে রওনক। বলে,
— শেষ রাতে আসছি।
— অহ্। তা আমাক ডাকলা না। আমিও থাকতাম তোমার সাথে।
— আরে এইখানে আসার কথা ছিল না। ঝামেলা লাগছিল বাড়িত। তাই আসছিলাম এক ফাঁকে।
— ঠিকাছে। এখন ওঠো। কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আজকে তো আনিস ভাই আসবে।
এবার ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে রওনক।
— কয় তারিখ আজকা?
— ঊনিশ।
— ঊনিশ! ওনার না তেইশ তারিখ আসার কথা ছিল।
— হু কিন্তু হুট করে নির্বাচনের ডেট আগায় নেয়ার ঘোষণা হইলো কাল রাতে। প্রচারণার ডেটও রানিং পাল্টায় ফেলা হইছে তারপর। ইদ্রিস আসি খবর দিয়া গেছে আনিস ভাইয়ের সাথে চৌধুরী সাবও আসবেন। সার্কিট হাউজে উঠবেন নিজাম চৌধুরী। বিকালে তোমারে যাইতে বলছেন।
— অসহ্য অসহ্য অসহ্য।
কপাল কুঁচকে সশব্দে মেঝেতে চাপড় মেরে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল রওনক।
ওকে এমন করতে দেখে হেসে ফেলল মিজান। কাঁধে হালকা চাপ দিয়ে শ্লেষের সাথে বলল,
— অসহ্য পথে নিজেই আইসা পড়ছো বন্ধু এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারা হইলে চলবে?

মিজানের কথায় তার দিকে চোখ মেলে তাকাল রওনক। চাপা ক্ষোভের সাথে বলল,
— আমি জানি মিজান আমি খুব খারাপ মানুষ। নেশা করি, লোক পিটাই। কুনদিন খুনের মামলায়ও জড়ায় যাব। মেলা অপরাধের বোঝা আমার কাঁধে। তা সত্ত্বেও ঐ ইবলিশটার মুখ আমার দেখতে ইচ্ছা করে না। এমনিই চেয়ার ধরে রেখে আমাদের শহরটারে নষ্ট করি দিতেছে শয়তানটা। প্রতিবার এক ইশতেহার পড়তে পড়তে তো মুখের ব্যথা হয়া গেল। লোকেও খাইতে চাবে না আর। অয় কোন লজ্জায় আবারও চেয়ারে বসবার চায়?
— এইসব আমাদের আলোচনা করে লাভ আছে বন্ধু? আমরা তার হুকুমের গোলাম। নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও আমাদের ওর হাত ধরেই চলতে হবে।
— আর ভবিষ্যৎ!
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় রওনক। মেঝেতে পড়ে থাকা চাবির দিকে ইশারা করে বলে,
— গাড়িটা বাড়িতে রেখে আসিস তো। যাওয়ার সময় পেট্রোল কিনিস। আর আশিকের জন্য চিপস,চকলেটও কিনি নিয়া যাস৷ টাকা আছে? সাথে কিন্তু টাকা নাই আমার।
আশিক হলো রওনকের একমাত্র ভাস্তে। বড় ভাই বদিউজ্জামানের ছেলে। বয়স সবে পাঁচ বছর।

রওনকের বিপরীতে মিজান মাথা ওপর নীচ করে বলল,
— হ আছে। ক্যান তুই বাড়ি যাবি না?
