চিঠি দিও ২

চিঠি দিও

___________________________

অতনুর বউয়ের নাম হলো আসমা। সম্পর্কের দিক দিয়ে সে অতনুর খালাতো বোন। বহুদিন যাবৎ তাকে পছন্দ করে অতনু। কখনো সামনে থেকে বলেনি। ভেবেছে সময় করে বলবে। এছাড়া আসমার মনের কথাও তো সে জানতো না। প্রত্যাখাত হবার ভয়ও বোধহয় মনের কোনো এক কোণে লুকিয়ে ছিল।
আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে তেমন যাতায়াত নেই অতনুর। আসমাকে দেখেছিল কোনো এক বিকেল বেলা শহরের পথে হুড তোলা রিকশায়। রূপবতীর মোহনীয় রূপ প্রথম ঝলকেই আকর্ষিত করেছিল তাকে। তারপর পিছু নেয়া৷ তখন সে জানতোও না এই আসমা সম্পর্কে তার খালাতো বোন হয়। যখন জানলো ভেবেছিল সরে আসবে কি না! আসলে পারিবারিক অনেক বিষয় আছে তো। অতনুদের সাথে কারোরই তেমন সুসম্পর্ক নেই।
কিন্তু মেয়ে তো তার জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি এবং ফ্রীতে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে। ওকে এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না অতনুর পক্ষে। একসময় মনে হলো এই মেয়ে বোধহয় বিয়ের আগে সম্পর্ক রাখতে রাজি হবে না। ইনিয়েবিনিয়ে তাই বাড়িতেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। সে প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেছিল আসমার বাবা। মানতে পারেনি অতনু। কিসের কমতি আছে তার মধ্যে? বড় ঘর, বড় পরিবার। চারিদিকে এত নাম-ডাক। আর কি চাই ওদের? রাগের চোটে শাঁসিয়ে এসেছিল আসমার বাবাকে। বলেছিল সহজভাবে মেনে না নিলে তুলে নিয়ে আসবে। ভদ্রলোক ভয় পেয়েছিলেন বৈকি! ভয়ের চোটে একপ্রকার লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন কোনো এক চাকুরে পাত্রের সাথে। তবে যতই ভদ্রলোক গোপনে বিয়েটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করুক এসব কথা তো চাপা থাকে না। বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসে ভেসে তেমন অতনুর কানেও চলে এসেছিল । খবরটা শুনে হাসি পেয়ে গেছিল অতনুর। অতনুকে উনি ঠিকভাবে চিনতে পারেননি । ও হলো শিকারী বাজ। কোনোকিছুর ওপর চোখ পড়লেই সেটা তৎক্ষনাৎ ওর। যেকোন উপায়ে নিজের করা চাই ই চাই । সেখানে আসমা তার ভালোবাসা৷ সহজে ওকে ছেড়ে দেয় কীভাবে?
সিদ্ধান্তটা খুব দ্রুত নিতে হয়েছে। মুখে বললেও তার আসমাকে তুলে আনার কথা ছিল না। কিন্তু কি আর করার! বিকল্প পথও তো খোলা রাখেনি শ্বশুর মশাই।
যাকগে পারিবারিক ঝামেলা তো চলতেই থাকবে। এই প্রসঙ্গ এখনকার মতো তোলা থাক। পরিস্থিতির সাথে এ ব্যাপারটাকে আলোকপাত করা যাবে। এখন বরং আসমাকে নিয়ে কথা হোক।

