চিঠি দিও ৩

চিঠি দিও

______________

“তোমার নামে দুইখান চিঠি আসছে রুনু”
পাখা বাতাস থামিয়ে রওনকের দিকে তাকাল হাসনা৷ সম্পর্কে সে রওনকের ভাবি হয়।
খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে রওনক তাকে শুধয়,
— কে পাঠিয়েছে? পড়ে দেখেছ?
— মানুষের চিঠি পড়তে হয় না জানো না। তবে প্রেরকের নাম দেখছি আমি।
— কে?
— একজন হইলো মনিষা সেন।
বলে একটু থামে হাসনা। কয়েক মুহুর্তের জন্য প্লেটে আঙুল স্থির হয়ে যায় রওনকের। দ্রুতই আবার স্থবিরতা কাটিয়ে সে প্রশ্ন করে,
— আরেকটা?
— আম্মার।
এবারে মুখ তুলে তাকায় রওনক। ভ্রু কুঁচকে নিরসভাবে জিজ্ঞেস করে,
— এখন আবার কি চাই ওনার?

কৈফিয়ত দেবার মতো করে হাসনা বলে,
— শুনছিলাম ওদিকে জল ব’সন্তের প্রাদুর্ভাব হইতেছে ইদানিং খুব। আম্মারও মনে হয়..

কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না হাসনা। রওনকের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটতে দেখে থেমে যায়।
— ওহ! তাহলে চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে।
পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করে ডাইনিংয়ের ওপর ফেলে রওনক বলে,
— পাঠায় দিও ভাবী।
পড়ে থাকা টাকাগুলোর দিকে চুপচাপ কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে হাসনা। দীর্ঘশ্বাস চেপে কোমল স্বরে বলে,
— চিঠিটা একবার পড়ে দেখলে হয় না রুনু? একজন মায়ের সাথে সন্তানের কি শুধু টাকারই সম্পর্ক?
— বারবার মা মা গান করবা না তো ভাবী। উনি আমার মা হয় না। বরং কেউই হয় না। কোনো সম্পর্ক নাই ওনার সাথে আমার, আমাদের। আঠারো বছর আগেই সব চুকেবুকে গেছে। উনি নিজে চুকায় ফেলছেন। এতদিন পর কোন লজ্জায় আবারও ফেলে যাওয়া বারান্দা মাড়ানোর চেষ্টা করতেছেন এইটাই শুধু বুঝি না।

— আমার মনে হয় উনি পাল্টায় গেছেন রুনু। চিঠিটা একবার খুলে পইড়ো তুমি।
হাসনার বিপরীতে এবার কিছু বলে না রওনক। আর কিছুক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে শেষে ভাতের প্লেটে ঝুপ করে পানি ঢেলে উঠে পড়ে। বিরোধ করে ওঠে হাসনা,
— ও কি! প্লেটে পানি ঢেলে দিলা। কিছুই তো খাইলা না।
— ক্ষুধা মরে গেছে।
সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায় রওনক। ওর গমন পথে তাকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হাসনা। মাঝেমধ্যে এই সংসারের মানুষগুলোর জন্য তার বড্ড মায়া হয়। স্বামীর মুখে যখন শোনে তাদের পুরোনো হাসিখুশি পরিবারটার কথা, তখন আফসোস জাগে। ভালোবাসাবিহীন কিছু সংসারের বোধহয় এমন করুণ দশা হয়! সারাটা জীবন শুধু ভুগিয়ে যায়।

ঘরে এসে পড়ার টেবিলের ওপর খাম দুখানা পড়ে থাকতে দেখে রওনক। হাতে নিয়ে জানালার ধারে চলে যায়। মায়ের দেয়া খামটা আগে খোলে। খসখসে ঘিয়ে রঙা কাগজে এবড়োখেবড়ো করে একটা লাইনই লেখা “তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন বাবা”
“প্রয়োজন” শব্দটা নিজে নিজে আওড়ায় রওনক। অত সুখী, সুন্দর সাজানো পরিবার থাকা সত্ত্বেও পুরোনো মানুষগুলোর কাছে তার কিসের প্রয়োজন? একটানে কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টু’করো করে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে । ছুঁড়ে ফেলে খামটাও। এরপর দ্বিতীয় খাম হাতে নেয়। প্রেরকের নামটায় আবারও চোখ চলে যায় “মনিষা সেন”
বাব্বাহ্ বিয়ে হতে না হতেই বরের নাম লাগিয়ে নিয়েছে নামের সাথে। অল্প হেসে খাম খুলে চিঠি বের করে। এখানে আবার লাইন সংখ্যা বেশ। আলোতে ধরে সময় নিয়ে পড়তে শুরু করে রওনক।