— উঁহু। কাজ আছে।
— খাওয়াদাওয়া করে আসতি অন্তত।
— লাগবে না।
শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বেরিয়ে পড়ে রওনক। লাগবে না বললেও এই মুহুর্তে চায়ের তৃষ্ণা অনুভব করছে বেশ। গতরাতে নেশার ফলে মাথা ধরে আছে। তারওপর বহুদিন পর মেঝেতে শোয়া। কাঁধ, কোমরের ব্যথায় শরীরের নাজেহাল অবস্থা।
ক্লাবঘরের বাইরে টিউবওয়েল বসানো আছে। ওখান থেকে হাতমুখ ধুয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো রওনক। চা-নাশতা খাওয়ার টাকা পকেটে আছে বোধহয়। মিজানকে ডাকলে ভালো হতো, একসাথে নাশতা করা যেত। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর একা থাকতে ইচ্ছে করছে।
আর পাঁচটা দিনের মতো হোটেলের সীমানায় পা রাখতেই সালামের তুবড়ি ছুটতে দেখা গেল। সদ্য ভর্তি হওয়া কিছু স্টুডেন্ট বাইরে ফেলে রাখা বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসে চা-বিস্কুটের সাথে বেশ আড্ডা জমিয়ে ফেলেছিল। ওরাও রওননকে দেখে সটান দাঁড়িয়ে সমস্বরে সালাম দিয়ে উঠল। বিষয়টা বেশ ভালো লাগল রওনকের। সালাম নিয়ে হাতের ইশারায় ওদের বসতে বলে ভেতরে ঢুকে গেল। নিত্যদিনের মতো সামনের দিকে খালি টেবিল ধরে চা-পরোটা অর্ডার করে এক বেয়ারাকে পেপার দিয়ে যেতে বলল। স্বল্প সময়ের মধ্যে চা এবং পেপার একত্রে দিয়ে গেল কম বয়সী বেয়ারাটি। ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতে পেপারে চোখ বুলতে শুরু করল রওনক।
অল্প কিছুক্ষণ পর হোটেলের রেডিওতে গান ছেড়ে দেয়া হলো। কিশোর কুমারের কণ্ঠে “আমার স্বপ্ন তুমি”
চকিতে পেপার থেকে মুখ তুলল রওনক। চট করে গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল ওর। ঠোঁট কামড়ে স্মিত হাসল ও। গতরাতে অপরিচিত সে ছায়া মানবী কতক সময় সুরের মায়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছিল ওকে, ঠিক মনে পড়ে না। এমন শ্রুতিমধুর কণ্ঠ কারোর হতে পারে আগে জানা ছিল না রওনকের। ছাদের কিনারে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে মেয়েটা যখন একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছিল তখনই রওনক ভেবে ফেলেছিল এই সুরের মূর্ছনায় প্রতিদিন ভেসে যাওয়া চাই ওর। ও জানে না মেয়েটা প্রতিদিন গাইবে কি না! কিন্তু বাড়িটার সামনে ও একবার করে হলেও যাবে প্রতিরাতে। অপেক্ষা করবে গান শোনবার৷ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ছায়া মানবী গাইবে, আর সুপ্রসন্ন না হলে?
না হলে কি করবে ভাবেনি রওনক। না বোধক ভাবনা চিরকাল এড়িয়ে যায় ও। নিষেধ-বারণ, প্রত্যাখ্যান এসব নিয়ে ভাবনা পুরোটা অপছন্দ রওনকের। ওর কেবল “হ্যাঁ” চাই সবখানে।

একদম শেষ রাতের দিকে গান থেমে যাওয়ার পর ফিরতি পথ ধরেছিল রওনক। যদিও ওর ফিরতে মন চাইছিল না কিন্তু নিজের একটা ইমেজ আছে না? ইমেজের কথা ভেবেও তো একটু সামলে চলতে হবে। যেহেতু গাড়িতে পেট্রোলও ছিল না তাই অনেকটা পথ ওকে হেঁটেই আসতে হয়েছে। পরে বড় রাস্তায় উঠলে কোত্থেকে একটা ভ্যানের দেখা মিলেছিল। সেই ভ্যানে করে হোন্ডাসমেত ক্লাবঘরে চলে এসেছিল ও। ক্লাবঘর খোলাই ছিল তখন। নেশাক্ত ছেলেপেলেগুলো এলোপাথাড়ি শুয়ে ঘুমিয়েছিল। কি মনে করে রওনকও শুয়েছিল ওদের পাশে। এরপর কখন ঘুমিয়ে গেছে মনে নেই।

— কি ইয়াং ম্যান পেপার পড়া হচ্ছে?