স্বল্প সময়ে আসমার সাথে বেশ কথা হয়েছে উপমার। এতটুকুতেই মনে হয়েছে তার টুকটুকে ভাবীটাও সেজো ভাইকে অসম্ভব ভালোবাসে। যদিও খোলাসা করে আসমা কিছুই বলেনি তাকে। তবে উপমার ধারণা মনে মনে ভাবীও পছন্দ করতো সেজো ভাইকে। বলার সাহস পায়নি। যতটুকু শুনল ওনারা বনেদি পরিবার৷ এসব পরিবারে প্রেমের বিয়ের চল নেই বললেই চলে। বিয়ের আগে প্রেম আবার কি জিনিস? যা হবে প্রেম-ভালোবাসা সব বিয়ের পর। বাড়ির লোক দেখেশুনে যার সাথে হাত মিলিয়ে দেবে সে-ই প্রাণের মানুষ, সে-ই প্রেমের মানুষ। এই নীতিকথা মানতে গিয়ে হৃদয়ে উত্থিত প্রেমানুভূতিটাকে আলগোছে লুকিয়ে রেখেছিল তার ভাবী। পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেনি। করার কথাও না। কিন্তু সেজো ভাই এসব নিয়ম-নীতির ধার ধারে না। মুখ দিয়ে একবার যা বলবে তাই বজ্র সত্য। ভাবি বিরোধ করতে চেয়েছিল কিন্তু ভাইয়ের দৃঢ়তার সামনে তা খাটেনি। উপমা দেখেছে বিয়ের ঘটনা বলার সময় ভাবীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। চঞ্চল চোখজোড়ায় অনাবিল আনন্দের উচ্ছ্বাস। ভালোবাসা বিষয়টা বোধহয় খুব ম্যাজিক্যাল।

ভাবীকে নিজের ঘরে এনে কাপড়-চোপড় দিয়ে ফ্রেশ হতে পাঠিয়েছে উপমা। মেজো মামাকে একটা চিঠি লেখা দরকার। চিঠি তো বড় ভাইকেও পাঠাতে হবে। অভ্র ফিরুক স্কুল থেকে। ও আসলে চিন্তাভাবনা করে লেখা যাবে নাহয় চিঠি। আপাতত মামিকে দেখা প্রয়োজন। বাইরের কাপড় ছেড়ে সরাসরি মামির ঘরের দিকে পা বাড়াল উপমা।
ঘরে গিয়ে দেখা গেল ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে তার মামি। মৃদু স্বরে সে কোঁকাচ্ছে। মাথার কাছে জান্নাতি বসা। জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। জ্বরও এসে গেছে নাকি মামির? কৌতূহলে বিছানায় মামির পাশে গিয়ে বসল উপমা। ভ্রু নাচিয়ে জান্নাতির কাছে জানতে চাইল কি অবস্থা? মুখে কিছু বলল না জান্নাতি কেবল করুণ চোখে তাকাল৷ খলা খাঁকারি দিয়ে উপমাই মামির গায়ে হাত রাখল। নরম সুরে শুধল,
— মামি জ্বর এসেছে আপনার?
উপমার স্বরে ঝট করে চোখ খুলে ফেলল শিল্পী। কপাল থেকে জান্নাতির হাত সরিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে নাকে কান্না করে উঠল,
— ওরে আব্বারে। আমার ব্যাটায় কি করল রে। আন্নি রে। কাকো না জানেয়া অয় বিয়া ক্যানে করল রে। ওরে আল্লাহ, আল্লাহ গো।
ধড়ফড় করে উঠে বসে আচমকা উপমাকে ধরে সবেগে ঝাঁকাতে লাগল শিল্পী এবং কান্নারত গলায় বলতে লাগল,
— ক তোর সেজো ভাই ক্যানে করল এরকম? অর বাপোক আমি কি জবাব দেব?
হঠাৎ ঝাঁকুনিতে তাজ্জব হয়ে গেল উপমা। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মামির কাঁধে ভরসার হাত রাখল সে। গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল স্বরে বলল,
— অস্থির হবেন না মামি। অস্থির হয়ে কোনো লাভ নেই। যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে করতে হবে। ঘটনা একটা ঘটেই গেছে এখন হাতে আর কিছু নেই। আমরা আছি সবাই, বড় মামা আছেন। উনি আসুক কলেজ থেকে। তারপর আবার মেজো মামা, বড় ভাই, মেজো ভাই সবাইকে চিঠি পাঠাতে হবে। সবাই এলে বসে একটা সুরাহা করা যাবে।
— কোনো সুরাহা হবে না মাগো। আমার মান-সম্মান সব ধুলায় মিশায় দিছে আমার আব্বা। সে কেমন মেয়ে তুলি আনি বিয়া করে। ছিঃ ছিঃ লজ্জা! হায়রে এই ব্যাটাক নিয়া কত গর্ব আছিল আমার। কত বড় বড় মানুষের সাথে তার উঠাবইস্যা। মন্ত্রী হবে একদিন আমার ব্যাটা।সে কেমন না বুঝিয়া অকারেন্স করি ফেলাইলো। হায় খোদা!