প্রিয় রওনক দা,
তোমাকে প্রিয় বলার অধিকার অবশিষ্ট রয়েছে কি? আমার কাছে তো তুমি আজও বড্ড প্রিয়। প্রিয় ছিলে এবং থাকবে। তোমার সাথে বোধহয় কখনো দেখা হবে না আর। দূরে চলে যাচ্ছি। যতটা দূরে গেলে তুমিময় পাগলামি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, ঠিক ততটা দূরে। আচ্ছা রওনক দা মানুষটা আমার হবে না নিয়তিতেই যদি লেখা থাকে তবে তার প্রতি প্রেম আসে কেন? কেন সে নিষিদ্ধ জেনেও বেহায়া মনটা তাকে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে ভীষণ ভাবে। নিষিদ্ধ জিনিসের ওপর টান বেশি এজন্য?
সামনা সামনি বলার সাহস করে উঠতে পারিনি কভু। আজ এত সাহস কোত্থেকে এলো,লিখে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। রওনক দা আমি তোমায় ভীষণ রকমের ভালোবাসি। কি কারণে এত ভালোবাসা এলো জানা নেই আমার৷
আদতে ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে ? নিজেকে প্রশ্ন করে কভু উত্তর পাইনি। উত্তরটা জানলে জানিও তো।
অন্ধপ্রেমের সংজ্ঞা কি? তোমার প্রতি কিন্তু আমার অন্ধপ্রেম রওনক দা। নইলে যে মানুষটাকে একদিনও চোখের দেখা দেখলাম না কেবল যার গল্প শুনলাম তার প্রতি এত প্রেম ঐ বয়সে এসেছিল কি করে? দাদার মুখে তোমার গল্প শুনে শুনেই কীভাবে তোমার অলীক মূর্তি বানিয়ে ফেলেছিলাম হৃদয় মন্দিরে। সামনে যখন এলে অবাক হয়ে দেখলাম আরে হৃদয়ের মূর্তিমান মানুষটা আর সামনের রক্ত-মাংসের মানুষটা তো একদম এক। কল্পনার সাথে বাস্তবের মিল এতখানিও হতে পারে?
আমি মেয়ে মানুষ। নিরীহ, নিস্পৃহ। ভালোবাসার তীব্র অনলে দাউ দাউ করে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছি হরদম, কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস জোটাতে পারিনি। বললেও কি তুমি আমার হতে? আমাকে বোধহয় সেই নজরে কখনো দেখনি তাই না? দেখার কথাও না। বন্ধু সহোদরা। স্নেহের চোখে দেখে এসেছ সবসময়। আমি কোনো প্রত্যাশা থেকে আজ লিখতে বসিনি। প্রত্যাশার সময় পেরিয়ে গেছে কি না! জানো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটাকে আমি নাম দিয়েছি আত্মবিধ্বংসী ভালোবাসা। তুমিময় একটা অনুভূতি শক্ত ফলার মতো গেঁথে আছে হৃদয় জমিনে। প্রতিনিয়ত তীক্ষ্ণ সূঁচালো আঘাতে চৌচির করে দেয় ও আমাকে। দিক। তবুও সরাতে ইচ্ছে করে না ওকে আমার। এই আঘাত যে আমার বড্ড প্রিয়। আঘাতটাই তো প্রতিনিয়ত স্মরণ করায় তোমার কথা। আসলে তোমাকে জড়িয়ে সবকিছুই আমার বড্ড প্রিয় রওনক দা। আঘাতও।
আচ্ছা রওনক দা তোমাকে স্মরণ করা কি আমার পাপ? পাপ হলে হবে। এতটুকু পাপ আমার থাকুক।
আচ্ছা একটা ভয়ানক কথা বলে শেষ করি।
তুমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করো? আমি কিন্তু শতভাগ করি। আমাদের তো সাতটা জন্ম হয়। এ জন্মে তুমি আমার হলে না। পরবর্তী জন্মগুলোতে বরং আমার হয়ে থেকো। কেমন?
ইতি,
মনিষা
পুনশ্চঃ মাঝেমধ্যে যদি চিঠির আবদার করি, যদি বলি চিঠি দিও রওনক দা। আমি অপেক্ষা করব। দেবে? জানি দেবে না। তুমি চাইবে না তোমার কারণে আমার সংসার ভাঙুক। ভাঙবে না, চিন্তা করো না। এতদিনের সমস্ত পাগলামি ভাষায় লিখে বিসর্জনের চেষ্টা করলাম তো। কতটুকু বিসর্জিত হলো জানি না। তবে আমার স্বামী মানুষটা ভালো। ওকে কষ্ট দিতে বাঁধবে আমার। বঞ্চিত করতে পারব না। থাক, কষ্ট জিনিসটা নাহয় আমার ভাগেই লেখা থাকুক। বাকি সবাই সুখে থাকুক।