পরিচিত কণ্ঠস্বরে ভাবনা সকলে ফুলস্টপ লাগিয়ে সচকিত হলো রওনক। বহুদিন পর সামনে প্রিয় শিক্ষককে দেখে সহাস্যে উঠে দাঁড়িয়ে সমিহের সাথে সালাম জানালো। প্রফেসর সালামের জবাব দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন ওর সাথে। জায়গা ছেড়ে দিয়ে রওনক পুনরায় সমিহের সাথে বলল,
— স্যার বসুন না।
— হ্যাঁ বসব। তো তোমার সাথের ছেলেটা কোথায়? কি যেন নাম ওর!
মনে করার চেষ্টা করলেন প্রফেসর। রওনকই বলে দিলো,
— মিজান। মিজান ওর নাম।
— হ্যাঁ হ্যাঁ মিজান। ও আসেনি? দেখছি না কোথাও।
বলে প্রফেসর আশেপাশে চোখ বুলালেন একবার। মাথা নেড়ে রওনক বলল,
— নাহ্ স্যার ও আসেনি আজ।
— আচ্ছা আচ্ছা। তো তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।
— জ্বী স্যার। আপনার জন্য চা বলে দিই।

বেয়ারাকে ডেকে দ্বিতীয় দফা চা নাশতা বলে দিয়ে এরপর বসল রওনক। শুরুতে কলেজ, রাজনীতি বিষয় টুকটাক আলাপ আলোচনা শেষে প্রফেসর রওনকের উদ্দেশ্যে বললেন,
— তোমাকে ইদানিং ক্লাসে পাই না রওনক। তুমি ব্রাইট ছেলে। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল তোমার। কিন্তু পড়াশোনা বাদ দিয়ে তুমি..
কথা সম্পূর্ণ করলেন না উনি। এতেই লজ্জা পেয়ে গেল রওনক। বুঝে উঠতে পারল না কি বলবে। কথা বলার জন্য কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করলেও কোনো শব্দ বেরুলো না। প্রফেসরই আবার বলে উঠলেন,
— ছাত্র রাজনীতি খারাপ জিনিস নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি একজন ছাত্রের সবকিছুরই প্রয়োজন আছে। কিন্তু তোমরা বর্তমান জেনারেশন পড়াশোনাটাকে গৌন করে রাজনীতিকে মুখ্য বানিয়ে ফেলেছ। অথচ রাজনীতিতে পোক্ত স্থান বানাতে হলে তোমার কিন্তু বিদ্যে থাকাও অত্যন্ত জরুরি। আসলে আমার খারাপই লাগে। কদিন আর হলো এলে তোমরা। উজ্জ্বল চেহারার উদ্যমী সব ছেলেপেলেরা। যাদের সরগমে ভরা থাকতো একসময় ক্লাস। আজ তোমাদের চাইলেও খুঁজে পাওয়া যায় না। খবর শুনি খুন-খারাবিতেও নাম।
— স্যার এসব ঔদ্ধত্যতায় তো আমাদের দলের পদচারণা নেই।
কোমল স্বরের বিরোধ রওনকের কন্ঠে। ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রফেসর আবারও বললেন,
— এই বয়স কি তোমাদের অস্ত্র ধরার কথা রওনক? তোমাদের সব বিদ্রোহ হবে কলম ধরে। কলমের জোরে তোলপাড় করে দেবে তোমরা সমাজকে। আমি পার্সোনালি তোমাকে খুবই পছন্দ করি। আমি জানি তোমার মধ্যে একটা স্পার্ক আছে সমাজকে পাল্টে দেয়ার। তুমি স্পার্কটা ভালো কাজে লাগাও রওনক। এই যে ক্লাস করো না, পরীক্ষা দাও না। এসব অনিয়ম কিন্তু তোমার জীবন চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজ বুঝতে পারছো না একদিন বুঝবে। তুমি যে পথে হাঁটছ কিংবা হাঁটতে চাইছ ওই পথটা ভীষণ ক্ষনস্থায়ী। সেকেন্ডের মধ্যে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা ওর আছে। চোখের সামনে বদিউজ্জামানের পরিণতি দেখেছ। এরপর অন্ততপক্ষে তোমার সতর্ক হওয়া উচিৎ।
তুমি বুদ্ধিমান ছেলে আশাকরি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?