ডুকরে উঠে পুনরায় কপাল চাপড়াতে শুরু করল শিল্পী।
কে জানে কেন মামির কান্না দেখে হুট করে উপমার হাসি পেয়ে গেল। ওপাশে জান্নাতি ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে মামির দিকে। ওর ভীতু চাউনি দেখে উপমার হাসি দ্বিগুণ হারে বেরুতে চাইল। তথাপি পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ঠোঁট কামড়ে আসন্ন হাসিটাকে দমন করে নিলো সে। এবং মামির কাঁধে হাত রেখে পুনরায় তাকে বোঝানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
— নতুন বউকে একবার চোখের দেখাটা দেখেন মামি। একটা পুতুল নিয়ে এসেছে সেজো ভাই। এত সুন্দর বউমা দেখে আপনি রাগ করে থাকতেই পারবেন না।
— কিসের সুন্দর! সুন্দর ধুইয়া পানি খাব আমি? খালাতি বইনোক কেমন মানুষ বিয়া করে। বংশের ভেতর বিয়া করলে কত সমস্যা হয় জানো তোমরা? কিচ্ছু জানো না। ছিঃ ছিঃ। বাচ্চা-কাচ্চা কিচ্ছু হবে না ঐ মেয়ের।
দাঁতে দাঁত চেপে রোষের সাথে বলল শিল্পী। মামির মুখে এমন কথা শুনে আঁতকে উঠল উপমা। বিরোধ করে বলল,
— ছিঃ মামি এসব কেমন কথা বলেন? ছেলের বউ হওয়ার আগে সে একটা মেয়ে। একটা মেয়ের জন্য মা হওয়া কত সৌভাগ্যের বিষয়। আপনিই তো বলেন আল্লাহর আরশ সবসময় খোলা থাকে। যখন তখন যে সে কথা বলতে নাই। সন্তানতূল্য মেয়েটাকে নিয়ে আপনি এতবড় বড় কথা বলতে পারলেন?
— আরও বলব আমি। অভিশাপ দিব অভিশাপ। আমার ব্যাটার মাথা খাইছে ঐ মেয়ে। নাইলে আমার ব্যাটা এতবড় কাজ করে! সুখে থাকতে পারবে না তো ঐ মেয়ে। অর জীবন..

চট করে মামির মুখে হাত দিয়ে কথা অসম্পূর্ণ করে দিল উপমা। মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে তার। মেজো মামি আর মামারও তো প্রেমের বিয়ে শুনেছিল নানির কাছে। সেই সময়ে ওরা যদি পছন্দ করে বিয়ে করতে পারে তাহলে ছেলের ক্ষেত্রে বিষয়টা মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? বউটাকে এখন অবধি দেখেওনি। না দেখে শাপশাপান্তই বা কীভাবে করতে পারে! মামির ওপর তীব্র বিতৃষ্ণা টের পেলো উপমা। আজ তার খুব করে বড় মামির শূন্যতা উপলব্ধি হলো। বড় মামি থাকলে এসব কিছুই হতো না। বরং কোনো ঝামেলা ছাড়াই সেজো ভাবীকে মেনে নিতো সবাই। বড় মামি খুব লক্ষ্মী একটা মানুষ ছিলেন কি না!
— উপ একটু বাইরে আয় তো।
গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে উপমাকে ডেকে উঠল অতনু। চৌকাঠে ছেলেকে দেখে নিমেষে অস্থির হয়ে উঠল শিল্পীও। কে জানে এত সাহস কোত্থেকে পেলো উপমা। মুখ বন্ধ মামির দিকে হঠাৎ চোখ বড় বড় করে তাকাল সে। কঠোর গলায় ফিসফিস করে বলল,
— বাইরে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে মামি। সেজো ভাইয়ের কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ওঁ কি পরিমাণ রেগে আছে। আপনি চিল্লাফাল্লা করলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে বললাম। একদম শান্ত হয়ে বসুন আমি শুনে আসি ওঁ কি বলে। রাগারাগি রাতেও করতে পারবেন।