চিঠিটা পড়া শেষ করে পুনরায় খামে ঢুকিয়ে রাখল রওনক। ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। অদ্ভুত গুমোট বাঁধা অনুভূতি। আসলেই মনিষাকে কখনো সেরকম নজরে দেখেনি ও। কিন্তু মনিষার মনের ভাব, চোখের ভাষা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল। তাই তো সামনা-সামনি হয়েছে খুব কম। চেয়েছিল দ্রুত বাচ্চা মেয়েটার অনুভূতির সাতকাহন ফুরিয়ে যাক। কিন্তু কি অদ্ভুত! আড়ালে থেকেই এতখানি ভালোবেসেছে মেয়েটা ওকে। কই ওর মধ্যে তো কিছুই নেই তেমন ভালোবাসবার মতো। তাহলে মেয়েটার হৃদয়ে কেন এসেছিল ভালোবাসা? যাই কারণ থাকুক ও চায় মেয়েটা ওকে ভুলে যাক। চঞ্চল প্রজাপতির মতো আনন্দে, আহলাদে হেসে-খেলে সংসার করুক। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে জানালার বাইরে নিগূঢ় আঁধারে চোখ রাখল রওনক। গুমোট অনুভূতিটা মুক্তি দিচ্ছে না কেন তাকে? আশ্চর্য! নিরর্থক এসব অনুভূতির মানে হয়? মিথ্যে বাঁধন কোনো কালেই পছন্দ নয় রওনকের। আজও পছন্দ হলো না। হাতের খামটা সযতনে ড্রয়ারে তুলে রেখে সিগারেটের প্যাকেট আর হোন্ডার চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও একটুখানি বাউণ্ডুলেপনায় গা ভাসাতে। তাহলে যদি গুমোট অনুভূতিটা ছেড়ে যায় ওকে!
___________________