— জ্বী স্যার। আমি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছি উভয় দিকটা।
— ভেরি গুড। জলদিই তোমাকে ক্লাসে দেখতে চাই রওনক। আই’ল বি ওয়েইটিং ফর ইউ ইয়াং ম্যান।
সস্নেহে রওনকের কাঁধে হাত রাখলেন প্রফেসর। মৃদু হাসি ফুটিয়ে রওনকও তাল মেলালো,
— অবশ্যই আসব স্যার।
— আজ তবে উঠি রওনক।
— স্যার এগিয়ে দিই?
— ওহ নো নো তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি যেতে পারব। তুমি ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। কেমন?
বলে ধীরপায়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।
__________________
৮.
তিনজনের গ্রুপ থেকে এখন ছয়জনের গ্রুপ হয়ে গেছে উপমারা৷ ক্লাস করতে করতেই সাজু, জিয়া এবং লায়লা যোগ হয়েছে ওদের দলে। উপমার তীব্র সন্দেহ গ্রুপের কিছু সদস্য বন্ধুত্বকে সাইড চেপে যুগলবন্দী হতে চলেছে খুব জলদি।
সাজু আর মিতালির হাবভাবে অন্তত তাই মনে হয়। সাজুরা এ শহরে নতুন এসেছে। যদিও ওদের নিজস্ব বাড়িই এখানে, কিন্তু বাবার চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন খুলনায় থাকা পড়েছিল। এবার বদলি হলো বলে নিজ বাড়িতে ফেরা। হুট করে আসায় সাজুর এখানে এডজাস্ট করতে বেশ কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকার পর, ওই কালচারে বেড়ে ওঠার পর হঠাৎ নতুন জায়গায় গেলে এডজাস্টমেন্টে কষ্ট হওয়ারই কথা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বোধহয় ভাষায়। দেশ এক হলেও এলাকা ভেদে ভাষা তো আলাদাই। এখানকার ভাষা মোটেই বুঝতে পারছে না সাজু। আবার সাজুর ভাষাও উপমারা বোঝে না। এজন্য আড্ডায় বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতে হয় সাজুকে। বন্ধুদের খারাপই লাগে। তবে সকলের চাইতে খারাপ লাগার পরিমাণ বেশি মিতালির। একা হলেই উপমাকে সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলে, “আহারে ছেলেটা চেয়েও ঠিকভাবে মিশতে পারতেছে না আমাদের সাথে। ওহোরে ছেলেটার কি কষ্ট!”
নৈমিত্তিক মিতালির আহা-উহু দেখে উপমা ঠিক বুঝে গিয়েছিল এই চিন্তার ভাঁজ তাদের মতো সরল সাধারণ নয়। এই চিন্তার ভাঁজে ঘাপলা আছে। তাই বিনামূল্যে একদিন পরামর্শ দিয়ে দিল,
“তুই শেখা সাজুকে রংপুরের ভাষা। বন্ধু হিসেবে এতটুকু সাহায্য করতেই পারিস। প্রতিদিন বিকেল করে ত্রিশ মিনিট ব্যয় করলেই তো হয়ে যাচ্ছে তাই না?”