এতটুকু বলে আর একমুহূর্ত বসল না উপমা। ঘুরে দরজার কাছে চলে গেল। সেজো ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা কমই হয় তার। ভাইয়ের এই গম্ভীর কণ্ঠস্বরটাকে কেন যেন ভয় লাগে উপমার। আজও লাগছে তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে কম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখা তাই সহজ হচ্ছে।
— হ্যাঁ বলো সেজো ভাই।
— ইয়ে মানে আসমা কোথায়? ফ্রেশ হয়েছে ও?
হালকা তুতলিয়ে শুধল অতনু। ওর আচমকা তোতলানোয় অবাক হলো উপমা। মাথা নেড়ে জবাব দিল,
— হয়েছে। আমার ঘরে আছে। কেন ডেকে দিব তাকে?
— থাক দরকার নেই। বরং ওকে খাওয়ার কিছু দে। অনেকক্ষণে এসেছে। সকাল থেকে খেয়েছে কি না! বাড়িতে কি রান্না হয়েছে? নতুন বউ এসেছে ভালমন্দ রান্না করা উচিৎ। বাজার লাগবে?

কথাটা অন্যদিকে তাকিয়ে একদম নীচু স্বরে বলল অতনু। উপমার বিস্ময় আরও বাড়ল। তার জাঁদরেল ভাইয়ের মুখে এত যত্নআত্তির কথা। কথা বলতে বলতে হুট করে তো নার্ভাসও হয়ে যাচ্ছে দেখা যায়। বোনের সামনে লজ্জা পাচ্ছে কি? হুট করে খুব মজা লাগল উপমার। চোখ সরু করে নীচু গলায় সে বলল,
— রান্না কি হয়েছে জানি না তবে প্রথমদিন তো নতুন বউকে খাইয়ে দিতে হয় সেজো ভাই। ভাবী একা একা কীভাবে খেতে বসবে। তুমিও চলো।
বলেই ওড়না মুখে চা”পা দিলো।
অতনু বিচক্ষণ ছেলে। বোনের ঠাট্টা বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার। যে বোন তার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকভাবে কথা বলতেও ভয় পায় সে আজ ঠাট্টা অবধি করছে। কি সাহস! ভাবতেই রাগ উঠে গেল অতনুর। রেগে চোখ গরম করে তাকাল সে উপমার দিকে। ভয় তো এক ফোঁটা পেলোই না উপমা উপরন্তু ভাইয়ের চোখ রাঙানো দেখে ওড়নার আড়ালে খিলখিল করে হেসে উঠল। আচমকা উপমার হাসিতে তাজ্জব বনে গেল অতনু। কিঞ্চিৎ লজ্জাভাবও অনুভূত হলো তার। পাছে উপমা বুঝে যায়, নিমেষ ব্যয় না করে দ্রুত প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলো সে। আজ রাগটাও ঠিকভাবে আসছে না বোধহয়। নইলে এতটুকু মেয়ে তার মুখের ওপর কীভাবে হেসে দেয়। আশ্চর্য!