বৃহস্পতিবার দিনটাকে মাঝেমধ্যে চাঁদরাত মনে হয় উপমার কাছে। পরদিন ছুটি। বাঁধাধরা পড়াশোনার চাপ নেই, মামার বকুনি নেই, নিয়মের কোনো বালাই নেই। এই একটা দিন স্বাধীন ভাবে যা মন চায় তাই করা যায়। মন চাইলে সারারাত জেগে গল্প করা যায়। বড় ভাইয়ের রেখে যাওয়া ভিসিআরে সিনেমা দেখা যায়, ইচ্ছেমতো নাচ-গান আনন্দ উৎসব সব করা যায়। আগে তো সপ্তাহ অন্তর অন্তর চড়ুইভাতিরও আয়োজন করতো ওরা। কিন্তু বড় ভাই, মেজো ভাই বাইরে যাওয়ার পর এসব আনন্দ আয়োজনে ভাটা পড়ে গিয়েছিল। সেজো ভাই তো কখনোই এসবের মধ্যে নেই। সে, অভ্র আর জান্নাতি। তিনজনে চড়ুইভাতি হয়? মাঝেমধ্যে খুব মন খারাপ হতো উপমার। কিন্তু মন খারাপ করেই বা লাভ কি? তার বিষণ্ণতা দেখার আছেই বা কে!
আজ বহুদিন পর আবারও চড়ুইভাতির আয়োজন করা হয়েছে উপমাদের বাড়িতে। বাড়ির মানুষরা বাড়িতে ফিরেছে, নতুন বউ এসেছে। কত উপলক্ষ! সন্ধ্যে থেকে সেজো ভাবীর সাথে ছুটোছুটি করে সব যোগাড় যন্ত্র করছে ও, অভ্র আর জান্নাতি। আয়োজন করা হয়েছে বাড়ির ছাদে। সুন্দর পাটি বিছিয়ে, লাইটিং করে ছাদ সাজিয়েছে ওরা দু ভাই-বোন। একপাশে ইট দিয়ে চুলো বানিয়ে রান্না চাপানো হয়েছে। রান্নার দিকটা পুরোটা দেখছে ভাবী আর জান্নাতি। মামিকে এতবার অনুরোধ করা হলো কিন্তু সে এলো না। গোজ মুখ করে ঘরে বসা। কেউ গেলেই রাম ধমকে বার করে দিচ্ছে। মামির আসলে রাগ বেড়েছে ভাবীকে সবাই মেনে নেয়ার পর থেকে। সে ভেবেছিল মামা এসে বোধহয় অস্বীকৃতি জানাবে, বউ মানবে না। বের করে দেয়া হবে ভাবীকে। কিন্তু কি অদ্ভুত। বের করে দেয়া দূরের ব্যাপার বরং এক বৈঠকেই মেনে নেয়া হলো ভাবীকে। উপমা নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কি করে অসম্ভবটা সম্ভব হলো? পরে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বুঝতে পেরেছে সেজো ভাবীর মতো এত মিষ্টি, লক্ষ্মী আর মিশুক মেয়েকে না মেনে কেউ থাকতেই পারবে না। ভাবী এসেই সবাইকে যেভাবে আপন করে নিয়েছে! দু’হাতে আগলে নিয়েছে সংসারটাকে। বড় মামি চলে যাওয়ার পরের সব এলোমেলো, অসামঞ্জস্যতা কয়েকদিনেই ঠিক করে ফেলেছে। পাশাপাশি সে ঘরকন্নায় নিপুণা। রান্নার হাতও চমৎকার। নানি বলতো পুরুষ মানুষের মনে যাওয়ার রাস্তা পেট দিয়ে শুরু হয়। ঠিকঠাক মতো পেট পুজোটা দিতে পারলে আপনা থেকে মনের দরজা খোলা পাওয়া যায়৷ এ তো নিরেট সত্যি। এতদিনে নিজ চোখে দেখে বিশ্বাস হলো উপমার। ক’দিন এসেছে বড় ভাই, মেজো ভাই? একবার ভাবীর রান্না খেয়েই ভক্ত হয়ে গেছে দুটো । একেকদিন খাওয়ার সময় গুলোতে টেবিলে চাঁদের হাট বসে যেন। খাবার দেয়া হচ্ছে শুনলেই ভীমড়ি খেয়ে বসে একেকজন। তারপর শুরু হয় খাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি। কে কোনটা আগে শেষ করতে পারবে! স্ট্রিক্ট বড় মামাও পারলে যোগ দেন ওদের সাথে। অবাক হয়ে যায় উপমা। আর মেজো মামা তো শান্তিপ্রিয় মানুষ। সে যে সবার আগে ভাবীকে মেনে নেবে এ জানা ছিল উপমার। মিয়া বিবি যেখানে রাজি সেখানে কাজির বিরোধ করে লাভ কোথায়?
— কিরে গায়িকা সারাদিন তো গান গেয়ে গেয়ে মাথা ধরিয়ে দিস আমাদের। আজ এত চুপচাপ কেন? পাগল আজকেই তো গান গাওয়ার উপযুক্ত দিন।
বড় ভাই আবিদের খোঁচায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় উপমা। কোমরে হাত রেখে বলে,
— আমি মাথা ধরিয়ে দিই তোমাদের? তোমরাই তো পারলে ডেকে এনে এনে গান শোনো আমার।
— ইশশ আমরা শুনি! তুই জোর করে শোনাস।
— জোর করে শোনাই তো এখন আবার শুনতে চাচ্ছ কেন?
মুখ বাঁকায় উপমা।
— আন্নি বু ঝগড়া পরে। গান শোনাও তো এখন। আসলেই তোমার গান ছাড়া জমছে না।
— আমার গানে মাথা ধরে রে বড় ভাইয়ের। থাক আমি কারো কষ্টের কারণ হতে চাই না।
মুখ ফিরিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলে উপমা।
— বড় ভাই তো একটা পাগল। পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া না করলে শান্তি হয় না ওর। তুমি কানে নিও না ওর কথা।
সান্ত্বনা স্বরূপ উপমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে অভ্র। ওদিকে ভ্রু কুঁচকে আবিদ হৈ হৈ করে ওঠে,
— কি দুর্নাম করছিস রে আমার নামে? সাবধানে হ্যাঁ। উঠলে কিন্তু খবর আছে।
— কথায় কথায় শুধু তোমার হুমকি-ধমকি।
অভ্রও মুখ বাঁকায় এবার। ওকে মুখ বাঁকাতে দেখে হেসে ওঠে সকলে। দূর থেকে আসমাও ওদের ভাই-বোনের খুনসুটি দেখে আর হাসে। রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে। মেয়ে মানুষের এসব হাসি-আনন্দ একদমই পছন্দ ছিল না বাবা-চাচাদের। এমন চিত্র আসমার জন্য নতুন। একদিকে যেমন অবাক লাগছে তেমন মজাও পাচ্ছে সে। এমন সুস্থ, সুন্দর, আনন্দময় জীবন তার কতদিনের কাম্য!
ভাসুর আর ননদের টুকটাক ঝগড়া দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে সেও উপমাকে অনুরোধ করে ওঠে একটা গান গাওয়ার জন্য। এ ক’দিনে বেশ কয়েকবারই গান শুনেছে সে উপমার কণ্ঠে। স্বীকার করতেই হবে ভীষণ ভাল গান করে মেয়েটা। যতটা সময় গায় মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রাখে সবাইকে।
ভাবীর অনুরোধে ঝগড়াঝাঁটিতে ইস্তফা দেয় উপমা। প্রিয় মানুষ প্রথম আবদার করল না শুনে পারা যায়? বড় ভাইকে ভেংচি কেটে ভাবীর দিকে ঘুরে বলে,
— শুধু তোমার জন্য গাইছি।
উপমার বাচ্চামি কথায় হাসি পেয়ে যায় আসমার। ঠোঁট টিপে হেসে মাথা নেড়ে সায় দেয় সে। উপমাও আলতো হেসে নড়েচড়ে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান ধরে,
“সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে,
ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা..”