পরামর্শ পছন্দ হয়েছিল মিতালির। শোনামাত্র চোখজোড়া চকচক করে উঠেছিল। পছন্দ হয়েছিল সাজুরও। তাই তো এক বলায় রাজি হয়ে গেল। এবং এরপর থেকে ক্লাস শেষে অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিট ওরা ভাষাশিক্ষায় ব্যয় করতে লাগল।
ভাষাশিক্ষায় সময় কাটাতে কাটাতে ওদের সখ্যতা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে দেখা গেল।

আর কেউ হোক না হোক উপমা কিন্তু খুশি। সাজু আর মিতালিকে পাশাপাশি মানায় ভীষণ।
সাজু খুব ভদ্র ছেলে। সুঠাম দেহি, সুদর্শন। সৌম্য ভাব ধরে রাখে চেহারায় এবং প্রখর তার ব্যক্তিত্ব। ছাত্র হিসেবেও ভালো। অপরদিকে মিতালি। সেও কি কম যায়? রূপে-গুণে অনন্যা একটা মেয়ে। নজরকাঁড়া তার রূপ-লাবণ্য এবং হাসি। উপমাদের গ্রুপ শুধু নয় পুরো ক্লাসে মিতালির মতো সুদর্শনা আর একজনও নেই।
সুন্দরী বান্ধবীদের সাথে চলাফেরা করার একটা সুবিধে আছে। ওদের বদৌলতে সবাই একটু ভিন্ন নজরে দেখতে শুরু করে। যে নজরে থাকে একটু ঈর্ষা, একটু মুগ্ধতা,একটু আকর্ষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা বেশ উপভোগ করে উপমা।
যুগোলবন্দী পায়রাদের জন্য এক মনে আনন্দ হলেও সাজুর সাথে সময় কাটাতে শুরু করার পর থেকে উপমা আর মিতালির নিয়ম করে বাড়ি ফেরায় ভাটা পড়ে গেছে। উপমাকে এখন আগের মতো একা একাই বাড়ি ফিরতে হয়। এতে অবশ্য সমস্যা হয় না। ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে বেণী ঘোরাতে ঘোরাতে সে প্রফুল্লচিত্তে হেঁটে যেতে পারে অনায়াসে। কলেজ থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশ। সময় লাগিয়ে হেঁটে যেতে শান্তি লাগে তার। কখনো তো ভ্যানে করেও যায় খোলা আকাশের নীচে পা দোলাতে দোলাতে। ভ্যানে চড়তে আরও আনন্দ। পূবের হাওয়া হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে ওর গায়ে। হাওয়ার আহলাদি স্পর্শে ভরশুন্য মনে হতে থাকে নিজেকে। চোখ বুঁজে ডানা মেলা পাখির মতো দু-হাত মেলে দেয় ও। মনে হয় সত্যি সত্যি উড়ছে।
আজকাল বোধহয় নির্ভয়ে সময় কাটাতে পারে উপমা। বাড়ি ফিরে যে এখন বকা খেতে হয় না। ভাবী আসার পর থেকে বাচ্চাদের বকাবকি করা বন্ধ করে দিয়েছেন মামি। তার সব বকাঝকা এখন সেজো ভাই আর ভাবীর জন্য তোলা।
__ বাড়ি ফিরিস উপ?
পেছন থেকে এসে ধপ করে উপমার পিঠে কিল বসিয়ে দেয় ডালিয়া। আচনক মারে “উফফ” করে উঠে মুখ কুঁচকে ফেলে উপমা। ধাতস্থ হলে চোখ রাঙিয়ে ডালিয়ার পানে তাকায়। কাচুমাচু মুখ করে ডালিয়ে শুধয়,
— ব্যথা পেয়েছিস?
— তো কি আনন্দ পেয়েছি? আদর করেছিস তুই আমাকে?
তেড়ে যেতে নেয় উপমা। ভয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে করুণ সুরে ডালিয়া বলে,
— ইশশ স্যরি রে। বুঝতে পারিনি। আর হবে না।

তবুও চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে উপমা। ডালিয়া যেন এবার কেঁদেই ফেলবে। উপমার হাত ধরে থেমে থেমে বলে,
— সত্যি স্যরি।
— আচ্ছা মাফ করলাম।
ওর কাঁদো কাঁদো মুখখানা দেখে মায়া হয় উপমার। মাফ পেয়েছে সেই খুশিতে তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে ওঠে ডালিয়া। লাফিয়ে এসে উপমার কাঁধ আঁকড়ে ধরে বলে,
— চল আজ একসাথে যাব। আমার নানু বাড়ি ঐ পথে। যেতে যেতে আমায় নামিয়ে দিবি। ঠিকাছে?