___________________________

লালবাগ বাজারে দো-চালা একটা চায়ের দোকানে বহুক্ষণ যাবৎ বসে আছে রওনক। ইতোমধ্যে কত কাপ চা খাওয়া হয়েছে গননা নেই। তবে এখন আবারও ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ দেখা যাচ্ছে তার হাতে। চুমুক দেবে দেবে করেও দিচ্ছে না। সে মূলত অপেক্ষা করছে মিজানের জন্য। বহুক্ষণ হয় মিজানকে একটা কাজে পাঠিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যাও হয়ে গেল এখন অবধি আসার নামগন্ধ নেই ছেলের। থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে বিরক্তই হলো রওনক। উঠে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে। হাঁটাহাঁটি করতে করতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।
আজ হাটবার। বাজার রমরমা। মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে চারিপাশ। কেউ বাজার-সদাই করছে। কেউবা চায়ের দোকানগুলোতে বসেছে গরম গরম চা-সিঙ্গাড়ার সাথে সন্ধ্যে আড্ডা উপভোগ করতে। কম বয়সী কিছু ছেলেপেলেরও আনাগোনা দেখা যাচ্ছে বাজারে। সম্ভবত ওরা কলেজের জুনিয়র৷ রওনককে দেখামাত্র কেমন তরল গলায় সমীহের সাথে সালাম দিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউবা কুশল বিনিময় করতে এগিয়ে আসছে। ইশারায় সকলের সালাম নিতে নিতে হাঁটাহাঁটি করছে রওনক। এই যে ছেলেপেলে গুলো সালাম দিচ্ছে, সবার ভেতরে কিন্তু এত আন্তরিকতা নেই;নেই সম্মানের লেশমাত্র । রওনককে ভয় পেয়ে সালাম দিচ্ছে ওরা। কেউ দিচ্ছে লোভে পড়ে । লোভ ক্ষমতার। আলগা সম্মান দেখালে ভাই যদি তাকে দলে আসার সুযোগ দেয়!
এই এরাই আবার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ না পেলে ক্ষেপে উঠতে দু’বার ভাববে না। তক্কে তক্কে থাকবে কখন রওনকের শরীর থেকে ধড় আলাদা করে দেয়া যায়। এই পথটা এরকমই। আশেপাশের মানুষগুলো এই পর্যায়ের খারাপ। স্বার্থের কাছে সকলে অন্ধ। মাঝে মাঝে রওনক ভাবে হিংস্র হায়েনাদের সাথে বসবাস তার। এক মুহুর্ত প্রাণের নিশ্চয়তা নেই এখানে।