এই মুহুর্তে বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সকলে উপস্থিত থাকলেও মেজো ছেলে আশিন এবং সেজো অতনু ছিল না। অতনুর তো পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু উপমার গান শুরু হলে চট করে আশিন এসে উপস্থিত হয় ছাদে। অল্প দূরত্ব রেখে বড় ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করা আসমার অভ্যাস। মেজো ভাসুরকে আজ একটু বেশিই পর্যবেক্ষণ করে আসমা। উপমাকে নিয়ে তার মুগ্ধতার দৃষ্টি এড়াতে পারে না আসমার থেকে। এ মুগ্ধতার ভাব অন্য। আচ্ছা এর গভীরতা ঠিক কতটুকু? উপমার দিক থেকে এতে প্রচ্ছন্ন সায় আছে কি! নাকি বিষয়টা পুরোটাই এক তরফা?
মনে উত্থিত প্রশ্নের জট এ মুহুর্তে খোলা সম্ভব হয় না আসমার পক্ষে। তবে সে ভেবে রাখে যত দ্রুত সম্ভব এ জট খুলে ফেলবে। এক তরফা হলে কিঞ্চিৎ দুঃখ লাগবে তার। মেজো ভাসুর মানুষটা খুব ভালো। শান্তশিষ্ট, ভদ্র। মার্জিত তার চলাফেরা৷ খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। এমন ভদ্র ভালো মানুষটা কষ্ট পেলে খারাপ লাগারই কথা৷
_____
রেলস্টেশন পেছনে ফেলে তেঁতুলতলা মোড়ের দিকে এগুচ্ছে রওনকের হোন্ডা। ক্লাবঘরে গিয়েছিল সে শুরুতে। নেশায় চূড় ছেলেপেলেদের সাথে আড্ডা জমানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দু পেগ নিয়ে আর এগোতে পারেনি। বিরক্তি বাড়ছিল। তাই বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। গন্তব্যহীন চলছে এখন।