— বেশ তো ভালোই হলো। চল মজা হবে আজ।

উপমাও পাল্টা ডালিয়ার কাঁধ আঁকড়ে ধরে হেসে ওঠে।
ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ বিধায় এই পথে মানুষের পদচারণা কম। দু বান্ধবী শান্তি মতো পুরো রাস্তা দখলে নিয়ে এঁকেবেঁকে গল্প করতে করতে এগোতে থাকে।

ওদিকে বাংলা ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য রিকশা নিয়েছে রওনক। হাতে সময় কম। দশ মিনিটের মধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ও আর পড়াশোনা দূরের সম্পর্ক হলেও আজ স্যার নিজে এসে বলে গেছেন। না গিয়ে পারে? দ্রুত হবে ভেবে রিকশাওয়ালাকে সাইন্স বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো রওনক। অর্ধেকটা পথ দ্রুতই এলো রিকশা। কিন্তু সাইন্স বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই গতি কমে গেল। বিরক্ত রওনক ধমকে উঠল রিকশাওয়ালাকে,
— এই চাচা গতি কমাইলা ক্যান? দ্রুত চলো।
— আব্বা ক্যাঙ্করি (কেমন করে) যাইম? সামনত দেখেন না চেংড়ি দুইটা কেমন রাস্তা বোলোক করি হাঁটতেছে।
— আরে তা বেল বাজাও না ক্যান?
— বেল তো নষ্ট।
কাচুমাচু মুখ করে বলল রিকশাচালক। বি”রক্তি বাড়ল রওনকের। মাথা হেলিয়ে দেখল ইউনিফর্ম পরা দুটো মেয়ে কাঁধ ধরাধরি করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে। কি আশ্চর্য! নেশা করেছে নাকি? রেগে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় ধমকে উঠল রওনক,
— এ্যাই মেয়েরা পথ ছাড়ো।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? রওনকের ধমক ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছালে তো! ওরা যা গল্পে মশগুল!
আরও দু একবার বড় গলায় ওদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিল রওনক। কিন্তু যখন দেখল কোনো কাজ হচ্ছে না তখন রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— যেমনে যাচ্ছিলা অমনেই যাও।
— আরে লাগি যাইবে তো ওমাক (ওদেরকে)।
— লাগুক। সতর্ক করেছি তো আমরা। না শুনলে আর কি করার!
— কিন্তু..
— যা বললাম তাই করো।
রিকশাওয়ালাকেও আরেকবার ধমক দিলো রওনক। বেচারা আর কি করে ওর কথা মতো টান দিলো রিকশায়। রিকশাটা যখন মেয়েদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুল ঠিক তখনই ওরাও সতর্ক হয়ে উঠল। এবং দু’জন দু’জনের হাত ছেড়ে দিয়ে ছিঁটকে সরে গেল পথের দু’পাশে। রিকশাওয়ালা কিছুটা গিয়ে থেমে গেল। রওনকও পিছু ঘুরে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলো কি না! কিন্তু পেছনে তাকাতেই একজনের চেহারা দেখে থমকে গেল।
— আরেহ্ ঐ মেয়েটা না! অতনুর বোন। কি যেন নাম ওর?
একা একা বিড়বিড় করে মনে করার চেষ্টা করল রওনক।
— উপমা। হ্যাঁ, উপমা। এই মেয়ে এখানে কি করে?
সগতোক্তিতে চট করে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলল রওনক। এই মেয়েটার সাথে বারবার দুর্ঘটনাবশতই কেন দেখা হয় ওর? আশ্চর্য!

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here