তর্জনীতে চেন ঘোরাতে ঘোরাতে রওনকের দিকে এগিয়ে আসছে মিজান। ভাবনা শেষে রওনক তখন চায়ে চুমুক বসিয়েছে। সহাস্যে মিজানকে এগিয়ে আসতে দেখে সে বুঝতে পারল মিজানকে যে কাজ দেয়া হয়েছিল তা যথার্থই সম্পন্ন করতে পেরেছে সে৷ দ্বিতীয়বার চায়ে চুমুক দিয়ে মুচকি হাসে রওনক।
ওদিকে গলা চড়িয়ে দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে রওনকের একদম পাশে এসে দাঁড়ায় মিজান। মাথাভর্তি নিজের কোঁকড়া চুলে হাত চালিয়ে ভাব নিয়ে বলে,
— সব খবর বাইর করি ফেলাইছি বস। বলো এখন কি দিবা?
— শালা এইটাই তোদের সমস্যা৷ ঘুষ ছাড়া কাম করবার চাইস না। বলছি তো একবার, যা চাবি তাই পায়া যাবি তবুও ছোঁকছোঁক করা লাগে তোর।
— দেখো বস অপমান করবা না। ডোন্ট ইনসাল্ট।
— আচ্ছা হইছে হইছে। ইংলিশ ঝাড়তে হবে না আর। এখন বল দেখি খবর বল।
— খবর হইলো মেয়ের নাম উপমা। পুরো নাম উপমা ইসলাম। তার আরও একটা শর্ট নেম আছে। আনন্দি। বাবা পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মা নেই। উপমাকে জন্ম দিতে গিয়ে বেচারি..
স্ত্রীকে কোনোকালেই ভালোবাসেনাই উপমার বাবা৷ তাই ভদ্রমহিলা মরাতে সুবিধাই হইছে৷ সদ্য জন্মানো কন্যা আর মৃত স্ত্রীকে সুলসুল করে শ্যালকদের হাতে গছায় দিয়া সে নাই হয়ে গেছে।
— মানে গায়েব?
— এক্কের। এরপর বহুদিন বহু খোঁজ খবরের পর জানা গেছে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে সস্ত্রীক ঝিনাইদহ। এ পক্ষের মেয়ের সাথে যোগাযোগ নাই বললেই চলে।
— বাঞ্চোদ।
মুখ বাঁকিয়ে থুতু ফেলল রওনক মাটিতে।
— আচ্ছা তারপর?
— উপমা থাকে তার মামার বাড়িতে। মানে আমাদের ক্যামেস্ট্রি প্রফেসর৷
— বলিস কি? প্রফেসরের ভাগ্নি!
— হু। প্রফেসরের তো কোনো সন্তান-সন্ততি নেই। ভাগ্নিকেই সে দত্তক নিছিল। বেশ কিছুদিন হলো প্রফেসরের স্ত্রীও মারা গেছেন। আপাতত পরিবারে আছে প্রফেসর, তার ছোট ভাই রাঙ্গা, ভাইবউ শিল্পী এবং সে পক্ষের চারজন পুত্র।
— বলিস কি রে, চার পুত্র! মেয়ে তো তাহলে চার ভাইয়ের এক বোন চম্পা।
— ইয়েস বস। চার ভাই ওকে পাখির ডানায় আগলে রাখে। তবে রাঙ্গা চাচার বড় দুই পুত্র কাজের সূত্রে অন্যান্য শহরে থাকলেও বাকি দুই পুত্র মিস.উপমার দুইজন বডি গার্ডের মতো।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হইতেছে সেই দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের নাম হইলো অতনু হাওলাদার।
এবার যেন চমকে উঠল রওনক। হাত ছলকে চায়ের কাপ থেকে বেশ খানিকটা চা মাটিতে পড়ে গেল।
বিস্মিত গলায় বলল,
— মানে আমার জাত শত্রু, আমাদের পার্টির পাণ্ডা হাওলাদার?
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল মিজান।
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে মিজানের দিকে তাকিয়ে রইল রওনক।
— একেবারে শত্রুর ঘরে হানা দিয়ে ফেলছি?
— তা নয় তো কি!
হতভম্বতায় কতক নিশ্চুপ থাকার পর রওনকের ঠোঁটের কোণে আস্তে আস্তে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠতে শুরু করল। কাপের অবশিষ্ট চাটুকু এক চুমুকে শেষ করে খুব রহস্যময় গলায় সে বলে উঠল,
— বাহ্ চমৎকার। এবার তবে জমবে খেলা। এতদিন আধা পানিতে নেমে কুমিরের সাথে লড়েছি। জমতেছিল না ঠিক। কিসের একটা অভাববোধ করতেছিলাম। এবার সে অভাব ঘোচার সময় আসছে। বুঝলি মিজান লড়াই সর্বদা লড়তে হয় পুরোটা পানিতে নেমে। প্রতি মুহুর্তে যেখানে জীবন-মরণ সংশয়।

বলতে বলতে হাসি গাঢ় হলো রওনকের। তেমন গভীর কোনো ভাবনা থেকে মেয়েটার পরিচয় বের করতে বলেনি ও মিজানকে। অপ্রত্যাশিতভাবে একটা খুনের সাক্ষী হয়ে গেছে মেয়েটা। যেকোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ওর উপস্থিতি আনিস ভাইয়ের কানে গেলে সমস্যা হতে পারে। রওনক চায়নি এসব রাজনৈতিক ঝামেলায় নিরীহ কেউ জড়িয়ে পড়ুক। তাই মেয়েটার সবরকমের খোঁজ খবর নিয়ে আসতে বলেছিল মিজানকে। সুবিধা-অসুবিধা হলে যেন সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন নয়। অদৃষ্টই তাকে টেনে এনে জড়িয়ে দিয়েছে রওনকের জীবনের সাথে। ওকে অস্ত্র বানিয়ে তবে অতনুকে কুপোকাত করা সহজ হবে। বহুদিনের একটা নোংরা হিসেব জমা পড়ে আছে আছে রওনকের খাতায়, অতনুর জন্য। এখন বোধহয় সুযোগ আসতে চলেছে, হিসেবটা সুদে-আসলে মিটিয়ে নেয়ার।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here