দেখতে দেখতে একসময় তেঁতুলতলাও পার হলো রওনকের হোন্ডা। শহীদ জররেজ সরণীর পথ ধরে এগোতে থাকে ও এবার৷ পুরো রাস্তা ফাঁকা বিধায় পথ চলতে সুবিধে হয়। যতখানি মন চায় স্পিড বাড়ানো যায়৷ স্পিড বাড়িয়ে, কমিয়ে রামমোহন ক্লাবে দু একটা চক্কর কাটে ও। তারপর মোড় ঘুরিয়ে চলে যায় ডিসি বাংলো রোডে। নিঝুম-নিস্তব্ধতায় বুজে আছে পুরো শহর। সে ছাড়া পথে কেউ নেই তেমন। ইতর প্রাণী গুলোও না।
ডিসি বাংলোর পথটা বেশি চুপচাপ। ভাগ্যিস আজ চাঁদনি রাত। রূপোলী আলোয় ভরপুর চারিদিক। নিগূঢ় অন্ধকার থাকলে পথটাকে গহীন জঙ্গল মনে হতো। চলতে চলতে পুনরায় স্পিড বাড়ায় রওনক। স্পিড বাড়ালে অদ্ভুত একটা শব্দ হয় তার হোন্ডাটাতে। খুব তীক্ষ্ণ বিরক্তিকর একটা শব্দ। খোদ সে শব্দে বিরক্ত হলেও আজ মজা লাগছে রওনকের৷ ঝিমনো শহরের নিস্তব্ধতায় চিঁড় ধরাতে পারছে ভেবে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে।
ডিসি বাংলোর পরের রাস্তাটায় সংস্করণের কাজ চলছে। বাঁশের বেরিগেড দিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। তাই চেকপোস্টের দিকে আর এগোতে পারল না রওনক। বাড়িতেও ফিরতে ইচ্ছে করছে না তার। গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে ভাবলো বাংলোর অপজিটে যে পথটা চলে গেছে ঐ পথে নাহয় যাওয়া হোক। পথটা ধরে এগোলে নতুন পাড়া। এই পাড়াটা শহরের অপেক্ষাকৃত উন্নত পাড়া বলেই পরিচিত। সুন্দর ভাষায় এলিট পাড়া। উচ্চবিত্ত সব মানুষদের বসবাস এখানে।
তেমন চেনাজানা না থাকলেও কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার আসা হয়েছিল রওনকের। আজ বহুদিন পর আবার এলো।
উচ্চবিত্তদের শান্তির ঘুমে হালকা ব্যাঘাত ঘটাতে মজাই লাগবে বোধহয়৷ ঈষৎ হেসে হোন্ডায় টান দিলো রওনক। উঁচু উঁচু দালানে ভরা দু পাশ আর মধ্যিখানে সদ্য হওয়া পিচঢালা রাস্তা। তার মধ্য দিয়ে হোন্ডা চালিয়ে যেতে এত আরাম! নিজেকে যেন রাজা-মহারাজা মনে হচ্ছে রওনকের। দু’পাশে পেয়াদারা কুর্নিশ করছে, সালাম ঠুকছে তাকে। পেয়াদা কারা? ঐ দালানগুলোর ভেতর নিশ্চিত মনে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো?
ফুরফুরে মনে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই টার্ন নিতে থাকে রওনক। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শেষ আছে। সে না-হয় অন্তহীন চলতে চায় কিন্তু অন্তহীন চলতে তো অঢেল পেট্রোলও প্রয়োজন। আজ বেরুবার মুহুর্তে মিটারটা দেখে নেয়া হয়নি। তারই ফলস্বরূপ চলতে চলতে আচমকা বিকট শব্দ করে থেমে যায় রওনকের সাধের হোন্ডা৷ আচমকা যাত্রা বিরতি আশা করেনি সে। যারপরনাই তাই বিরক্ত হলো রওনক। চোখ ঘোরাতেই একটু সামনে শাটার নামানো একটা দোকান নজরে এলো ওর। নেমে পায়ে হেঁটে দোকানটা পর্যন্ত নিয়ে গেল হোন্ডা। দোকানের এক পাশে জ্বলজ্বল করছে ২০ ওয়াটের হলুদ টিউব লাইট। চোখ ঘষে সেই আলোয় মিটারের দিকে চোখ বুলিয়ে বুঝল গাড়ি থেমে যাওয়ার কারণ। পেট্রোলই তো শেষ। নিমেষে বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠল ওর মুখ। নোংরা শব্দে খিস্তি দিয়ে হোন্ডা এক পাশে স্ট্যান্ড করে রাখল। এখন এই মাঝ রাস্তায় পেট্রোল পাওয়া দুষ্কর। ফিরবে কীভাবে? পায়ে হেঁটে! নাক কুঁচকে হোন্ডায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল রওনক। সিগারেট খাওয়া দরকার একটা। সিগারেটে দু টান দিলে ফ্রেশ লাগে রওনকের। বিরক্ত হয়ে লাভ নেই এখন, বরং আয়েশ করে সুখটান দিক একটু। তারপর না-হয় ভাবা যাবে বাড়ি কীভাবে ফিরবে।
ভাবনানুযায়ি চট করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে নিলো রওনক। দু ঠোঁটের ফাঁকে আলতো করে সিগারেট চেপে দেশলাইয়ে মাত্র কাঁঠি ছুঁইয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে;ঠিক সেই মুহুর্তে খুব অকস্মাৎ পেছন দিক থেকে ধীর অথচ ভীষণ সুরেলা গলায় ভেসে আসতে শোনা গেল,
“আমি কখনো যাইনি জলে, কখনো ভাসিনি নীলে
কখনো রাখিনি চোখ, ডানামেলা গাঙচিলে।
আবার যেদিন তুমি সমুদ্রস্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়
বলো নেবে তো আমায়?”

“এত রাতে গান করে কে?”
স্বগতোক্তি করে সিগারেট নামিয়ে কৌতূহলি চোখে আশেপাশে তাকাতে লাগল রওনক। তখন আবারও গানের বর্ধিতাংশ ভেসে এলো,

“আমি শুনেছি সেদিন নাকি, তুমি তুমি তুমি মিলে
তোমরা সদলবলে সভা করেছিলে
আর সেদিন তোমরা নাকি, অনেক জটিল ধাধা
না বলা অনেক কথা কথা বলেছিলে।
কেনো শুধু ছুটে চলা, একই একই কথা বলা
নিজের জন্যে বাচা নিজেকে নিয়ে
যদি ভালোবাসা নাই থাকে, শুধু একা একা লাগে
কোথায় শান্তি পাবো, কোথায় গিয়ে
বলো কোথায় গিয়ে?”

সুরের তীব্রতা অনুসরণ করে এবার চট করে সামনে তাকাল রওনক। তখুনি নজরে এলো কয়েক কদম এগিয়ে ওপাশে রাস্তার ধারেই যে দ্বিতল বাড়িটা তার ছাদে এক কোণে এক নারীমূর্তি দাঁড়ানো এবং সে-ই হচ্ছে গানের উৎস৷
এতক্ষণে খুঁজে পেয়েছে ভেবে ঠোঁট প্রসারিত করে টুপ করে সিগারেট পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল রওনক। খুব অদ্ভুতভাবে তার আর সিগারেট খেতে মন চাইছে না বরং অদূরের ঐ ছায়া মানবীর সুরের মূর্ছনায় ভেসে যেতে মন চাইছে।
পাগলাটে ছেলে রওনক। মনে তার যখন যা ওঠে তখন তা-ই করা চাই। এই যে গান শোনার বাসনা হুট করে জাগ্রত হলো, তারপর সে ঠিক ঠিক হোন্ডা ফেলে দ্বিতল বাড়ির কাছে গিয়ে রাস্তার ধারে জামু ফেলে গালে হাত রেখে বসে পড়ল। বাকি রাত তারপর গান শুনেই কাবার।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here